বিএসএমএমইউতে কমিশনের নামে মিলেমিশে লোপাট ১২৬ কোটি টাকা

দুলাল হোসেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা সেবামূল্যের (ইউজার ফি) ১২৬ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে পকেটে পুরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এই অর্থ ফেরত দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও সাড়া মিলছে না। এ বিষয়ে হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় বিএসএমএমইউর কয়েকটি বিভাগে রোগীর কাছ থেকে আদায় করা সেবামূল্য মুনাফার একটি অংশ কমিশন হিসেবে নিতে পারেন চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেবামূল্য খাতের আয় থেকে পরীক্ষা—নিরীক্ষার সব খরচ বাদে যে পরিমাণ মুনাফা হবে, তার ৩০ শতাংশ নিতে পারেন তারা। কিন্তু মুনাফার হিসাব না করে মোট আদায় করা অর্থের ৩০ শতাংশ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ অমান্য করে প্রতিষ্ঠানটির ২০টি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশন থেকে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকার বেশি নিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে আয়কর বাবদ সরকারের পাওনা রয়েছে ২০ কোটি ২৩ হাজার ৮৬১ টাকা।

বিভিন্ন নথিপত্রের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ২০০৭ সালের ২৭ মে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত ছিল, ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য পরীক্ষা এবং বিভিন্ন অপারেশনাল প্রসিডিউর থেকে পাওয়া অর্থ থেকে বিভিন্ন রি—এজেন্ট এবং পরীক্ষা—নিরীক্ষা, সংশ্লিষ্ট প্রচলিত অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা—কর্মচারীর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ শিক্ষক—চিকিৎসকরা পাবেন। আর কর্মকর্তা—কর্মচারীরা ৪০ শতাংশ পাবেন।

এরপর একই বছরের ৪ অক্টোবর কমিশন বণ্টনের বিষয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়। যদিও প্রশাসনিক আদেশে কমিশন গ্রহণের বিষয়টি ২০০৭ সালের ২৭ মে কার্যকর বলে গণ্য করা হয়। তখন থেকেই লভ্যাংশের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ ভাগ করা শুরু হয়।

২০০৭ সালের ২৭ মে থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭টি বিভাগের মধ্যে ২০টির মুনাফার ৩০ শতাংশ হারে চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা কমিশন পাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় ২০০ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত নেওয়া হয় ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকা।

জানা যায়, কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন ড. আহমেদ আবু সালেহসহ কয়েকজন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চ কমিশন প্রদান স্থগিত রাখার আদেশ দেন। একই সঙ্গে যারা প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি টাকা নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফেরত এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই অর্থ ফেরত দিতে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর আদেশ জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস। রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. আব্দুল হান্নান স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের রিট পিটিশন নম্বর—১৫৩৬০/২০১৮ মোতাবেক প্রদত্ত রায়ের প্রেক্ষিতে মাইক্রোবায়োলজি, ভাইরোলজি, মলিকুলার বায়োলজি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রিসহ যেসব বিভাগ ইউজার ফি আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, নার্স ও কর্মচারীর মধ্যে বণ্টন করেন, তাদের জানানো যাচ্ছে— সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিট লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ বণ্টনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা নিট লভ্যাংশের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ নিয়েছেন, তাদের অতিরিক্ত নেওয়া অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বিভাগ ইউজার ফি সংগ্রহ করে, তাদের আর্থিক বছর শেষে লাভক্ষতির হিসাব ও মুনাফা নির্ধারণ এবং ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত নেওয়া অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ ও আদায় না হওয়া পর্যন্ত ইউজার ফি খাতের সংগৃহীত টাকা বিলি—বণ্টন স্থগিত করা হলো।’

তবে এই আদেশ জারির পর দুই বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকেই সাড়া মেলেনি। উল্টো ওই আদেশের পরও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন কয়েকটি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

তথ্য বলছে, কমিশনের নামে নেওয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত আনা, কমিশন প্রদান—সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিশন হিসেবে নেওয়া অর্থের পরিমাণ নির্ধারণে কয়েক দফা কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো—ভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) মো. শহীদুল্লাহ সিকদারকে প্রধান করে প্রথম কমিটি করা হয়। ওই সময় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া। কমিটি বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করে। কিন্তু কোনো টাকা ফেরত আনতে পারেনি।

কমিটির এক সদস্য কালবেলাকে বলেন, কমিশনের নামে এই অর্থ ভাগাভাগিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রভাবশালী শিক্ষক জড়িত। তারা সব সময়ই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। তাদের হস্তক্ষেপের কারণেই টাকা আদায় সম্ভব হয়নি।

জানা যায়, কমিশনের নামে ভাগাভাগি করা অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণ নিরূপণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০২০ সালের ২৬ জুলাই বিএসএমএমইউর পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. আবদুস সোবহানকে সভাপতি ও সহকারী পরিচালক (অডিট) মো. আশরাফুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটি করা হয়।

কমিটিকে আলাদাভাবে প্রতিটি বিভাগের পরীক্ষা—নিরীক্ষাসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে নিট আয়ের ৩০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ পৃথক করে অতিরিক্ত অর্থ কোথায় ব্যয় করা হয়েছে, কারা নিয়েছেন এবং কোন হিসাবে জমা রয়েছে, তা নিরূপণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাদের প্রতিবেদন উপাচার্যের দপ্তরে দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে প্রাপ্য কমিশন থেকে ১২৪ কোটি ৯৬ লাখ ১৫ হাজার ৪১৪ টাকা বেশি হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়।

এরপর ২০২০ সালের ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ—উপাচার্য (উন্নয়ন ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেনকে প্রধান করে ইউজার ফি আদায় করে লাভের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে আয়ের ৩০ শতাংশ গ্রহণকৃত অর্থের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি করা হয়।

জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘যারা প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি টাকা নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিয়ে একটি আপিল হয়েছে। সেই আপিলের শুনানি চূড়ান্ত হয়নি। তবে যারা ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন, তাদের সবার কাছ থেকে কমিশনের নামে নেওয়া অতিরিক্ত টাকা কেটে রাখা হয়েছে। আপিলের রায় যদি তাদের পক্ষে যায়, তাহলে তারা এই টাকা ফেরত পাবেন।’

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনেকে যে পরিমাণ পেনশন পাবেন, তার থেকে বেশি টাকা কমিশন হিসেবে নিয়েছে। আপিলের রায় তাদের পক্ষে না যায়, তাহলে সরকারি যে প্রক্রিয়ায় টাকা আদায় করা হয়, সেভাবে আদায় করা হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএসএমএমইউর ২০টি বিভাগে ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে ৭৫২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৭ টাকা আয় হয়। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪২৯ কোটি ৬০ লাখ ৫৩ হাজার ৫০২ টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২৩ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮১৪ টাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নিট মুনাফার ৩০ শতাংশ কমিশন হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক—কর্মচারীদের পাওনার পরিমাণ ৮৩ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার ৭০১ টাকা। এর থেকে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে পাওনা ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু তারা কমিশন নিয়েছেন ২০০ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা, যা তাদের পাওনা অর্থের চেয়ে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকা বেশি। তারা যে পরিমাণ টাকা নিয়েছেন, সেই টাকার আয়কর আসে ২০ কোটি ২৩ হাজার ৮৬১ টাকা।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ব্যয়ের অনিয়ম—দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারের অডিট প্রতিবেদনে। সিভিল অডিট অধিদপ্তরের ২০২০—২১ অর্থবছরে অডিট প্রতিবেদনে বিএসএমএমইউতে ইউজার ফির ১২৬ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া অডিট প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অনিয়ম—দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদেশে যদি লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ টাকা নেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে, আর সেখানে যদি আয়ের ৩০ শতাংশ নেওয়া হয়, সেটা হলো আদেশ অমান্য করা। তারা এটা করতে পারে না। এটা সিস্টেমেটিকলি করা হয়েছে, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমি মনে করি, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা উচিত।

কোন বিভাগ নিয়েছে কতো টাকা

ভাইরোলজি বিভাগ : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে যে ২০টি বিভাগের অর্থ লোপাটের তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা নিয়েছে ভাইরোলজি বিভাগ। বিভাগটি ইউজার ফি বাবদ আয় হয়েছে ১১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮৪৯ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৭৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে ৩৯ কোটি ৮২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৮ টাকা। লাভ থেকে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে এ বিভাগের চিকিৎসক—কর্মচারীরা কমিশন হিসেবে পাওনা ১০ কোটি ৯০ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩৮ টাকা। কিন্তু তারা কমিশন নিয়েছেন ৩৪ কোটি ৮৩ হাজার ১২৯ টাকা। অর্থাৎ ভাইরোলজি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা—কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশনের থেকে ২৩ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার ৩২০ টাকা বেশি নিয়েছেন।

মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ : বিভাগটিতে ইউজার ফি খাতে আয় হয়েছে ১১৩ কোটি ৪০ লাখ ১৫ হাজার ১৪ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৬০ কোটি ৬৫ লাখ ১৩ হাজার ৭৭ টাকা। লাভ হয়েছে ৫২ কোটি ৭৫ লাখ ১ হাজার ৯৩৭ টাকা। লাভ থেকে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে কমিশন হিসেবে পাওনা ১৪ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ৪৮৭ টাকা। অথচ তারা নিয়েছে ৩৪ কোটি ২ লাখ ৪ হাজার ৫০৫ টাকা। অর্থাৎ মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা—কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশনের থেকে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৭ টাকা বেশি নিয়েছে।

বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ : এ বিভাগে ইউজার ফি বাবদ আয় হয়েছে ১২০ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮২ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৬৩ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার ৭৮০ টাকা। আয় থেকে ব্যয় ও আয়করের টাকা বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কমিশন পাওনা ১৫ কোটি ৪৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৩ টাকা। অথচ তারা নিয়েছেন ৩৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৬ হাজার ৩৮১ টাকা। অর্থাৎ এ বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা—কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশন থেকে ১৮ কোটি ৩৭ লাখ ৩৯৭ টাকা বেশি নিয়েছেন।

অন্যান্য বিভাগের মধ্যে প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি নিয়েছেন ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ১০ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৫ টাকা। এ ছাড়া হেমাটোলজি বিভাগে ৬ কোটি ৯২ লাখ ৮১ হাজার ৫৯২ টাকা; প্যাথলজি বিভাগে ৪ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ৩২৫ টাকা।

অন্যান্য বিভাগ : অতিরিক্ত কমিশন নেওয়া অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে রেডিওলজি বিভাগে ১৩ কোটি ৭৫ লাখ ২৭ হাজার ৩১৫ টাকা; কার্ডিওলজি বিভাগে ১০ কোটি ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৩১২ টাকা; ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে ১০ কোটি ৪২ লাখ ৭ হাজার ১৮ টাকা; কনজারভেটিভ অ্যান্ড এন্ডোটিক্স বিভাগে ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৭ টাকা; ওরাল অ্যান্ড মেক্সিল সার্জারি বিভাগে ৫৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮৮৬ টাকা; অর্থোডন্টিক্স বিভাগে ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৮২ টাকা; প্রস্থোডন্টিক্স বিভাগে ৩৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৯২ টাকা; পেডোডন্টিক্স বিভাগে ২২ লাখ ৫৬ হাজার ৬৮ টাকা; কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে ২ কোটি ২১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭১ টাকা; ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে ১ কোটি ২৩ লাখ ৬ হাজার ১৪০ টাকা; শিশু হেমাটোলজি বিভাগে ১ কোটি ২৬ লাখ ৫২ হাজার ৯৬৮ টাকা; ইউরোলজি বিভাগে ৫১ লাখ ৩৯ হাজার ১৫০ টাকা; শিশু কার্ডিওলজি বিভাগে ৮ লাখ ৫১ হাজার ২৯৫ টাকা এবং ভাসকুলার সার্জারি বিভাগে ৫২ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৫ টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে।

বিএসএমএমইউতে কমিশনের নামে মিলেমিশে লোপাট ১২৬ কোটি টাকা

দুলাল হোসেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা সেবামূল্যের (ইউজার ফি) ১২৬ কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে পকেটে পুরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এই অর্থ ফেরত দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও সাড়া মিলছে না। এ বিষয়ে হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় বিএসএমএমইউর কয়েকটি বিভাগে রোগীর কাছ থেকে আদায় করা সেবামূল্য মুনাফার একটি অংশ কমিশন হিসেবে নিতে পারেন চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেবামূল্য খাতের আয় থেকে পরীক্ষা—নিরীক্ষার সব খরচ বাদে যে পরিমাণ মুনাফা হবে, তার ৩০ শতাংশ নিতে পারেন তারা। কিন্তু মুনাফার হিসাব না করে মোট আদায় করা অর্থের ৩০ শতাংশ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ অমান্য করে প্রতিষ্ঠানটির ২০টি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশন থেকে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকার বেশি নিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে আয়কর বাবদ সরকারের পাওনা রয়েছে ২০ কোটি ২৩ হাজার ৮৬১ টাকা।

বিভিন্ন নথিপত্রের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ২০০৭ সালের ২৭ মে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত ছিল, ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য পরীক্ষা এবং বিভিন্ন অপারেশনাল প্রসিডিউর থেকে পাওয়া অর্থ থেকে বিভিন্ন রি—এজেন্ট এবং পরীক্ষা—নিরীক্ষা, সংশ্লিষ্ট প্রচলিত অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা—কর্মচারীর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ শিক্ষক—চিকিৎসকরা পাবেন। আর কর্মকর্তা—কর্মচারীরা ৪০ শতাংশ পাবেন।

এরপর একই বছরের ৪ অক্টোবর কমিশন বণ্টনের বিষয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়। যদিও প্রশাসনিক আদেশে কমিশন গ্রহণের বিষয়টি ২০০৭ সালের ২৭ মে কার্যকর বলে গণ্য করা হয়। তখন থেকেই লভ্যাংশের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ ভাগ করা শুরু হয়।

২০০৭ সালের ২৭ মে থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭টি বিভাগের মধ্যে ২০টির মুনাফার ৩০ শতাংশ হারে চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা কমিশন পাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় ২০০ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত নেওয়া হয় ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকা।

জানা যায়, কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন ড. আহমেদ আবু সালেহসহ কয়েকজন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চ কমিশন প্রদান স্থগিত রাখার আদেশ দেন। একই সঙ্গে যারা প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি টাকা নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফেরত এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই অর্থ ফেরত দিতে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর আদেশ জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস। রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. আব্দুল হান্নান স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের রিট পিটিশন নম্বর—১৫৩৬০/২০১৮ মোতাবেক প্রদত্ত রায়ের প্রেক্ষিতে মাইক্রোবায়োলজি, ভাইরোলজি, মলিকুলার বায়োলজি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রিসহ যেসব বিভাগ ইউজার ফি আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, নার্স ও কর্মচারীর মধ্যে বণ্টন করেন, তাদের জানানো যাচ্ছে— সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিট লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ বণ্টনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা নিট লভ্যাংশের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ নিয়েছেন, তাদের অতিরিক্ত নেওয়া অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বিভাগ ইউজার ফি সংগ্রহ করে, তাদের আর্থিক বছর শেষে লাভক্ষতির হিসাব ও মুনাফা নির্ধারণ এবং ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত নেওয়া অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ ও আদায় না হওয়া পর্যন্ত ইউজার ফি খাতের সংগৃহীত টাকা বিলি—বণ্টন স্থগিত করা হলো।’

তবে এই আদেশ জারির পর দুই বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকেই সাড়া মেলেনি। উল্টো ওই আদেশের পরও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন কয়েকটি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

তথ্য বলছে, কমিশনের নামে নেওয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত আনা, কমিশন প্রদান—সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিশন হিসেবে নেওয়া অর্থের পরিমাণ নির্ধারণে কয়েক দফা কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো—ভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) মো. শহীদুল্লাহ সিকদারকে প্রধান করে প্রথম কমিটি করা হয়। ওই সময় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া। কমিটি বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করে। কিন্তু কোনো টাকা ফেরত আনতে পারেনি।

কমিটির এক সদস্য কালবেলাকে বলেন, কমিশনের নামে এই অর্থ ভাগাভাগিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রভাবশালী শিক্ষক জড়িত। তারা সব সময়ই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। তাদের হস্তক্ষেপের কারণেই টাকা আদায় সম্ভব হয়নি।

জানা যায়, কমিশনের নামে ভাগাভাগি করা অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণ নিরূপণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০২০ সালের ২৬ জুলাই বিএসএমএমইউর পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. আবদুস সোবহানকে সভাপতি ও সহকারী পরিচালক (অডিট) মো. আশরাফুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটি করা হয়।

কমিটিকে আলাদাভাবে প্রতিটি বিভাগের পরীক্ষা—নিরীক্ষাসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে নিট আয়ের ৩০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ পৃথক করে অতিরিক্ত অর্থ কোথায় ব্যয় করা হয়েছে, কারা নিয়েছেন এবং কোন হিসাবে জমা রয়েছে, তা নিরূপণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাদের প্রতিবেদন উপাচার্যের দপ্তরে দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে প্রাপ্য কমিশন থেকে ১২৪ কোটি ৯৬ লাখ ১৫ হাজার ৪১৪ টাকা বেশি হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়।

এরপর ২০২০ সালের ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ—উপাচার্য (উন্নয়ন ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেনকে প্রধান করে ইউজার ফি আদায় করে লাভের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে আয়ের ৩০ শতাংশ গ্রহণকৃত অর্থের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি করা হয়।

জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘যারা প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি টাকা নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিয়ে একটি আপিল হয়েছে। সেই আপিলের শুনানি চূড়ান্ত হয়নি। তবে যারা ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন, তাদের সবার কাছ থেকে কমিশনের নামে নেওয়া অতিরিক্ত টাকা কেটে রাখা হয়েছে। আপিলের রায় যদি তাদের পক্ষে যায়, তাহলে তারা এই টাকা ফেরত পাবেন।’

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনেকে যে পরিমাণ পেনশন পাবেন, তার থেকে বেশি টাকা কমিশন হিসেবে নিয়েছে। আপিলের রায় তাদের পক্ষে না যায়, তাহলে সরকারি যে প্রক্রিয়ায় টাকা আদায় করা হয়, সেভাবে আদায় করা হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএসএমএমইউর ২০টি বিভাগে ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে ৭৫২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৭ টাকা আয় হয়। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪২৯ কোটি ৬০ লাখ ৫৩ হাজার ৫০২ টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২৩ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮১৪ টাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নিট মুনাফার ৩০ শতাংশ কমিশন হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক—কর্মচারীদের পাওনার পরিমাণ ৮৩ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার ৭০১ টাকা। এর থেকে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে পাওনা ৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু তারা কমিশন নিয়েছেন ২০০ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬১২ টাকা, যা তাদের পাওনা অর্থের চেয়ে ১২৬ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টাকা বেশি। তারা যে পরিমাণ টাকা নিয়েছেন, সেই টাকার আয়কর আসে ২০ কোটি ২৩ হাজার ৮৬১ টাকা।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ব্যয়ের অনিয়ম—দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারের অডিট প্রতিবেদনে। সিভিল অডিট অধিদপ্তরের ২০২০—২১ অর্থবছরে অডিট প্রতিবেদনে বিএসএমএমইউতে ইউজার ফির ১২৬ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া অডিট প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অনিয়ম—দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদেশে যদি লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ টাকা নেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে, আর সেখানে যদি আয়ের ৩০ শতাংশ নেওয়া হয়, সেটা হলো আদেশ অমান্য করা। তারা এটা করতে পারে না। এটা সিস্টেমেটিকলি করা হয়েছে, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমি মনে করি, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা উচিত।

কোন বিভাগ নিয়েছে কতো টাকা

ভাইরোলজি বিভাগ : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে যে ২০টি বিভাগের অর্থ লোপাটের তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা নিয়েছে ভাইরোলজি বিভাগ। বিভাগটি ইউজার ফি বাবদ আয় হয়েছে ১১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮৪৯ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৭৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ টাকা। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে ৩৯ কোটি ৮২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৮ টাকা। লাভ থেকে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে এ বিভাগের চিকিৎসক—কর্মচারীরা কমিশন হিসেবে পাওনা ১০ কোটি ৯০ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩৮ টাকা। কিন্তু তারা কমিশন নিয়েছেন ৩৪ কোটি ৮৩ হাজার ১২৯ টাকা। অর্থাৎ ভাইরোলজি বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা—কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশনের থেকে ২৩ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার ৩২০ টাকা বেশি নিয়েছেন।

মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ : বিভাগটিতে ইউজার ফি খাতে আয় হয়েছে ১১৩ কোটি ৪০ লাখ ১৫ হাজার ১৪ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৬০ কোটি ৬৫ লাখ ১৩ হাজার ৭৭ টাকা। লাভ হয়েছে ৫২ কোটি ৭৫ লাখ ১ হাজার ৯৩৭ টাকা। লাভ থেকে ১০ শতাংশ আয়কর বাদ দিয়ে কমিশন হিসেবে পাওনা ১৪ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ৪৮৭ টাকা। অথচ তারা নিয়েছে ৩৪ কোটি ২ লাখ ৪ হাজার ৫০৫ টাকা। অর্থাৎ মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা—কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশনের থেকে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৭ টাকা বেশি নিয়েছে।

বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ : এ বিভাগে ইউজার ফি বাবদ আয় হয়েছে ১২০ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮২ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৬৩ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার ৭৮০ টাকা। আয় থেকে ব্যয় ও আয়করের টাকা বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কমিশন পাওনা ১৫ কোটি ৪৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৩ টাকা। অথচ তারা নিয়েছেন ৩৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৬ হাজার ৩৮১ টাকা। অর্থাৎ এ বিভাগের চিকিৎসক, কর্মকর্তা—কর্মচারীরা প্রাপ্য কমিশন থেকে ১৮ কোটি ৩৭ লাখ ৩৯৭ টাকা বেশি নিয়েছেন।

অন্যান্য বিভাগের মধ্যে প্রাপ্য কমিশন থেকে বেশি নিয়েছেন ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ১০ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৫ টাকা। এ ছাড়া হেমাটোলজি বিভাগে ৬ কোটি ৯২ লাখ ৮১ হাজার ৫৯২ টাকা; প্যাথলজি বিভাগে ৪ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ৩২৫ টাকা।

অন্যান্য বিভাগ : অতিরিক্ত কমিশন নেওয়া অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে রেডিওলজি বিভাগে ১৩ কোটি ৭৫ লাখ ২৭ হাজার ৩১৫ টাকা; কার্ডিওলজি বিভাগে ১০ কোটি ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৩১২ টাকা; ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে ১০ কোটি ৪২ লাখ ৭ হাজার ১৮ টাকা; কনজারভেটিভ অ্যান্ড এন্ডোটিক্স বিভাগে ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৭ টাকা; ওরাল অ্যান্ড মেক্সিল সার্জারি বিভাগে ৫৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮৮৬ টাকা; অর্থোডন্টিক্স বিভাগে ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৮২ টাকা; প্রস্থোডন্টিক্স বিভাগে ৩৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৯২ টাকা; পেডোডন্টিক্স বিভাগে ২২ লাখ ৫৬ হাজার ৬৮ টাকা; কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে ২ কোটি ২১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭১ টাকা; ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে ১ কোটি ২৩ লাখ ৬ হাজার ১৪০ টাকা; শিশু হেমাটোলজি বিভাগে ১ কোটি ২৬ লাখ ৫২ হাজার ৯৬৮ টাকা; ইউরোলজি বিভাগে ৫১ লাখ ৩৯ হাজার ১৫০ টাকা; শিশু কার্ডিওলজি বিভাগে ৮ লাখ ৫১ হাজার ২৯৫ টাকা এবং ভাসকুলার সার্জারি বিভাগে ৫২ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৫ টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে।