ঢাবির শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় হঠাৎ বেড়ে ৮ গুণ
আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
![](https://shikkha-shikkhangan.com/wp-content/uploads/2023/01/kalbela_2023-01_b0f50bc4-7368-48af-a63a-3b116afd1564_DU.jpg)
প্রতীকী ছবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় এক বছরে বেড়েছে ৮ গুণ। শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা করে, যা আগের বছর ছিল ২১ হাজার ২৩৮ টাকা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে। এখানে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৩৪৬ টাকা। আর শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে কম খরচ করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাত্র ৭৪৩ টাকা। অথচ উচ্চশিক্ষায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক ব্যয়ে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। ফারাক রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবেও।
উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে সর্বশেষ এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য নিয়ে এখন নতুন প্রতিবেদনের কাজ চলছে।
বর্তমানে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫০টি। এর মধ্যে কয়েকটি এখনো পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেনি। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব বলছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিভুক্ত কলেজ, মাদ্রাসাগুলো বাদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৭ লাখ ২০ হাজার ৩৭৯। তবে কলেজ, মাদ্রাসাসহ মিলিয়ে উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী আছে ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭। আর ১০৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম আছে ৯৯টিতে। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব বলছে, ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭।
ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০ সালে ৩৯ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২১ হাজার ২৩৮ টাকা। অথচ ২০২১ সালে ৩৭ হাজার ৪২৮ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা করে। এক বছরে ২ হাজার শিক্ষার্থী কমলেও ব্যয় এক লাফে বেড়ে গেছে ৮ গুণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৮৬৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৩১ কোটি ৭৯ লাখ টাকার বাজেটের মধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে ব্যয় ধরা হয় ৬১১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৭৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অথচ ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৭ হাজার ৪২৮ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা করে ব্যয় হলে এক বছরে মোট ব্যয় হয় ৬৯২ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, সব টাকা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশেই খরচ হয়। আমাদের চাকরিটাই হলো শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদের জন্যই আমাদের রাখা হয়েছে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ২৮ গুণ। ২০২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২৮ হাজার টাকা; কিন্তু ২০২১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৩৪৬ টাকা দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ১২ গুণ। ২০২০ সালে বুয়েটের ৮ হাজার ৮৫১ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২৩ হাজার ৯৬০ টাকা; কিন্তু ২০২১ সালে শিক্ষার্থী কমে ৬ হাজার ৯৫৯ হলেও শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬০ টাকা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ১৪৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বাজেট ঘোষিত হয়েছিল। জবির ১৫ হাজার ৯৬০ শিক্ষার্থীর জন্য ৭৬ হাজার টাকা করে ব্যয় হলে শিক্ষার্থীদের পেছনেই ব্যয় হয় ১২১ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ২৭৭ কোটি ৭৪ লাখ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ২৬৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ১৫ হাজার ৮৮ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা করে ব্যয় হলে মোট ব্যয় ২৪৪ কোটি ৪২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
অন্যদিকে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় আগের বছরের চেয়ে কম দেখালেও তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ৯ লাখ ২৫ হাজার ৯৬৯ টাকা এবং ২০২০ সালে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৭ টাকা দেখানো হলেও ২০২১ সালে দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। আর শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ২০১৯ সালে ৬৭ হাজার টাকা থেকে ২০২০ সালে এক লাফে ২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা দেখানো হলেও ২০২১ সালে তা কমিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় সবচেয়ে কম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ২০২০ সালে ১ হাজার ১৫১ টাকা থেকে ছিল। ২০২১ সালে তা কমে ৭৪৩ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় কম বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েও। ২০২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ২ হাজার ৭৯৩ টাকা।
এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের বিষয়ে ইউজিসি বলছে, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত থাকলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় অনেক কম। ফলে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান হ্রাস পাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের হিসাবে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন ও অবসর সুবিধার খরচের টাকা আছে, আবার আনুষঙ্গিক আরও কিছু খরচও আছে। সঙ্গে আছে গবেষণা অনুদান। এখানে মূলত অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতি কেনা ছাড়া বার্ষিক বাজেটে যে ব্যয় দেখানো হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের হিসাবটি করা হয়।
এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, যতটা খরচ হয়, তা মোট শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখানো হয়েছে। আমরা তো বাস্তব চিত্র তুলে আনতে পারি না। মোট সম্পদ কত আছে, মূল্যায়ন কত হয়েছে, কতজন শিক্ষার্থী বের হয়েছে এবং কত টাকা সরকার দিয়েছে এগুলো পরিমাপ করার জন্য একটি মানসম্মত প্রক্রিয়া আছে। সেই প্রক্রিয়ায় করা গেলে আসল চিত্র বোঝা যেত। আমরা তা করতে পারি না, আমাদের সেই পদ্ধতিও নেই। এটা আমাদের ব্যর্থতা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অসামঞ্জস্য হিসাব : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে মানিকগঞ্জের নর্থ প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮ লাখ ৯৮ হাজার ২৭৬ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজিতে, ২৫ শিক্ষার্থীর পেছনে তাদের ব্যয় ৪ লাখ ৩৮ হাজার ১৩ টাকা করে। শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের দিক দিয়ে তৃতীয় রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, ৭৪ শিক্ষার্থীর জন্য তাদের ব্যয় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯২১ টাকা করে।
এ বিষয়ে জানতে নর্থ প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এফ এম এ সালামের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮০ টাকা, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৬০ হাজার ৭২৫ টাকা, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ২১ হাজার ৯৬ টাকা, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৬১ হাজার ২১৬ টাকা, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ১ লাখ ৮২ হাজার ৪৯৯ টাকা, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ১ লাখ ১০ হাজার ৯৬ টাকা, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৮৩ হাজার ৯২৭ টাকা, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯০ টাকা।
আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫১ টাকা। ৯৩ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮ টাকা করে ব্যয় দেখিয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এ ছাড়া লাখের ওপর শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখিয়েছে আরও ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। ১২ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত জেড এন আর এফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসে শিক্ষার্থীপ্রতি কোনো ব্যয় দেখানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক পরিচালক ওমর ফারুখ কালবেলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন এমন তথ্য দিয়েছে সে বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।
![](https://shikkha-shikkhangan.com/wp-content/uploads/2023/01/logo-removebg-preview-1.png)
ঢাবির শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় হঠাৎ বেড়ে ৮ গুণ
আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
![](https://shikkha-shikkhangan.com/wp-content/uploads/2023/01/kalbela_2023-01_b0f50bc4-7368-48af-a63a-3b116afd1564_DU.jpg)
প্রতীকী ছবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় এক বছরে বেড়েছে ৮ গুণ। শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা করে, যা আগের বছর ছিল ২১ হাজার ২৩৮ টাকা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে। এখানে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৩৪৬ টাকা। আর শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে কম খরচ করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাত্র ৭৪৩ টাকা। অথচ উচ্চশিক্ষায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক ব্যয়ে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। ফারাক রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবেও।
উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে সর্বশেষ এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য নিয়ে এখন নতুন প্রতিবেদনের কাজ চলছে।
বর্তমানে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫০টি। এর মধ্যে কয়েকটি এখনো পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেনি। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব বলছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিভুক্ত কলেজ, মাদ্রাসাগুলো বাদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৭ লাখ ২০ হাজার ৩৭৯। তবে কলেজ, মাদ্রাসাসহ মিলিয়ে উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী আছে ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭। আর ১০৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম আছে ৯৯টিতে। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব বলছে, ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭।
ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০ সালে ৩৯ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২১ হাজার ২৩৮ টাকা। অথচ ২০২১ সালে ৩৭ হাজার ৪২৮ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা করে। এক বছরে ২ হাজার শিক্ষার্থী কমলেও ব্যয় এক লাফে বেড়ে গেছে ৮ গুণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৮৬৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৩১ কোটি ৭৯ লাখ টাকার বাজেটের মধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে ব্যয় ধরা হয় ৬১১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৭৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অথচ ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৭ হাজার ৪২৮ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা করে ব্যয় হলে এক বছরে মোট ব্যয় হয় ৬৯২ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, সব টাকা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশেই খরচ হয়। আমাদের চাকরিটাই হলো শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদের জন্যই আমাদের রাখা হয়েছে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ২৮ গুণ। ২০২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২৮ হাজার টাকা; কিন্তু ২০২১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৩৪৬ টাকা দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ১২ গুণ। ২০২০ সালে বুয়েটের ৮ হাজার ৮৫১ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২৩ হাজার ৯৬০ টাকা; কিন্তু ২০২১ সালে শিক্ষার্থী কমে ৬ হাজার ৯৫৯ হলেও শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬০ টাকা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ১৪৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বাজেট ঘোষিত হয়েছিল। জবির ১৫ হাজার ৯৬০ শিক্ষার্থীর জন্য ৭৬ হাজার টাকা করে ব্যয় হলে শিক্ষার্থীদের পেছনেই ব্যয় হয় ১২১ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ২৭৭ কোটি ৭৪ লাখ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ২৬৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ১৫ হাজার ৮৮ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা করে ব্যয় হলে মোট ব্যয় ২৪৪ কোটি ৪২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
অন্যদিকে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় আগের বছরের চেয়ে কম দেখালেও তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ৯ লাখ ২৫ হাজার ৯৬৯ টাকা এবং ২০২০ সালে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৭ টাকা দেখানো হলেও ২০২১ সালে দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। আর শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ২০১৯ সালে ৬৭ হাজার টাকা থেকে ২০২০ সালে এক লাফে ২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা দেখানো হলেও ২০২১ সালে তা কমিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় সবচেয়ে কম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ২০২০ সালে ১ হাজার ১৫১ টাকা থেকে ছিল। ২০২১ সালে তা কমে ৭৪৩ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় কম বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েও। ২০২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ২ হাজার ৭৯৩ টাকা।
এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের বিষয়ে ইউজিসি বলছে, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত থাকলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় অনেক কম। ফলে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান হ্রাস পাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের হিসাবে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন ও অবসর সুবিধার খরচের টাকা আছে, আবার আনুষঙ্গিক আরও কিছু খরচও আছে। সঙ্গে আছে গবেষণা অনুদান। এখানে মূলত অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতি কেনা ছাড়া বার্ষিক বাজেটে যে ব্যয় দেখানো হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের হিসাবটি করা হয়।
এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, যতটা খরচ হয়, তা মোট শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখানো হয়েছে। আমরা তো বাস্তব চিত্র তুলে আনতে পারি না। মোট সম্পদ কত আছে, মূল্যায়ন কত হয়েছে, কতজন শিক্ষার্থী বের হয়েছে এবং কত টাকা সরকার দিয়েছে এগুলো পরিমাপ করার জন্য একটি মানসম্মত প্রক্রিয়া আছে। সেই প্রক্রিয়ায় করা গেলে আসল চিত্র বোঝা যেত। আমরা তা করতে পারি না, আমাদের সেই পদ্ধতিও নেই। এটা আমাদের ব্যর্থতা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অসামঞ্জস্য হিসাব : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে মানিকগঞ্জের নর্থ প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮ লাখ ৯৮ হাজার ২৭৬ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজিতে, ২৫ শিক্ষার্থীর পেছনে তাদের ব্যয় ৪ লাখ ৩৮ হাজার ১৩ টাকা করে। শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ের দিক দিয়ে তৃতীয় রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, ৭৪ শিক্ষার্থীর জন্য তাদের ব্যয় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯২১ টাকা করে।
এ বিষয়ে জানতে নর্থ প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এফ এম এ সালামের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮০ টাকা, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৬০ হাজার ৭২৫ টাকা, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ২১ হাজার ৯৬ টাকা, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৬১ হাজার ২১৬ টাকা, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ১ লাখ ৮২ হাজার ৪৯৯ টাকা, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ১ লাখ ১০ হাজার ৯৬ টাকা, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ১ লাখ ৮৩ হাজার ৯২৭ টাকা, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯০ টাকা।
আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫১ টাকা। ৯৩ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮ টাকা করে ব্যয় দেখিয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এ ছাড়া লাখের ওপর শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখিয়েছে আরও ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। ১২ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত জেড এন আর এফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসে শিক্ষার্থীপ্রতি কোনো ব্যয় দেখানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক পরিচালক ওমর ফারুখ কালবেলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন এমন তথ্য দিয়েছে সে বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।