আকাশ পর্যবেক্ষণ শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত হোক

সিসা ও ধূলিকণা দিয়ে যেভাবে আচ্ছাদিত ঢাকার আকাশ, তাতে চাঁদও ঠিকমতো দেখা যায় না, এমনকি টেলিস্কোপ দিয়েও। তবু তাকানো ভঙ্গির মধ্য দিয়ে যে মহাজাগতিক তৃষ্ণা কিশোরদের মধ্যে দেখেছি, তা প্রাচীন আবেগকে মনে করিয়ে দেয়।

টেলিস্কোপ শিক্ষার্থীদের মনে আকাশ পর্যবেক্ষণের কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে পারে। ছবি: পেক্সেলস

আসিফ

কোনো নক্ষত্র ঠিক সূর্য ওঠার আগে এবং অস্ত যাওয়ার পরে ওঠে। ঋতুর সঙ্গে সময় ও অবস্থানে সেগুলোর কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে।আমরা যদি নক্ষত্রগুলোকে সতর্কভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নথিভুক্ত করি, তাহলে আমরাও ঋতুগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব।

প্রতিদিন সূর্য দিগন্তের ওপরে কোথায় ওঠে নজর রাখার মাধ্যমে বছরের প্রতিটি ক্ষণকেও পরিমাপ আমরা করতে পারব। আকাশ আসলে বিশাল একটা পঞ্জিকা; ধৈর্য, সামর্থ্য ও নথিভুক্ত তথ্য রক্ষার ক্ষমতাসম্পন্ন যে কারোর কাছেই তা সহজলভ্য এবং পঠনযোগ্য হতে পারে।

প্রাচীনকালে আকাশের পঞ্জিকাকে সঠিকভাবে পড়ার সামর্থ্যেই নিহিত ছিল জীবন ও মৃত্যুর বিষয়টি। নতুন চাঁদের পর অর্ধচন্দ্রের পুনঃ উদয়; পূর্ণগ্রহণের পর সূর্যের আবার ফিরে আসা; রাতে এর ঝঞ্ঝাপূর্ণ অনুপস্থিতির পর সকালে এর উদয় পৃথিবীময় মানুষ লক্ষ করল: এই প্রতিভাস আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে মৃত্যুকে অতিক্রমের সম্ভাবনার কথা বলেছিল।

যুগের পর যুগ অতিক্রমের সঙ্গে, মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। আরও নিখুঁতভাবে সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম। আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলাম—উপযুক্ত শিকারের সময়, বীজ বপন ও ফসল কাটার সময় গোত্র বা সম্প্রদায়গুলোকে একত্র করার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে। পরিমাপের ক্ষেত্রে সূক্ষ্মতার উন্নতি আমাদের উপাত্ত বা নথিপত্রকে রক্ষায় সহায়তা করেছিল। অতএব প্রকৃতির ঘটনার পর্যবেক্ষণ, গণিতশাস্ত্র এবং লেখার বিকাশকে উৎসাহিত করতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ভূমিকা রেখেছিল।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের টিকে থাকার স্বার্থে, খালি চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ ছিল খুবই জরুরি। মাঝি, জেলে ও কৃষকদেরও প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন পড়েছিল আকাশের মেজাজমর্জি বোঝার জন্য।

তাহলে আজ যে শিশুরা বড় হচ্ছে, তাদের আকাশ চেনানো হচ্ছে না কেন? শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ হিসেবে এ বিষয়টি গ্রাহ্য করছি না কেন? আবার শিল্পকলা, সংগীতের মতো আকাশ অবলোকনকে বড়জোর আরেকটি এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কেন এগোচ্ছি? অথচ ইতিহাসে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় মৌলিক হাতিয়ার হিসেবে এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করা হয়েছে, তার বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। এগুলোই সহনশীলতা, নমনীয়তা, মানবিকতার প্রসার ঘটাত। তাহলে শিক্ষায় এগুলো আবশ্যিক বিষয় হিসেবে যুক্ত হলো না কেন? তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় কী শিখছে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা, এই পৃথিবীতে? শুধুই প্রফিট অ্যান্ড লস বা লাভ এবং ক্ষতি বা এস্টাবিলিশমেন্ট, ব্যবসার ঘুঁটিতে পরিণত হওয়া?

এ কারণে সমাজের অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন সব মানুষ আসছেন, যাঁরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো যথার্থ পরিকল্পনাও করতে পারছেন না। অথচ পৃথিবী নামের গ্রহের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক কিছু ব্যাপার রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় রয়েছে পঞ্চাশটি তারা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইসরায়েলের প্রতিটির একটি করে; মিয়ানমারের চৌদ্দটি; গ্রানাডা ও ভেনেজুয়েলার সাতটি; চীনের পাঁচটি; ইরাকের তিনটি; জাপান, উরুগুয়ে, মালয়, বাংলাদেশ, তাইওয়ানের সূর্য; ব্রাজিলের একটি মহাজাগতিক গোলক; অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম সামোয়া, নিউজিল্যান্ড এবং পাপুয়া নিউগিনির পতাকায় সাউদার্ন ক্রসের জ্যোতিষ্কপুঞ্জ; কম্বোডিয়ার অ্যাংকর ভ্যাট, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক মানমন্দির; ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার মহাজাগতিক প্রতীকগুলো।

আসিফ

অনেক সমাজতান্ত্রিক জাতি তাদের পতাকায় নক্ষত্র চিহ্ন প্রদর্শন করে। অনেক ইসলামিক দেশের পতাকায় পূর্ণ চাঁদ থাকে। পৃথিবীর জাতীয় পতাকাগুলোর প্রায় অর্ধেক জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতীক ব্যবহার করছে। এই প্রতিভাসটি অসাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ বা গোঁড়ামিহীন বিশ্বের কথা বলে। এটি কেবল আমাদের সময়ে সীমাবদ্ধ নয়: খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর হতে সুমেরীয় সিলিন্ডার সিল নামমুদ্রায়ও দেখা গেছে।

এসব থেকে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে জাতিগুলো জড়িয়ে ধরতে চায় মহাজগতের ক্ষমতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার কিছু একটাকে। আমরা খুঁজে ফিরি মহাবিশ্বের সঙ্গে একটি সংযোগ। আমরা ঘটনাগুলো ব্যাপক মাত্রায় গণনা করতে চাই। এটা বলে দেয় যে আমরা সংযুক্ত-জ্যোতিষীদের ব্যক্তিগত, কল্পনাশক্তিহীন ছোট মাপে নয়, বরং গভীরতম সব পথে; বিশেষ করে পদার্থের উৎপত্তি, পৃথিবীর বাসযোগ্যতা, মানব প্রজাতির বিবর্তন ও গন্তব্যকে অন্তর্ভুক্ত করে আমরা আমাদের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে গভীর পথে যাত্রা করতে পারি।

এগুলো আমরা স্কুল থেকেই সূচনা করতে পারি, বিশেষ করে আকাশ পর্যবেক্ষণ আর কিছু মৌলিক প্রশ্নের অবতারণা করে। যদিও পর্যবেক্ষণের ধরন পাল্টেছে। আমি যতবার স্কুল, কলেজ বা বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর কোনো আয়োজনে বক্তব্য দিয়েছি, সঙ্গে যদি কোনো টেলিস্কোপ থেকেছে, তাহলে সেখানে চোখ রেখে অবলোকনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে আকুলতা দেখেছি, তা সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। সিসা ও ধূলিকণা দিয়ে যেভাবে আচ্ছাদিত ঢাকার আকাশ, তাতে চাঁদও ঠিকমতো দেখা যায় না, এমনকি টেলিস্কোপ দিয়েও। তবু তাকানো ভঙ্গির মধ্য দিয়ে যে মহাজাগতিক তৃষ্ণা কিশোরদের মধ্যে দেখেছি, তা প্রাচীন আবেগকে মনে করিয়ে দেয়।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আকাশ পর্যবেক্ষণে টেলিস্কোপ রাখে না কেন? অনেক কিছুর চেয়ে টেলিস্কোপের ক্রয়মূল্য কম; এটা বিশেষ কোনো ডিভাইস নয়, ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো, অনেকটা মাইক্রোস্কোপের মতো, অনেকটা ক্যামেরার মতো। ডজন ডজন ক্লাস যেখানে কিছু করতে পারে না, সেখানে একটা টেলিস্কোপ শিক্ষার্থীদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে পারে, আর স্বপ্নের ঘোর তৈরি করতে পারে তার অনেক অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই রয়েছে। প্রতিটি স্কুলে একটা মাইক্রোস্কোপ, ম্যাগনিফাইং গ্লাসের পাশাপাশি একটা টেলিস্কোপ তো থাকতেই পারে।

যদি আমরা পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমস্থলের মধ্য দিয়ে যাই, আগুন ঝরা নদীর তীর ধরে হেঁটে চলি, তাহলে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ শুনি, মৃত তিমিদের ভেসে আসা হিমছড়ির বেলাভূমিতে দাঁড়ালেও সে শব্দ শুনতে পাই। পৃথিবীর গভীর গিরিখাতগুলোর মধ্য দিয়ে বাতাসের সে হাহাকারের, কশাঘাতের শব্দ স্মরণ করিয়ে দেয়—৪০ হাজার প্রজন্মের নারী-পুরুষের চিন্তন প্রবাহের আমরা হলাম সর্বশেষ প্রজাতি।

আমাদের সভ্যতা সেই পূর্বতন প্রজন্মগুলোর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ যাদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। তাদের সম্পর্কে জানা এবং সেসব অভিজ্ঞতার আলোয় ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াই হচ্ছে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।

আমরা যদি ধর্মগ্রন্থগুলোর দিকেও তাকাই, ধর্মালয়গুলোর নির্মাণশৈলী লক্ষ করি জ্যোতির্বিজ্ঞান মানমন্দিরের সঙ্গে কতই না মিল খুঁজে পাব। সেই প্রাচীনকাল থেকে, সবাই আকাশের আরাধনা করতে চায়, সবাই আকাশেই মুক্তি খোঁজে, যাকে আমরা মহাজাগতিক ঐক্য বলেই অভিহিত করতে পারি। আসুন, এই ঐক্যকে কেন্দ্র করে আমরা আবর্তিত হই, নিজেদের দৃষ্টিকে শিকড়ের দিকে ধাবিত করি, যাতে ভবিষ্যৎকে সহনশীলতা ও মানবিকতায় মোকাবিলা করতে পারি।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা এবং সম্পাদক, মহাবৃত্ত 

আকাশ পর্যবেক্ষণ শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত হোক

সিসা ও ধূলিকণা দিয়ে যেভাবে আচ্ছাদিত ঢাকার আকাশ, তাতে চাঁদও ঠিকমতো দেখা যায় না, এমনকি টেলিস্কোপ দিয়েও। তবু তাকানো ভঙ্গির মধ্য দিয়ে যে মহাজাগতিক তৃষ্ণা কিশোরদের মধ্যে দেখেছি, তা প্রাচীন আবেগকে মনে করিয়ে দেয়।

টেলিস্কোপ শিক্ষার্থীদের মনে আকাশ পর্যবেক্ষণের কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে পারে। ছবি: পেক্সেলস

আসিফ

কোনো নক্ষত্র ঠিক সূর্য ওঠার আগে এবং অস্ত যাওয়ার পরে ওঠে। ঋতুর সঙ্গে সময় ও অবস্থানে সেগুলোর কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে।আমরা যদি নক্ষত্রগুলোকে সতর্কভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নথিভুক্ত করি, তাহলে আমরাও ঋতুগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব।

প্রতিদিন সূর্য দিগন্তের ওপরে কোথায় ওঠে নজর রাখার মাধ্যমে বছরের প্রতিটি ক্ষণকেও পরিমাপ আমরা করতে পারব। আকাশ আসলে বিশাল একটা পঞ্জিকা; ধৈর্য, সামর্থ্য ও নথিভুক্ত তথ্য রক্ষার ক্ষমতাসম্পন্ন যে কারোর কাছেই তা সহজলভ্য এবং পঠনযোগ্য হতে পারে।

প্রাচীনকালে আকাশের পঞ্জিকাকে সঠিকভাবে পড়ার সামর্থ্যেই নিহিত ছিল জীবন ও মৃত্যুর বিষয়টি। নতুন চাঁদের পর অর্ধচন্দ্রের পুনঃ উদয়; পূর্ণগ্রহণের পর সূর্যের আবার ফিরে আসা; রাতে এর ঝঞ্ঝাপূর্ণ অনুপস্থিতির পর সকালে এর উদয় পৃথিবীময় মানুষ লক্ষ করল: এই প্রতিভাস আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে মৃত্যুকে অতিক্রমের সম্ভাবনার কথা বলেছিল।

যুগের পর যুগ অতিক্রমের সঙ্গে, মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। আরও নিখুঁতভাবে সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম। আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলাম—উপযুক্ত শিকারের সময়, বীজ বপন ও ফসল কাটার সময় গোত্র বা সম্প্রদায়গুলোকে একত্র করার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে। পরিমাপের ক্ষেত্রে সূক্ষ্মতার উন্নতি আমাদের উপাত্ত বা নথিপত্রকে রক্ষায় সহায়তা করেছিল। অতএব প্রকৃতির ঘটনার পর্যবেক্ষণ, গণিতশাস্ত্র এবং লেখার বিকাশকে উৎসাহিত করতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ভূমিকা রেখেছিল।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের টিকে থাকার স্বার্থে, খালি চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ ছিল খুবই জরুরি। মাঝি, জেলে ও কৃষকদেরও প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন পড়েছিল আকাশের মেজাজমর্জি বোঝার জন্য।

তাহলে আজ যে শিশুরা বড় হচ্ছে, তাদের আকাশ চেনানো হচ্ছে না কেন? শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ হিসেবে এ বিষয়টি গ্রাহ্য করছি না কেন? আবার শিল্পকলা, সংগীতের মতো আকাশ অবলোকনকে বড়জোর আরেকটি এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কেন এগোচ্ছি? অথচ ইতিহাসে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় মৌলিক হাতিয়ার হিসেবে এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করা হয়েছে, তার বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। এগুলোই সহনশীলতা, নমনীয়তা, মানবিকতার প্রসার ঘটাত। তাহলে শিক্ষায় এগুলো আবশ্যিক বিষয় হিসেবে যুক্ত হলো না কেন? তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় কী শিখছে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা, এই পৃথিবীতে? শুধুই প্রফিট অ্যান্ড লস বা লাভ এবং ক্ষতি বা এস্টাবিলিশমেন্ট, ব্যবসার ঘুঁটিতে পরিণত হওয়া?

এ কারণে সমাজের অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন সব মানুষ আসছেন, যাঁরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো যথার্থ পরিকল্পনাও করতে পারছেন না। অথচ পৃথিবী নামের গ্রহের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক কিছু ব্যাপার রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় রয়েছে পঞ্চাশটি তারা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইসরায়েলের প্রতিটির একটি করে; মিয়ানমারের চৌদ্দটি; গ্রানাডা ও ভেনেজুয়েলার সাতটি; চীনের পাঁচটি; ইরাকের তিনটি; জাপান, উরুগুয়ে, মালয়, বাংলাদেশ, তাইওয়ানের সূর্য; ব্রাজিলের একটি মহাজাগতিক গোলক; অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম সামোয়া, নিউজিল্যান্ড এবং পাপুয়া নিউগিনির পতাকায় সাউদার্ন ক্রসের জ্যোতিষ্কপুঞ্জ; কম্বোডিয়ার অ্যাংকর ভ্যাট, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক মানমন্দির; ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার মহাজাগতিক প্রতীকগুলো।

আসিফ

অনেক সমাজতান্ত্রিক জাতি তাদের পতাকায় নক্ষত্র চিহ্ন প্রদর্শন করে। অনেক ইসলামিক দেশের পতাকায় পূর্ণ চাঁদ থাকে। পৃথিবীর জাতীয় পতাকাগুলোর প্রায় অর্ধেক জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতীক ব্যবহার করছে। এই প্রতিভাসটি অসাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ বা গোঁড়ামিহীন বিশ্বের কথা বলে। এটি কেবল আমাদের সময়ে সীমাবদ্ধ নয়: খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর হতে সুমেরীয় সিলিন্ডার সিল নামমুদ্রায়ও দেখা গেছে।

এসব থেকে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে জাতিগুলো জড়িয়ে ধরতে চায় মহাজগতের ক্ষমতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার কিছু একটাকে। আমরা খুঁজে ফিরি মহাবিশ্বের সঙ্গে একটি সংযোগ। আমরা ঘটনাগুলো ব্যাপক মাত্রায় গণনা করতে চাই। এটা বলে দেয় যে আমরা সংযুক্ত-জ্যোতিষীদের ব্যক্তিগত, কল্পনাশক্তিহীন ছোট মাপে নয়, বরং গভীরতম সব পথে; বিশেষ করে পদার্থের উৎপত্তি, পৃথিবীর বাসযোগ্যতা, মানব প্রজাতির বিবর্তন ও গন্তব্যকে অন্তর্ভুক্ত করে আমরা আমাদের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে গভীর পথে যাত্রা করতে পারি।

এগুলো আমরা স্কুল থেকেই সূচনা করতে পারি, বিশেষ করে আকাশ পর্যবেক্ষণ আর কিছু মৌলিক প্রশ্নের অবতারণা করে। যদিও পর্যবেক্ষণের ধরন পাল্টেছে। আমি যতবার স্কুল, কলেজ বা বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর কোনো আয়োজনে বক্তব্য দিয়েছি, সঙ্গে যদি কোনো টেলিস্কোপ থেকেছে, তাহলে সেখানে চোখ রেখে অবলোকনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে আকুলতা দেখেছি, তা সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। সিসা ও ধূলিকণা দিয়ে যেভাবে আচ্ছাদিত ঢাকার আকাশ, তাতে চাঁদও ঠিকমতো দেখা যায় না, এমনকি টেলিস্কোপ দিয়েও। তবু তাকানো ভঙ্গির মধ্য দিয়ে যে মহাজাগতিক তৃষ্ণা কিশোরদের মধ্যে দেখেছি, তা প্রাচীন আবেগকে মনে করিয়ে দেয়।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আকাশ পর্যবেক্ষণে টেলিস্কোপ রাখে না কেন? অনেক কিছুর চেয়ে টেলিস্কোপের ক্রয়মূল্য কম; এটা বিশেষ কোনো ডিভাইস নয়, ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো, অনেকটা মাইক্রোস্কোপের মতো, অনেকটা ক্যামেরার মতো। ডজন ডজন ক্লাস যেখানে কিছু করতে পারে না, সেখানে একটা টেলিস্কোপ শিক্ষার্থীদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে পারে, আর স্বপ্নের ঘোর তৈরি করতে পারে তার অনেক অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই রয়েছে। প্রতিটি স্কুলে একটা মাইক্রোস্কোপ, ম্যাগনিফাইং গ্লাসের পাশাপাশি একটা টেলিস্কোপ তো থাকতেই পারে।

যদি আমরা পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমস্থলের মধ্য দিয়ে যাই, আগুন ঝরা নদীর তীর ধরে হেঁটে চলি, তাহলে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ শুনি, মৃত তিমিদের ভেসে আসা হিমছড়ির বেলাভূমিতে দাঁড়ালেও সে শব্দ শুনতে পাই। পৃথিবীর গভীর গিরিখাতগুলোর মধ্য দিয়ে বাতাসের সে হাহাকারের, কশাঘাতের শব্দ স্মরণ করিয়ে দেয়—৪০ হাজার প্রজন্মের নারী-পুরুষের চিন্তন প্রবাহের আমরা হলাম সর্বশেষ প্রজাতি।

আমাদের সভ্যতা সেই পূর্বতন প্রজন্মগুলোর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ যাদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। তাদের সম্পর্কে জানা এবং সেসব অভিজ্ঞতার আলোয় ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াই হচ্ছে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।

আমরা যদি ধর্মগ্রন্থগুলোর দিকেও তাকাই, ধর্মালয়গুলোর নির্মাণশৈলী লক্ষ করি জ্যোতির্বিজ্ঞান মানমন্দিরের সঙ্গে কতই না মিল খুঁজে পাব। সেই প্রাচীনকাল থেকে, সবাই আকাশের আরাধনা করতে চায়, সবাই আকাশেই মুক্তি খোঁজে, যাকে আমরা মহাজাগতিক ঐক্য বলেই অভিহিত করতে পারি। আসুন, এই ঐক্যকে কেন্দ্র করে আমরা আবর্তিত হই, নিজেদের দৃষ্টিকে শিকড়ের দিকে ধাবিত করি, যাতে ভবিষ্যৎকে সহনশীলতা ও মানবিকতায় মোকাবিলা করতে পারি।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা এবং সম্পাদক, মহাবৃত্ত