নয়ছয়ের ২০ কোটিতে অধ্যক্ষের স্কুল

শরীফুল আলম সুমন

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের ভর্তিবাণিজ্য প্রায় ওপেন সিক্রেট বিষয়। সরকারের একাধিক তদন্তেও বিষয়টি প্রমাণিত। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে আইডিয়ালের মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী ক্যাম্পাসে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, নির্দিষ্ট কোম্পানির গাইড বই কিনতে বাধ্য করা, নির্দিষ্ট টেইলর প্রতিষ্ঠান থেকে ড্রেস বানানোসহ নানা ধরনের বাণিজ্য করছে একটি সিন্ডিকেট।

আইডিয়ালের লুটপাট করা টাকা থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করে রাজধানীর আফতাবনগরে ১০ তলা নিজস্ব ভবনে এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ চালু করেছে ওই সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিকানায় রয়েছেন আইডিয়ালের সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। প্রায় ১৯ বছর ধরে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে গত ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যান তিনি। এ ছাড়া রয়েছেন বর্তমানে আইডিয়ালে কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আতিকুর রহমান খান (যিনি ইঞ্জিনিয়ার আতিক হিসেবে পরিচিত)। তারা দুজন নামে-বেনামে স্কুলের মালিকানায় আছেন। গভর্নিং বডির প্রভাবশালী এক সদস্যের সন্তানও এ স্কুলের মালিকানায় রয়েছেন।

শাহান আরা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘এটা আমাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস।’ স্কুলের মালিকানায় কে কে আছেন, স্কুলের অর্থায়নে কে আছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিছুই বলব না।’ স্কুলের মালিকানায় আইডিয়ালের ইঞ্জিনিয়ার আতিক বা তার পরিবারের কেউ আছেন কি না জানতে চাইলেও বলেন, ‘আমি এখন কিছুই বলব না।’ ইঞ্জিনিয়ার আতিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এভারকেয়ার স্কুলের সঙ্গে জড়িত নই। স্কুলটি শাহান আরা বেগম করেছেন। আমি কিছু বলতে পারব না।’ এরপর তিনি ‘ওকে’ বলে ফোন রেখে দেন।

অভিভাবক পরিচয় দিয়ে এভারকেয়ার স্কুলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আলামিন তুহিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘স্কুলটির নিজস্ব ক্যাম্পাস আছে। জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হবে। এখন ভর্তি চলছে। স্কুলের মালিকানায় আছেন শাহান আরা ম্যাডাম। আইডিয়াল স্কুলের আরও কয়েকজন এ স্কুলের মালিকানায় আছেন। উপদেষ্টা হিসেবে আছেন সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা। আমাদের সরকারি অনুমোদন আছে। স্কুলের সঙ্গে এত বড় মাপের লোক জড়িত যে, আমাদের অনুমোদন নেওয়া কোনো ব্যাপার না।’

আফতাবনগরে ঢুকতেই চোখে পড়বে ‘এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’-এর নাম। দেয়াল লিখনে, ব্যানারে, রিকশার পেছনে এ স্কুলের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। বিজ্ঞাপনে লেখা আছে ‘এভারকেয়ার ইন্টা. স্কুল অ্যান্ড কলেজ’; পরিচালনায় ড. শাহান আরা বেগম, সাবেক অধ্যক্ষ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা। ভর্তি চলছে প্লে থেকে ৮ম শ্রেণি, বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন; পর্যায়ক্রমে দ্বাদশ শ্রেণি। নিজস্ব ভবন : বাড়ি-৪৮, রোড-০২, ব্লক-বি, আফতাবনগর, ইমপিরিয়াল কলেজ সংলগ্ন, বাড্ডা।’ স্কুলের ফোন নম্বরও দেওয়া আছে।

এত আয়োজন করে বিশাল বাজেটের এ স্কুল চালু করা হলেও তা অবৈধ বলে জানা গেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এভারকেয়ার নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন এখনো আমরা দিইনি। এ নামে কোনো আবেদনও জমা পড়েনি। বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী ভর্তি করলে তা হবে অবৈধ।’

এভারকেয়ার স্কুলের অনুমতির ব্যাপারে শাহান আরা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা আগামী বছর শুরু করছি। যখন অষ্টম শ্রেণি বা তার ওপরের ক্লাস চালু হবে তখন আমরা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অনুমতি নেব।’

এ প্রতিবেদক গত ১৩ নভেম্বর এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে যান। দেখা যায়, স্কুল ভবনের ১০ তলার কাজ চলছে। ভবনের বাইরের আস্তরণের কাজ শেষ হয়নি। ভেতরেও কিছু কাজ বাকি। তবে খুবই জোরেশোরে ভবনটির নির্মাণকাজ চলছে। আফতাবনগরের ‘ডি’ ও ‘এন’ ব্লকের দুটি জমিতে কিছুদিন আগেও এ স্কুলের নামে সাইনবোর্ড টানানো ছিল বলে এলাকাবাসী জানান।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, এভারকেয়ার স্কুলের জমির পরিমাণ পাঁচ কাঠা। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, আফতাবনগরে সামনের দিকের এ জায়গার প্রতি কাঠার দাম দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। সেই হিসাবে জমির দামই ১০ কোটি টাকা। আর ১০ তলা ভবন নির্মাণে কমপক্ষে ৫-৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আসবাবপত্র, কম্পিউটার, গাড়িসহ নানা সরঞ্জাম কিনতে আরও ২-৩ কোটি টাকা লেগেছে। প্রথম বছরে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, প্রচারসহ অন্যান্য কাজে আরও কোটিখানেক খরচ হবে। এ হিসাবে স্কুলের পেছনে খরচ ২০ কোটি টাকার মতো।

জানা যায়, আইডিয়ালের সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের স্বামী একটি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন; বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। শাহান আরা অবসরে গেলেও তার নানা আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত চলমান থাকায় তার অবসরকালীন সুবিধা আটকে রাখা হয়েছে। আতিক আইডিয়াল স্কুলে ২০০৪ সালে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এখন ৩০ হাজার টাকা বেতন পান। তারা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কীভাবে এত টাকা ব্যয়ে স্কুল চালু করছেন, তা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

শুধু স্কুলই নয়, আইডিয়ালের সিন্ডিকেটে আছে দুটি ডেভেলপার কোম্পানি। ওইসব কোম্পানিতে স্কুলের লুটপাটের টাকা চালান করে বৈধ করা হয়। ‘ভিশন ৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’-এর মালিকানায় আছেন আতিকুর রহমান ও তার স্ত্রী, শাহান আরা বেগমের ছেলে, আইডিয়ালের বনশ্রী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী, আইডিয়ালের মতিঝিল শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী এবং গভর্নিং বডির দুজন সদস্য এ কোম্পানির মালিকানায় আছেন। অন্য কোম্পানি ‘৭১ ভিশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড’-এর মালিকানায় রয়েছেন আতিকের বড় ভাই, যিনি একটি ব্যাংকের চাকরি শেষে এখন অবসরে আছেন। এ ছাড়া শাহান আরার মেয়ে, আতিক ও তার স্ত্রী এবং গভর্নিং বডির আরেকজন সদস্য এর মালিকানায় রয়েছেন।

সূত্র জানায়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম চলে মূলত একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। সিন্ডিকেটের মূল হোতা ইঞ্জিনিয়ার আতিক। তার সহযোগী সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম, আতিকের বড় ভাই আইডিয়ালের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম খান (যিনি আগামী ৩০ নভেম্বর অবসরে যাবেন) ও আতিকের মামাশ^শুর আইডিয়ালের বনশ্রী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন। ভর্তিবাণিজ্যের সঙ্গে আইডিয়ালের গভর্নিং বডির একাধিক সদস্য জড়িত আছেন। প্রতিটি ভর্তিতে এ চক্র ৩-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। এভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছে তারা।

