বিশ্ববিদ্যালয় : বিধি-বিধান, পরিচালনা এবং ইউজিসি

ড. ফেরদৌস জামান

ভারত স্বাধীনের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘একটি দেশ আত্মমর্যাদাশীল ও সমৃদ্ধ হয় যদি তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানে, গবেষণায় নিবিষ্ট ও সুশৃংখল থাকে। ’ মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটি অপরিসীম, বিস্তৃত ও ব্যাপক। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, আর্ট, কলা, সামাজিক ও বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয়াদি—এককথায় সব কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। গবেষণা, একাডেমিক ডিসকোর্স ও নতুন জ্ঞান উৎপাদনে বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় অগ্রগামী।

বিশ্ব ইতিহাসে ৮৫৭-৮৫৯ সালে প্রথম মরক্কোয় আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগে দর্শন, আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে মোডেনা, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। তবে শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্মশাস্ত্রালয় হিসেবে পরিচিত ছিল।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। যার ৯টি ছিল পূর্ব বাংলায়। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভূ-আঞ্চলিক ষড়যন্ত্রসহ নানা প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই এই ভূখণ্ডে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এপার বাংলার জাতিসত্তা, অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচিত হয় এখানে। অবশ্য দীর্ঘ এই ৫০ বছরে পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় আরো পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। দেশমাতৃকার চরম দুঃসময়ে এই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সদ্যঃস্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ-১০ ধারা অনুযায়ী তিনি ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, সমাজ ও অর্থনৈতিক সংস্কারক অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে। অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদানের পরই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

এভাবে পেরিয়েছে পাঁচটি দশক। এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় বর্তমানে দেশে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫২টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। অবশিষ্ট ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে আলাদা আলাদা আইন। সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করলেও সে নিজে জানে না কিভাবে চলছে, কোন আইনে এগোচ্ছে তার বিদ্যাপীঠ। আজকের এই লেখাটি মূলত তাদের জন্যই। কারণ বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হলো আইনসংক্রান্ত। অর্থাৎ একটি মাত্র আইন দ্বারা দেশের সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়।

পক্ষান্তরে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় নিজস্ব আইন দ্বারা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দুই ধরনের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এর একটি হলো স্বায়ত্তশাসিত, অন্যটি হলো সংবিধিবদ্ধ। যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা পরিচালিত বা পুনর্গঠিত এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট আছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত। এর বাইরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংবিধিবদ্ধ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। গঠন, প্রতিষ্ঠা, ধরন এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছয়ভাবে বিভক্ত।

বৈশিষ্ট্য ও ধরন অনুযায়ী এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক দায়িত্ব পালন করে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শুধু একাডেমিক বিষয়গুলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ দেখভাল করে। অন্যদিকে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তথা হাসপাতাল পরিচালনার অংশটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখভাল করে থাকে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি তথা চ্যান্সেলরের সচিবালয় হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দেশের পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ উল্লিখিত তিনটি পদের প্যানেল তৈরি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর অফিস আদেশ জারি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ধারা অনুযায়ী সিনেট, সিন্ডিকেট তথা রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগের বিষয়টিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে সম্পন্ন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বিশেষজ্ঞ সদস্য (মন্ত্রণালয় তথা চ্যান্সেলর নমিনি) মনোনয়নসংক্রান্ত যাবতীয় প্রক্রিয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্গানোগ্রামের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি এবং সংবিধি মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজস্ব জনবল দিয়ে কিংবা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে তদন্তপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক : আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে একটি ছাড়া অন্যটি অচল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ বার্ষিক বাজেট সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করে তা অনুমোদন করিয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে থাকে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নতুন পদ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। নতুন বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও সেন্টার খোলার অনুমোদন প্রদান করে থাকে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা ও আসবাবপত্র ক্রয়ের নিমিত্তে দেশি ও বিদেশি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে অর্থের সংস্থান করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে থাকে। ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ নিবিড় সম্পর্ক মূলত শিক্ষার সম্প্রসারণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

সম্মানিত শিক্ষকদের গবেষণাধর্মী পুস্তক এবং গবেষণামূলক জার্নাল প্রকাশের জন্য ‘ইউজিসি স্বর্ণপদক’ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি, প্রবিধি, সংবিধি এবং অর্গানোগ্রাম প্রণয়নে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা প্রদান করে থাকে। কোনো উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরপেক্ষ তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে উপস্থাপন করে থাকে ইউজিসি।

দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ই-লাইব্রেরির সুবিধা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ এ কার্যক্রম বিস্তর এক কর্মযজ্ঞ। কারণ তিনটি ভিন্ন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি যদি স্থবির হয়, তবে এর প্রভাব উচ্চশিক্ষা পরিবারের প্রতিটি সদস্য, এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ে।

লেখক : সচিব, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং সদস্য বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল

বিশ্ববিদ্যালয় : বিধি-বিধান, পরিচালনা এবং ইউজিসি

ড. ফেরদৌস জামান

ভারত স্বাধীনের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘একটি দেশ আত্মমর্যাদাশীল ও সমৃদ্ধ হয় যদি তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানে, গবেষণায় নিবিষ্ট ও সুশৃংখল থাকে। ’ মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটি অপরিসীম, বিস্তৃত ও ব্যাপক। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, আর্ট, কলা, সামাজিক ও বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয়াদি—এককথায় সব কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। গবেষণা, একাডেমিক ডিসকোর্স ও নতুন জ্ঞান উৎপাদনে বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় অগ্রগামী।

বিশ্ব ইতিহাসে ৮৫৭-৮৫৯ সালে প্রথম মরক্কোয় আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগে দর্শন, আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে মোডেনা, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। তবে শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্মশাস্ত্রালয় হিসেবে পরিচিত ছিল।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। যার ৯টি ছিল পূর্ব বাংলায়। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভূ-আঞ্চলিক ষড়যন্ত্রসহ নানা প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই এই ভূখণ্ডে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এপার বাংলার জাতিসত্তা, অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচিত হয় এখানে। অবশ্য দীর্ঘ এই ৫০ বছরে পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় আরো পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। দেশমাতৃকার চরম দুঃসময়ে এই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সদ্যঃস্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ-১০ ধারা অনুযায়ী তিনি ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, সমাজ ও অর্থনৈতিক সংস্কারক অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে। অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদানের পরই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

এভাবে পেরিয়েছে পাঁচটি দশক। এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় বর্তমানে দেশে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫২টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। অবশিষ্ট ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে আলাদা আলাদা আইন। সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করলেও সে নিজে জানে না কিভাবে চলছে, কোন আইনে এগোচ্ছে তার বিদ্যাপীঠ। আজকের এই লেখাটি মূলত তাদের জন্যই। কারণ বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হলো আইনসংক্রান্ত। অর্থাৎ একটি মাত্র আইন দ্বারা দেশের সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়।

পক্ষান্তরে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় নিজস্ব আইন দ্বারা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দুই ধরনের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এর একটি হলো স্বায়ত্তশাসিত, অন্যটি হলো সংবিধিবদ্ধ। যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা পরিচালিত বা পুনর্গঠিত এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট আছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত। এর বাইরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংবিধিবদ্ধ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। গঠন, প্রতিষ্ঠা, ধরন এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছয়ভাবে বিভক্ত।

বৈশিষ্ট্য ও ধরন অনুযায়ী এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক দায়িত্ব পালন করে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শুধু একাডেমিক বিষয়গুলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ দেখভাল করে। অন্যদিকে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তথা হাসপাতাল পরিচালনার অংশটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখভাল করে থাকে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি তথা চ্যান্সেলরের সচিবালয় হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দেশের পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ উল্লিখিত তিনটি পদের প্যানেল তৈরি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর অফিস আদেশ জারি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ধারা অনুযায়ী সিনেট, সিন্ডিকেট তথা রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগের বিষয়টিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে সম্পন্ন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বিশেষজ্ঞ সদস্য (মন্ত্রণালয় তথা চ্যান্সেলর নমিনি) মনোনয়নসংক্রান্ত যাবতীয় প্রক্রিয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্গানোগ্রামের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি এবং সংবিধি মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজস্ব জনবল দিয়ে কিংবা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে তদন্তপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক : আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে একটি ছাড়া অন্যটি অচল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ বার্ষিক বাজেট সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করে তা অনুমোদন করিয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে থাকে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নতুন পদ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। নতুন বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও সেন্টার খোলার অনুমোদন প্রদান করে থাকে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা ও আসবাবপত্র ক্রয়ের নিমিত্তে দেশি ও বিদেশি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে অর্থের সংস্থান করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে থাকে। ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ নিবিড় সম্পর্ক মূলত শিক্ষার সম্প্রসারণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

সম্মানিত শিক্ষকদের গবেষণাধর্মী পুস্তক এবং গবেষণামূলক জার্নাল প্রকাশের জন্য ‘ইউজিসি স্বর্ণপদক’ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি, প্রবিধি, সংবিধি এবং অর্গানোগ্রাম প্রণয়নে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা প্রদান করে থাকে। কোনো উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নিরপেক্ষ তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে উপস্থাপন করে থাকে ইউজিসি।

দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ই-লাইব্রেরির সুবিধা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ এ কার্যক্রম বিস্তর এক কর্মযজ্ঞ। কারণ তিনটি ভিন্ন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি যদি স্থবির হয়, তবে এর প্রভাব উচ্চশিক্ষা পরিবারের প্রতিটি সদস্য, এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ে।

লেখক : সচিব, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং সদস্য বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল