গবেষণায় গুরুত্ব বাড়িয়েছি আমরা

 

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

বিজ্ঞান হচ্ছে মনের পরিশ্রমের কারুকাজ’-ফ্রান্সিস বেকনের এ উক্তির সঙ্গে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে; কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমানের আধুনিক মানবসভ্যতা বিজ্ঞানের আশীর্বাদস্বরূপ।বিজ্ঞান আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর বিজ্ঞানের যে শাখাটি ছাড়া মানুষ বর্তমানে তার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না, সেটি হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান।

বর্তমানে সব ক্ষেত্রেই আমরা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। তবে আজকের এ আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা বিজ্ঞানের বহুদিনের গবেষণার ফলাফল। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাস অতি সুপ্রচীন। খ্রিষ্ট জন্মের শত শত বছর আগেই দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা একই সঙ্গে প্রতিভাত হয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো এক্ষেত্রে গ্রিক সভ্যতা এগিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে মিসরীয়, চৈনিক, মুসলিম ও ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্র এগোতে থাকে। অষ্ঠাদশ শতকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চিকিৎসা গবেষণাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক কাঠামো প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মানুষের চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি গবেষণায়ও অনেক উন্নতি করেছে। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে।

উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা ও বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা গবেষণাও চলছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ১৩টি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং নিপসমসহ পাঁচটি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের চিকিৎসক শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মানোন্নয়নের যথেষ্ট ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছিল না। চিকিৎসা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন দেশে একটি স্বতন্ত্র ও গবেষণাসমৃদ্ধ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সব মেডিকেল কলেজের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান। এদেশের চিকিৎসক সমাজ চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে তাদের সব প্রত্যাশা পূরণের ভরসাস্থলের সন্ধান পান। জনগণের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং দেশের চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন আইপিজিএমআরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে উন্নীত করার মধ্যে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ আন্তর্জাতিক মান অর্জন করে দেশের জনসাধারণের সুচিকিৎসায় নিয়োজিত হবেন-এ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল, প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে আবারও আইপিজিএমআর করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দেশের সব পেশাজীবী ও জনসাধারণ তীব্র ক্ষোভ ও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তীব্র আন্দোলনের ফলে বিএনপি-জামায়াত সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। জনসাধারণের বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আবারও ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সেলেন্সে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারডেমসংলগ্ন বেতার ভবনের জমি ও হাসপাতালের উত্তর পার্শ্বের ১২ বিঘা জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সহায়তা ও দিকনির্দেশনায় খুব দ্রুত নতুন কেবিন ব্লক সম্প্রসারণ, অনকোলজি ভবন নতুন বহিঃবিভাগ, আধুনিক আইসিইউ, ওটি কমপ্লেক্স, মেডিকেল কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ এবং সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার ৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট সুপার স্পেশালাইজড বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য গবেষণার বিকল্প নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা জোরদার করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতের বরাদ্দ পাঁচগুণ অর্থাৎ ৪ কোটি টাকা থেকে ২২ কোটি ৪০ লাখ টাকায় উন্নীত করেছে। পাশাপাশি সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় ভালো গবেষণার থিসিস পেপারের জন্য ভিসি অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে। এ ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, রেসিডেন্টদের গবেষণার প্রতি মনোযোগ বেড়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

এছাড়াও চলতি শিক্ষাবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে বেগবান করার জন্য প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ২৪ চিকিৎসক-গবেষককে পিএইচডি কোর্সে এনরোলমেন্ট করা হয়েছে। গবেষণার মানকে আরও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য এআইএমএস, ব্রাউন ও শিকাগো এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে, যাতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা-গবেষণার জ্ঞান বিনিময় করা যায়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রমের ১০০ কোটি টাকা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমে ইতোমধ্যে ২০ কোটি টাকা পেয়েছেন ফ্যাকালটির বিভিন্ন বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকরা। এজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে এ গবেষণাকাজের বরাদ্দ দ্বিগুণ করতে পারব বলে বর্তমান ভিসি হিসাবে আমি আশাবাদী। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রমে মাথাপিছু যেখানে মাত্র ২৫০০ টাকা বরাদ্দ ছিল, বর্তমান সরকার সেখানে মাথাপিছু দুই লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করছে, যা বর্তমান সরকারের আরও একটি বড় সাফল্য।

বর্তমানে আমরা গবেষণায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি, যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। গবেষণায় দেখা গেছে, মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কোভিড-১৯-এর টিকা গ্রহীতাদের ওপর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। সেখানে দেখা গেছে, টিকা গ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের ওপর গবেষণা চলমান রয়েছে।

উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান; উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সংযুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এ প্রত্যাশা সবার। সবাই মিলে যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সফল হবেই।

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

গবেষণায় গুরুত্ব বাড়িয়েছি আমরা

 

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

বিজ্ঞান হচ্ছে মনের পরিশ্রমের কারুকাজ’-ফ্রান্সিস বেকনের এ উক্তির সঙ্গে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে; কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমানের আধুনিক মানবসভ্যতা বিজ্ঞানের আশীর্বাদস্বরূপ।বিজ্ঞান আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর বিজ্ঞানের যে শাখাটি ছাড়া মানুষ বর্তমানে তার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না, সেটি হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান।

বর্তমানে সব ক্ষেত্রেই আমরা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। তবে আজকের এ আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা বিজ্ঞানের বহুদিনের গবেষণার ফলাফল। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাস অতি সুপ্রচীন। খ্রিষ্ট জন্মের শত শত বছর আগেই দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা একই সঙ্গে প্রতিভাত হয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো এক্ষেত্রে গ্রিক সভ্যতা এগিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে মিসরীয়, চৈনিক, মুসলিম ও ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্র এগোতে থাকে। অষ্ঠাদশ শতকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চিকিৎসা গবেষণাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক কাঠামো প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মানুষের চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি গবেষণায়ও অনেক উন্নতি করেছে। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে।

উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা ও বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা গবেষণাও চলছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ১৩টি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং নিপসমসহ পাঁচটি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের চিকিৎসক শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মানোন্নয়নের যথেষ্ট ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছিল না। চিকিৎসা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন দেশে একটি স্বতন্ত্র ও গবেষণাসমৃদ্ধ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সব মেডিকেল কলেজের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান। এদেশের চিকিৎসক সমাজ চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে তাদের সব প্রত্যাশা পূরণের ভরসাস্থলের সন্ধান পান। জনগণের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং দেশের চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন আইপিজিএমআরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে উন্নীত করার মধ্যে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ আন্তর্জাতিক মান অর্জন করে দেশের জনসাধারণের সুচিকিৎসায় নিয়োজিত হবেন-এ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল, প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে আবারও আইপিজিএমআর করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দেশের সব পেশাজীবী ও জনসাধারণ তীব্র ক্ষোভ ও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তীব্র আন্দোলনের ফলে বিএনপি-জামায়াত সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। জনসাধারণের বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আবারও ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সেলেন্সে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারডেমসংলগ্ন বেতার ভবনের জমি ও হাসপাতালের উত্তর পার্শ্বের ১২ বিঘা জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ সহায়তা ও দিকনির্দেশনায় খুব দ্রুত নতুন কেবিন ব্লক সম্প্রসারণ, অনকোলজি ভবন নতুন বহিঃবিভাগ, আধুনিক আইসিইউ, ওটি কমপ্লেক্স, মেডিকেল কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ এবং সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার ৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট সুপার স্পেশালাইজড বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য গবেষণার বিকল্প নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা জোরদার করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতের বরাদ্দ পাঁচগুণ অর্থাৎ ৪ কোটি টাকা থেকে ২২ কোটি ৪০ লাখ টাকায় উন্নীত করেছে। পাশাপাশি সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় ভালো গবেষণার থিসিস পেপারের জন্য ভিসি অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে। এ ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, রেসিডেন্টদের গবেষণার প্রতি মনোযোগ বেড়েছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

এছাড়াও চলতি শিক্ষাবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে বেগবান করার জন্য প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ২৪ চিকিৎসক-গবেষককে পিএইচডি কোর্সে এনরোলমেন্ট করা হয়েছে। গবেষণার মানকে আরও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য এআইএমএস, ব্রাউন ও শিকাগো এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে, যাতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা-গবেষণার জ্ঞান বিনিময় করা যায়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রমের ১০০ কোটি টাকা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমে ইতোমধ্যে ২০ কোটি টাকা পেয়েছেন ফ্যাকালটির বিভিন্ন বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকরা। এজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে এ গবেষণাকাজের বরাদ্দ দ্বিগুণ করতে পারব বলে বর্তমান ভিসি হিসাবে আমি আশাবাদী। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রমে মাথাপিছু যেখানে মাত্র ২৫০০ টাকা বরাদ্দ ছিল, বর্তমান সরকার সেখানে মাথাপিছু দুই লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করছে, যা বর্তমান সরকারের আরও একটি বড় সাফল্য।

বর্তমানে আমরা গবেষণায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি, যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। গবেষণায় দেখা গেছে, মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কোভিড-১৯-এর টিকা গ্রহীতাদের ওপর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। সেখানে দেখা গেছে, টিকা গ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের ওপর গবেষণা চলমান রয়েছে।

উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান; উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সংযুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এ প্রত্যাশা সবার। সবাই মিলে যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সফল হবেই।

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়