সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম

‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভার্চুয়ালি কোনো স্কিল সাপ্লাই করে না’

দৈনিক আজকের পত্রিকায় ১৫ নভেম্বর ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষায় ব্যয়: টাকা যাচ্ছে উড়ে উড়ে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ওপর মতামত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ রানা।

মোহম্মদ আজম। ছবি: সংগৃহীত

উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার কারণগুলো কী কী বলে মনে করেন?
আমাদের সব সময় মনে রাখা দরকার, এটা সারা বিশ্বের প্রবণতা। বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্রবণতা। তৃতীয় বিশ্ব তো বটে, এমনকি ইউরোপ থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় সেটেল হতে যায়। তবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার হারটা একটু বেশি। আমাদের খোঁজটা আসলে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। যায় কেন? অন্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি কেন? তা খুঁজে বের করতে হবে। সেদিক থেকে দেখলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে প্রধান কারণটি আমার মতে, শিক্ষার্থীরা আসলে বিদেশে সেটেল হতে চায়। এই সেটেল হওয়ার জন্য পড়াশোনা করতে যাওয়াটা তার জন্য সুবিধাজনক। তার কারণ, ছেলেমেয়েরা মূলত যায় তার মা-বাবার টাকায়। ফলে মা-বাবারা মনে করেন, ছেলেমেয়েকে বিদেশে সেটেল করতে হবে। তাই তাদের মা-বাবারা আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের পর বিদেশে পাঠিয়ে দেন।

অভিভাবকদের বক্তব্য হলো, ও তো বিদেশে যাবেই, তো আগেভাগেই যাক। এটাই প্রধান কারণ বিদেশে সেটেল হওয়ার। এর পেছনে একটা প্র্যাকটিক্যাল কারণ আছে আমাদের দেশের বাস্তবতায়। সেটা হলো, ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থা তো সর্বব্যাপী হয়ে গেছে, একদম মধ্যবিত্ত পর্যন্ত। কমবেশি সব মা-বাবা তাঁর সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়াম পড়াতে পাঠান। এখন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ার পরে, যাঁদের পারিবারিকভাবে কোনো প্রকারের সুবিধা, ক্ষমতা, সক্ষমতা আছে; তাঁরাই মূলত ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হন। তার কারণ হলো—প্রথমত, সাংস্কৃতিকভাবে সেই ছেলেমেয়েরা আর দেশে থাকতে চায় না। কারণ তারা ইংরেজি মিডিয়াম পড়ার কারণে সাংস্কৃতিকভাবে এমন এক মাইনসেটের মাধ্যমে বড় হয় যে তারা আর দেশে থাকতে চায় না। তার মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মা-বাবা মেয়েদের বিদেশে পাঠাতে চান না।

এবং যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য কম, তাঁদের ছেলেমেয়েরা এ দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এরপর দ্বিতীয় প্রধান কারণটি হলো, আমাদের উচ্চশিক্ষা বলতে যেটা বোঝায়, সেটা খুব বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পড়াশোনার মান খারাপ। ফলে এখানে পড়ার জন্য ছেলেমেয়েরা খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এখানকার যে ডিগ্রি, সেটা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারবে, এটা এখানকার বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে না। একটু মিলিয়ে দেখলে দেখতে পাব যে বুয়েট বা ঢাকা মেডিকেল কলেজে যেসব ছেলেমেয়ে চান্স পায় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একটা বিষয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ভালোভাবে বিক্রি করতে পারবে, সেসব বিষয়ে পড়ে তারাই আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করে বিদেশে চলে যায়। এ কারণে আমাদের এখানকার ডিগ্রি বিদেশে কম বিক্রয়যোগ্য, তাই এখানকার অধিকাংশ অভিভাবক ও ছেলেমেয়ে মনে করে, এখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করে বিদেশে চলে যাওয়া ভালো। এগুলোই প্রধান কারণ বলে ধারণা করি।