জানা যায়, তিন বছর আগে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইডিয়ালের মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী শাখার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির ১২২ জনের ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্র জব্দ করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। তারা তদন্তে ৬৯টি খাতায় উত্তর রাবার দিয়ে মুছে ঘষামাজা ও ওভাররাইটিং করার প্রমাণ পান। কিছু খাতায় হাতের লেখার অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়। আতিকের সিন্ডিকেট উত্তরপত্র ঘষামাজা করে ভর্তি করত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইডিয়ালের তিনটি ক্যাম্পাসের প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর ড্রেস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, ক্যান্টিন, লাইব্রেরি সবই বেনামে আতিকের মালিকানাধীন। স্কুলের যত ধরনের কেনাকাটা, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ সবই করেন তিনি। দরপত্রেও অংশ নেয় নামে-বেনামে তারই প্রতিষ্ঠান। সেখানে চলে বড় ধরনের লুটপাট। গত ১৫ বছরে স্কুলটিতে সাত শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিযুক্ত হয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ এবং কর্মচারী নিয়োগে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।

আতিক কর্মচারী হলেও চলাচল করেন দামি গাড়িতে। বিশ্বাস লাইব্রেরির পাশাপাশি আইডিয়াল স্কুলের প্রতিটি ক্যাম্পাসের ক্যান্টিন বেনামে তিনিই চালান। বনশ্রীর ‘ডি’ ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকেন নিজের ১৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে। আফতাবনগরের ‘ই’ ব্লকের ২৮ নম্বরে তার আছে ১০ তলা বাড়ি। আফতাবনগরের ‘বি’ ব্লকের ৩৪ নম্বর বাড়িতে ‘বিশ^াস বাজার’ নামে একটি সুপার শপ রয়েছে তার। বনশ্রীর ‘জি’ ব্লকের ৫ নম্বর রোডের ৫২-৫৪ নম্বর প্লটে ‘ভিশন ৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’-এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন। বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের ১ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাড়িতে বিশাল শোরুম ভাড়া দিয়েছেন। মেরুল বাড্ডার আনন্দনগর হাজী ওয়াকিল উদ্দিন সড়কের ১ নম্বর রোডে ৭৪৭ নম্বর বাড়িটি আতিকের শ্বশুরের। সেখানে তার টাকায় উঠেছে সাততলা ভবন। গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি ও পিকনিক স্পট। আতিকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে একাধিক অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

নয়ছয়ের ২০ কোটিতে অধ্যক্ষের স্কুল

শরীফুল আলম সুমন

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের ভর্তিবাণিজ্য প্রায় ওপেন সিক্রেট বিষয়। সরকারের একাধিক তদন্তেও বিষয়টি প্রমাণিত। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে আইডিয়ালের মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী ক্যাম্পাসে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, নির্দিষ্ট কোম্পানির গাইড বই কিনতে বাধ্য করা, নির্দিষ্ট টেইলর প্রতিষ্ঠান থেকে ড্রেস বানানোসহ নানা ধরনের বাণিজ্য করছে একটি সিন্ডিকেট।

আইডিয়ালের লুটপাট করা টাকা থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করে রাজধানীর আফতাবনগরে ১০ তলা নিজস্ব ভবনে এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ চালু করেছে ওই সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিকানায় রয়েছেন আইডিয়ালের সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। প্রায় ১৯ বছর ধরে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে গত ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যান তিনি। এ ছাড়া রয়েছেন বর্তমানে আইডিয়ালে কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আতিকুর রহমান খান (যিনি ইঞ্জিনিয়ার আতিক হিসেবে পরিচিত)। তারা দুজন নামে-বেনামে স্কুলের মালিকানায় আছেন। গভর্নিং বডির প্রভাবশালী এক সদস্যের সন্তানও এ স্কুলের মালিকানায় রয়েছেন।

শাহান আরা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘এটা আমাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস।’ স্কুলের মালিকানায় কে কে আছেন, স্কুলের অর্থায়নে কে আছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিছুই বলব না।’ স্কুলের মালিকানায় আইডিয়ালের ইঞ্জিনিয়ার আতিক বা তার পরিবারের কেউ আছেন কি না জানতে চাইলেও বলেন, ‘আমি এখন কিছুই বলব না।’ ইঞ্জিনিয়ার আতিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এভারকেয়ার স্কুলের সঙ্গে জড়িত নই। স্কুলটি শাহান আরা বেগম করেছেন। আমি কিছু বলতে পারব না।’ এরপর তিনি ‘ওকে’ বলে ফোন রেখে দেন।

অভিভাবক পরিচয় দিয়ে এভারকেয়ার স্কুলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আলামিন তুহিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘স্কুলটির নিজস্ব ক্যাম্পাস আছে। জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হবে। এখন ভর্তি চলছে। স্কুলের মালিকানায় আছেন শাহান আরা ম্যাডাম। আইডিয়াল স্কুলের আরও কয়েকজন এ স্কুলের মালিকানায় আছেন। উপদেষ্টা হিসেবে আছেন সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা। আমাদের সরকারি অনুমোদন আছে। স্কুলের সঙ্গে এত বড় মাপের লোক জড়িত যে, আমাদের অনুমোদন নেওয়া কোনো ব্যাপার না।’

আফতাবনগরে ঢুকতেই চোখে পড়বে ‘এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’-এর নাম। দেয়াল লিখনে, ব্যানারে, রিকশার পেছনে এ স্কুলের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। বিজ্ঞাপনে লেখা আছে ‘এভারকেয়ার ইন্টা. স্কুল অ্যান্ড কলেজ’; পরিচালনায় ড. শাহান আরা বেগম, সাবেক অধ্যক্ষ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা। ভর্তি চলছে প্লে থেকে ৮ম শ্রেণি, বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন; পর্যায়ক্রমে দ্বাদশ শ্রেণি। নিজস্ব ভবন : বাড়ি-৪৮, রোড-০২, ব্লক-বি, আফতাবনগর, ইমপিরিয়াল কলেজ সংলগ্ন, বাড্ডা।’ স্কুলের ফোন নম্বরও দেওয়া আছে।

এত আয়োজন করে বিশাল বাজেটের এ স্কুল চালু করা হলেও তা অবৈধ বলে জানা গেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এভারকেয়ার নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন এখনো আমরা দিইনি। এ নামে কোনো আবেদনও জমা পড়েনি। বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী ভর্তি করলে তা হবে অবৈধ।’

এভারকেয়ার স্কুলের অনুমতির ব্যাপারে শাহান আরা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা আগামী বছর শুরু করছি। যখন অষ্টম শ্রেণি বা তার ওপরের ক্লাস চালু হবে তখন আমরা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অনুমতি নেব।’

এ প্রতিবেদক গত ১৩ নভেম্বর এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে যান। দেখা যায়, স্কুল ভবনের ১০ তলার কাজ চলছে। ভবনের বাইরের আস্তরণের কাজ শেষ হয়নি। ভেতরেও কিছু কাজ বাকি। তবে খুবই জোরেশোরে ভবনটির নির্মাণকাজ চলছে। আফতাবনগরের ‘ডি’ ও ‘এন’ ব্লকের দুটি জমিতে কিছুদিন আগেও এ স্কুলের নামে সাইনবোর্ড টানানো ছিল বলে এলাকাবাসী জানান।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, এভারকেয়ার স্কুলের জমির পরিমাণ পাঁচ কাঠা। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, আফতাবনগরে সামনের দিকের এ জায়গার প্রতি কাঠার দাম দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। সেই হিসাবে জমির দামই ১০ কোটি টাকা। আর ১০ তলা ভবন নির্মাণে কমপক্ষে ৫-৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আসবাবপত্র, কম্পিউটার, গাড়িসহ নানা সরঞ্জাম কিনতে আরও ২-৩ কোটি টাকা লেগেছে। প্রথম বছরে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, প্রচারসহ অন্যান্য কাজে আরও কোটিখানেক খরচ হবে। এ হিসাবে স্কুলের পেছনে খরচ ২০ কোটি টাকার মতো।

জানা যায়, আইডিয়ালের সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের স্বামী একটি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন; বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। শাহান আরা অবসরে গেলেও তার নানা আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত চলমান থাকায় তার অবসরকালীন সুবিধা আটকে রাখা হয়েছে। আতিক আইডিয়াল স্কুলে ২০০৪ সালে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এখন ৩০ হাজার টাকা বেতন পান। তারা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কীভাবে এত টাকা ব্যয়ে স্কুল চালু করছেন, তা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

শুধু স্কুলই নয়, আইডিয়ালের সিন্ডিকেটে আছে দুটি ডেভেলপার কোম্পানি। ওইসব কোম্পানিতে স্কুলের লুটপাটের টাকা চালান করে বৈধ করা হয়। ‘ভিশন ৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’-এর মালিকানায় আছেন আতিকুর রহমান ও তার স্ত্রী, শাহান আরা বেগমের ছেলে, আইডিয়ালের বনশ্রী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী, আইডিয়ালের মতিঝিল শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী এবং গভর্নিং বডির দুজন সদস্য এ কোম্পানির মালিকানায় আছেন। অন্য কোম্পানি ‘৭১ ভিশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড’-এর মালিকানায় রয়েছেন আতিকের বড় ভাই, যিনি একটি ব্যাংকের চাকরি শেষে এখন অবসরে আছেন। এ ছাড়া শাহান আরার মেয়ে, আতিক ও তার স্ত্রী এবং গভর্নিং বডির আরেকজন সদস্য এর মালিকানায় রয়েছেন।

সূত্র জানায়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম চলে মূলত একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। সিন্ডিকেটের মূল হোতা ইঞ্জিনিয়ার আতিক। তার সহযোগী সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম, আতিকের বড় ভাই আইডিয়ালের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম খান (যিনি আগামী ৩০ নভেম্বর অবসরে যাবেন) ও আতিকের মামাশ^শুর আইডিয়ালের বনশ্রী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন। ভর্তিবাণিজ্যের সঙ্গে আইডিয়ালের গভর্নিং বডির একাধিক সদস্য জড়িত আছেন। প্রতিটি ভর্তিতে এ চক্র ৩-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে। এভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছে তারা।

জানা যায়, তিন বছর আগে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইডিয়ালের মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী শাখার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির ১২২ জনের ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্র জব্দ করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। তারা তদন্তে ৬৯টি খাতায় উত্তর রাবার দিয়ে মুছে ঘষামাজা ও ওভাররাইটিং করার প্রমাণ পান। কিছু খাতায় হাতের লেখার অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়। আতিকের সিন্ডিকেট উত্তরপত্র ঘষামাজা করে ভর্তি করত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইডিয়ালের তিনটি ক্যাম্পাসের প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর ড্রেস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, ক্যান্টিন, লাইব্রেরি সবই বেনামে আতিকের মালিকানাধীন। স্কুলের যত ধরনের কেনাকাটা, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ সবই করেন তিনি। দরপত্রেও অংশ নেয় নামে-বেনামে তারই প্রতিষ্ঠান। সেখানে চলে বড় ধরনের লুটপাট। গত ১৫ বছরে স্কুলটিতে সাত শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিযুক্ত হয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ এবং কর্মচারী নিয়োগে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।

আতিক কর্মচারী হলেও চলাচল করেন দামি গাড়িতে। বিশ্বাস লাইব্রেরির পাশাপাশি আইডিয়াল স্কুলের প্রতিটি ক্যাম্পাসের ক্যান্টিন বেনামে তিনিই চালান। বনশ্রীর ‘ডি’ ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকেন নিজের ১৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে। আফতাবনগরের ‘ই’ ব্লকের ২৮ নম্বরে তার আছে ১০ তলা বাড়ি। আফতাবনগরের ‘বি’ ব্লকের ৩৪ নম্বর বাড়িতে ‘বিশ^াস বাজার’ নামে একটি সুপার শপ রয়েছে তার। বনশ্রীর ‘জি’ ব্লকের ৫ নম্বর রোডের ৫২-৫৪ নম্বর প্লটে ‘ভিশন ৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’-এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন। বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের ১ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাড়িতে বিশাল শোরুম ভাড়া দিয়েছেন। মেরুল বাড্ডার আনন্দনগর হাজী ওয়াকিল উদ্দিন সড়কের ১ নম্বর রোডে ৭৪৭ নম্বর বাড়িটি আতিকের শ্বশুরের। সেখানে তার টাকায় উঠেছে সাততলা ভবন। গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি ও পিকনিক স্পট। আতিকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে একাধিক অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন।