প্রশ্ন ফাঁসে শতকোটি টাকার লেনদেন

ইমন রহমান
মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করত একটি চক্র। প্রশ্ন বিক্রি করে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৯৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আর এসব টাকা তারা দেশের ১৩৫টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছে। এছাড়া এ টাকার একটি অংশ দিয়ে চক্রের সদস্যরা এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। ২০০৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চক্রের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিক্রির টাকা লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন ফাঁস করে অর্জিত টাকা চক্রটির সদস্যরা বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট কিনতেও ব্যবহার করেছেন। শুধু মেডিকেলে প্রশ্নফাঁস চক্রটির হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু’র ৩৩টি ব্যাংক হিসাবেই জমা পড়েছে প্রশ্ন বিক্রির ২১ কোটি ৬ লাখ টাকার বেশি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওইসব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে টাকা। বর্তমানে নামমাত্র কিছু টাকা আছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত মানি লন্ডারিং আইনে করা একটি মামলার তদন্তে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে, আগামী এক মাসের মধ্যে চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মামলাটির এজাহারনামীয় ১৪ আসামি ছাড়াও তাদের আরও চার সহযোগীর তথ্য পেয়েছে সিআইডি। সব মিলে ১৮ থেকে ২০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের পাশাপাশি ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন এবং চিকিৎসা পেশায় আছেন এমন কয়েকজনের নামও উল্লেখ করা হচ্ছে চার্জশিটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মাধবী রানী পাল গত বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চক্রটি প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে ভর্তিচ্ছুদের কাছে বিভিন্ন দামে বিক্রি করত। তদন্তে মামলার এজাহারনামীয় আসামি ছাড়াও আরও কিছু ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে যাদের নাম এই মুহূর্তে প্রকাশ করা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘চক্রটিকে প্রশ্ন ফাঁসের একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট বলা যায়।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁস করেছে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিদপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মেশিনম্যান আব্দুস সালাম। ফাঁস করা প্রশ্নপত্র বিক্রি চক্রটির সমন্বয়কারী জসিম উদ্দিন ভূঁইয়ার খালাতো ভাই আব্দুস সালাম। জসিম উদ্দিন মেডিকেল কোচিং সেন্টার শুভেচ্ছা, ফেইথ, থ্রি ডক্টরস, রেটিনা, প্রাইমেট, এভিস, মেডিকোসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মালিক, পরিচালক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় মেডিকেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী সংগ্রহ ও ফাঁসকৃত প্রশ্ন বিক্রি করত। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো ২ থেকে ৭ লাখ টাকা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যারা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন তাদের কয়েকজনের তথ্যও চার্জশিটে উল্লেখ থাকবে। এদের কেউ এখনো শিক্ষার্থী আবার কেউ পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি। মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের প্রধান জসিম উদ্দিন ভূঁইয়াসহ জাকির হোসেন দিপু ও পারভেজ খানকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে এই চক্রের আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের অন্যতম সদস্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিদপ্তরের মেশিনম্যান সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানম-ি মডেল থানায় ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা করে সিআইডি। এজাহারে ১৪ আসামির নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয়ে ৩০ থেকে ৪০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি জসিম উদ্দিন ও আব্দুস সালামসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তারা এখনো জেলে রয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
অনুসন্ধানকালে সিআইডি জানতে পেরেছে, চক্রের হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া কোনো পেশায় নিয়োজিত ছিলেন না। তার আপন খালাতো ভাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনম্যান মো. আব্দুস সালামের কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করতেন। জসিম চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে সারা দেশে মেডিকেল, ডেন্টাল ও আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের ভর্তিচ্ছুদের কাছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিক্রি করতেন। প্রশ্নপত্র বিক্রির টাকা জসিমের বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৩টি হিসাবে লেনদেন হয়েছে। ২০০৬ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব হিসাবে ২১ কোটি ২৭ লাখ ৫ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া তার নামে বিপুল অঙ্কের এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র কেনার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। নিজ নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩২টি দলিলের মাধ্যমে ১ হাজার ২২৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ জমি কিনেছেন যার দলিল মূল্য ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। তবে এসব জমির বাজারমূল্য কয়েকগুণ বেশি বলে সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে। রাজধানীর মিরপুরে পাঁচ ও তিন তলা বিশিষ্ট দুটি বাড়ি কিনেছেন জসিম, যার বাজারমূল্য দুই কোটি টাকার বেশি। মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৯ দশমিক ৬ কাঠা জমির প্লট রয়েছে তার। প্রশ্নপত্র বিক্রির অবৈধ টাকায় জসিমের মা জহুরা ভূঁইয়ার নামে ৫টি দলিলে ১৬৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি কেনেন জসিম। যার দলিল মূল্য ১ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। পরবর্তী সময়ে ওই জমি হেবা ঘোষণার মাধ্যমে জসিম নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করে নেন। জসিমের স্ত্রী শারমীন আরা জেসমিন শিল্পীর ১৩টি ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া শিল্পীর নামে কোটি টাকার এফডিআর ও সঞ্চয়পত্রও রয়েছে। অবৈধভাবে কামানো টাকা দিয়ে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ৬টি দলিলে ২৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন যার দলিল মূল্য ৫ কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মিরপুর ও সাভারে ১৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় ১ হাজার ৩১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ জমি কিনেছেন জসিমের স্ত্রী।
সিআইডি কর্মকর্তারা আরও জানতে পেরেছেন, জসিমের বড় বোন শাহজাদী আক্তার ওরফে মীরা মূলত আব্দুস সালামের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে জসিমের কাছে পৌঁছে দিতেন। ফলে প্রশ্ন বিক্রির টাকার একটি বড় অংশ ভাগ পেতেন মীরা। তার ৪টি ব্যাংক হিসাব ও এফডিআরের তথ্য পায় সিআইডি। ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় ১ কোটি ৭০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা জমা হয়েছে। ঢাকার মিরপুরে তিনটি প্লট ও ৬ তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি রয়েছে মীরার। চক্রের অন্যতম হোতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনম্যান (চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) মো. আব্দুস সালামের নামে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মানিকগঞ্জ শাখার একটি হিসাবে ২ কোটি ৮৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া ১৪ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ও ৬ লাখ টাকা মূল্যের দুটি দোকান পাওয়া গেছে তার নামে। প্রশ্নপত্র বিক্রির টাকা দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬টি দলিলে ২৫২ দশমিক ৫ শতাংশ জমি কেনেন সালাম। যার দলিল মূল্য ২ কোটি ৬০ লাখ হলেও প্রকৃত মূল্য তিনগুণ বেশি। এছাড়া তার স্ত্রী নাসরিন আক্তারের নামেও জমি কিনেছেন। চক্রের অন্যতম সদস্য চক্ষু চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহম্মেদের ৩৯টি ব্যাংক হিসাবে প্রশ্নপত্র বিক্রির ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা জমা হয়। ময়েজ উদ্দিন আহম্মেদ প্রশ্ন বিক্রিতে জড়িত ফেইথ নামক মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। এছাড়া চক্রের সদস্য রাশেদ খান মেননেন ৬টি ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ৬৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা জমা হয়। এম এইচ পারভেজ খানের ৫টি ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা জমা হয়।
চক্রের আরেক সদস্য ডা. জেড এম এস সালেহীন শোভনের ৫টি ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জমা হয়। জসিমের ছোট বোনের জামাই জাকির হাসান দিপুর ৮টি হিসাবে ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা জমা হয়। তার নামে এফডিআরও রয়েছে। চক্রের সদস্য আলমাস হোসেনের ২টি ব্যাংক হিসাবে ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা জমা হয়। সাজ্জাদের ৬টি ব্যাংক হিসাবে ৩৪ লাখসহ চক্রের অন্যদের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
সিআইডি’র ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. হুমায়ুন কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। অনেকের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। দ্রুতই চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।’

প্রশ্ন ফাঁসে শতকোটি টাকার লেনদেন

ইমন রহমান
মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করত একটি চক্র। প্রশ্ন বিক্রি করে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৯৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আর এসব টাকা তারা দেশের ১৩৫টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছে। এছাড়া এ টাকার একটি অংশ দিয়ে চক্রের সদস্যরা এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। ২০০৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চক্রের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিক্রির টাকা লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন ফাঁস করে অর্জিত টাকা চক্রটির সদস্যরা বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট কিনতেও ব্যবহার করেছেন। শুধু মেডিকেলে প্রশ্নফাঁস চক্রটির হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু’র ৩৩টি ব্যাংক হিসাবেই জমা পড়েছে প্রশ্ন বিক্রির ২১ কোটি ৬ লাখ টাকার বেশি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওইসব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে টাকা। বর্তমানে নামমাত্র কিছু টাকা আছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত মানি লন্ডারিং আইনে করা একটি মামলার তদন্তে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে, আগামী এক মাসের মধ্যে চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মামলাটির এজাহারনামীয় ১৪ আসামি ছাড়াও তাদের আরও চার সহযোগীর তথ্য পেয়েছে সিআইডি। সব মিলে ১৮ থেকে ২০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের পাশাপাশি ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন এবং চিকিৎসা পেশায় আছেন এমন কয়েকজনের নামও উল্লেখ করা হচ্ছে চার্জশিটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মাধবী রানী পাল গত বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চক্রটি প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে ভর্তিচ্ছুদের কাছে বিভিন্ন দামে বিক্রি করত। তদন্তে মামলার এজাহারনামীয় আসামি ছাড়াও আরও কিছু ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে যাদের নাম এই মুহূর্তে প্রকাশ করা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘চক্রটিকে প্রশ্ন ফাঁসের একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট বলা যায়।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁস করেছে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিদপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মেশিনম্যান আব্দুস সালাম। ফাঁস করা প্রশ্নপত্র বিক্রি চক্রটির সমন্বয়কারী জসিম উদ্দিন ভূঁইয়ার খালাতো ভাই আব্দুস সালাম। জসিম উদ্দিন মেডিকেল কোচিং সেন্টার শুভেচ্ছা, ফেইথ, থ্রি ডক্টরস, রেটিনা, প্রাইমেট, এভিস, মেডিকোসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মালিক, পরিচালক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় মেডিকেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী সংগ্রহ ও ফাঁসকৃত প্রশ্ন বিক্রি করত। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো ২ থেকে ৭ লাখ টাকা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যারা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন তাদের কয়েকজনের তথ্যও চার্জশিটে উল্লেখ থাকবে। এদের কেউ এখনো শিক্ষার্থী আবার কেউ পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি। মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের প্রধান জসিম উদ্দিন ভূঁইয়াসহ জাকির হোসেন দিপু ও পারভেজ খানকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে এই চক্রের আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের অন্যতম সদস্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিদপ্তরের মেশিনম্যান সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানম-ি মডেল থানায় ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা করে সিআইডি। এজাহারে ১৪ আসামির নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয়ে ৩০ থেকে ৪০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামি জসিম উদ্দিন ও আব্দুস সালামসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তারা এখনো জেলে রয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
অনুসন্ধানকালে সিআইডি জানতে পেরেছে, চক্রের হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া কোনো পেশায় নিয়োজিত ছিলেন না। তার আপন খালাতো ভাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনম্যান মো. আব্দুস সালামের কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করতেন। জসিম চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে সারা দেশে মেডিকেল, ডেন্টাল ও আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের ভর্তিচ্ছুদের কাছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিক্রি করতেন। প্রশ্নপত্র বিক্রির টাকা জসিমের বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৩টি হিসাবে লেনদেন হয়েছে। ২০০৬ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব হিসাবে ২১ কোটি ২৭ লাখ ৫ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া তার নামে বিপুল অঙ্কের এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র কেনার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। নিজ নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩২টি দলিলের মাধ্যমে ১ হাজার ২২৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ জমি কিনেছেন যার দলিল মূল্য ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। তবে এসব জমির বাজারমূল্য কয়েকগুণ বেশি বলে সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে। রাজধানীর মিরপুরে পাঁচ ও তিন তলা বিশিষ্ট দুটি বাড়ি কিনেছেন জসিম, যার বাজারমূল্য দুই কোটি টাকার বেশি। মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৯ দশমিক ৬ কাঠা জমির প্লট রয়েছে তার। প্রশ্নপত্র বিক্রির অবৈধ টাকায় জসিমের মা জহুরা ভূঁইয়ার নামে ৫টি দলিলে ১৬৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি কেনেন জসিম। যার দলিল মূল্য ১ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। পরবর্তী সময়ে ওই জমি হেবা ঘোষণার মাধ্যমে জসিম নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করে নেন। জসিমের স্ত্রী শারমীন আরা জেসমিন শিল্পীর ১৩টি ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ৮৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া শিল্পীর নামে কোটি টাকার এফডিআর ও সঞ্চয়পত্রও রয়েছে। অবৈধভাবে কামানো টাকা দিয়ে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ৬টি দলিলে ২৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন যার দলিল মূল্য ৫ কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মিরপুর ও সাভারে ১৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় ১ হাজার ৩১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ জমি কিনেছেন জসিমের স্ত্রী।
সিআইডি কর্মকর্তারা আরও জানতে পেরেছেন, জসিমের বড় বোন শাহজাদী আক্তার ওরফে মীরা মূলত আব্দুস সালামের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে জসিমের কাছে পৌঁছে দিতেন। ফলে প্রশ্ন বিক্রির টাকার একটি বড় অংশ ভাগ পেতেন মীরা। তার ৪টি ব্যাংক হিসাব ও এফডিআরের তথ্য পায় সিআইডি। ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় ১ কোটি ৭০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা জমা হয়েছে। ঢাকার মিরপুরে তিনটি প্লট ও ৬ তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি রয়েছে মীরার। চক্রের অন্যতম হোতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনম্যান (চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) মো. আব্দুস সালামের নামে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মানিকগঞ্জ শাখার একটি হিসাবে ২ কোটি ৮৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া ১৪ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ও ৬ লাখ টাকা মূল্যের দুটি দোকান পাওয়া গেছে তার নামে। প্রশ্নপত্র বিক্রির টাকা দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬টি দলিলে ২৫২ দশমিক ৫ শতাংশ জমি কেনেন সালাম। যার দলিল মূল্য ২ কোটি ৬০ লাখ হলেও প্রকৃত মূল্য তিনগুণ বেশি। এছাড়া তার স্ত্রী নাসরিন আক্তারের নামেও জমি কিনেছেন। চক্রের অন্যতম সদস্য চক্ষু চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহম্মেদের ৩৯টি ব্যাংক হিসাবে প্রশ্নপত্র বিক্রির ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা জমা হয়। ময়েজ উদ্দিন আহম্মেদ প্রশ্ন বিক্রিতে জড়িত ফেইথ নামক মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। এছাড়া চক্রের সদস্য রাশেদ খান মেননেন ৬টি ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ৬৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা জমা হয়। এম এইচ পারভেজ খানের ৫টি ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা জমা হয়।
চক্রের আরেক সদস্য ডা. জেড এম এস সালেহীন শোভনের ৫টি ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জমা হয়। জসিমের ছোট বোনের জামাই জাকির হাসান দিপুর ৮টি হিসাবে ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা জমা হয়। তার নামে এফডিআরও রয়েছে। চক্রের সদস্য আলমাস হোসেনের ২টি ব্যাংক হিসাবে ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা জমা হয়। সাজ্জাদের ৬টি ব্যাংক হিসাবে ৩৪ লাখসহ চক্রের অন্যদের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
সিআইডি’র ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. হুমায়ুন কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। অনেকের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। দ্রুতই চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।’