এটার সঙ্গে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ব্যাপার নেই? 
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কিন্তু বিশেষভাবে ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এটা সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়গুলোতে লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমাদের আশপাশের প্রচুর লোক ইমিগ্রেশন নিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে চেষ্টা করছে বিদেশে যাওয়ার। তার কারণ হলো, আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এমন পরিমাণ বেড়েছে যে আমাদের আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান, এমনকি মধ্যবিত্তরা তাঁদের সন্তানদের এখানে রাখতে নিরাপত্তা বোধ করছেন না। ফলে তারা ব্যাপকভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই আমি আবারও বলছি, এ প্রবণতা তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্র আছে, বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে বেশি আছে—এটা সংখ্যাগত দিক থেকে প্রমাণ করা যাবে। ফলে আমাদের অনিশ্চয়তাগুলো এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা রেখেছে।

শিক্ষার ব্যয় মেটানোর জন্য বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিপুল টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটার প্রতিকার কী হতে পারে? 
আমাদের একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে কোনো ব্যক্তির ক্যারিয়ার গঠন বা ভবিষ্যৎ যাপন কীভাবে করবে, নাগরিক হিসেবে আমরা কোনো ধরনের বাধা দিতে পারি না। মানে, কেউ যদি মনে করে তিনি এভাবে ক্যারিয়ার গঠন করবে, তার ব্যাপারে কোনো বাধা দিতে পারি না। একই সঙ্গে আমাদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে, কিছুসংখ্যক লোক এই সুবিধা নিচ্ছে। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক লোক বাংলাদেশে থাকছে। ফলে তাদের যে সামাজিক জীবনযাপন, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, অগ্রগতি—এগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে, এ ব্যাপারে ভাবিত হওয়া উচিত।

ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাচ্ছে। তারা তো সেখানে টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করে। আর কয়েক বছর তার বিদেশে থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার জন্য বিপুল টাকা বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে বেশি যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হলো বৃত্তির ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করা। এটা হয়তো করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে পদ্ধতিটা হতে পারে, যারা বৃত্তি ও প্রস্তুতি নিয়ে বা সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে যাবে, সে ক্ষেত্রে আমাদের গরিব দেশে ডলারের চাপ একটু কমবে।

পড়ার জন্য বিদেশে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কি? 
আমি ব্যাপারটাকে একেবারেই এভাবে দেখতে চাই না। আমি দেখতে চাই আসলে এখানে উচ্চশিক্ষা মানের দিক দিয়ে নিম্নমানের স্তরে আছে। প্রথম সমস্যা হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভার্চুয়ালি কোনো স্কিল সাপ্লাই করে না, তারা শুধু একটা গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি দেয়। এমনভাবে স্কিল ডেভেলপমেন্ট করে না, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারে। এটা সবাই জানে, এই ডিগ্রি শুধু আন্তর্জাতিক বাজারে কেন, দেশীয় বাজারেও চলে না। সবাই জানে এখানে পড়াশোনা করে মাঝারি বা নিম্নমানের প্রতিষ্ঠান চালাতেও স্কিল তৈরি করতে পারছি না। এখানে ব্যাপারটা পরিষ্কার, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়াশোনার প্রধান ব্যাপার যে স্কিল সাপ্লাই করা, সেটা এখানে হচ্ছে না।

তাই ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে কম আগ্রহী হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো, এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো আভিজাত্য দাঁড়ায়নি। কিছু ক্ষেত্রে বুয়েট বা ঢাকা মেডিকেল কলেজে এটা আছে। এখানকার কোনো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে শহুরে ছেলেমেয়েরা পড়ার স্বপ্ন দেখে না। এটা হলো আমাদের গোড়ার সমস্যা। ছেলেমেয়েরা এখানকার উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম আগ্রহ বোধ করে না। যত দিন পর্যন্ত আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিকভাবে মর্যাদাবান করতে না পারব, তত দিন ছেলেমেয়েদের শুধু দোষারোপ করা অনৈতিক কাজ হবে। আরেকটা কথা হলো, পুরো প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা পালন করছে, যেটা নিয়ে এখানে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি।

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম

‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভার্চুয়ালি কোনো স্কিল সাপ্লাই করে না’

দৈনিক আজকের পত্রিকায় ১৫ নভেম্বর ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষায় ব্যয়: টাকা যাচ্ছে উড়ে উড়ে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ওপর মতামত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ রানা।

মোহম্মদ আজম। ছবি: সংগৃহীত

উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার কারণগুলো কী কী বলে মনে করেন?
আমাদের সব সময় মনে রাখা দরকার, এটা সারা বিশ্বের প্রবণতা। বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্রবণতা। তৃতীয় বিশ্ব তো বটে, এমনকি ইউরোপ থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় সেটেল হতে যায়। তবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার হারটা একটু বেশি। আমাদের খোঁজটা আসলে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। যায় কেন? অন্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি কেন? তা খুঁজে বের করতে হবে। সেদিক থেকে দেখলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে প্রধান কারণটি আমার মতে, শিক্ষার্থীরা আসলে বিদেশে সেটেল হতে চায়। এই সেটেল হওয়ার জন্য পড়াশোনা করতে যাওয়াটা তার জন্য সুবিধাজনক। তার কারণ, ছেলেমেয়েরা মূলত যায় তার মা-বাবার টাকায়। ফলে মা-বাবারা মনে করেন, ছেলেমেয়েকে বিদেশে সেটেল করতে হবে। তাই তাদের মা-বাবারা আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের পর বিদেশে পাঠিয়ে দেন।

অভিভাবকদের বক্তব্য হলো, ও তো বিদেশে যাবেই, তো আগেভাগেই যাক। এটাই প্রধান কারণ বিদেশে সেটেল হওয়ার। এর পেছনে একটা প্র্যাকটিক্যাল কারণ আছে আমাদের দেশের বাস্তবতায়। সেটা হলো, ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাব্যবস্থা তো সর্বব্যাপী হয়ে গেছে, একদম মধ্যবিত্ত পর্যন্ত। কমবেশি সব মা-বাবা তাঁর সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়াম পড়াতে পাঠান। এখন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ার পরে, যাঁদের পারিবারিকভাবে কোনো প্রকারের সুবিধা, ক্ষমতা, সক্ষমতা আছে; তাঁরাই মূলত ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হন। তার কারণ হলো—প্রথমত, সাংস্কৃতিকভাবে সেই ছেলেমেয়েরা আর দেশে থাকতে চায় না। কারণ তারা ইংরেজি মিডিয়াম পড়ার কারণে সাংস্কৃতিকভাবে এমন এক মাইনসেটের মাধ্যমে বড় হয় যে তারা আর দেশে থাকতে চায় না। তার মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মা-বাবা মেয়েদের বিদেশে পাঠাতে চান না।

এবং যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য কম, তাঁদের ছেলেমেয়েরা এ দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এরপর দ্বিতীয় প্রধান কারণটি হলো, আমাদের উচ্চশিক্ষা বলতে যেটা বোঝায়, সেটা খুব বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পড়াশোনার মান খারাপ। ফলে এখানে পড়ার জন্য ছেলেমেয়েরা খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এখানকার যে ডিগ্রি, সেটা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারবে, এটা এখানকার বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে না। একটু মিলিয়ে দেখলে দেখতে পাব যে বুয়েট বা ঢাকা মেডিকেল কলেজে যেসব ছেলেমেয়ে চান্স পায় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একটা বিষয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ভালোভাবে বিক্রি করতে পারবে, সেসব বিষয়ে পড়ে তারাই আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করে বিদেশে চলে যায়। এ কারণে আমাদের এখানকার ডিগ্রি বিদেশে কম বিক্রয়যোগ্য, তাই এখানকার অধিকাংশ অভিভাবক ও ছেলেমেয়ে মনে করে, এখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করে বিদেশে চলে যাওয়া ভালো। এগুলোই প্রধান কারণ বলে ধারণা করি।

এটার সঙ্গে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ব্যাপার নেই? 
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কিন্তু বিশেষভাবে ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এটা সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়গুলোতে লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমাদের আশপাশের প্রচুর লোক ইমিগ্রেশন নিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে চেষ্টা করছে বিদেশে যাওয়ার। তার কারণ হলো, আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এমন পরিমাণ বেড়েছে যে আমাদের আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান, এমনকি মধ্যবিত্তরা তাঁদের সন্তানদের এখানে রাখতে নিরাপত্তা বোধ করছেন না। ফলে তারা ব্যাপকভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই আমি আবারও বলছি, এ প্রবণতা তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্র আছে, বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে বেশি আছে—এটা সংখ্যাগত দিক থেকে প্রমাণ করা যাবে। ফলে আমাদের অনিশ্চয়তাগুলো এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা রেখেছে।

শিক্ষার ব্যয় মেটানোর জন্য বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিপুল টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটার প্রতিকার কী হতে পারে? 
আমাদের একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে কোনো ব্যক্তির ক্যারিয়ার গঠন বা ভবিষ্যৎ যাপন কীভাবে করবে, নাগরিক হিসেবে আমরা কোনো ধরনের বাধা দিতে পারি না। মানে, কেউ যদি মনে করে তিনি এভাবে ক্যারিয়ার গঠন করবে, তার ব্যাপারে কোনো বাধা দিতে পারি না। একই সঙ্গে আমাদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে, কিছুসংখ্যক লোক এই সুবিধা নিচ্ছে। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক লোক বাংলাদেশে থাকছে। ফলে তাদের যে সামাজিক জীবনযাপন, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, অগ্রগতি—এগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে, এ ব্যাপারে ভাবিত হওয়া উচিত।

ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাচ্ছে। তারা তো সেখানে টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করে। আর কয়েক বছর তার বিদেশে থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার জন্য বিপুল টাকা বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে বেশি যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হলো বৃত্তির ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করা। এটা হয়তো করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে পদ্ধতিটা হতে পারে, যারা বৃত্তি ও প্রস্তুতি নিয়ে বা সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে যাবে, সে ক্ষেত্রে আমাদের গরিব দেশে ডলারের চাপ একটু কমবে।

পড়ার জন্য বিদেশে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কি? 
আমি ব্যাপারটাকে একেবারেই এভাবে দেখতে চাই না। আমি দেখতে চাই আসলে এখানে উচ্চশিক্ষা মানের দিক দিয়ে নিম্নমানের স্তরে আছে। প্রথম সমস্যা হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভার্চুয়ালি কোনো স্কিল সাপ্লাই করে না, তারা শুধু একটা গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি দেয়। এমনভাবে স্কিল ডেভেলপমেন্ট করে না, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারে। এটা সবাই জানে, এই ডিগ্রি শুধু আন্তর্জাতিক বাজারে কেন, দেশীয় বাজারেও চলে না। সবাই জানে এখানে পড়াশোনা করে মাঝারি বা নিম্নমানের প্রতিষ্ঠান চালাতেও স্কিল তৈরি করতে পারছি না। এখানে ব্যাপারটা পরিষ্কার, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়াশোনার প্রধান ব্যাপার যে স্কিল সাপ্লাই করা, সেটা এখানে হচ্ছে না।

তাই ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে কম আগ্রহী হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো, এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো আভিজাত্য দাঁড়ায়নি। কিছু ক্ষেত্রে বুয়েট বা ঢাকা মেডিকেল কলেজে এটা আছে। এখানকার কোনো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে শহুরে ছেলেমেয়েরা পড়ার স্বপ্ন দেখে না। এটা হলো আমাদের গোড়ার সমস্যা। ছেলেমেয়েরা এখানকার উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম আগ্রহ বোধ করে না। যত দিন পর্যন্ত আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিকভাবে মর্যাদাবান করতে না পারব, তত দিন ছেলেমেয়েদের শুধু দোষারোপ করা অনৈতিক কাজ হবে। আরেকটা কথা হলো, পুরো প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা পালন করছে, যেটা নিয়ে এখানে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি।