বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক ও উচ্চতর যোগ্যতা

ড. পরিতোষ চন্দ্র রায়

প্রতীকী ছবি

এক সময় ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসাবে শেরেবাংলা কৃষি কলেজ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ এবং পটুয়াখালী কৃষি কলেজে অনার্স কোর্স চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এ সুদূরপ্রাসারী সিদ্ধান্তের ফসল আজ সবাই ভোগ করছে। কয়েক বছর আগে জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব নামে একটি কলেজও অধিভুক্তি দিয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এটিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজকে অধিভুক্তি দিয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অনুষদের মোট ছয়টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসরণ করেই সেখানে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। শিক্ষক নিয়োগেও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মনোনীত প্রতিনিধি, বিষয় বিশেষজ্ঞ, বহিস্থ পরীক্ষক ও অন্য সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষা নিয়ে যাচাই-বাছাই করে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়।

দেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এভাবে প্রযুক্তি শিক্ষার আলো ছড়াতে পারলে সেটা ইতিবাচকভাবেই দেখা যায়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশের দরিদ্র এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিতে পারে, তাহলে সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো উচিত। হাবিপ্রবির অধিভুক্ত দেশের একমাত্র এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়টিকে ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারি করার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৯ সালে এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কতটা আন্তরিক, এ সিদ্ধান্ত তারই সাক্ষ্য বহন করে। তবে দেশের উন্নয়নবিরোধী কোনো মহলের ষড়যন্ত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সজাগ থাকা দরকার। প্রায় অর্ধযুগ ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অবদান রাখা এ প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে নানান রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ মহাবিদ্যালয়ের যে অংশটির জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে, সেই অনার্স কোর্সের বিরুদ্ধেই নানান রকম অজুহাত দাঁড় করানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সমন্বয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠন করে লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষা নিয়ে মেধা যাচাই করে প্রার্থী নির্বাচন করা হলেও অর্ধযুগ পরে শিক্ষকদের এখন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করা হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগের সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রকাশনা এবং লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী বাছাই করে। নিয়োগের সময় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ বলতে কোনো কিছুর বাধ্যবাধকতা ছিল না। পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও নিবন্ধন সনদ চাওয়া হয়নি। এ দায় তো কোনো শিক্ষকের ওপর চাপানো যায় না।

শিক্ষক নিবন্ধন আসলে কাদের জন্য? কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন পদের জন্য নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয় বা পরীক্ষার আয়োজন করা হয়, সেটা আগে জানা দরকার। বিভিন্ন স্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন নিম্নমাধ্যমিক (অষ্টম শ্রেণি), মাধ্যমিক (দশম শ্রেণি), উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) এবং স্নাতক (পাস) স্তরের এমপিওভুক্ত পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য এনটিআরসি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেয়। যিনি যে বিষয়ের শিক্ষক হতে চান এবং যোগ্য, তিনি সেই বিষয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলে নিবন্ধন সনদ পান। এখন প্রশ্ন হলো, স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য এনটিআরসি কি কোনো নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি কখনো দিয়েছে? যদি না দিয়ে থাকে, তাহলে স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষক হওয়ার জন্য আগ্রহী একজন প্রার্থী এ নিবন্ধন সনদ কোথায় পাবেন? কেউ হয়তো বলবেন, উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতক (পাশ) কোর্সের জন্য নিবন্ধন সনদ থাকলেই চলবে। তাকে প্রশ্ন করব, তাহলে কেউ যদি মাধ্যমিক (স্কুল) স্তরের জীববিজ্ঞান বিষয়ের জন্য নিবন্ধন সনদ অর্জন করেন, তাকে কি উচ্চমাধ্যমিক (কলেজ) স্তরের প্রাণিবিজ্ঞান বা উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে? প্রাণিবিজ্ঞান বা উদ্ভিদবিজ্ঞান তো জীববিজ্ঞানেরই অংশ! যদি না যায়, তাহলে যিনি স্নাতক (সম্মান) স্তরের প্রভাষক হতে আগ্রহী বা শিক্ষকতা করছেন, তার কাছে কীভাবে স্নাতক (পাশ) বা উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) স্তরের নিবন্ধন সনদ নিয়ে খুশি হতে পারি?

