অনার্স-মাস্টার্স অনুমোদন পাওয়া কলেজগুলোর কী হবে?
বিমল সরকার

দেশের সবচেয়ে বড় পরিসরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে সারা দেশের ২ হাজার ২৫৭টি কলেজ এবং আনুমানিক ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। অনার্স পড়ানো হয় ৮৮১টি আর মাস্টার্স ১৭০টি কলেজে। অধিভুক্ত কলেজ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং কর্মপরিধি বিবেচনায় আমাদের দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ বা কাছাকাছি আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এমন একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে সচেতন ব্যক্তিদের কৌতূহল-আগ্রহ এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানটি জাতির প্রত্যাশা পূরণে কতটুকু সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে বা রাখতে পেরেছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে গত ২১ অক্টোবর রাজধানীর ধানমণ্ডিতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান তার বক্তব্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। ওই সংবাদ সম্মেলন এবং এতে উপাচার্য পরিবেশিত বিভিন্ন তথ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে পরদিন (২২ অক্টোবর ২০২২) বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খবর বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছর : প্রতি ৪ দিনে একটি কলেজ অনুমোদন’। যুগান্তরের প্রতিবেদনটির শুরুটা ঠিক এভাবে : ‘প্রতিষ্ঠার পর বিগত ২২ বছরের প্রতি ৪ দিনে একটি করে কলেজ অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিভিন্ন ধরনের ২২৫৭টি কলেজ আছে। অথচ ১৯৯২ সালে ৪৫৫টি কলেজ নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। নির্বিচারে গ্রামে-গঞ্জেও কলেজ, বিশেষ করে অনার্স প্রোগ্রামের অনুমোদন দেওয়া হয়। ওইসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও শিক্ষক নেই। আবার যে সংখ্যক শিক্ষক আছেন, তাদের সবাই নিয়মিত বেতন-ভাতা পান না। তাই নিয়মিত ক্লাস আর শিক্ষা কার্যক্রম হয় না। ফলে এ প্রতিষ্ঠানটির ডিগ্রির মান নিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষার অ্যাপেক্স বডি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন করে আর কোনো কলেজে অনার্স পাঠের অনুমোদন দেওয়া হবে না। গত দুবছর ধরেই এ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।’
প্রতিবেদনটিতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ থাকলেও আমি এখানে সেসব উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। প্রতি ৪ দিনে একটি করে কলেজ অনুমোদন! আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য ও চমকে যাওয়ার মতো মনে হলেও এ তথ্য অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ডিগ্রি স্তরে নতুন নতুন কলেজ অনুমোদন দেওয়া, বিভিন্ন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করার হিড়িক পড়ে যায়। নব্বইয়ের দশকে যেমন-তেমন, ২০০০ সালের পর তা যেন এক বেপরোয়া গতিতে এগোতে শুরু করে। আর এভাবেই হালে মোট ২২৫৭টি কলেজের মধ্যে ১৭০টিতে মাস্টার্স আর ৮৮১টিতে অনার্স কার্যক্রম চালু রয়েছে। তার মানে ঘর থেকে বের হয়ে দুই পা ফেলতেই ডিগ্রি কলেজ, তিন পা ফেললে অনার্স আর চার পা ফেললে মাস্টার্স কলেজ! হ্যাঁ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষার আজকাল এমনই বন্দোবস্ত!
দেখতে দেখতে সবার সামনে কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল! পেছনের কথা অনেকের জানা থাকলেও এখানে খানিকটা উল্লেখ করি। ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার শুরু। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম আর ১৯৭৩ সালে রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠা পায়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের শুরুটা এমনই। বাংলাদেশ অঞ্চলে ২৭টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে সময় লাগে মোট ১০০ বছর (১৮৪১-১৯৪১)। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় আমাদের পূর্ববঙ্গে মোট কলেজের সংখ্যা হয় ৩৪। আর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের পথচলা শুরু হয় ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মোট ১৩৬টি কলেজ নিয়ে। ২০ বছর পর ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার সময় কলেজের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৫৫। ২০০১ সালে ১০০০ আর ২০১৪ সালে ১৪৮২। এর ৮ বছরের মাথায় ২২৫৭ (২০২২ সাল)।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন করে আর কোনো কলেজে অনার্স পাঠের অনুমোদন দেওয়া হবে না। তা তো বুঝলাম, এখন থেকে নতুন কোনো কলেজে অনার্স পাঠের অনুমোদন দেওয়া হবে না। স্পষ্ট করে না বললেও এ-ও না হয় বুঝে নিলাম যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নতুন আর কোনো কলেজেরও অনুমোদন দেবে না। কিন্তু এ কথাই কি যথেষ্ট? যে বিপুলসংখ্যক কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং এর একেকটিতে অনার্স বা মাস্টার্স খোলা হয়েছে, তাদের কী হবে? একদিন না একদিন প্রশ্ন উঠতে পারে, গত ১৪ বছর কিংবা ৩০ বছর ধরে এমন সর্বনাশা কাজটি কেন করা হলো?
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

অনার্স-মাস্টার্স অনুমোদন পাওয়া কলেজগুলোর কী হবে?
বিমল সরকার

দেশের সবচেয়ে বড় পরিসরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে সারা দেশের ২ হাজার ২৫৭টি কলেজ এবং আনুমানিক ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। অনার্স পড়ানো হয় ৮৮১টি আর মাস্টার্স ১৭০টি কলেজে। অধিভুক্ত কলেজ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং কর্মপরিধি বিবেচনায় আমাদের দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ বা কাছাকাছি আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এমন একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে সচেতন ব্যক্তিদের কৌতূহল-আগ্রহ এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানটি জাতির প্রত্যাশা পূরণে কতটুকু সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে বা রাখতে পেরেছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে গত ২১ অক্টোবর রাজধানীর ধানমণ্ডিতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান তার বক্তব্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। ওই সংবাদ সম্মেলন এবং এতে উপাচার্য পরিবেশিত বিভিন্ন তথ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে পরদিন (২২ অক্টোবর ২০২২) বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খবর বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছর : প্রতি ৪ দিনে একটি কলেজ অনুমোদন’। যুগান্তরের প্রতিবেদনটির শুরুটা ঠিক এভাবে : ‘প্রতিষ্ঠার পর বিগত ২২ বছরের প্রতি ৪ দিনে একটি করে কলেজ অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিভিন্ন ধরনের ২২৫৭টি কলেজ আছে। অথচ ১৯৯২ সালে ৪৫৫টি কলেজ নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। নির্বিচারে গ্রামে-গঞ্জেও কলেজ, বিশেষ করে অনার্স প্রোগ্রামের অনুমোদন দেওয়া হয়। ওইসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও শিক্ষক নেই। আবার যে সংখ্যক শিক্ষক আছেন, তাদের সবাই নিয়মিত বেতন-ভাতা পান না। তাই নিয়মিত ক্লাস আর শিক্ষা কার্যক্রম হয় না। ফলে এ প্রতিষ্ঠানটির ডিগ্রির মান নিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষার অ্যাপেক্স বডি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন করে আর কোনো কলেজে অনার্স পাঠের অনুমোদন দেওয়া হবে না। গত দুবছর ধরেই এ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।’
প্রতিবেদনটিতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ থাকলেও আমি এখানে সেসব উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। প্রতি ৪ দিনে একটি করে কলেজ অনুমোদন! আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য ও চমকে যাওয়ার মতো মনে হলেও এ তথ্য অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ডিগ্রি স্তরে নতুন নতুন কলেজ অনুমোদন দেওয়া, বিভিন্ন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করার হিড়িক পড়ে যায়। নব্বইয়ের দশকে যেমন-তেমন, ২০০০ সালের পর তা যেন এক বেপরোয়া গতিতে এগোতে শুরু করে। আর এভাবেই হালে মোট ২২৫৭টি কলেজের মধ্যে ১৭০টিতে মাস্টার্স আর ৮৮১টিতে অনার্স কার্যক্রম চালু রয়েছে। তার মানে ঘর থেকে বের হয়ে দুই পা ফেলতেই ডিগ্রি কলেজ, তিন পা ফেললে অনার্স আর চার পা ফেললে মাস্টার্স কলেজ! হ্যাঁ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষার আজকাল এমনই বন্দোবস্ত!
দেখতে দেখতে সবার সামনে কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল! পেছনের কথা অনেকের জানা থাকলেও এখানে খানিকটা উল্লেখ করি। ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার শুরু। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম আর ১৯৭৩ সালে রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠা পায়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের শুরুটা এমনই। বাংলাদেশ অঞ্চলে ২৭টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে সময় লাগে মোট ১০০ বছর (১৮৪১-১৯৪১)। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় আমাদের পূর্ববঙ্গে মোট কলেজের সংখ্যা হয় ৩৪। আর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের পথচলা শুরু হয় ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মোট ১৩৬টি কলেজ নিয়ে। ২০ বছর পর ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার সময় কলেজের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৫৫। ২০০১ সালে ১০০০ আর ২০১৪ সালে ১৪৮২। এর ৮ বছরের মাথায় ২২৫৭ (২০২২ সাল)।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন করে আর কোনো কলেজে অনার্স পাঠের অনুমোদন দেওয়া হবে না। তা তো বুঝলাম, এখন থেকে নতুন কোনো কলেজে অনার্স পাঠের অনুমোদন দেওয়া হবে না। স্পষ্ট করে না বললেও এ-ও না হয় বুঝে নিলাম যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নতুন আর কোনো কলেজেরও অনুমোদন দেবে না। কিন্তু এ কথাই কি যথেষ্ট? যে বিপুলসংখ্যক কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং এর একেকটিতে অনার্স বা মাস্টার্স খোলা হয়েছে, তাদের কী হবে? একদিন না একদিন প্রশ্ন উঠতে পারে, গত ১৪ বছর কিংবা ৩০ বছর ধরে এমন সর্বনাশা কাজটি কেন করা হলো?
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক