পাস কম জিপিএ ৫ বেশি

পাসের হার ৮৭.৪৪ শতাংশ ২,৬৯,৬০২ জন জিপিএ ৫ দাখিলে ৮২.২২ শতাংশ কারিগরিতে ৮৯.৫৫ শতাংশ

শরীফুল আলম সুমন

গত বছরের চেয়ে এবার এসএসসি ও সমমানের ফলাফলে পাসের হার কমেছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। কিন্তু জিপিএ-৫ বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২ জন। যা মোট উত্তীর্ণের ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এসএসসি পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর এ বছরই সবচেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। মূলত বেশি প্রশ্নের মধ্য থেকে খুবই কম উত্তরের সুযোগ থাকায় জিপিএ ৫-এর এ উল্লম্ফন বলে মনে করছেন পরীক্ষাসংশ্লিষ্টরা।

গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় বোর্ড চেয়ারম্যানদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বছরের এসএসসি ও সমমানের ফলাফলের অনুলিপি হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এরপর দুপুর ১টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী।

এবার ৯টি সাধারণ বোর্ডসহ ১১ শিক্ষা বোর্ডে ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন। গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৯৭৫টি। তবে একজনও পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০টি।

আর গত বছর পাসের হার ছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন শিক্ষার্থী। ওই বছর শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৮টি আর ৫ হাজার ৪৯৪টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শতভাগ পাস করেছিল।

একাধিক শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জিপিএ ৫-এর উল্লম্ফনের পেছনে তিনটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমত এ বছর প্রত্যেক পরীক্ষার রচনামূলক অংশে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল বেশি। রচনামূলকে কোনো পরীক্ষায় ১১টির মধ্যে ৪টি এবং ব্যবহারিক থাকা পরীক্ষায় ৮টির মধ্যে ৩টির উত্তর দিতে হয়েছে। নৈর্ব্যক্তিক অংশে কোনো পরীক্ষায় ৩০টির মধ্যে ১৫টি এবং ব্যবহারিক থাকা পরীক্ষায় ২৫টির মধ্যে ১৫টির উত্তর দিতে হয়েছে। আর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে ৫০ নম্বরের, সেখানে তুলনামূলক আগের চেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে খুব সহজেই উত্তর করা সম্ভব হয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ সাবজেক্ট ম্যাপিং। এবার ১২টি বিষয়ের মধ্যে ৯টির পরীক্ষা হয়েছে। বাকি তিনটিতে এসএসসির ক্ষেত্রে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), দাখিলের ক্ষেত্রে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) এবং এসএসসি ও দাখিলের (ভোকেশনাল) ক্ষেত্রে নবম শ্রেণির ফলের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে। সাধারণত এসএসসির চেয়ে জেএসসি বা জেডিসিতে বেশি পাস করলেও বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, উচ্চতর গণিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নম্বর কম পায়। আবার তুলনামূলক সহজ বিষয়গুলোতে নম্বর বেশি পায়। এবার যেহেতু বাংলাদেশ ও বিশ^ পরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে। সেগুলোতে জেএসসি ও জেডিসিতে বেশি নম্বর পাওয়ায় অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ ৫ পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, পরীক্ষার জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে পরীক্ষা শুরু হলেও এবার করোনা এবং বন্যার কারণে তা পিছিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। এতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বছরের চেয়ে সাত মাসেরও বেশি সময় পায়। অথচ এ বছরের এসএসসির সিলেবাস ছিল সংক্ষিপ্ত। যা তাদের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা এ বছর প্রস্তুতির জন্য অনেক বেশি সময় পেয়েছে। করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। আবার করোনার প্রাদুর্ভাব কমলে সরাসরি ক্লাস করেছে। শিক্ষার্থীরা বেশি পড়াশোনা করতে পেরেছে। এতে জিপিএ ৫ বেড়েছে। তবে আমরা চাই আমাদের সব শিক্ষার্থীই পাস করুক।’

জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম নম্বরের পরীক্ষা হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অপশন ছিল বেশি। এমনকি শিক্ষার্থীরা নৈর্ব্যক্তিকেও অপশন পেয়েছে। যার কারণে প্রতিটি প্রশ্নই ভালো করে লেখার সুযোগ পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়নি। এতে কোনো শিক্ষার্থী জেএসসি বা জেডিসিতে খারাপ করলেও এসএসসিতে সে প্রভাব পড়েনি। ফলে জিপিএ ৫ বেড়ে গেছে।’

গত বছরের চেয়ে পাসের হার কিছুটা কমার কারণ জানিয়ে অধ্যাপক তপন কুমার বলেন, ‘এসএসসির ১২টি বিষয়ের মধ্যে গত বছর ৯টি বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছিল। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। শুধু তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। জেএসসিতে বেশি পাস করলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ভালো ফল করে না। অথচ ওই বিষয়গুলোতেই গত বছর সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছিল। এতে পাসের হার বেড়ে গেলেও এ বছরের চেয়ে জিপিএ ৫ কম ছিল। আর এ বছর ঠিক তার বিপরীত। তিনটি সহজ বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে। ফলে পাসের হার কিছুটা কমলেও জিপিএ ৫ বেড়েছে।’

শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং কম বিষয়ে হওয়ায় এবার শূন্য পাস প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। কেন তারা খারাপ করল সে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।’

ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে : এ বছর পাসের ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির দিক দিয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩ জন ছেলে অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮ লাখ ৭০ হাজার ৪৬ জন। ছেলেদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ১৫৬ জন। অন্যদিকে ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন মেয়ে অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৩ জন। মেয়েদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৬ জন। অর্থাৎ ছেলেদের চেয়ে ৩ হাজার ৫২৭ জন বেশি মেয়ে পাস করেছে এবং ২৭ হাজার ২৯০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছে।

শিক্ষার্থী বেশি মানবিকে, ফল ভালো বিজ্ঞানে : বিজ্ঞান বিভাগে ৫ লাখ ৭ হাজার ২৫৪ শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৪৭৪ জন, পাসের হার ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ৯৮৯ জন, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিভাগের ৪০ দশমিক ৮১ শতাংশই জিপিএ ৫ পেয়েছে। মানবিক বিভাগ থেকে ৭ লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৪২৯ জন, পাসের হার ৮০ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৭২৫ জন, অর্থাৎ ১ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে।

অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৩ লাখ ১৪৭ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন, পাসের হার ৯১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৯ জন, অর্থাৎ ৫ দশমিক ০১ শতাংশ জিপিএ ৫ পেয়েছে।

তবে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষায় পাস করেছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৮৩ জন। পাসের হার ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৭ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিলে (ভোকেশনাল) পাস করেছে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৬৫ জন। পাসের হার ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৫ জন।

সর্বোচ্চ পাস যশোর বোর্ডে : এ বছর সবচেয়ে ভালো ফল করেছে যশোর বোর্ড, তাদের পাসের হার ৯৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। এরপর কুমিল্লা ৯১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ঢাকা ৯০ দশমিক ৩ শতাংশ, বরিশাল ৮৯ দশমিক ৬১ শতাংশ, কারিগরি বোর্ডে ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ময়মনসিংহ ৮৯ দশমিক ২, চট্টগ্রাম ৮৭ দশমিক ৫৩, রাজশাহী ৮৫ দশমিক ৮৮, মাদ্রাসা বোর্ডে ৮২ দশমিক ২২, দিনাজপুর ৮১ দশমিক ১৬ এবং সিলেট বোর্ডে পাস করেছে ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।

সিলেট বোর্ডের ফল তুলনামূলক খারাপ হওয়ার পেছনে বন্যা পরিস্থিতিকে দায়ী করেন সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রমা বিজয় সরকার।

বিষয়ভিত্তিক ফল : ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলায় পাসের হার ৯৯.৭৭ শতাংশ, ইংরেজিতে ৯৬.৬৫ শতাংশ, গণিতে ৯৪.৬৩ শতাংশ, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.৪৩ শতাংশ, রসায়নে ৯৮.৭৬ শতাংশ, উদ্ভিদবিজ্ঞানে ৯৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, অ্যাকাউন্টিংয়ে ৯৭.৬৯ শতাংশ, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে ৯৭.৮৯ শতাংশ, অর্থনীতিতে ৯৭.৪৫ শতাংশ, কৃষি শিক্ষায় ৯৯.৬৩ শতাংশ এবং গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে ৯৯.০৭ শতাংশ।

ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন শুরু আজ : এসএসসির ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন শুরু হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএমএসের মাধ্যমে ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করা যাবে। প্রতিটি বিষয় ও প্রতি পত্রের জন্য ১২৫ টাকা হারে চার্জ কাটা হবে। যেসব বিষয়ের দুটি পত্র (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) রয়েছে, সেসব বিষয়ের ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করলে ২৫০ টাকা ফি কাটা হবে। তবে পরীক্ষা না হওয়া বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে বোর্ড।

পাস কম জিপিএ ৫ বেশি

পাসের হার ৮৭.৪৪ শতাংশ ২,৬৯,৬০২ জন জিপিএ ৫ দাখিলে ৮২.২২ শতাংশ কারিগরিতে ৮৯.৫৫ শতাংশ

শরীফুল আলম সুমন

গত বছরের চেয়ে এবার এসএসসি ও সমমানের ফলাফলে পাসের হার কমেছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। কিন্তু জিপিএ-৫ বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২ জন। যা মোট উত্তীর্ণের ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এসএসসি পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর এ বছরই সবচেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। মূলত বেশি প্রশ্নের মধ্য থেকে খুবই কম উত্তরের সুযোগ থাকায় জিপিএ ৫-এর এ উল্লম্ফন বলে মনে করছেন পরীক্ষাসংশ্লিষ্টরা।

গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় বোর্ড চেয়ারম্যানদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বছরের এসএসসি ও সমমানের ফলাফলের অনুলিপি হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এরপর দুপুর ১টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী।

এবার ৯টি সাধারণ বোর্ডসহ ১১ শিক্ষা বোর্ডে ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন। গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৯৭৫টি। তবে একজনও পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০টি।

আর গত বছর পাসের হার ছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন শিক্ষার্থী। ওই বছর শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৮টি আর ৫ হাজার ৪৯৪টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শতভাগ পাস করেছিল।

একাধিক শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জিপিএ ৫-এর উল্লম্ফনের পেছনে তিনটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমত এ বছর প্রত্যেক পরীক্ষার রচনামূলক অংশে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল বেশি। রচনামূলকে কোনো পরীক্ষায় ১১টির মধ্যে ৪টি এবং ব্যবহারিক থাকা পরীক্ষায় ৮টির মধ্যে ৩টির উত্তর দিতে হয়েছে। নৈর্ব্যক্তিক অংশে কোনো পরীক্ষায় ৩০টির মধ্যে ১৫টি এবং ব্যবহারিক থাকা পরীক্ষায় ২৫টির মধ্যে ১৫টির উত্তর দিতে হয়েছে। আর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে ৫০ নম্বরের, সেখানে তুলনামূলক আগের চেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে খুব সহজেই উত্তর করা সম্ভব হয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ সাবজেক্ট ম্যাপিং। এবার ১২টি বিষয়ের মধ্যে ৯টির পরীক্ষা হয়েছে। বাকি তিনটিতে এসএসসির ক্ষেত্রে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), দাখিলের ক্ষেত্রে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) এবং এসএসসি ও দাখিলের (ভোকেশনাল) ক্ষেত্রে নবম শ্রেণির ফলের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে। সাধারণত এসএসসির চেয়ে জেএসসি বা জেডিসিতে বেশি পাস করলেও বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, উচ্চতর গণিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নম্বর কম পায়। আবার তুলনামূলক সহজ বিষয়গুলোতে নম্বর বেশি পায়। এবার যেহেতু বাংলাদেশ ও বিশ^ পরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে। সেগুলোতে জেএসসি ও জেডিসিতে বেশি নম্বর পাওয়ায় অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ ৫ পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, পরীক্ষার জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে পরীক্ষা শুরু হলেও এবার করোনা এবং বন্যার কারণে তা পিছিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। এতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বছরের চেয়ে সাত মাসেরও বেশি সময় পায়। অথচ এ বছরের এসএসসির সিলেবাস ছিল সংক্ষিপ্ত। যা তাদের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা এ বছর প্রস্তুতির জন্য অনেক বেশি সময় পেয়েছে। করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। আবার করোনার প্রাদুর্ভাব কমলে সরাসরি ক্লাস করেছে। শিক্ষার্থীরা বেশি পড়াশোনা করতে পেরেছে। এতে জিপিএ ৫ বেড়েছে। তবে আমরা চাই আমাদের সব শিক্ষার্থীই পাস করুক।’

জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম নম্বরের পরীক্ষা হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অপশন ছিল বেশি। এমনকি শিক্ষার্থীরা নৈর্ব্যক্তিকেও অপশন পেয়েছে। যার কারণে প্রতিটি প্রশ্নই ভালো করে লেখার সুযোগ পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়নি। এতে কোনো শিক্ষার্থী জেএসসি বা জেডিসিতে খারাপ করলেও এসএসসিতে সে প্রভাব পড়েনি। ফলে জিপিএ ৫ বেড়ে গেছে।’

গত বছরের চেয়ে পাসের হার কিছুটা কমার কারণ জানিয়ে অধ্যাপক তপন কুমার বলেন, ‘এসএসসির ১২টি বিষয়ের মধ্যে গত বছর ৯টি বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছিল। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। শুধু তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। জেএসসিতে বেশি পাস করলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ভালো ফল করে না। অথচ ওই বিষয়গুলোতেই গত বছর সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছিল। এতে পাসের হার বেড়ে গেলেও এ বছরের চেয়ে জিপিএ ৫ কম ছিল। আর এ বছর ঠিক তার বিপরীত। তিনটি সহজ বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে। ফলে পাসের হার কিছুটা কমলেও জিপিএ ৫ বেড়েছে।’

শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং কম বিষয়ে হওয়ায় এবার শূন্য পাস প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। কেন তারা খারাপ করল সে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।’

ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে : এ বছর পাসের ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির দিক দিয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩ জন ছেলে অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮ লাখ ৭০ হাজার ৪৬ জন। ছেলেদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ১৫৬ জন। অন্যদিকে ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন মেয়ে অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৩ জন। মেয়েদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৬ জন। অর্থাৎ ছেলেদের চেয়ে ৩ হাজার ৫২৭ জন বেশি মেয়ে পাস করেছে এবং ২৭ হাজার ২৯০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছে।

শিক্ষার্থী বেশি মানবিকে, ফল ভালো বিজ্ঞানে : বিজ্ঞান বিভাগে ৫ লাখ ৭ হাজার ২৫৪ শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৪৭৪ জন, পাসের হার ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ৯৮৯ জন, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিভাগের ৪০ দশমিক ৮১ শতাংশই জিপিএ ৫ পেয়েছে। মানবিক বিভাগ থেকে ৭ লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৪২৯ জন, পাসের হার ৮০ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৭২৫ জন, অর্থাৎ ১ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে।

অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৩ লাখ ১৪৭ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন, পাসের হার ৯১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৯ জন, অর্থাৎ ৫ দশমিক ০১ শতাংশ জিপিএ ৫ পেয়েছে।

তবে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষায় পাস করেছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৮৩ জন। পাসের হার ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৭ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিলে (ভোকেশনাল) পাস করেছে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৬৫ জন। পাসের হার ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৫ জন।

সর্বোচ্চ পাস যশোর বোর্ডে : এ বছর সবচেয়ে ভালো ফল করেছে যশোর বোর্ড, তাদের পাসের হার ৯৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। এরপর কুমিল্লা ৯১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ঢাকা ৯০ দশমিক ৩ শতাংশ, বরিশাল ৮৯ দশমিক ৬১ শতাংশ, কারিগরি বোর্ডে ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ময়মনসিংহ ৮৯ দশমিক ২, চট্টগ্রাম ৮৭ দশমিক ৫৩, রাজশাহী ৮৫ দশমিক ৮৮, মাদ্রাসা বোর্ডে ৮২ দশমিক ২২, দিনাজপুর ৮১ দশমিক ১৬ এবং সিলেট বোর্ডে পাস করেছে ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।

সিলেট বোর্ডের ফল তুলনামূলক খারাপ হওয়ার পেছনে বন্যা পরিস্থিতিকে দায়ী করেন সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রমা বিজয় সরকার।

বিষয়ভিত্তিক ফল : ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলায় পাসের হার ৯৯.৭৭ শতাংশ, ইংরেজিতে ৯৬.৬৫ শতাংশ, গণিতে ৯৪.৬৩ শতাংশ, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.৪৩ শতাংশ, রসায়নে ৯৮.৭৬ শতাংশ, উদ্ভিদবিজ্ঞানে ৯৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, অ্যাকাউন্টিংয়ে ৯৭.৬৯ শতাংশ, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে ৯৭.৮৯ শতাংশ, অর্থনীতিতে ৯৭.৪৫ শতাংশ, কৃষি শিক্ষায় ৯৯.৬৩ শতাংশ এবং গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে ৯৯.০৭ শতাংশ।

ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন শুরু আজ : এসএসসির ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন শুরু হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএমএসের মাধ্যমে ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করা যাবে। প্রতিটি বিষয় ও প্রতি পত্রের জন্য ১২৫ টাকা হারে চার্জ কাটা হবে। যেসব বিষয়ের দুটি পত্র (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) রয়েছে, সেসব বিষয়ের ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করলে ২৫০ টাকা ফি কাটা হবে। তবে পরীক্ষা না হওয়া বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে বোর্ড।