ধরা যাক, একজন প্রার্থী স্নাতক (সম্মান) স্তরের কৃষি অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক হতে চান। তাহলে তিনি বায়োটেকনোলজিতে শিক্ষকতা করার নিবন্ধন সনদ কোথায় পাবেন? কোনো যাচাইকারী ব্যক্তি হয়তো তার কাছে কৃষি বিষয়ের নিবন্ধন সনদ চাইবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের কৃষি শিক্ষা আর স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ের বায়োটেকনোলজির সিলেবাস এক নয়। আবার মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের কৃষি শিক্ষা আর স্নাতক (সম্মান) স্তরের কৃষিও এক নয়। আকাশ জমিন তফাৎ। কৃষি শিক্ষা হলো একটি মাত্র বিষয়। কিন্তু স্নাতক (সম্মান) স্তরের কৃষি অনেক বিষয় নিয়ে একটি অনুষদ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে যে কৃষি শিক্ষা বিষয় আছে, সেখানে পড়ানো হয় হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রভৃতির লালন-পালন, মোটাতাজাকরণ জাতীয় বিষয় নিয়ে। আর স্নাতক (সম্মান) কোর্সের বায়োটেকনোলজিতে পড়ানো হয় ক্লোনিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিন এডিটিং প্রভৃতি বিষয়ে। একজনের কৃষি বিষয়ে নিবন্ধন সনদ আছে; আর অন্য একজনের বায়োটেকনোলজিতে পিএইচডি বা পোস্ট ডক আছে। কাকে আপনি বায়োটেকনোলজির যোগ্য শিক্ষক ভাববেন? কোনো বিষয়ের সিলেবাস সম্পর্কে যদি কারও পরিপূর্ণ ধারণা না থাকে, তাহলে তার পক্ষে বলা সম্ভব হবে না যে, কোন বিষয়ের জন্য কোন ব্যক্তিটি যোগ্য।

স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী একজন শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত; উপরন্তু সেই বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রকাশনা থাকা দরকার। সারা দেশে নতুন এবং পুরোনো সরকারি কলেজগুলোতে যে শিক্ষকরা স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পাঠদান করছেন, তাদের স্কলারশিপ এবং শিক্ষাছুটি দিয়ে পিএইচডি এবং পোস্ট ডক করার সুযোগ দেওয়া উচিত। তা না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে না। কিন্তু সেই চিন্তা না করে, যথার্থ পদক্ষেপ না নিয়ে, আমরা স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষকদের কাছে নিবন্ধন সনদ খুঁজছি। নিবন্ধন সনদকে আমি অবহেলার চোখে দেখতে চাই না। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য এ নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করার পেছনে অনেক যুক্তি দেখানো যাবে। কিন্তু স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির জন্য এ সনদ মোটেই কার্যকর কোনো সমাধান নয়। স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির পাঠদান করতে হলে শিক্ষার্থীর চেয়ে ওই শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কয়েক স্তর বেশি থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের জ্ঞানের পার্থক্য যত বেশি হবে, জ্ঞানের প্রবাহ তত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য যদি উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের প্রয়োজন না হয়, তাহলে পঞ্চম শ্রেণি বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ কোনো শিক্ষার্থীকেই তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যায়! দশম বা একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তো মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যায়! যদি না যায়, তাহলে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে কীভাবে নিবন্ধন সনদকে বাধ্যতামূলক করা যায়? সদ্য সরকারি করা কলেজগুলোতে আত্মীকরণের সময় দেখা যাচ্ছে, কোনো বিষয়ে তিন-চার মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনো শিক্ষক ওই বিষয়ের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন; আবার নিজ বিষয়ে তিন-চার বছর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেও কেউ অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন। শিক্ষকের যোগ্যতা মাপার এ বিস্ময়কর ঘটনাগুলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস হয়ে থাকবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পিএইচডি গবেষকদের অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন। পিএইচডি গবেষকদের উৎসাহিত করার জন্য এবং গবেষণায় আকৃষ্ট করার জন্য আগে যে পরিমাণ বৃত্তি দেওয়া হতো, সেটা তিনি স্বেচ্ছায় বাড়িয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কয়েক বছর আগে একটি প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে তাকে একসঙ্গে তিনটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে। পৃথিবীর অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়াই যায় না। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের গবেষণা, প্রকাশনা এবং পিএইচডি পোস্ট ডক অভিজ্ঞতাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়। জ্ঞান পরিমাপের আসলে নির্ভরযোগ্য কোনো মাপকাঠি নেই। শিক্ষকতা করার যোগ্যতা মাপা আসলেই কঠিন বিষয়। একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে অনেক গুণাবলি থাকা প্রয়োজন। তবুও প্রযুক্তিগত শিক্ষা দিতে গেলে একজন শিক্ষকের অন্তত উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন। উচ্চশিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করে প্রধানমন্ত্রীর এ স্বপ্ন এবং সদিচ্ছা পূরণে বাধা সৃষ্টি করা মোটেই কাম্য নয়। দেশের উন্নয়নবিরোধী কোনো মহলের চক্রান্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা যেন ব্যাহত না হয়, কোনো শিক্ষককে যেন আইনি জটিলতায় ফেলা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার পথ মসৃণ করতে প্রযুক্তিবান্ধব এ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে; অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকদের অবশ্যই মূল্যায়ন করবে-এ প্রত্যাশাই করি।

ড. পরিতোষ চন্দ্র রায় : গবেষক ও শিক্ষক

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক ও উচ্চতর যোগ্যতা

ড. পরিতোষ চন্দ্র রায়

প্রতীকী ছবি

এক সময় ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসাবে শেরেবাংলা কৃষি কলেজ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ এবং পটুয়াখালী কৃষি কলেজে অনার্স কোর্স চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এ সুদূরপ্রাসারী সিদ্ধান্তের ফসল আজ সবাই ভোগ করছে। কয়েক বছর আগে জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব নামে একটি কলেজও অধিভুক্তি দিয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এটিও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজকে অধিভুক্তি দিয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অনুষদের মোট ছয়টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসরণ করেই সেখানে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। শিক্ষক নিয়োগেও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মনোনীত প্রতিনিধি, বিষয় বিশেষজ্ঞ, বহিস্থ পরীক্ষক ও অন্য সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষা নিয়ে যাচাই-বাছাই করে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়।

দেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এভাবে প্রযুক্তি শিক্ষার আলো ছড়াতে পারলে সেটা ইতিবাচকভাবেই দেখা যায়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশের দরিদ্র এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিতে পারে, তাহলে সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো উচিত। হাবিপ্রবির অধিভুক্ত দেশের একমাত্র এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়টিকে ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারি করার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৯ সালে এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কতটা আন্তরিক, এ সিদ্ধান্ত তারই সাক্ষ্য বহন করে। তবে দেশের উন্নয়নবিরোধী কোনো মহলের ষড়যন্ত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সজাগ থাকা দরকার। প্রায় অর্ধযুগ ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অবদান রাখা এ প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে নানান রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ মহাবিদ্যালয়ের যে অংশটির জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে, সেই অনার্স কোর্সের বিরুদ্ধেই নানান রকম অজুহাত দাঁড় করানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সমন্বয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠন করে লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষা নিয়ে মেধা যাচাই করে প্রার্থী নির্বাচন করা হলেও অর্ধযুগ পরে শিক্ষকদের এখন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করা হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগের সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রকাশনা এবং লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী বাছাই করে। নিয়োগের সময় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ বলতে কোনো কিছুর বাধ্যবাধকতা ছিল না। পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও নিবন্ধন সনদ চাওয়া হয়নি। এ দায় তো কোনো শিক্ষকের ওপর চাপানো যায় না।

শিক্ষক নিবন্ধন আসলে কাদের জন্য? কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন পদের জন্য নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয় বা পরীক্ষার আয়োজন করা হয়, সেটা আগে জানা দরকার। বিভিন্ন স্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন নিম্নমাধ্যমিক (অষ্টম শ্রেণি), মাধ্যমিক (দশম শ্রেণি), উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) এবং স্নাতক (পাস) স্তরের এমপিওভুক্ত পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য এনটিআরসি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেয়। যিনি যে বিষয়ের শিক্ষক হতে চান এবং যোগ্য, তিনি সেই বিষয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলে নিবন্ধন সনদ পান। এখন প্রশ্ন হলো, স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য এনটিআরসি কি কোনো নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি কখনো দিয়েছে? যদি না দিয়ে থাকে, তাহলে স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষক হওয়ার জন্য আগ্রহী একজন প্রার্থী এ নিবন্ধন সনদ কোথায় পাবেন? কেউ হয়তো বলবেন, উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতক (পাশ) কোর্সের জন্য নিবন্ধন সনদ থাকলেই চলবে। তাকে প্রশ্ন করব, তাহলে কেউ যদি মাধ্যমিক (স্কুল) স্তরের জীববিজ্ঞান বিষয়ের জন্য নিবন্ধন সনদ অর্জন করেন, তাকে কি উচ্চমাধ্যমিক (কলেজ) স্তরের প্রাণিবিজ্ঞান বা উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে? প্রাণিবিজ্ঞান বা উদ্ভিদবিজ্ঞান তো জীববিজ্ঞানেরই অংশ! যদি না যায়, তাহলে যিনি স্নাতক (সম্মান) স্তরের প্রভাষক হতে আগ্রহী বা শিক্ষকতা করছেন, তার কাছে কীভাবে স্নাতক (পাশ) বা উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) স্তরের নিবন্ধন সনদ নিয়ে খুশি হতে পারি?

ধরা যাক, একজন প্রার্থী স্নাতক (সম্মান) স্তরের কৃষি অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক হতে চান। তাহলে তিনি বায়োটেকনোলজিতে শিক্ষকতা করার নিবন্ধন সনদ কোথায় পাবেন? কোনো যাচাইকারী ব্যক্তি হয়তো তার কাছে কৃষি বিষয়ের নিবন্ধন সনদ চাইবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের কৃষি শিক্ষা আর স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ের বায়োটেকনোলজির সিলেবাস এক নয়। আবার মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের কৃষি শিক্ষা আর স্নাতক (সম্মান) স্তরের কৃষিও এক নয়। আকাশ জমিন তফাৎ। কৃষি শিক্ষা হলো একটি মাত্র বিষয়। কিন্তু স্নাতক (সম্মান) স্তরের কৃষি অনেক বিষয় নিয়ে একটি অনুষদ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে যে কৃষি শিক্ষা বিষয় আছে, সেখানে পড়ানো হয় হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রভৃতির লালন-পালন, মোটাতাজাকরণ জাতীয় বিষয় নিয়ে। আর স্নাতক (সম্মান) কোর্সের বায়োটেকনোলজিতে পড়ানো হয় ক্লোনিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিন এডিটিং প্রভৃতি বিষয়ে। একজনের কৃষি বিষয়ে নিবন্ধন সনদ আছে; আর অন্য একজনের বায়োটেকনোলজিতে পিএইচডি বা পোস্ট ডক আছে। কাকে আপনি বায়োটেকনোলজির যোগ্য শিক্ষক ভাববেন? কোনো বিষয়ের সিলেবাস সম্পর্কে যদি কারও পরিপূর্ণ ধারণা না থাকে, তাহলে তার পক্ষে বলা সম্ভব হবে না যে, কোন বিষয়ের জন্য কোন ব্যক্তিটি যোগ্য।

স্নাতক (সম্মান) স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী একজন শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত; উপরন্তু সেই বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রকাশনা থাকা দরকার। সারা দেশে নতুন এবং পুরোনো সরকারি কলেজগুলোতে যে শিক্ষকরা স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পাঠদান করছেন, তাদের স্কলারশিপ এবং শিক্ষাছুটি দিয়ে পিএইচডি এবং পোস্ট ডক করার সুযোগ দেওয়া উচিত। তা না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে না। কিন্তু সেই চিন্তা না করে, যথার্থ পদক্ষেপ না নিয়ে, আমরা স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষকদের কাছে নিবন্ধন সনদ খুঁজছি। নিবন্ধন সনদকে আমি অবহেলার চোখে দেখতে চাই না। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য এ নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করার পেছনে অনেক যুক্তি দেখানো যাবে। কিন্তু স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির জন্য এ সনদ মোটেই কার্যকর কোনো সমাধান নয়। স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির পাঠদান করতে হলে শিক্ষার্থীর চেয়ে ওই শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কয়েক স্তর বেশি থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের জ্ঞানের পার্থক্য যত বেশি হবে, জ্ঞানের প্রবাহ তত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য যদি উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের প্রয়োজন না হয়, তাহলে পঞ্চম শ্রেণি বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ কোনো শিক্ষার্থীকেই তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যায়! দশম বা একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তো মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যায়! যদি না যায়, তাহলে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে কীভাবে নিবন্ধন সনদকে বাধ্যতামূলক করা যায়? সদ্য সরকারি করা কলেজগুলোতে আত্মীকরণের সময় দেখা যাচ্ছে, কোনো বিষয়ে তিন-চার মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনো শিক্ষক ওই বিষয়ের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন; আবার নিজ বিষয়ে তিন-চার বছর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেও কেউ অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন। শিক্ষকের যোগ্যতা মাপার এ বিস্ময়কর ঘটনাগুলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস হয়ে থাকবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পিএইচডি গবেষকদের অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন। পিএইচডি গবেষকদের উৎসাহিত করার জন্য এবং গবেষণায় আকৃষ্ট করার জন্য আগে যে পরিমাণ বৃত্তি দেওয়া হতো, সেটা তিনি স্বেচ্ছায় বাড়িয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কয়েক বছর আগে একটি প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে তাকে একসঙ্গে তিনটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে। পৃথিবীর অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়াই যায় না। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের গবেষণা, প্রকাশনা এবং পিএইচডি পোস্ট ডক অভিজ্ঞতাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়। জ্ঞান পরিমাপের আসলে নির্ভরযোগ্য কোনো মাপকাঠি নেই। শিক্ষকতা করার যোগ্যতা মাপা আসলেই কঠিন বিষয়। একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে অনেক গুণাবলি থাকা প্রয়োজন। তবুও প্রযুক্তিগত শিক্ষা দিতে গেলে একজন শিক্ষকের অন্তত উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন। উচ্চশিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করে প্রধানমন্ত্রীর এ স্বপ্ন এবং সদিচ্ছা পূরণে বাধা সৃষ্টি করা মোটেই কাম্য নয়। দেশের উন্নয়নবিরোধী কোনো মহলের চক্রান্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা যেন ব্যাহত না হয়, কোনো শিক্ষককে যেন আইনি জটিলতায় ফেলা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার পথ মসৃণ করতে প্রযুক্তিবান্ধব এ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে; অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকদের অবশ্যই মূল্যায়ন করবে-এ প্রত্যাশাই করি।

ড. পরিতোষ চন্দ্র রায় : গবেষক ও শিক্ষক