উচ্চশিক্ষা, বেকারত্ব ও মানসিক সমস্যা

মাছুম বিল্লাহ

চলতি মাসের ১০ তারিখ পালিত হলো বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। করোনা মহামারীর কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি। মানুষের মধ্যে করোনা-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ২৫ শতাংশেরও বেশি উদ্বেগ ও হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এর বাইরে নন।

মহামারীর আগে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক প্রতি আটজনের মধ্যে একজন মানসিক ব্যাধি নিয়ে বসবাস করছিলেন। মহামারীর পর এ সংখ্যা বেড়েছে। একই সময়ে মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পরিষেবা, তহবিলের স্বল্পতারও সংকট তৈরি হয়েছে। আঁচল ফাউন্ডেশন ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অ্যাকাডেমিক চাপের প্রভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, আগের তুলনায় ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় মনোযোগ কমে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, যাদের অনেকেই বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার মতো চরমতম পথ, যেটি উদ্বেগজনক একটি বিষয়।

জরিপে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত ১ হাজার ৬৪০ শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। এদের মধ্যে ছাত্র ৪৩.৯ শতাংশ ও ছাত্রী ৫৬.১ শতাংশ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন বিবেচনায় জড়িয়ে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৬৭.৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের, ২৩.৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ২.২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মানসিক ঝুঁকি বাড়ছে এবং আত্মহত্যার প্রবণতাও খুব বেড়েছে। ৫৭.৯৯ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগ তাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে। মোবাইল-ল্যাপটপ ব্যবহারের আসক্তি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছ ৭০.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ওপর। অতিরিক্ত ঘুম ও নিন্দ্রাহীনতায় ভুগছেন ৭১.৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৪৭.৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর অভিমত, তারা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছেন বা নিজেকে গুটিছে নিয়েছেন।

আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন ২.৪৪ শতাংশ। আর আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে এসেছেন ৫ শতাংশ। ৩৪.১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা-সংক্রান্ত সমস্যা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিলেন। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১০ শতাংশের বেশি ঘন ঘন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে বিষয়টির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন না। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী বড় কোর্স শেষ করার ফলে তা বোধগম্যের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া কভিড মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশাকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক চাপ, অভিভাবকদের চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানসিক সুস্থতাবিষয়ক বেশ কটি নিয়ামক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে উত্তরে আসে কিছু ‘উদ্বেগজনক’ তথ্য।

মোট অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কভিড মহামারীর পরবর্তী সময়ে তাদের নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগে তারা জর্জরিত। পাশাপাশি দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে শিক্ষার্থীদের জীবনে। মন খারাপ হওয়া, হঠাৎ ক্লান্তিবোধ করাসহ নানা বিষয় শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছে ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থীর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশে^ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে। ভঙ্গুর মানসিক স্বাস্থ্যই মূলত আত্মহত্যার জন্য দায়ী। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী দেশে দুই কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন মানসিক রোগে ভুগছেন। শতাংশ হিসেবে এটি ১৬.৮। জরিপ মতে, বর্তমানে দেশে ১৬.৫ কোটির বেশি মানুষের জন্য মাত্র ২৭০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। আর কাউন্সেলিংয়ের জন্য আছেন ২৫০ জন সাইকোলজিস্ট, যা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, অভিমান ইত্যাদি রয়েছে। গুরুতর কোনো মানসিক রোগ না থাকা সত্ত্বেও পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই কোনো সংকট বা মানসিক চাপে হঠাৎ করেই ঝোঁকের বশে অনেকে আত্মহত্যা করে বা করার চেষ্টা চালায়। মানসিক চাপ, যেকোনো প্রত্যাখ্যান বা কোনো দুর্ঘটনায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার দক্ষতার অভাবে এমনটি ঘটতে পারে। আঁচলের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘ বিরতির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৩.৮৪ শতাংশের আত্মবিশ^াস কমেছে। তৈরি হয়েছে শিক্ষা শেষে চাকরি পাওয়ার দুশ্চিন্তা।

করোনা-পরবর্তী ধাক্কায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনা যে পুরোপুরি শিক্ষাবান্ধব নয় তা আরেকবার সামনে চলে এলো। আর এটা ঠিক করার জন্য দৃশ্যমান ও কার্যত কোনো কার্যকর পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। এত দিন নতুন কারিকুলাম নিয়ে বেশ আলোচনা চললেও ইদানীং সেটাও থিতিয়ে পড়েছে। বলা হলো, বর্তমানের যুগের উপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের মাধ্যমে শিখবে এবং শিক্ষার্থীরা একবিংশ শতাব্দী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমর্থ হবে। এ যুগের শিক্ষার্থীরা কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করা দরকার সেগুলো ক্লাসরুম থেকে নেওয়ার জন্য বসে নেই। তারা দিন-রাত অনলাইনে যুক্ত থেকে এগুলো শিখে নিচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় দরকার গবেষণা, দরকার বিশ্বায়নের শিক্ষাসেটির যে হাল তা দেখলে রীতিমতো অবাক হতে হয়। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় নিয়ে আসা যাচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো সমাজেরই অংশ। সামাজিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, অশিক্ষা ও কুশিক্ষার প্রভাব শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের ওপর গিয়ে পড়ছে।

আমাদের তরুণ সমাজের হতাশার একটি বড় কারণটি হচ্ছে দেশে চাকরির বাজারের সংকোচন। এই তরুণদের উদ্যোক্তা বানানোর কথা শোনা গেলেও বাস্তবতা তার বিপরীত। কেউ কেউ নিজ প্রচেষ্টায় ‘আউটসোর্সিং মার্কেটে ঢুকছে। দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ বিসিএস পরীক্ষামুখী। এ নিয়ে অনেক সমালোচনাও হচ্ছে, কারণ টেকনিক্যাল বিভাগের শিক্ষার্থী যাদের উপার্জন ভালোই, যারা দেশকে অন্যভাবে সেবা দিতে পারতেন তারাও ছুটছেন বিসিএসের পেছনে। বিসিএসে না হলে আবার হতাশা। হতাশা যেন কাটছেই না। জনসংখ্যার লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির একটা স্তরে এসে বাংলাদেশ একটা সুবিধাজনক স্তরে প্রবেশ করেছিল, সেটি হচ্ছে তরুণ সমাজ এখন সবচেয়ে বেশি। জনশুমারি ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৯ শতাংশ তরুণ, ২৮ শতাংশ শিশু এবং মোট কর্মক্ষম মানুষ হচ্ছে ৬৫.৫১ শতাংশ। এই সংখ্যা আমাদের শক্তি হতে পারত কিন্তু তা না হয়ে দিন দিন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে পড়ছে। এই হতাশা তরুণ থেকে মধ্যবয়সী সবার মধ্যে। সরকার না পারছে জনসংখ্যা সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারছে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জনশক্তির যে উন্নয়ন সেটি আমাদের উন্নয়ন সংজ্ঞাতে সেভাবে নেই।

এখন ধরে নেওয়া হয় যে, চাকরিতে গিয়ে শিখবে। আর এ কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে নজর কম। ভাবে কোনো রকম একটি কাগজ বা সনদ জোগাড় করতে পারলেই হলো। শিক্ষা-দীক্ষা যা কিছু দরকার সবকিছু চাকরিতে ঢুকে করবে। এই চিন্তা হলে তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কমে যায়, আর যাচ্ছেও তাই। বেসরকারি চাকরি পেতে হলে আর পাওয়ার পর টিকে থাকতে হলে বর্তমান যুগের স্কিলগুলো অর্জন করতেই হবে। আর অ্যানালাইটিক্যাল রিজনিং অর্জন করা প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের। পিপল, ইমেজ আর প্রফিট চক্রটি কিন্তু এখন বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে একটি ব্র্যান্ডিং। যার অর্থ হচ্ছে একজন দক্ষ কর্মী কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড। বাইরে তার পরিচিতিই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সেভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। চাকরির জন্য স্কিল প্রয়োজন সেটি কিন্তু কোনো বিশ^বিদ্যালয়ই সঠিকভাবে শেখায় না। চাকরিতে ঢোকার পর দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীই মেইল করতে পারেন না, ইংরেজিতে দুর্বল, অনেকে ঠিকমতো লিখতেও পারেন না। দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে এবং সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের তৈরির চেষ্টা করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও মানসিক সমস্যা যেন না বাড়তে পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ জরুরি।

লেখক: সাবেক শিক্ষক ক্যাডেট কলেজ রাজউক কলেজ ও বাউবি

উচ্চশিক্ষা, বেকারত্ব ও মানসিক সমস্যা

মাছুম বিল্লাহ

চলতি মাসের ১০ তারিখ পালিত হলো বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। করোনা মহামারীর কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি। মানুষের মধ্যে করোনা-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ২৫ শতাংশেরও বেশি উদ্বেগ ও হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এর বাইরে নন।

মহামারীর আগে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক প্রতি আটজনের মধ্যে একজন মানসিক ব্যাধি নিয়ে বসবাস করছিলেন। মহামারীর পর এ সংখ্যা বেড়েছে। একই সময়ে মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পরিষেবা, তহবিলের স্বল্পতারও সংকট তৈরি হয়েছে। আঁচল ফাউন্ডেশন ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অ্যাকাডেমিক চাপের প্রভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, আগের তুলনায় ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় মনোযোগ কমে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, যাদের অনেকেই বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার মতো চরমতম পথ, যেটি উদ্বেগজনক একটি বিষয়।

জরিপে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত ১ হাজার ৬৪০ শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। এদের মধ্যে ছাত্র ৪৩.৯ শতাংশ ও ছাত্রী ৫৬.১ শতাংশ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন বিবেচনায় জড়িয়ে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৬৭.৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের, ২৩.৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ২.২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মানসিক ঝুঁকি বাড়ছে এবং আত্মহত্যার প্রবণতাও খুব বেড়েছে। ৫৭.৯৯ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগ তাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে। মোবাইল-ল্যাপটপ ব্যবহারের আসক্তি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছ ৭০.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ওপর। অতিরিক্ত ঘুম ও নিন্দ্রাহীনতায় ভুগছেন ৭১.৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৪৭.৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর অভিমত, তারা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছেন বা নিজেকে গুটিছে নিয়েছেন।

আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন ২.৪৪ শতাংশ। আর আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে এসেছেন ৫ শতাংশ। ৩৪.১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা-সংক্রান্ত সমস্যা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিলেন। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১০ শতাংশের বেশি ঘন ঘন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে বিষয়টির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন না। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী বড় কোর্স শেষ করার ফলে তা বোধগম্যের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া কভিড মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশাকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক চাপ, অভিভাবকদের চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানসিক সুস্থতাবিষয়ক বেশ কটি নিয়ামক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে উত্তরে আসে কিছু ‘উদ্বেগজনক’ তথ্য।

মোট অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কভিড মহামারীর পরবর্তী সময়ে তাদের নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগে তারা জর্জরিত। পাশাপাশি দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে শিক্ষার্থীদের জীবনে। মন খারাপ হওয়া, হঠাৎ ক্লান্তিবোধ করাসহ নানা বিষয় শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছে ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থীর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশে^ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে। ভঙ্গুর মানসিক স্বাস্থ্যই মূলত আত্মহত্যার জন্য দায়ী। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী দেশে দুই কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন মানসিক রোগে ভুগছেন। শতাংশ হিসেবে এটি ১৬.৮। জরিপ মতে, বর্তমানে দেশে ১৬.৫ কোটির বেশি মানুষের জন্য মাত্র ২৭০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। আর কাউন্সেলিংয়ের জন্য আছেন ২৫০ জন সাইকোলজিস্ট, যা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, অভিমান ইত্যাদি রয়েছে। গুরুতর কোনো মানসিক রোগ না থাকা সত্ত্বেও পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই কোনো সংকট বা মানসিক চাপে হঠাৎ করেই ঝোঁকের বশে অনেকে আত্মহত্যা করে বা করার চেষ্টা চালায়। মানসিক চাপ, যেকোনো প্রত্যাখ্যান বা কোনো দুর্ঘটনায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার দক্ষতার অভাবে এমনটি ঘটতে পারে। আঁচলের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘ বিরতির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৩.৮৪ শতাংশের আত্মবিশ^াস কমেছে। তৈরি হয়েছে শিক্ষা শেষে চাকরি পাওয়ার দুশ্চিন্তা।

করোনা-পরবর্তী ধাক্কায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনা যে পুরোপুরি শিক্ষাবান্ধব নয় তা আরেকবার সামনে চলে এলো। আর এটা ঠিক করার জন্য দৃশ্যমান ও কার্যত কোনো কার্যকর পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। এত দিন নতুন কারিকুলাম নিয়ে বেশ আলোচনা চললেও ইদানীং সেটাও থিতিয়ে পড়েছে। বলা হলো, বর্তমানের যুগের উপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের মাধ্যমে শিখবে এবং শিক্ষার্থীরা একবিংশ শতাব্দী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমর্থ হবে। এ যুগের শিক্ষার্থীরা কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করা দরকার সেগুলো ক্লাসরুম থেকে নেওয়ার জন্য বসে নেই। তারা দিন-রাত অনলাইনে যুক্ত থেকে এগুলো শিখে নিচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় দরকার গবেষণা, দরকার বিশ্বায়নের শিক্ষাসেটির যে হাল তা দেখলে রীতিমতো অবাক হতে হয়। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় নিয়ে আসা যাচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো সমাজেরই অংশ। সামাজিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, অশিক্ষা ও কুশিক্ষার প্রভাব শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের ওপর গিয়ে পড়ছে।

আমাদের তরুণ সমাজের হতাশার একটি বড় কারণটি হচ্ছে দেশে চাকরির বাজারের সংকোচন। এই তরুণদের উদ্যোক্তা বানানোর কথা শোনা গেলেও বাস্তবতা তার বিপরীত। কেউ কেউ নিজ প্রচেষ্টায় ‘আউটসোর্সিং মার্কেটে ঢুকছে। দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ বিসিএস পরীক্ষামুখী। এ নিয়ে অনেক সমালোচনাও হচ্ছে, কারণ টেকনিক্যাল বিভাগের শিক্ষার্থী যাদের উপার্জন ভালোই, যারা দেশকে অন্যভাবে সেবা দিতে পারতেন তারাও ছুটছেন বিসিএসের পেছনে। বিসিএসে না হলে আবার হতাশা। হতাশা যেন কাটছেই না। জনসংখ্যার লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির একটা স্তরে এসে বাংলাদেশ একটা সুবিধাজনক স্তরে প্রবেশ করেছিল, সেটি হচ্ছে তরুণ সমাজ এখন সবচেয়ে বেশি। জনশুমারি ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৯ শতাংশ তরুণ, ২৮ শতাংশ শিশু এবং মোট কর্মক্ষম মানুষ হচ্ছে ৬৫.৫১ শতাংশ। এই সংখ্যা আমাদের শক্তি হতে পারত কিন্তু তা না হয়ে দিন দিন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে পড়ছে। এই হতাশা তরুণ থেকে মধ্যবয়সী সবার মধ্যে। সরকার না পারছে জনসংখ্যা সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারছে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জনশক্তির যে উন্নয়ন সেটি আমাদের উন্নয়ন সংজ্ঞাতে সেভাবে নেই।

এখন ধরে নেওয়া হয় যে, চাকরিতে গিয়ে শিখবে। আর এ কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে নজর কম। ভাবে কোনো রকম একটি কাগজ বা সনদ জোগাড় করতে পারলেই হলো। শিক্ষা-দীক্ষা যা কিছু দরকার সবকিছু চাকরিতে ঢুকে করবে। এই চিন্তা হলে তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কমে যায়, আর যাচ্ছেও তাই। বেসরকারি চাকরি পেতে হলে আর পাওয়ার পর টিকে থাকতে হলে বর্তমান যুগের স্কিলগুলো অর্জন করতেই হবে। আর অ্যানালাইটিক্যাল রিজনিং অর্জন করা প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের। পিপল, ইমেজ আর প্রফিট চক্রটি কিন্তু এখন বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে একটি ব্র্যান্ডিং। যার অর্থ হচ্ছে একজন দক্ষ কর্মী কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড। বাইরে তার পরিচিতিই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সেভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। চাকরির জন্য স্কিল প্রয়োজন সেটি কিন্তু কোনো বিশ^বিদ্যালয়ই সঠিকভাবে শেখায় না। চাকরিতে ঢোকার পর দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীই মেইল করতে পারেন না, ইংরেজিতে দুর্বল, অনেকে ঠিকমতো লিখতেও পারেন না। দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে এবং সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের তৈরির চেষ্টা করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও মানসিক সমস্যা যেন না বাড়তে পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ জরুরি।

লেখক: সাবেক শিক্ষক ক্যাডেট কলেজ রাজউক কলেজ ও বাউবি