কোনো ব্যক্তির লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় না

শরীফুল আলম সুমন

দেশ রূপান্তরের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার শরীফুল আলম সুমন

দেশ রূপান্তর : উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা জানতে চাই। কর্মসংস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয়গুলো তারা কতখানি যুক্ত করতে পেরেছে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : সত্যিকার অর্থে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক বেশি ভূমিকা পালন করছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় মান বজায় রেখে চলছে, তারাই বড় ভূমিকা রাখছে। আর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আছে। কারণ যেসব বিষয়ের মার্কেট ডিমান্ড আছে, সেগুলোই তারা চালু করছে। ইইই, সিএসই, ফার্মেসি থেকে শুরু করে রোবটিকসের মতো বিষয়গুলো তারা খুলেছে। স্কিলড ম্যানপাওয়ার তৈরিতে যেসব বিষয় কাজে লাগে, সেগুলোর অনুমোদনই তারা নিচ্ছে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বেশ স্মার্ট হয়। ইংরেজিতে কথা বলা থেকে শুরু করে তারা জানে, কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্লাব, সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত থাকে। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।

ফলে তাদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে এসে কাজে লাগাচ্ছেন। ফলে তারা শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারছেন।

দেশ রূপান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংশোধন হচ্ছে, এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুবিধা-অসুবিধা কী হতে পারে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া আগে থেকেই চলছে। আমি এই বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাকে আহ্বায়ক করে কমিটি করা হয়েছে। এটা কিন্তু ইউজিসি করেনি, এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি। আমরা আইনের খসড়াটা সফট অ্যাপ্রোচ করেছি। ট্রাস্টি বোর্ডসহ সবকিছু বিবেচনায় রেখেই কাজটা করা হয়েছে।

আইনের খসড়ায় ট্রাস্টি বোর্ডে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ রাখার যে কথা বলা হয়েছে, তা কিন্তু ইউজিসির প্রস্তাব নয়। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ। এখন সংসদের একটা সুপারিশ, সেটা তো আমরা বাদ দিতে পারি না। আর যদি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এক-তৃতীয়াংশ রাখা হয়, তাহলে তো খারাপ হওয়ারও কথা নয়। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য থাকে অর্থ আত্মসাৎ বা অনৈতিক কাজ করা, তাহলে তো তারা তাদের পরিবার বা নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কাউকে ট্রাস্টি বোর্ডে রাখতে চাইবেন না। এ খসড়া আইন যদি সংসদে পাস হয়, তাহলে ট্রাস্টি বোর্ডে যদি ৯ জন সদস্য থাকেন, সেখানে নতুন করে হয়তো আরও কয়েকজন যুক্ত করতে হবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ কিন্তু ফি নির্ধারণ বা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইউজিসি অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এত দিন তারা সেটা করত না। এখন তারা যেন সেটা করে, সে জন্য ভাষাগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে আমরা যে প্রস্তাব পাঠিয়েছি, সেটা সংসদে যাওয়ার পর পরিবর্তন-পরিবর্ধনও হতে পারে।

দেশ রূপান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কি অলাভজনকই থাকা উচিত? আপনার মতামত জানতে চাই।

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : আমার মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মোটেই অলাভজনক নয়। যদি তারা মানসম্মত শিক্ষা দেয়, তাহলে তারা লাভজনক। তবে এই লাভের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে, অর্থাৎ একাডেমিক ও স্ট্রাকচারাল উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। কোনো ব্যক্তির লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে শত শত কোটি টাকা আছে। এখন বিশ^বিদ্যালয়ের আয়টা ব্যক্তির পকেটে যাবে কি না, সেটা নিয়েই আমাদের প্রশ্ন।

আমরা যদি আমাদের জাতির পিতাকে মানি, তাহলে তিনি কী চেয়েছিলেন, তা আগে জানতে হবে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষাও ছিল সরকারি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকও ধীরে ধীরে সরকারি সহায়তার আওতায় এসেছে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে ছিলেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী স্থাপিত হয়েছে। ফলে যারা এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হয়েছেন, তারা জেনেশুনেই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করেছেন। ইউরোপ, আমেরিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাভের টাকা কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাউন্ডেশনে যায়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা কিন্তু সেখান থেকে টাকা নিতে লজ্জাবোধ করেন। অর্থলোভী তারা নন। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেই তা দেখা যায় না।

দেশ রূপান্তর : সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমিসহ কোনো সুবিধাই দেওয়া হয় না। তাহলে এটা কি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সরকারকে জমি বা টাকা দিতে হয়, তাহলে ট্রাস্টিরা কেন আছেন? তারা তো সোশ্যাল স্ট্যাটাসের জন্য ট্রাস্টি হয়েছেন। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদেরই তো কন্ট্রিবিউট করার কথা। আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে চলছে, তারা নিজেরাই তো শত শত কোটি টাকার জায়গা কিনেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সবকিছু করা সম্ভব। যারা পারছে না, তারা মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে না, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সুবিধা দিতে পারছে না। এখন না পারলে স্যারেন্ডার করতে হবে। যারা পারবে, তারা দায়িত্ব নেবে।

আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মূলত ফ্রি পড়ছে, সেখানে নামমাত্র বেতন নেওয়া হয়। এটা রাষ্ট্রীয় নীতি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো উচ্চহারে টিউশন ফি নেওয়া হয়। তাহলে তাদের কেন সুবিধা দেবে সরকার?

দেশ রূপান্তর : দেশে ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি কি যথাযথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল করতে পারছে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের জন্য ইউজিসির লোকবল কম। কিন্তু ইউজিসির যে অবকাঠামোগত অবস্থা, সেখানে নতুন লোক নিয়োগের সুযোগ নেই বললেই চলে। আগে ইউজিসির অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে, তারপর সহকারী বা উপপরিচালক পর্যায়ে নতুন লোক নিয়োগ দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় করার। এখন প্রতি জেলায় যদি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়, সেখানে বড়জোর আরেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে। কিন্তু এখন ঢাকাতেই যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো কোনোটা শিক্ষার্থী পায় না। চট্টগ্রাম, খুলনাসহ অনেক জেলায় একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে এখন আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই। তবে যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই, সেখানে হয়তো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। এটা আসলে চাহিদার অনুপাতে হওয়া উচিত।

দেশ রূপান্তর : কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের কথা আমরা জানতে পারি, সেগুলোর ব্যাপারে ইউজিসি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম পেলেই আমরা তদন্ত কমিটি করছি। হয়তো মন্ত্রণালয় করছে অথবা আমরা করছি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম বেশি, তাদের দু-একটার ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠনের সুপারিশও আমরা করছি। আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৫(৭) ধারা প্রয়োগের সুপারিশ করছি, মন্ত্রণালয় সেগুলো আমলে নিয়েছে।

শিক্ষার্থীরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, তাদের স্মৃতিতে থাকবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। কিন্তু সেটা হচ্ছে না, অথচ শিক্ষার্থীরা ঠিকই তাদের টিউশন ফি দিয়ে গেছে। এ জন্য আমরা আইন অনুযায়ী স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছি। এখন যদি কেউ যেতে না পারে, তাহলে তাদের নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করা হবে। এখন যাদের তিন হাজার শিক্ষার্থী আছে, দেখা যাবে পর্যায়ক্রমে তাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ-ছয় শতে নেমে আসবে। আমি আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভেবেচিন্তে তাদের সিদ্ধান্ত নেবে।

দেশ রূপান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আপনার পরামর্শ কী?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা না করে প্রত্যেকেরই এমআইটি, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করা উচিত। তাদের কারিকুলাম ফলো করা উচিত। ওখানে কীভাবে পড়ায়, তা আমাদের শিক্ষকদের জানা উচিত। শিক্ষকদের ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি, মাস্টার্সের মতো কোর্সে পাঠানো উচিত। এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম থাকা উচিত, ওখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা না এলেও আমাদের যাওয়া উচিত। সম্ভব হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও পাঠাতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু টাকা এ খাতে খরচ করতে হবে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভাগভিত্তিক অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, গ্র্যাজুয়েট প্রোফাইল, ইন্টারন্যাশনাল অফিস থাকা দরকার। কারিকুলাম কমিটিতে অ্যালামনাই ও চাকরিদাতাদের প্রতিনিধি থাকা দরকার। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী ১০, ১৫ বা ২০ বছরের একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। সে অনুযায়ী ফিজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে। বিষয় পছন্দেও চাকরির বাজারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবে চললে আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলোও পর্যায়ক্রমে বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারবে।

দেশ রূপান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

কোনো ব্যক্তির লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় না

শরীফুল আলম সুমন

দেশ রূপান্তরের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার শরীফুল আলম সুমন

দেশ রূপান্তর : উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা জানতে চাই। কর্মসংস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয়গুলো তারা কতখানি যুক্ত করতে পেরেছে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : সত্যিকার অর্থে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক বেশি ভূমিকা পালন করছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় মান বজায় রেখে চলছে, তারাই বড় ভূমিকা রাখছে। আর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আছে। কারণ যেসব বিষয়ের মার্কেট ডিমান্ড আছে, সেগুলোই তারা চালু করছে। ইইই, সিএসই, ফার্মেসি থেকে শুরু করে রোবটিকসের মতো বিষয়গুলো তারা খুলেছে। স্কিলড ম্যানপাওয়ার তৈরিতে যেসব বিষয় কাজে লাগে, সেগুলোর অনুমোদনই তারা নিচ্ছে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বেশ স্মার্ট হয়। ইংরেজিতে কথা বলা থেকে শুরু করে তারা জানে, কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্লাব, সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত থাকে। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।

ফলে তাদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে এসে কাজে লাগাচ্ছেন। ফলে তারা শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারছেন।

দেশ রূপান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংশোধন হচ্ছে, এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুবিধা-অসুবিধা কী হতে পারে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া আগে থেকেই চলছে। আমি এই বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাকে আহ্বায়ক করে কমিটি করা হয়েছে। এটা কিন্তু ইউজিসি করেনি, এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি। আমরা আইনের খসড়াটা সফট অ্যাপ্রোচ করেছি। ট্রাস্টি বোর্ডসহ সবকিছু বিবেচনায় রেখেই কাজটা করা হয়েছে।

আইনের খসড়ায় ট্রাস্টি বোর্ডে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ রাখার যে কথা বলা হয়েছে, তা কিন্তু ইউজিসির প্রস্তাব নয়। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশ। এখন সংসদের একটা সুপারিশ, সেটা তো আমরা বাদ দিতে পারি না। আর যদি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এক-তৃতীয়াংশ রাখা হয়, তাহলে তো খারাপ হওয়ারও কথা নয়। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য থাকে অর্থ আত্মসাৎ বা অনৈতিক কাজ করা, তাহলে তো তারা তাদের পরিবার বা নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কাউকে ট্রাস্টি বোর্ডে রাখতে চাইবেন না। এ খসড়া আইন যদি সংসদে পাস হয়, তাহলে ট্রাস্টি বোর্ডে যদি ৯ জন সদস্য থাকেন, সেখানে নতুন করে হয়তো আরও কয়েকজন যুক্ত করতে হবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ কিন্তু ফি নির্ধারণ বা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইউজিসি অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এত দিন তারা সেটা করত না। এখন তারা যেন সেটা করে, সে জন্য ভাষাগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে আমরা যে প্রস্তাব পাঠিয়েছি, সেটা সংসদে যাওয়ার পর পরিবর্তন-পরিবর্ধনও হতে পারে।

দেশ রূপান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কি অলাভজনকই থাকা উচিত? আপনার মতামত জানতে চাই।

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : আমার মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মোটেই অলাভজনক নয়। যদি তারা মানসম্মত শিক্ষা দেয়, তাহলে তারা লাভজনক। তবে এই লাভের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে, অর্থাৎ একাডেমিক ও স্ট্রাকচারাল উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। কোনো ব্যক্তির লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে শত শত কোটি টাকা আছে। এখন বিশ^বিদ্যালয়ের আয়টা ব্যক্তির পকেটে যাবে কি না, সেটা নিয়েই আমাদের প্রশ্ন।

আমরা যদি আমাদের জাতির পিতাকে মানি, তাহলে তিনি কী চেয়েছিলেন, তা আগে জানতে হবে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষাও ছিল সরকারি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকও ধীরে ধীরে সরকারি সহায়তার আওতায় এসেছে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে ছিলেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী স্থাপিত হয়েছে। ফলে যারা এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হয়েছেন, তারা জেনেশুনেই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করেছেন। ইউরোপ, আমেরিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাভের টাকা কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাউন্ডেশনে যায়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা কিন্তু সেখান থেকে টাকা নিতে লজ্জাবোধ করেন। অর্থলোভী তারা নন। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেই তা দেখা যায় না।

দেশ রূপান্তর : সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমিসহ কোনো সুবিধাই দেওয়া হয় না। তাহলে এটা কি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি সরকারকে জমি বা টাকা দিতে হয়, তাহলে ট্রাস্টিরা কেন আছেন? তারা তো সোশ্যাল স্ট্যাটাসের জন্য ট্রাস্টি হয়েছেন। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদেরই তো কন্ট্রিবিউট করার কথা। আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে চলছে, তারা নিজেরাই তো শত শত কোটি টাকার জায়গা কিনেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সবকিছু করা সম্ভব। যারা পারছে না, তারা মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে না, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সুবিধা দিতে পারছে না। এখন না পারলে স্যারেন্ডার করতে হবে। যারা পারবে, তারা দায়িত্ব নেবে।

আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মূলত ফ্রি পড়ছে, সেখানে নামমাত্র বেতন নেওয়া হয়। এটা রাষ্ট্রীয় নীতি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো উচ্চহারে টিউশন ফি নেওয়া হয়। তাহলে তাদের কেন সুবিধা দেবে সরকার?

দেশ রূপান্তর : দেশে ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি কি যথাযথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল করতে পারছে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের জন্য ইউজিসির লোকবল কম। কিন্তু ইউজিসির যে অবকাঠামোগত অবস্থা, সেখানে নতুন লোক নিয়োগের সুযোগ নেই বললেই চলে। আগে ইউজিসির অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে, তারপর সহকারী বা উপপরিচালক পর্যায়ে নতুন লোক নিয়োগ দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় করার। এখন প্রতি জেলায় যদি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়, সেখানে বড়জোর আরেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারে। কিন্তু এখন ঢাকাতেই যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো কোনোটা শিক্ষার্থী পায় না। চট্টগ্রাম, খুলনাসহ অনেক জেলায় একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে এখন আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই। তবে যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই, সেখানে হয়তো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। এটা আসলে চাহিদার অনুপাতে হওয়া উচিত।

দেশ রূপান্তর : কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের কথা আমরা জানতে পারি, সেগুলোর ব্যাপারে ইউজিসি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম পেলেই আমরা তদন্ত কমিটি করছি। হয়তো মন্ত্রণালয় করছে অথবা আমরা করছি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম বেশি, তাদের দু-একটার ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠনের সুপারিশও আমরা করছি। আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৫(৭) ধারা প্রয়োগের সুপারিশ করছি, মন্ত্রণালয় সেগুলো আমলে নিয়েছে।

শিক্ষার্থীরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, তাদের স্মৃতিতে থাকবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। কিন্তু সেটা হচ্ছে না, অথচ শিক্ষার্থীরা ঠিকই তাদের টিউশন ফি দিয়ে গেছে। এ জন্য আমরা আইন অনুযায়ী স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছি। এখন যদি কেউ যেতে না পারে, তাহলে তাদের নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করা হবে। এখন যাদের তিন হাজার শিক্ষার্থী আছে, দেখা যাবে পর্যায়ক্রমে তাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ-ছয় শতে নেমে আসবে। আমি আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভেবেচিন্তে তাদের সিদ্ধান্ত নেবে।

দেশ রূপান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আপনার পরামর্শ কী?

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা না করে প্রত্যেকেরই এমআইটি, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করা উচিত। তাদের কারিকুলাম ফলো করা উচিত। ওখানে কীভাবে পড়ায়, তা আমাদের শিক্ষকদের জানা উচিত। শিক্ষকদের ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি, মাস্টার্সের মতো কোর্সে পাঠানো উচিত। এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম থাকা উচিত, ওখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা না এলেও আমাদের যাওয়া উচিত। সম্ভব হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও পাঠাতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু টাকা এ খাতে খরচ করতে হবে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভাগভিত্তিক অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, গ্র্যাজুয়েট প্রোফাইল, ইন্টারন্যাশনাল অফিস থাকা দরকার। কারিকুলাম কমিটিতে অ্যালামনাই ও চাকরিদাতাদের প্রতিনিধি থাকা দরকার। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী ১০, ১৫ বা ২০ বছরের একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। সে অনুযায়ী ফিজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যান করতে হবে। বিষয় পছন্দেও চাকরির বাজারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবে চললে আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলোও পর্যায়ক্রমে বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারবে।

দেশ রূপান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. বিশ্বজিৎ চন্দ : আপনাকেও ধন্যবাদ।