প্রশ্নফাঁসে খাম-রহস্য

আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের

পুরোনো ছবি

একের পর এক পদক্ষেপের পরও দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা থামছে না। যে কোনো পরীক্ষা সামনে এলেই এ নিয়ে আতঙ্কে থাকেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সময়ে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সারা দেশে প্রশ্ন পাঠাতে নিম্নমানের খাম ব্যবহারের কারণেই প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলরা এ তথ্য জানিয়েছেন।

জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মতো পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়োগ পরীক্ষার আগেও প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে থাকেন দায়িত্বশীলরা। নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বারবার প্রশ্নফাঁস হওয়ায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন তারা।

পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের দাবি, সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার পরও মানসম্পন্ন খামের ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ায় প্রশ্নফাঁসের ঝুঁকি দূর হচ্ছে না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ নথির নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাম ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও কোনো কোনো কর্মকর্তার অনীহার কারণে তা করা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। তবে নব্বইয়ের দশকে এ সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করে। মাঝে কয়েক বছর এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও ২০১৪ সালের পর নতুন করে মাথাচাড়া দেয় এই প্রবণতা। পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়। এরপর সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে কয়েক বছর প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে আসেনি; কিন্তু ২০১৮ সালের পরে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় আবারও প্রশ্নফাঁস হয়েছে। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাতেও প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা দূর হয়নি।

জানা যায়, চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ওই কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান। বাছাইয়ের সময় তিনি উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা আব্দুর

রহমানের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। অনিরাপদ খামে প্রশ্ন রাখার কারণেই তিনি এমন সুযোগ পেয়েছিলেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, ওই প্রধান শিক্ষক মূল খাম থেকে প্রশ্ন সরিয়ে অন্য খামে রেখে নতুন করে সিলগালা করলেও তাৎক্ষণিকভাবে তা ধরা পড়েনি। প্রশ্ন বের করার পর লুৎফর রহমান নিজের কোচিং সেন্টারের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে একেকটি প্রশ্ন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। উত্তরপত্রের কপি গোপনে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়। দুটি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর প্রধান শিক্ষকের কক্ষে অভিযান চালিয়ে আরও চারটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। এরপর তাকেসহ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের আটক করা হয়।

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যেভাবে তৈরি হয় : পাবলিক পরীক্ষা শুরুর পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে শিক্ষক বাছাই করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রশ্নপত্র প্রণয়নের প্রাথমিক কার্যক্রম। প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি পত্রের জন্য বাছাই করা হয় অন্য শিক্ষা বোর্ডের চারজন অভিজ্ঞ শিক্ষক। তবে সাধারণ ধারার প্রশ্ন এভাবে করা হলেও সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয় ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে। সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন কার্যক্রমে অংশ নেন সব বোর্ডের প্রশ্ন প্রণেতারা। সাধারণ ধারার প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা প্রতিটি পত্রের জন্য চার সেট প্রশ্ন তৈরি করে তা সিলগালা করে পাঠিয়ে দেন বোর্ডে। এরপর বোর্ড প্রশ্নপত্র মডারেশনের জন্য প্রতি পত্রের ক্ষেত্রে অন্য বোর্ডের চারজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়। নির্ধারিত দিনে মডারেটররা শিক্ষা বোর্ড অফিসে হাজির হয়ে নির্ধারিত কক্ষে বসে সিলগালা তুলে প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে আবারও সিলগালা করে বুঝিয়ে দেন বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে। সিলগালা অবস্থায়ই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে। তিনি অন্যান্য বোর্ডের চেয়ারম্যানদের ডেকে লটারির আয়োজন করেন। এক বোর্ডের চেয়ারম্যান অন্য বোর্ডের প্রশ্নপত্র নির্বাচন করেন লটারিতে। সিলগালা অবস্থায় চারটি সেট থেকে লটারিতে নির্বাচন করা হয় দুটি সেট। নির্বাচিত দুই সেট প্রশ্ন সিলগালা অবস্থায়ই ছাপার জন্য পাঠানো হয় বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়ে (বিজি প্রেস)। চাহিদা অনুযায়ী ছাপিয়ে প্যাকেটজাত করে প্রশ্ন সিলগালা অবস্থায় পাঠানো হয় জেলা প্রশাসকের কাছে। ট্রাঙ্কভরা প্রশ্নপত্রগুলো উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী কর্মকর্তার ট্রেজারিতে রাখা হয়। নিরাপত্তা বা ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ফাঁড়ি বা ব্যাংকের লকারে রাখা হয় প্রশ্নপত্র। পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্তরা ট্রাঙ্কের ভেতরে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সেটের প্রশ্নপত্র নির্ধারিত কেন্দ্রে সরবরাহ করেন। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে প্রশ্ন গ্রহণ করেন কেন্দ্র সচিব।

সিকিউরিটি খামের প্রচলন যেভাবে : সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তৎকালীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাত আহমেদ একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি ভেন্ডারদের সঙ্গে সভা করে। কমিটির সভায় বিশেষ ধরনের খাম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সভার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আগে দড়ি দিয়ে বাঁধা প্রশ্নপত্র ট্রেজারি বা থানায় আসত। এরপর সেগুলো লকারে রাখা হতো। সেখান থেকে কেউ প্রশ্ন নিয়ে গেলে ধরার উপায় ছিল না। সে কারণে প্রশ্নফাঁস স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এজন্য প্রত্যেক দিনের প্রশ্ন খামবন্দি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খামটি এমন হবে, যা একবার খোলার পর আর লাগানো যাবে না। তাৎক্ষণিক দেশে এ ধরনের খাম না পাওয়ায় হয়তো ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ওই সিদ্ধান্তের পর প্রশ্নফাঁস একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

তখন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে কমিটি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল সিকিউরিটি খাম ব্যবস্থা। এটাসহ কিছু যৌক্তিক সিদ্ধান্তের কারণে প্রশ্নফাঁস রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নিরাপত্তার কারণে সারা পৃথিবীতেই প্রশ্নপত্র রাখার জন্য বিশেষ এক ধরনের খাম ব্যবহার করা হয়। এই খামটি বাংলাদেশে তৈরি হয় না। দেশি কোম্পানিগুলো ভারত থেকে আমদানি করে সেগুলো সরবরাহ করে। যার নাম টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ। এই খাম তিন ধরনের হয়ে থাকে। টাইপ-১ খাম সাধারণ, টাইপ-২ খাম খুললে সেই খামে আর গ্লু বা আটা লাগানো যায় না আর টাইপ-৩ খাম খুললে গ্লু এর রঙই পরিবর্তন হয়ে যায়। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে টাইপ-২ খাম ব্যবহার শুরু হয়। এই খামে উন্নত মানের কাঁচামাল ব্যবহার করায় এর দাম দেশি সাধারণ খামের চেয়ে বেশি। সূত্র আরও জানায়, প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষা আয়োজনে সবকটি বোর্ডেরই প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এখন ডলারের দাম বাড়ায় ১২৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে এক-একটি টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ আমদানিতে খরচ পড়ছে প্রায় ৬০ টাকার মতো। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার চিন্তা না করে টাকা বাঁচাতে খামের টেন্ডারের শর্ত শিথিল করছেন বোর্ড কর্মকর্তারা।

নিম্নমানের খাম ব্যবহারের অভিযোগ : শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানান, পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে আন্তঃবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সব বোর্ডকে জানায়। এরপর বোর্ডগুলো আলাদা টেন্ডারের মাধ্যমে খাম কিনে থাকে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রাখার জন্য বোর্ডগুলোর দুই রকম খামের প্রয়োজন হয়। এক ধরনের খামের ভেতর প্রশ্নপত্র থাকে, যা সরাসরি বিজি প্রেস থেকে সরবরাহ করা হয়। এই খাম অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে তৈরি। বিজি প্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেই খামে প্রশ্নপত্র ঢুকিয়ে সিল করে দেন। আর এক ধরনের খাম ব্যবহার করেন বোর্ডের কর্মচারীরা। প্রতিদিনের চাহিদা অনুযায়ী বিজি প্রেসের দেওয়া খাম এই বড় খামের মধ্যে ঢুকিয়ে সিল করা হয়। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড বাদে অন্য সব বোর্ড এই বিশেষ ধরনের খাম ব্যবহার করেছিল। তারপর ধীরে ধীরে টেন্ডারের শর্ত শিথিল করে নিম্নমানের খাম সরবরাহের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধব চন্দ্র রুদ্র কালবেলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালের দিকে শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রথম সিকিউরিটি খাম দেখতে চাইল। তখন ভারত থেকে আমদানিকৃত খাম দেখানো হলো। এখন সিকিউরিটি খাম বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হচ্ছে।’

জানা গেছে, প্রশ্নপত্রের খামের গ্লু দুই উপায়ে খোলা যায়। একটি হট কম্প্রেশন এবং অন্যটি কোল্ড কম্প্রেশন; কিন্তু টেম্পার প্রুফ খামের ক্ষেত্রে এই দুই পদ্ধতি প্রয়োগ করেও খাম খোলা সম্ভব নয়। ফলে টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ অনেক নিরাপদ।

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘সিকিউরিটি খামগুলো ভারত থেকে আনা হয়। এগুলো কুরিয়ারে ব্যবহৃত পলিব্যাগের মতো। এসব খাম একবারই ব্যবহার করা যায়। অধিকতর নিরাপত্তার জন্য পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রাখতে এই খাম ব্যবহার করা হয়।’ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ ব্যবহার করছে বলেও জানান তিনি।

টেম্পার প্রুফ খাম নিরাপদ হওয়ার পরও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তা আমদানি না করে নিম্নমানের খাম ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ এসআরবি নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই বোর্ডে খাম সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছিল।

বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১১টি বোর্ড টেন্ডার করে সবচেয়ে কম দর দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে খাম সরবরাহের কাজ দিচ্ছে। বোর্ডের পরীক্ষা শাখা থেকে স্যাম্পল অনুমোদনের পর কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। কোম্পানিগুলো দেশি কাঁচামালে ওই খাকি খাম (সিকিউরিটি খাম) তৈরি করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জেলার ট্রেজারি বা থানা থেকে কর্মকর্তারা প্রতিদিন প্রশ্ন নিতে আসেন না। ফলে কেন্দ্র সচিবরা এক দিনের প্রশ্ন নিতে গিয়ে তার সঙ্গে অন্য দিনের প্রশ্নও নিয়ে আসতে পারেন; কিন্তু তদারকি না থাকায় সেটি কেউ ধরতে পারে না। কারণ, খাম খুললেও ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘আমার জানামতে ঢাকার বাইরের বোর্ডগুলোও এমন ইনভেলাপ (সিকিউরিটি খাম) ব্যবহার করে। আমাদের দেশেও খাম বানানো হচ্ছে, হয়তো একটু ব্যবধান থাকতে পারে। তারপরও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।’

পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম (এন আই) খান কালবেলাকে বলেন, ‘কোন সময় প্রশ্ন করা হচ্ছে, কখন প্রশ্ন মডারেট হচ্ছে, এগুলো খোঁজ রাখতে হবে। যারা প্রশ্ন তৈরি করছে তাদের পেছনে গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে তদারকি করতে হবে, যাতে প্রশ্ন এদিক-সেদিক হতে না পারে। এগুলো করলে প্রশ্নফাঁস করার সাহস কেউ পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসে সমস্যা দেখা দিতো ছাপার জায়গায়। সে জন্য আমরা চেয়েছিলাম পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্রেই প্রশ্নপত্র ছাপা হবে। সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতি হলো আইপি প্রিন্টার দিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপানো। পরীক্ষা কেন্দ্রে আইপি প্রিন্টার থাকবে, প্রশ্নব্যাংক থাকবে। অটোমেটিক প্রশ্ন সর্টিং হবে, তারপর চেক করে দিলে মডারেটররাও তা টের পাবে না। আইপি প্রিন্টারে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ছাপা হবে। এটা করা গেলে প্রশ্নফাঁস করা সম্ভব নয়। কুড়িগ্রামে যা হয়েছে, এগুলো হতেই থাকবে যদি কোনো সংস্কার করা না হয়।’

তবে ভিন্ন মত ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারের। তিনি বলেন, ‘আইপি প্রিন্টার দিয়ে ছাপানো হলে পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই প্রশ্নফাঁস হবে। তাছাড়া, দেশের সব জেলায় একই সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নাও থাকতে পারে। সে কারণে এখনই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। এবার নতুন নিয়ম করা হয়েছে- প্রতিনিধি না পাঠিয়ে পরীক্ষায় দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সশরীরে উপস্থিত থেকে প্রশ্নপত্র বাছাই, সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব।’

প্রশ্নফাঁসে খাম-রহস্য

আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের

পুরোনো ছবি

একের পর এক পদক্ষেপের পরও দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা থামছে না। যে কোনো পরীক্ষা সামনে এলেই এ নিয়ে আতঙ্কে থাকেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সময়ে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সারা দেশে প্রশ্ন পাঠাতে নিম্নমানের খাম ব্যবহারের কারণেই প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলরা এ তথ্য জানিয়েছেন।

জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মতো পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়োগ পরীক্ষার আগেও প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে থাকেন দায়িত্বশীলরা। নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বারবার প্রশ্নফাঁস হওয়ায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন তারা।

পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের দাবি, সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার পরও মানসম্পন্ন খামের ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ায় প্রশ্নফাঁসের ঝুঁকি দূর হচ্ছে না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ নথির নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাম ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও কোনো কোনো কর্মকর্তার অনীহার কারণে তা করা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। তবে নব্বইয়ের দশকে এ সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করে। মাঝে কয়েক বছর এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও ২০১৪ সালের পর নতুন করে মাথাচাড়া দেয় এই প্রবণতা। পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়। এরপর সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে কয়েক বছর প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে আসেনি; কিন্তু ২০১৮ সালের পরে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় আবারও প্রশ্নফাঁস হয়েছে। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাতেও প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা দূর হয়নি।

জানা যায়, চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ওই কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান। বাছাইয়ের সময় তিনি উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা আব্দুর

রহমানের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। অনিরাপদ খামে প্রশ্ন রাখার কারণেই তিনি এমন সুযোগ পেয়েছিলেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, ওই প্রধান শিক্ষক মূল খাম থেকে প্রশ্ন সরিয়ে অন্য খামে রেখে নতুন করে সিলগালা করলেও তাৎক্ষণিকভাবে তা ধরা পড়েনি। প্রশ্ন বের করার পর লুৎফর রহমান নিজের কোচিং সেন্টারের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে একেকটি প্রশ্ন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। উত্তরপত্রের কপি গোপনে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়। দুটি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর প্রধান শিক্ষকের কক্ষে অভিযান চালিয়ে আরও চারটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। এরপর তাকেসহ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের আটক করা হয়।

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যেভাবে তৈরি হয় : পাবলিক পরীক্ষা শুরুর পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশে শিক্ষক বাছাই করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রশ্নপত্র প্রণয়নের প্রাথমিক কার্যক্রম। প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি পত্রের জন্য বাছাই করা হয় অন্য শিক্ষা বোর্ডের চারজন অভিজ্ঞ শিক্ষক। তবে সাধারণ ধারার প্রশ্ন এভাবে করা হলেও সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয় ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে। সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন কার্যক্রমে অংশ নেন সব বোর্ডের প্রশ্ন প্রণেতারা। সাধারণ ধারার প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা প্রতিটি পত্রের জন্য চার সেট প্রশ্ন তৈরি করে তা সিলগালা করে পাঠিয়ে দেন বোর্ডে। এরপর বোর্ড প্রশ্নপত্র মডারেশনের জন্য প্রতি পত্রের ক্ষেত্রে অন্য বোর্ডের চারজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়। নির্ধারিত দিনে মডারেটররা শিক্ষা বোর্ড অফিসে হাজির হয়ে নির্ধারিত কক্ষে বসে সিলগালা তুলে প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে আবারও সিলগালা করে বুঝিয়ে দেন বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে। সিলগালা অবস্থায়ই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে। তিনি অন্যান্য বোর্ডের চেয়ারম্যানদের ডেকে লটারির আয়োজন করেন। এক বোর্ডের চেয়ারম্যান অন্য বোর্ডের প্রশ্নপত্র নির্বাচন করেন লটারিতে। সিলগালা অবস্থায় চারটি সেট থেকে লটারিতে নির্বাচন করা হয় দুটি সেট। নির্বাচিত দুই সেট প্রশ্ন সিলগালা অবস্থায়ই ছাপার জন্য পাঠানো হয় বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়ে (বিজি প্রেস)। চাহিদা অনুযায়ী ছাপিয়ে প্যাকেটজাত করে প্রশ্ন সিলগালা অবস্থায় পাঠানো হয় জেলা প্রশাসকের কাছে। ট্রাঙ্কভরা প্রশ্নপত্রগুলো উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী কর্মকর্তার ট্রেজারিতে রাখা হয়। নিরাপত্তা বা ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ফাঁড়ি বা ব্যাংকের লকারে রাখা হয় প্রশ্নপত্র। পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্তরা ট্রাঙ্কের ভেতরে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সেটের প্রশ্নপত্র নির্ধারিত কেন্দ্রে সরবরাহ করেন। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে প্রশ্ন গ্রহণ করেন কেন্দ্র সচিব।

সিকিউরিটি খামের প্রচলন যেভাবে : সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তৎকালীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাত আহমেদ একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি ভেন্ডারদের সঙ্গে সভা করে। কমিটির সভায় বিশেষ ধরনের খাম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সভার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আগে দড়ি দিয়ে বাঁধা প্রশ্নপত্র ট্রেজারি বা থানায় আসত। এরপর সেগুলো লকারে রাখা হতো। সেখান থেকে কেউ প্রশ্ন নিয়ে গেলে ধরার উপায় ছিল না। সে কারণে প্রশ্নফাঁস স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এজন্য প্রত্যেক দিনের প্রশ্ন খামবন্দি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খামটি এমন হবে, যা একবার খোলার পর আর লাগানো যাবে না। তাৎক্ষণিক দেশে এ ধরনের খাম না পাওয়ায় হয়তো ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ওই সিদ্ধান্তের পর প্রশ্নফাঁস একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

তখন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে কমিটি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল সিকিউরিটি খাম ব্যবস্থা। এটাসহ কিছু যৌক্তিক সিদ্ধান্তের কারণে প্রশ্নফাঁস রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নিরাপত্তার কারণে সারা পৃথিবীতেই প্রশ্নপত্র রাখার জন্য বিশেষ এক ধরনের খাম ব্যবহার করা হয়। এই খামটি বাংলাদেশে তৈরি হয় না। দেশি কোম্পানিগুলো ভারত থেকে আমদানি করে সেগুলো সরবরাহ করে। যার নাম টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ। এই খাম তিন ধরনের হয়ে থাকে। টাইপ-১ খাম সাধারণ, টাইপ-২ খাম খুললে সেই খামে আর গ্লু বা আটা লাগানো যায় না আর টাইপ-৩ খাম খুললে গ্লু এর রঙই পরিবর্তন হয়ে যায়। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে টাইপ-২ খাম ব্যবহার শুরু হয়। এই খামে উন্নত মানের কাঁচামাল ব্যবহার করায় এর দাম দেশি সাধারণ খামের চেয়ে বেশি। সূত্র আরও জানায়, প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষা আয়োজনে সবকটি বোর্ডেরই প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এখন ডলারের দাম বাড়ায় ১২৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে এক-একটি টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ আমদানিতে খরচ পড়ছে প্রায় ৬০ টাকার মতো। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার চিন্তা না করে টাকা বাঁচাতে খামের টেন্ডারের শর্ত শিথিল করছেন বোর্ড কর্মকর্তারা।

নিম্নমানের খাম ব্যবহারের অভিযোগ : শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানান, পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে আন্তঃবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সব বোর্ডকে জানায়। এরপর বোর্ডগুলো আলাদা টেন্ডারের মাধ্যমে খাম কিনে থাকে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রাখার জন্য বোর্ডগুলোর দুই রকম খামের প্রয়োজন হয়। এক ধরনের খামের ভেতর প্রশ্নপত্র থাকে, যা সরাসরি বিজি প্রেস থেকে সরবরাহ করা হয়। এই খাম অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে তৈরি। বিজি প্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেই খামে প্রশ্নপত্র ঢুকিয়ে সিল করে দেন। আর এক ধরনের খাম ব্যবহার করেন বোর্ডের কর্মচারীরা। প্রতিদিনের চাহিদা অনুযায়ী বিজি প্রেসের দেওয়া খাম এই বড় খামের মধ্যে ঢুকিয়ে সিল করা হয়। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড বাদে অন্য সব বোর্ড এই বিশেষ ধরনের খাম ব্যবহার করেছিল। তারপর ধীরে ধীরে টেন্ডারের শর্ত শিথিল করে নিম্নমানের খাম সরবরাহের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধব চন্দ্র রুদ্র কালবেলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালের দিকে শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রথম সিকিউরিটি খাম দেখতে চাইল। তখন ভারত থেকে আমদানিকৃত খাম দেখানো হলো। এখন সিকিউরিটি খাম বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হচ্ছে।’

জানা গেছে, প্রশ্নপত্রের খামের গ্লু দুই উপায়ে খোলা যায়। একটি হট কম্প্রেশন এবং অন্যটি কোল্ড কম্প্রেশন; কিন্তু টেম্পার প্রুফ খামের ক্ষেত্রে এই দুই পদ্ধতি প্রয়োগ করেও খাম খোলা সম্ভব নয়। ফলে টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ অনেক নিরাপদ।

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘সিকিউরিটি খামগুলো ভারত থেকে আনা হয়। এগুলো কুরিয়ারে ব্যবহৃত পলিব্যাগের মতো। এসব খাম একবারই ব্যবহার করা যায়। অধিকতর নিরাপত্তার জন্য পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রাখতে এই খাম ব্যবহার করা হয়।’ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার টেম্পার প্রুফ ইনভেলাপ ব্যবহার করছে বলেও জানান তিনি।

টেম্পার প্রুফ খাম নিরাপদ হওয়ার পরও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তা আমদানি না করে নিম্নমানের খাম ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ এসআরবি নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই বোর্ডে খাম সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছিল।

বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১১টি বোর্ড টেন্ডার করে সবচেয়ে কম দর দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে খাম সরবরাহের কাজ দিচ্ছে। বোর্ডের পরীক্ষা শাখা থেকে স্যাম্পল অনুমোদনের পর কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। কোম্পানিগুলো দেশি কাঁচামালে ওই খাকি খাম (সিকিউরিটি খাম) তৈরি করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জেলার ট্রেজারি বা থানা থেকে কর্মকর্তারা প্রতিদিন প্রশ্ন নিতে আসেন না। ফলে কেন্দ্র সচিবরা এক দিনের প্রশ্ন নিতে গিয়ে তার সঙ্গে অন্য দিনের প্রশ্নও নিয়ে আসতে পারেন; কিন্তু তদারকি না থাকায় সেটি কেউ ধরতে পারে না। কারণ, খাম খুললেও ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘আমার জানামতে ঢাকার বাইরের বোর্ডগুলোও এমন ইনভেলাপ (সিকিউরিটি খাম) ব্যবহার করে। আমাদের দেশেও খাম বানানো হচ্ছে, হয়তো একটু ব্যবধান থাকতে পারে। তারপরও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।’

পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম (এন আই) খান কালবেলাকে বলেন, ‘কোন সময় প্রশ্ন করা হচ্ছে, কখন প্রশ্ন মডারেট হচ্ছে, এগুলো খোঁজ রাখতে হবে। যারা প্রশ্ন তৈরি করছে তাদের পেছনে গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে তদারকি করতে হবে, যাতে প্রশ্ন এদিক-সেদিক হতে না পারে। এগুলো করলে প্রশ্নফাঁস করার সাহস কেউ পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসে সমস্যা দেখা দিতো ছাপার জায়গায়। সে জন্য আমরা চেয়েছিলাম পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্রেই প্রশ্নপত্র ছাপা হবে। সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতি হলো আইপি প্রিন্টার দিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপানো। পরীক্ষা কেন্দ্রে আইপি প্রিন্টার থাকবে, প্রশ্নব্যাংক থাকবে। অটোমেটিক প্রশ্ন সর্টিং হবে, তারপর চেক করে দিলে মডারেটররাও তা টের পাবে না। আইপি প্রিন্টারে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ছাপা হবে। এটা করা গেলে প্রশ্নফাঁস করা সম্ভব নয়। কুড়িগ্রামে যা হয়েছে, এগুলো হতেই থাকবে যদি কোনো সংস্কার করা না হয়।’

তবে ভিন্ন মত ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারের। তিনি বলেন, ‘আইপি প্রিন্টার দিয়ে ছাপানো হলে পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই প্রশ্নফাঁস হবে। তাছাড়া, দেশের সব জেলায় একই সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নাও থাকতে পারে। সে কারণে এখনই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। এবার নতুন নিয়ম করা হয়েছে- প্রতিনিধি না পাঠিয়ে পরীক্ষায় দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সশরীরে উপস্থিত থেকে প্রশ্নপত্র বাছাই, সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব।’