অন্যদৃষ্টি

এত কলেজ, মান কোথায়!

বিমল সরকার

দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে হলে জনপ্রতিনিধি, আমলা ও রাজনীতিকদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া চাই। দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, গৌরব-গরিমা, এমনকি ভূগোল সম্পর্কেও তাঁদের সঠিক ধারণা থাকতে হবে। শিক্ষাসহ আর্থসামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং মানুষের জীবন-জীবিকার চিত্রটি তাঁদের নখদর্পণে থাকা চাই। ২০০ বছরের ইংরেজ শাসন ও শোষণ, ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের সঙ্গে যুক্ত হয় পূর্বাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে অনতিক্রম্য বৈষম্য। সবারই মনে রাখা দরকার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই; বিকল্প হয় না।
দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তের কথা পাঁচ-সাত বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য জোর কদমে কাজও এগিয়ে চলেছে। সারাদেশে (৬৪ জেলায়) এখন পর্যন্ত পাবলিক-প্রাইভেট মিলে আনুমানিক ১৬০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা- এ টার্গেট বাস্তবায়নের বোধ করি বেশি দেরি নেই। অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ও সার্বিক পরিবেশ নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের প্রশ্ন এবং নানা আলোচনা-সমালোচনা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশে বর্তমানে ডিগ্রি স্তরের কলেজ রয়েছে অন্তত ২ হাজার ২৫০টি। কলেজগুলোর মধ্যে ৮৮০টিতে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ার ব্যবস্থা। এসব কলেজের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স পড়ার ব্যবস্থা আছে অন্তত ১৭০টিতে।
ডিগ্রি স্তরে কলেজের সংখ্যার দিক দিয়ে বিভাগীয় শহরসহ চট্টগ্রাম জেলা দেশের মধ্যে শীর্ষে। ১৬টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ জেলায় সবচেয়ে বেশি, মোট ৮৭টি কলেজ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় রাজশাহী। মহানগরীসহ ১১ উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী জেলায় কলেজ আছে ৮৪টি। এরপর রাজধানী ঢাকা, সংখ্যায় তৃতীয় স্থানে। দুই সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) এবং পার্শ্ববর্তী পাঁচটি উপজেলাসহ ঢাকায় কলেজ রয়েছে মোট ৮০টি। এরপর খুলনা। মহানগরী এলাকা এবং ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা জেলায় ডিগ্রি কলেজ রয়েছে ৫০টি। এমনই আট উপজেলার রংপুর জেলায় ৪৫, ১০ উপজেলার বরিশাল জেলায় ৪২ এবং ১২ উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহে ৪১টি কলেজ। ১৩ উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট জেলায় রয়েছে ৩৮টি, ৮টি বিভাগীয় মর্যাদা পাওয়া জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম কলেজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার সরকারি কোনো টার্গেট আছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে যত্রতত্র কলেজ প্রতিষ্ঠা থেমে নেই। আমার পূর্বসূরি শিক্ষক, অভিভাবক ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা তো বটেই, এমনকি আমার সমসাময়িক অনেকেই জেনে বোধ করি বিস্মিত হবেন- বিভিন্ন জেলায় প্রতিটিতে ছয়টি করে ২৫টি উপজেলায় আর পাঁচটি করে কলেজ রয়েছে অন্তত ৫০টি উপজেলায়। শুধু তাই না, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের একটি মাত্র জেলায় (মহানগরী নয়) সদরসহ মোট আটটি উপজেলায় কলেজ রয়েছে ৫৬টি (গড়ে প্রতি উপজেলায় ৭টি)। এর মধ্যে পাঁচটি উপজেলার প্রতিটিতে রয়েছে ছয়টি করে কলেজ।
আরও একটি কথা। হয়তো অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এ ছাড়া আমাদের দেশের আলোকে সহজে বিশ্বাস করার মতো কোনো কথাও নয় এটি। সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় ২-১০টি নয়, কমপক্ষে ৭০টি উপজেলা রয়েছে; যেগুলোর প্রতিটিতে রয়েছে ডিগ্রি স্তরের চারটি কলেজ।
কলেজ আছে অথচ ছাত্র নেই বা ভর্তি হতে চায় না, তা কখনও কাম্য হতে পারে না। লাগামহীনভাবে কলেজ স্থাপনের প্রবণতা দূর করতে হবে। আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে। দেশে নতুন করে আরও উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণ উপযোগী প্রতিষ্ঠান (ডিগ্রি কলেজ) স্থাপনের দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। তার চেয়ে উচ্চশিক্ষার মান ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। সঠিক ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ ও গুরুত্ব দিলে মান আপনাতেই বাড়তে থাকবে।
বিমল সরকার :অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

অন্যদৃষ্টি

এত কলেজ, মান কোথায়!

বিমল সরকার

দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে হলে জনপ্রতিনিধি, আমলা ও রাজনীতিকদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া চাই। দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, গৌরব-গরিমা, এমনকি ভূগোল সম্পর্কেও তাঁদের সঠিক ধারণা থাকতে হবে। শিক্ষাসহ আর্থসামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং মানুষের জীবন-জীবিকার চিত্রটি তাঁদের নখদর্পণে থাকা চাই। ২০০ বছরের ইংরেজ শাসন ও শোষণ, ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের সঙ্গে যুক্ত হয় পূর্বাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে অনতিক্রম্য বৈষম্য। সবারই মনে রাখা দরকার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই; বিকল্প হয় না।
দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তের কথা পাঁচ-সাত বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য জোর কদমে কাজও এগিয়ে চলেছে। সারাদেশে (৬৪ জেলায়) এখন পর্যন্ত পাবলিক-প্রাইভেট মিলে আনুমানিক ১৬০টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা- এ টার্গেট বাস্তবায়নের বোধ করি বেশি দেরি নেই। অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ও সার্বিক পরিবেশ নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের প্রশ্ন এবং নানা আলোচনা-সমালোচনা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশে বর্তমানে ডিগ্রি স্তরের কলেজ রয়েছে অন্তত ২ হাজার ২৫০টি। কলেজগুলোর মধ্যে ৮৮০টিতে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ার ব্যবস্থা। এসব কলেজের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স পড়ার ব্যবস্থা আছে অন্তত ১৭০টিতে।
ডিগ্রি স্তরে কলেজের সংখ্যার দিক দিয়ে বিভাগীয় শহরসহ চট্টগ্রাম জেলা দেশের মধ্যে শীর্ষে। ১৬টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ জেলায় সবচেয়ে বেশি, মোট ৮৭টি কলেজ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় রাজশাহী। মহানগরীসহ ১১ উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী জেলায় কলেজ আছে ৮৪টি। এরপর রাজধানী ঢাকা, সংখ্যায় তৃতীয় স্থানে। দুই সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) এবং পার্শ্ববর্তী পাঁচটি উপজেলাসহ ঢাকায় কলেজ রয়েছে মোট ৮০টি। এরপর খুলনা। মহানগরী এলাকা এবং ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা জেলায় ডিগ্রি কলেজ রয়েছে ৫০টি। এমনই আট উপজেলার রংপুর জেলায় ৪৫, ১০ উপজেলার বরিশাল জেলায় ৪২ এবং ১২ উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহে ৪১টি কলেজ। ১৩ উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট জেলায় রয়েছে ৩৮টি, ৮টি বিভাগীয় মর্যাদা পাওয়া জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম কলেজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার সরকারি কোনো টার্গেট আছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে যত্রতত্র কলেজ প্রতিষ্ঠা থেমে নেই। আমার পূর্বসূরি শিক্ষক, অভিভাবক ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা তো বটেই, এমনকি আমার সমসাময়িক অনেকেই জেনে বোধ করি বিস্মিত হবেন- বিভিন্ন জেলায় প্রতিটিতে ছয়টি করে ২৫টি উপজেলায় আর পাঁচটি করে কলেজ রয়েছে অন্তত ৫০টি উপজেলায়। শুধু তাই না, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের একটি মাত্র জেলায় (মহানগরী নয়) সদরসহ মোট আটটি উপজেলায় কলেজ রয়েছে ৫৬টি (গড়ে প্রতি উপজেলায় ৭টি)। এর মধ্যে পাঁচটি উপজেলার প্রতিটিতে রয়েছে ছয়টি করে কলেজ।
আরও একটি কথা। হয়তো অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এ ছাড়া আমাদের দেশের আলোকে সহজে বিশ্বাস করার মতো কোনো কথাও নয় এটি। সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় ২-১০টি নয়, কমপক্ষে ৭০টি উপজেলা রয়েছে; যেগুলোর প্রতিটিতে রয়েছে ডিগ্রি স্তরের চারটি কলেজ।
কলেজ আছে অথচ ছাত্র নেই বা ভর্তি হতে চায় না, তা কখনও কাম্য হতে পারে না। লাগামহীনভাবে কলেজ স্থাপনের প্রবণতা দূর করতে হবে। আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে। দেশে নতুন করে আরও উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণ উপযোগী প্রতিষ্ঠান (ডিগ্রি কলেজ) স্থাপনের দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। তার চেয়ে উচ্চশিক্ষার মান ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। সঠিক ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ ও গুরুত্ব দিলে মান আপনাতেই বাড়তে থাকবে।
বিমল সরকার :অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক