বিদেশে উচ্চশিক্ষায় ব্যয়

টাকা যাচ্ছে উড়ে উড়ে

রাহুল শর্মা

উচ্চশিক্ষার জন্য বৈধ পথেই ছয় অর্থবছরে বিদেশে পাঠানো হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে শেষ অর্থবছরে (২০২১-২২) গেছে ৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) পাঠানো হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের ব্যালান্স অব পেমেন্টস উপবিভাগের ওই প্রতিবেদনমতে, বিদেশে উচ্চশিক্ষা বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো টাকার পরিমাণই প্রতিবছর বাড়ছে। ছয় বছরে এ হার বেড়ে হয়েছে তিন গুণের কাছাকাছি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছরই বাড়ছে বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এর জন্য পরিবারকে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। কারণ, বৃত্তি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশে পড়াশোনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত ছয় অর্থবছরে মোট ১৩৯ কোটি ৩৪ লাখ ডলার বা সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে) বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই পাঠানো হয়েছে ১৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৬০৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনমতে, ব্যাংকের মাধ্যমে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ১৫ কোটি ৪ লাখ ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৭ লাখ ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাঠানো হয় ১৯ কোটি ৬১ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে। পরের অর্থবছরে গেছে ২৪ কোটি ৩১ লাখ ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ কোটি ৫১ লাখ ডলারে।

অবৈধ পথে যায় দুই-তিন গুণ 
তবে দেশের নামকরা কয়েকটি স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং ফার্মের কর্ণধারেরা বলছেন, সাধারণত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ভর্তি ফি, এক সেমিস্টারের টিউশন ফি এবং বাসস্থান ও অন্যান্য ফি ইত্যাদি দিয়ে বিদেশে পড়তে চলে যায়। এ টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে দুটি পথ—একটি ব্যাংকিং চ্যানেল, আরেকটি অবৈধ পথ হুন্ডি। তাঁদের মতে, বৈধ পথে বা ব্যাংকের মাধ্যমে যত টাকা যায়, তার দুই-তিন গুণ টাকা অবৈধ পথে যায়।

হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর উপায় প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন, মালয়েশিয়ার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে ভর্তি ফি, এক সেমিস্টারের টিউশন ফি ও থাকার খরচ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে হয়। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রশ্নের মুখে পড়ার ভয়ে অনেক অভিভাবক সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় এখানেই দেন সংশ্লিষ্ট এজেন্ট বা প্রতিনিধিকে। স্থানীয় প্রতিনিধি তখন ওই দেশে থাকা প্রতিনিধিকে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ জমা দিতে বলেন। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকও স্বজনের মাধ্যমে বা অন্য উপায়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ করার ব্যবস্থা করেন। আবার অনেকে টাকা পাচারের জন্যও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে থাকেন।

সম্প্রতি লন্ডনে কিংস কলেজে পড়াশোনা করতে গেছেন ঢাকার শ্যামলীর এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিত এক কনসালট্যান্ট ফার্মকে নগদ টাকা দিয়েছি, তারাই প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ করেছে।’

অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ফরিদুল হক অবশ্য বলেন, ‘আমরা আমাদের সদস্যদের কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছি, এ ধরনের বেআইনি কাজ যেন কেউ না করে। এতে দেশের ক্ষতি হয়।’

যে কারণে অবৈধ পথে
হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কারণ সম্পর্কে একটি কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনার জন্য যেতে চাইলে স্থানীয় ব্যাংকে স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে (বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে) বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ফি পরিশোধ করা হয়। এক লাখ টাকার বেশি পাঠাতে হলে আয়ের উৎস উল্লেখ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আয়ের উৎস জানাতে অভিভাবকের অনীহা থাকে। ফলে তাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। আবার অনেকে কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে আর কিছু হুন্ডিতে পাঠান।

শ্যামলীর ওই তরুণ বলেন, ‘বৈধ পথে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচই আনা সম্ভব হয়। এর বাইরে আরও অনেক খরচ রয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে এ টাকা আনা অনেক সহজ।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ধারণা, উচ্চশিক্ষার জন্য বৈধ চ্যানেলে যে পরিমাণ টাকা পাঠানো যায়, তা পর্যাপ্ত নয়। নানা আইনি জটিলতার মুখে পড়ার শঙ্কা তো রয়েছেই। এ জন্য কেউ কেউ হয়তো ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এ প্রক্রিয়া যদি জটিল হয়ে থাকে, তা-ও সহজ করতে হবে। কেননা শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিলে দেশেরই উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

বিদেশে যান বছরে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী
ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে গেছেন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কাজী ফরিদুল হকের ধারণা, প্রতিবছর ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যান। তিনি বলেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিদেশে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করেন। পড়াশোনা শেষে তাঁরা সে দেশে কাজের অনুমতি পান। এতে রেমিট্যান্স আসে।

ইউনেসকোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ৮ হাজার ৬৬৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়া (৭ হাজার ৫৪৮ জন), আর তৃতীয় অস্ট্রেলিয়া (৫ হাজার ৬৪৭ জন)।

যে কারণে বিদেশে যাওয়ার ঝোঁক
রাজধানীর আইইএলটিএস ও জিআরই কোচিং করায় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিড় বাড়া দেখেই বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ কতটা।
আইইএলটিএস কোর্স করতে আগ্রহী শেরপুর টাউন ক্লাব পাবলিক লাইব্রেরি মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মিনহু স্নাতা মিহা। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিরাপদ পরিবেশ আমাকে খুবই ভাবাচ্ছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ইডেন কলেজের ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই বিদেশে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া উন্নত জীবনযাপনের হাতছানি তো আছেই।’

মৃদুল ভট্টাচার্য নামের এক অভিভাবক অবশ্য বলেন, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই তো পড়ার সুযোগ পায় না। আর বিদেশে পড়তে যে টাকার প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি টিউশন ফি আদায় করছে দেশে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আবার দেশে শিক্ষার মানও প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া বিদেশে গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরিরও সুযোগ রয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ বাড়ার বড় কারণ। এ ছাড়া রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার কারণেও অনেক পরিবার সন্তানকে বিদেশে পাঠাতে আগ্রহী। বেশির ভাগ অভিভাবকই আশা করেন, সন্তান উচ্চশিক্ষা শেষে সেখানে চাকরি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে।’

বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবু ইউসুফ মিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

দেশে মান নিয়ে প্রশ্ন
এ বিষয়ে ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিল আফরোজা বেগম বলেন, ‘আমাদের এখানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এটা চরম বাস্তবতা। এ জন্যই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর পড়তে বিদেশ যাচ্ছে।’

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশে যে মানের উচ্চশিক্ষা একজন শিক্ষার্থী পাবে, সেটা আমাদের দেশে নেই। আমাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগটা কোথায়?’ তিনি আরও বলেন, উচ্চশিক্ষায় যে পরিমাণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা পূরণ করতে পারছি না। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত চাপই প্রমাণ করে, প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে এখনো প্রস্তুত হয়নি। মূল কথা হলো, আমরা এখনো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি গুছিয়ে উঠতে পারিনি।’

বিদেশে উচ্চশিক্ষায় ব্যয়

টাকা যাচ্ছে উড়ে উড়ে

রাহুল শর্মা

উচ্চশিক্ষার জন্য বৈধ পথেই ছয় অর্থবছরে বিদেশে পাঠানো হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে শেষ অর্থবছরে (২০২১-২২) গেছে ৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) পাঠানো হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের ব্যালান্স অব পেমেন্টস উপবিভাগের ওই প্রতিবেদনমতে, বিদেশে উচ্চশিক্ষা বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো টাকার পরিমাণই প্রতিবছর বাড়ছে। ছয় বছরে এ হার বেড়ে হয়েছে তিন গুণের কাছাকাছি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছরই বাড়ছে বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এর জন্য পরিবারকে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। কারণ, বৃত্তি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশে পড়াশোনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত ছয় অর্থবছরে মোট ১৩৯ কোটি ৩৪ লাখ ডলার বা সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে) বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই পাঠানো হয়েছে ১৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৬০৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনমতে, ব্যাংকের মাধ্যমে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ১৫ কোটি ৪ লাখ ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৭ লাখ ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাঠানো হয় ১৯ কোটি ৬১ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে। পরের অর্থবছরে গেছে ২৪ কোটি ৩১ লাখ ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ কোটি ৫১ লাখ ডলারে।

অবৈধ পথে যায় দুই-তিন গুণ 
তবে দেশের নামকরা কয়েকটি স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং ফার্মের কর্ণধারেরা বলছেন, সাধারণত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ভর্তি ফি, এক সেমিস্টারের টিউশন ফি এবং বাসস্থান ও অন্যান্য ফি ইত্যাদি দিয়ে বিদেশে পড়তে চলে যায়। এ টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে দুটি পথ—একটি ব্যাংকিং চ্যানেল, আরেকটি অবৈধ পথ হুন্ডি। তাঁদের মতে, বৈধ পথে বা ব্যাংকের মাধ্যমে যত টাকা যায়, তার দুই-তিন গুণ টাকা অবৈধ পথে যায়।

হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর উপায় প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন, মালয়েশিয়ার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে ভর্তি ফি, এক সেমিস্টারের টিউশন ফি ও থাকার খরচ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে হয়। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রশ্নের মুখে পড়ার ভয়ে অনেক অভিভাবক সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় এখানেই দেন সংশ্লিষ্ট এজেন্ট বা প্রতিনিধিকে। স্থানীয় প্রতিনিধি তখন ওই দেশে থাকা প্রতিনিধিকে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ জমা দিতে বলেন। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকও স্বজনের মাধ্যমে বা অন্য উপায়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ করার ব্যবস্থা করেন। আবার অনেকে টাকা পাচারের জন্যও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে থাকেন।

সম্প্রতি লন্ডনে কিংস কলেজে পড়াশোনা করতে গেছেন ঢাকার শ্যামলীর এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘আমার পরিচিত এক কনসালট্যান্ট ফার্মকে নগদ টাকা দিয়েছি, তারাই প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ করেছে।’

অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ফরিদুল হক অবশ্য বলেন, ‘আমরা আমাদের সদস্যদের কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছি, এ ধরনের বেআইনি কাজ যেন কেউ না করে। এতে দেশের ক্ষতি হয়।’

যে কারণে অবৈধ পথে
হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কারণ সম্পর্কে একটি কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনার জন্য যেতে চাইলে স্থানীয় ব্যাংকে স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে (বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে) বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ফি পরিশোধ করা হয়। এক লাখ টাকার বেশি পাঠাতে হলে আয়ের উৎস উল্লেখ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আয়ের উৎস জানাতে অভিভাবকের অনীহা থাকে। ফলে তাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। আবার অনেকে কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে আর কিছু হুন্ডিতে পাঠান।

শ্যামলীর ওই তরুণ বলেন, ‘বৈধ পথে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচই আনা সম্ভব হয়। এর বাইরে আরও অনেক খরচ রয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে এ টাকা আনা অনেক সহজ।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ধারণা, উচ্চশিক্ষার জন্য বৈধ চ্যানেলে যে পরিমাণ টাকা পাঠানো যায়, তা পর্যাপ্ত নয়। নানা আইনি জটিলতার মুখে পড়ার শঙ্কা তো রয়েছেই। এ জন্য কেউ কেউ হয়তো ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এ প্রক্রিয়া যদি জটিল হয়ে থাকে, তা-ও সহজ করতে হবে। কেননা শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিলে দেশেরই উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

বিদেশে যান বছরে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী
ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে গেছেন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কাজী ফরিদুল হকের ধারণা, প্রতিবছর ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যান। তিনি বলেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিদেশে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করেন। পড়াশোনা শেষে তাঁরা সে দেশে কাজের অনুমতি পান। এতে রেমিট্যান্স আসে।

ইউনেসকোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ৮ হাজার ৬৬৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়া (৭ হাজার ৫৪৮ জন), আর তৃতীয় অস্ট্রেলিয়া (৫ হাজার ৬৪৭ জন)।

যে কারণে বিদেশে যাওয়ার ঝোঁক
রাজধানীর আইইএলটিএস ও জিআরই কোচিং করায় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিড় বাড়া দেখেই বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ কতটা।
আইইএলটিএস কোর্স করতে আগ্রহী শেরপুর টাউন ক্লাব পাবলিক লাইব্রেরি মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মিনহু স্নাতা মিহা। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিরাপদ পরিবেশ আমাকে খুবই ভাবাচ্ছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ইডেন কলেজের ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই বিদেশে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া উন্নত জীবনযাপনের হাতছানি তো আছেই।’

মৃদুল ভট্টাচার্য নামের এক অভিভাবক অবশ্য বলেন, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই তো পড়ার সুযোগ পায় না। আর বিদেশে পড়তে যে টাকার প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি টিউশন ফি আদায় করছে দেশে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আবার দেশে শিক্ষার মানও প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া বিদেশে গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরিরও সুযোগ রয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ বাড়ার বড় কারণ। এ ছাড়া রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার কারণেও অনেক পরিবার সন্তানকে বিদেশে পাঠাতে আগ্রহী। বেশির ভাগ অভিভাবকই আশা করেন, সন্তান উচ্চশিক্ষা শেষে সেখানে চাকরি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে।’

বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবু ইউসুফ মিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

দেশে মান নিয়ে প্রশ্ন
এ বিষয়ে ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিল আফরোজা বেগম বলেন, ‘আমাদের এখানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এটা চরম বাস্তবতা। এ জন্যই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর পড়তে বিদেশ যাচ্ছে।’

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশে যে মানের উচ্চশিক্ষা একজন শিক্ষার্থী পাবে, সেটা আমাদের দেশে নেই। আমাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগটা কোথায়?’ তিনি আরও বলেন, উচ্চশিক্ষায় যে পরিমাণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা পূরণ করতে পারছি না। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত চাপই প্রমাণ করে, প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে এখনো প্রস্তুত হয়নি। মূল কথা হলো, আমরা এখনো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি গুছিয়ে উঠতে পারিনি।’