বিমানের এমডির কক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস
নুরুজ্জামান লাবু ও আহমেদ দীপ্ত

বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল খোদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. যাহিদ হোসেনের কক্ষ থেকে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক প্রশাসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়োগ পরীক্ষার আগে ওই কক্ষেই প্রশ্নগুলো ফটোকপি করা হয়। ফটোকপির দায়িত্বে ছিলেন এমডির দপ্তরের কর্মী জাহিদ হাসান। ফটোকপির ফাঁকে তিনি মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্রের একটি ছবি তুলে নেন। পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তবে বিমানের এমডি মো. যাহিদ হোসেন দৈনিক বাংলার কাছে দাবি করেছেন, তার কক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা ঠিক না।
মামলার তদন্ত ও আদালত সূত্র বলছে, বিমানের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের মধ্যে ৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে তারা ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার নাম বলেছেন।
তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে এ নিয়ে কেউ সরাসরি মন্তব্য করেননি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে ব্রিফিং করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। পরে তা বিশ্লেষণ করে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মামলার এজাহারেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, সেই প্রশ্নগুলো বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) তাইজ ইবনে আনোয়ারের ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে ও এমএলএসএস জাকিরের কাছে পাঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জাফি ও মাহাবুব আলী নামে দুই ব্যক্তির হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরেও ওই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। মাহাবুব আলী এমডির গাড়িচালক হিসেবে কাজ করেন। বক্তব্য জানতে এমএলএসএস জাকির ও গাড়িচালক মাহাবুবের মোবাইল নম্বরে ফোন করলে দুজনের নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই তারা পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত দুই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) তাইজ ইবনে আনোয়ার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমার মোবাইলে এমন কোনো প্রশ্ন আসেনি। প্রশ্নপত্র ফটোকপি করার সময় আমি ওই কক্ষে ছিলামও না।’
প্রশ্নপত্র প্রস্তুতে ছিল না পর্যাপ্ত নিরাপত্তা
বিমানের একটি সূত্র বলছে, বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি, ফটোকপি ও বিতরণের কোনো অংশেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিমানের এমডি নিজ কক্ষে নিয়মিত বসলেও প্রশাসন বিভাগের পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কারণে প্রশাসন পরিচালকের কক্ষেও তিনি মাঝে মাঝে বসতেন। ওই কক্ষেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফটোকপি করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেখানেও নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি ছিল।
বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের যে কমিটি করা হয় তার প্রধান ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. যাহিদ হোসেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ, বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ট্রেনিং সেন্টারের (বিএটিসি) অধ্যক্ষ এ বি এম নাজমুল হুদা, মহাব্যবস্থাপক (জিএসই) তাইজ ইবনে আনোয়ার, মহাব্যবস্থাপক আইটি (ভারপ্রাপ্ত) মো. আনোয়ারুল হক।
জানা গেছে, প্রশ্নপত্র তৈরির পর পরীক্ষায় ব্যবহারের জন্য ফটোকপি করার সময় কমিটির দুই সদস্য সেখানে ছিলেন না। তাদের পরিবর্তে অন্য দুজন কর্মকর্তাকে সেই কক্ষে প্রবেশ এবং অবস্থানের অনুমতি দেয়া হয়। এ ছাড়া কমিটির সদস্যসহ কর্মচারীদের কাউকেই দেহ তল্লাশি বা মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে সেখানে আছেন কি না তাও যাচাই করা হয়নি।
নিয়োগ কমিটির অন্যতম সদস্য মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে মুঠোফোন সঙ্গে নিয়ে আসা নিষেধ ছিল। এ কারণে নতুন করে চেক করা হয়নি। ফটোকপির সময় আমরা উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু এর ফাঁকেই ফটোকপির দায়িত্বে থাকা জাহিদ হয়তো ছবি তুলতে পারে।’
কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতেই কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হলো জানতে চাইলে মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ বলেন, ‘আমরাও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে।’
কমিটির আরেক সদস্য এ বি এম নাজমুল হুদা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সদস্য মো. আনোয়ারুল হক দাবি করেন, তিনি কমিটির সদস্যই ছিলেন না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. যাহিদ হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমি পরিচালক প্রশাসনের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করলেও কক্ষটিতে নিয়মিত বসি না। মাঝেমধ্যে দাপ্তরিক কাজে যেতে হয়। ফলে সরাসরি আমার কক্ষ থেকেই প্রশ্নটি ফাঁস হয়েছে তা ঠিক না।’
প্রশ্নপত্র প্রণয়নে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাব প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার বিমানের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘সেখানে মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) উপস্থিত ছিলেন। নিরাপত্তার বিষয়টি তার দেখার কথা।’ প্রশ্নপত্র ফটোকপি করার সময় মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) উপস্থিত ছিলেন না জানালে এমডি বলেন, ‘তার তো থাকার কথা। এ বিষয়ে আমরাও একটি ইনকোয়ারি করছি। ইনকোয়ারির পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’
তবে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্ন ফাঁসে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের পাশাপাশি তদারকির দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের দায়ও পর্যালোচনা করা হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ দায় এড়াতে পারবেন না।
তদন্তে অসহযোগিতা বিমানের
এদিকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা তদন্তে অসহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে খোদ বিমানের বিরুদ্ধে। তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা একাধিকবার তদন্তের বিষয়ে কথা বলার জন্য বিমানের এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। উল্টো তিনি পুলিশি তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে নানা জায়গায় তদবির করেছেন।
গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তাকে পুরো প্রক্রিয়াটি জানানো এবং জানার জন্য গোয়েন্দা কার্যালয়ে আসার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই গোয়েন্দা কার্যালয়ে আসতে রাজি হননি।’
তবে বিমানের এমডি অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আগেও একবার তারা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। তার পরও ‘সুনাম ক্ষুণ্ন হবে’ মনে করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বর্তমানে অনেকেই বিমানের বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন।
গত ২১ অক্টোবর বেলা ৩টায় বিমানের ১০ পদের বিপরীতে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে প্রথমে দক্ষিণখান এলাকা থেকে বিমানের অফিস সহায়ক হারুনুর রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এমটি অপারেটর মোহাম্মদ মাহফুজুল আলম ও এনামুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন পৃথক অভিযানে দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকা থেকে এমটি অপারেটর জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বিমানের প্রধান কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অফিস সহায়ক আওলাদ হোসেনকে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনকে ৫৪ ধারায় আদালতে সোপর্দ করে ছয় দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে দুই দিন পর প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা জাহিদ হাসান ও সামজু ওরফে সোবহানকে গ্রেপ্তার করেন গোয়েন্দারা। ২৪ অক্টোবর ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মাসুদকে। তাদেরও প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তী সময়ে জাভেদসহ আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
বিমান ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, জাহিদ ও আওলাদ এমডির দপ্তরের অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। সোবহান ও জাভেদ পরিচালক প্রশাসনের দপ্তরের অফিস সহায়ক। বাকিরা এমটি অপারেটর (গাড়িচালক) হিসেবে কাজ করতেন। গ্রেপ্তার মাসুদ বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) তাইজ ইবনে আনোয়ারের গাড়ি চালান। জাহাঙ্গীর আলম আগে তাইজ ইবনে আনোয়ারের গাড়ি চালাতেন।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বিমানের এমডির বর্তমান গাড়িচালক মাহবুব আলী এই চক্রের অন্যতম একজন হোতা। ঘটনার পর থেকেই তিনি আত্মগোপনে আছেন। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।

বিমানের এমডির কক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস
নুরুজ্জামান লাবু ও আহমেদ দীপ্ত

বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল খোদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. যাহিদ হোসেনের কক্ষ থেকে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক প্রশাসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়োগ পরীক্ষার আগে ওই কক্ষেই প্রশ্নগুলো ফটোকপি করা হয়। ফটোকপির দায়িত্বে ছিলেন এমডির দপ্তরের কর্মী জাহিদ হাসান। ফটোকপির ফাঁকে তিনি মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্রের একটি ছবি তুলে নেন। পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তবে বিমানের এমডি মো. যাহিদ হোসেন দৈনিক বাংলার কাছে দাবি করেছেন, তার কক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা ঠিক না।
মামলার তদন্ত ও আদালত সূত্র বলছে, বিমানের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের মধ্যে ৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে তারা ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার নাম বলেছেন।
তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে এ নিয়ে কেউ সরাসরি মন্তব্য করেননি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে ব্রিফিং করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। পরে তা বিশ্লেষণ করে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠানোর প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মামলার এজাহারেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, সেই প্রশ্নগুলো বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) তাইজ ইবনে আনোয়ারের ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে ও এমএলএসএস জাকিরের কাছে পাঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জাফি ও মাহাবুব আলী নামে দুই ব্যক্তির হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরেও ওই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। মাহাবুব আলী এমডির গাড়িচালক হিসেবে কাজ করেন। বক্তব্য জানতে এমএলএসএস জাকির ও গাড়িচালক মাহাবুবের মোবাইল নম্বরে ফোন করলে দুজনের নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই তারা পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত দুই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) তাইজ ইবনে আনোয়ার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমার মোবাইলে এমন কোনো প্রশ্ন আসেনি। প্রশ্নপত্র ফটোকপি করার সময় আমি ওই কক্ষে ছিলামও না।’
প্রশ্নপত্র প্রস্তুতে ছিল না পর্যাপ্ত নিরাপত্তা
বিমানের একটি সূত্র বলছে, বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি, ফটোকপি ও বিতরণের কোনো অংশেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিমানের এমডি নিজ কক্ষে নিয়মিত বসলেও প্রশাসন বিভাগের পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কারণে প্রশাসন পরিচালকের কক্ষেও তিনি মাঝে মাঝে বসতেন। ওই কক্ষেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফটোকপি করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেখানেও নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি ছিল।
বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের যে কমিটি করা হয় তার প্রধান ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. যাহিদ হোসেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ, বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ট্রেনিং সেন্টারের (বিএটিসি) অধ্যক্ষ এ বি এম নাজমুল হুদা, মহাব্যবস্থাপক (জিএসই) তাইজ ইবনে আনোয়ার, মহাব্যবস্থাপক আইটি (ভারপ্রাপ্ত) মো. আনোয়ারুল হক।
জানা গেছে, প্রশ্নপত্র তৈরির পর পরীক্ষায় ব্যবহারের জন্য ফটোকপি করার সময় কমিটির দুই সদস্য সেখানে ছিলেন না। তাদের পরিবর্তে অন্য দুজন কর্মকর্তাকে সেই কক্ষে প্রবেশ এবং অবস্থানের অনুমতি দেয়া হয়। এ ছাড়া কমিটির সদস্যসহ কর্মচারীদের কাউকেই দেহ তল্লাশি বা মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে সেখানে আছেন কি না তাও যাচাই করা হয়নি।
নিয়োগ কমিটির অন্যতম সদস্য মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে মুঠোফোন সঙ্গে নিয়ে আসা নিষেধ ছিল। এ কারণে নতুন করে চেক করা হয়নি। ফটোকপির সময় আমরা উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু এর ফাঁকেই ফটোকপির দায়িত্বে থাকা জাহিদ হয়তো ছবি তুলতে পারে।’
কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতেই কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হলো জানতে চাইলে মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ বলেন, ‘আমরাও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে।’
কমিটির আরেক সদস্য এ বি এম নাজমুল হুদা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সদস্য মো. আনোয়ারুল হক দাবি করেন, তিনি কমিটির সদস্যই ছিলেন না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. যাহিদ হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমি পরিচালক প্রশাসনের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করলেও কক্ষটিতে নিয়মিত বসি না। মাঝেমধ্যে দাপ্তরিক কাজে যেতে হয়। ফলে সরাসরি আমার কক্ষ থেকেই প্রশ্নটি ফাঁস হয়েছে তা ঠিক না।’
প্রশ্নপত্র প্রণয়নে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাব প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার বিমানের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘সেখানে মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) উপস্থিত ছিলেন। নিরাপত্তার বিষয়টি তার দেখার কথা।’ প্রশ্নপত্র ফটোকপি করার সময় মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) উপস্থিত ছিলেন না জানালে এমডি বলেন, ‘তার তো থাকার কথা। এ বিষয়ে আমরাও একটি ইনকোয়ারি করছি। ইনকোয়ারির পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’
তবে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্ন ফাঁসে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের পাশাপাশি তদারকির দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের দায়ও পর্যালোচনা করা হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ দায় এড়াতে পারবেন না।
তদন্তে অসহযোগিতা বিমানের
এদিকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা তদন্তে অসহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে খোদ বিমানের বিরুদ্ধে। তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা একাধিকবার তদন্তের বিষয়ে কথা বলার জন্য বিমানের এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। উল্টো তিনি পুলিশি তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে নানা জায়গায় তদবির করেছেন।
গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তাকে পুরো প্রক্রিয়াটি জানানো এবং জানার জন্য গোয়েন্দা কার্যালয়ে আসার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই গোয়েন্দা কার্যালয়ে আসতে রাজি হননি।’
তবে বিমানের এমডি অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আগেও একবার তারা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। তার পরও ‘সুনাম ক্ষুণ্ন হবে’ মনে করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বর্তমানে অনেকেই বিমানের বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন।
গত ২১ অক্টোবর বেলা ৩টায় বিমানের ১০ পদের বিপরীতে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে প্রথমে দক্ষিণখান এলাকা থেকে বিমানের অফিস সহায়ক হারুনুর রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এমটি অপারেটর মোহাম্মদ মাহফুজুল আলম ও এনামুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন পৃথক অভিযানে দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকা থেকে এমটি অপারেটর জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বিমানের প্রধান কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় অফিস সহায়ক আওলাদ হোসেনকে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনকে ৫৪ ধারায় আদালতে সোপর্দ করে ছয় দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে দুই দিন পর প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা জাহিদ হাসান ও সামজু ওরফে সোবহানকে গ্রেপ্তার করেন গোয়েন্দারা। ২৪ অক্টোবর ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মাসুদকে। তাদেরও প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তী সময়ে জাভেদসহ আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
বিমান ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, জাহিদ ও আওলাদ এমডির দপ্তরের অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। সোবহান ও জাভেদ পরিচালক প্রশাসনের দপ্তরের অফিস সহায়ক। বাকিরা এমটি অপারেটর (গাড়িচালক) হিসেবে কাজ করতেন। গ্রেপ্তার মাসুদ বিমানের মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) তাইজ ইবনে আনোয়ারের গাড়ি চালান। জাহাঙ্গীর আলম আগে তাইজ ইবনে আনোয়ারের গাড়ি চালাতেন।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বিমানের এমডির বর্তমান গাড়িচালক মাহবুব আলী এই চক্রের অন্যতম একজন হোতা। ঘটনার পর থেকেই তিনি আত্মগোপনে আছেন। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।