শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামের পূর্ণরূপ ব্যবহার জরুরি কি?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্টেকহোল্ডারের অভাব নেই। এর ভেতর অধিকাংশই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। প্রবাদ আছে-a headmaster has eleven husband. এতগুলো পক্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সহজ কাজ নয়। কখনো কখনো এ কর্তৃপক্ষদের ভিতর সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তখন বিপাকে পড়েন। শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তির কারণ হয়।
করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের দুই দফায় অনুদান প্রদান করেন। শিক্ষকপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা এবং কর্মচারীপ্রতি আড়াই হাজার টাকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই বরাদ্দ সবার কাছে পৌঁছেনি। উপজেলা শিক্ষা অফিস নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের তালিকা সংগ্রহ করে জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠায়। জেলা শিক্ষা অফিস সেই তালিকা পাঠায় জেলা প্রশাসকের কাছে। সেখান থেকে তালিকা যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ২০২০ সালের জুনে প্রথম দফায় এই তালিকা পাঠানোতে একটা ভুলের উদাহরণ হলো-জেলা প্রশাসকের কার্যালয় যশোরের চৌগাছা উপজেলার তালিকা না পাঠিয়ে শার্শা উপজেলার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের নামের তালিকা দুবার পাঠায়। এত করে চৌগাছা উপজেলার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে কোনো বরাদ্দ না এসে শার্শা উপজেলার শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে দুইবারের বরাদ্দ আসে। অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণ এগারো লাখ সত্তর হাজার টাকা। শার্শা থেকে চৌগাছার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা কম। জেলা প্রশাসক এ টাকা থেকে চৌগাছা উপজেলার শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুদান প্রদান করে বাকি লক্ষাধিক টাকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফেরত দিতে পারতেন। তিনি সেটা না করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বরাবর ভুল সংশোধনের অনুমোদন চেয়ে পত্র লেখেন। সেই পত্রের আর জবাব মেলেনি। অনুদানের টাকাও আর শিক্ষক-কর্মচারীরা পাননি। টাকাটা জেলা প্রশাসকের কাছেই রয়ে যায়।
দ্বিতীয়বার বিকাশ কিংবা রকেটে সরাসরি অর্থ প্রদানের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের মোবাইল নম্বর সংবলিত তালিকা নেওয়া হয়। এবারে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দু-একজনের মোবাইল অ্যাকাউন্টে অনুদানের টাকা ঢুকলেও অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীর মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকেনি। সারা দেশের চিত্রটা ছিল এরকম। অনুদানবঞ্চিত নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষা অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানিয়ে সদুত্তর পাননি।
আগে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপবৃত্তির টাকা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ব্যাংকের লোকেরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতেন। এখন উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা প্রেরণের সিস্টেম চালু হয়েছে। উপবৃত্তির কিস্তির টাকা শিক্ষার্থীদের প্রেরণের সময় কেউ বলে টাকা পেয়েছি, আবার কেউ বলে পায়নি। শিক্ষার্থীদের টাকা প্রেরণের পর সেই তালিকা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলে পাওয়া না পাওয়ার হিসাবটা মিলিয়ে নেওয়া যেত। টাকা পাঠানোর ভেতর কোনো গড়বড়ের ঘটনা ঘটছে কি না কে জানে?
দুই
সবশেষ এ বছর জানুয়ারিতে লকডাউন দেওয়া হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময় শিক্ষা বোর্ড থেকে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনি প্রক্রিয়া যেখানে যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় স্থগিত করার নির্দেশনা আসে। আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনি তফশিল অনুযায়ী ম্যানেজিং কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। এ নির্দেশনার কারণে কমিটি গঠনের কাজ আটকে যায়। এক মাস পর লকডাউন উঠে গেলে কমিটি গঠনের কাজ যেখানে যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে আবার শুরু করার নির্দেশনা আসে। আমার প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠনের কাজ সামান্যই বাকি ছিল। প্রিসাইডিং অফিসার যেখানে যে অবস্থায় বলতে পূর্বঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী কমিটির কাজ সম্পাদন করা বুঝেন। তিনি ‘ব্যাক ডেটে’ কমিটি চূড়ান্ত করে দিলে বোর্ডে আটকে যায়। বোর্ড থেকে লকডাউনের সময়কাল পিছিয়ে কমিটি গঠনের বাকি কাজ করার নির্দেশনা এলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ হতো না। কমিটি অনুমোদিত না হওয়ায় আবার এডহক কমিটিতে চলে যেতে হয়। বোর্ড ফিসসহ কমিটি তৈরির কাজে আট হাজারের ওপর টাকা ব্যয় হয়। কমিটি অনুমোদিত না হওয়ায় বিদ্যালয় পরিদর্শককে এডহক কমিটির জন্য ওই ফিস সমন্বয়ের অনুরোধ করলে তিনি আবারও ফিস প্রদানের নিয়মের কথা জানান।
তিন
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত নাম পরিবর্তন করে পূর্ণাঙ্গ নামে রূপান্তরের জরুরিভিত্তিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় পূর্ণাঙ্গ নাম ব্যবহারের প্রমাণস্বরূপ প্রতিষ্ঠানের নামফলক, প্রতিষ্ঠানের প্যাড এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের নামাঙ্কিত সিলগুলো শিক্ষা অফিসে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে নামের এ পূর্ণরূপ ব্যবহার কতটা বাস্তবসম্মত?
নামসংক্ষেপের দুটি ধারা রয়েছে-একটি হলো, ব্যক্তির নামসংক্ষেপ এবং অপরটি হলো স্থানের নামসংক্ষেপ। একজন ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হলে সিল, প্যাড, ফলকে তার নামের পূর্ণরূপ ব্যবহারে তেমন সমস্যা নেই। যদিও যশোরের সরকারি এমএম (মাইকেল মদুসূদন দত্ত) কলেজ, বরিশালের সরকারি বিএম (ব্রজমোহন) কলেজ-এ রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পূর্ণরূপ লিখিত হলেও সাধারণে নামের সংক্ষিপ্ত রূপই উচ্চারিত হবে। তবে স্থানের সংক্ষিপ্ত নামের পূর্র্ণরূপ ব্যবহারে সমস্যা রয়েছে। সাধারণত কোনো একটি জনপদের নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হলে নামের পূর্ণরূপ লেখা হয়ে থাকে। একাধিক স্থানের নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হলে তবেই নাম সংক্ষিপ্ত করার প্রয়োজন পড়ে। মফস্বল এলাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের নাম নিয়ে করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রামগুলোর অংশীদারত্ব দিয়ে সেখান থেকে শিক্ষার্থী আকর্ষণ করা এরকম নামকরণের অন্যতম উদ্দেশ্যে। গ্রামের সংখ্যা একাধিক হওয়ায় এক্ষেত্রে নাম সংক্ষেপণের প্রয়োজন পড়েছে।
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিআরএকেএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পাশাপাশি ৫টি গ্রামের আদ্যাক্ষর নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে। গ্রামগুলো হলো-বলিভদ্রপুর, রামচন্দ্রপুর, আজমপুর, কাশিপুর ও সৈয়দপুর। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পূর্বে এতগুলো নামের পূর্ণরূপ যোগ হলে সিল, প্যাড কী ঢাউস আকার ধারণ করবে, তা সহজেই অনুমেয়। এতগুলো গ্রামের পূর্ণনামসহ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম উচ্চারণ করবে না।
যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় এবিসিডি নামে একটি স্কুল এবং আরেকটি কলেজ রয়েছে। উপজেলার বাইরেও কলেজটির পরিচিতি রয়েছে। এবিসিডি নামকরণ করা হয়েছে আরাজী সুলতানপুর, বকশীপুর, চাকলা এবং দেবীপুর এই চারটি গ্রামের আদ্যাক্ষর নিয়ে। এবিসিডি নামে একটা ছন্দ আছে, শুনতেও শ্রুতিমধুর। এখন নাম পরিবর্তন করে পূর্ণাঙ্গ নাম ব্যবহার করলেও এলাকাবাসী আগের নামেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করবে।
সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রথম রেজুলেশনে নামকরণের বিষয়টি উল্লেখ থাকে। কর্তৃপক্ষ নামকরণের ইতিহাস তদন্তের প্রয়োজনবোধ করলে ওই রেজুলেশনের কপি নিয়েই নামকরণের প্রেক্ষাপট অবহিত হতে পারেন। বর্তমান যুগ অনেক ফাস্ট হয়ে গেছে। অল্প কথায় এখন অধিক বিষয় বোঝাতে হয়। অনেক শব্দই এখন অংশত বলা হয়, বাকি অংশ উহ্য থাকে। ইউনিভার্সিটি না বলে ভার্সিটি কথাটা সাধারণে চল হয়ে গেছে। নামের পূর্ণরূপ লেখা হলেও যদি সেটার প্রচলন না ঘটে, তবে সেই নামকরণের সার্থকতা কোথায়?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম কেবল নিজ প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় না, সরকারি নানা দপ্তরেও নামটা নথিবদ্ধ থাকে। আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে তিনটি গ্রামের আদ্যাক্ষর নিয়ে। পূর্ণনাম ব্যবহারের নির্দেশনা আসার আগে ম্যানেজিং কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। নামের সংক্ষিপ্ত রূপেই নির্বাচনি তফশিল প্রকাশিত হয়। এখন পূর্ণনামের সিল, প্যাডে শিক্ষা বোর্ডে কমিটি অনুমোদনের আবেদন করলে বিদ্যালয় পরিদর্শক বোর্ডের ওয়েবসাইটে বিদ্যমান সংক্ষিপ্ত নামের সিল-প্যাডে আবেদন করতে বলেন। এ বছর একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। যে নামে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হলো, ওই নামেই শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ সম্পন্ন না হলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। নামের পরিবর্তন ঘটাতে হলে শিক্ষা বোর্ড, ব্যানবেইস, ডিডিপিআই, এনটিআরসিএ, মাউশি এসব দপ্তরেও একযোগে সেই পরিবর্তন আনা আবশ্যক।
আশা করি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পূর্ণনাম ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা পুনর্বিবেচনা করবে; আর পূর্ণনাম ব্যবহার করতে হলে সব দপ্তরে ওই নাম প্রতিস্থাপন করবে।
শরীফুজ্জামান আগা খান : শিক্ষক ও গবেষক

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামের পূর্ণরূপ ব্যবহার জরুরি কি?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্টেকহোল্ডারের অভাব নেই। এর ভেতর অধিকাংশই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। প্রবাদ আছে-a headmaster has eleven husband. এতগুলো পক্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সহজ কাজ নয়। কখনো কখনো এ কর্তৃপক্ষদের ভিতর সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তখন বিপাকে পড়েন। শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তির কারণ হয়।
করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের দুই দফায় অনুদান প্রদান করেন। শিক্ষকপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা এবং কর্মচারীপ্রতি আড়াই হাজার টাকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই বরাদ্দ সবার কাছে পৌঁছেনি। উপজেলা শিক্ষা অফিস নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের তালিকা সংগ্রহ করে জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠায়। জেলা শিক্ষা অফিস সেই তালিকা পাঠায় জেলা প্রশাসকের কাছে। সেখান থেকে তালিকা যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ২০২০ সালের জুনে প্রথম দফায় এই তালিকা পাঠানোতে একটা ভুলের উদাহরণ হলো-জেলা প্রশাসকের কার্যালয় যশোরের চৌগাছা উপজেলার তালিকা না পাঠিয়ে শার্শা উপজেলার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের নামের তালিকা দুবার পাঠায়। এত করে চৌগাছা উপজেলার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে কোনো বরাদ্দ না এসে শার্শা উপজেলার শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে দুইবারের বরাদ্দ আসে। অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণ এগারো লাখ সত্তর হাজার টাকা। শার্শা থেকে চৌগাছার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা কম। জেলা প্রশাসক এ টাকা থেকে চৌগাছা উপজেলার শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুদান প্রদান করে বাকি লক্ষাধিক টাকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফেরত দিতে পারতেন। তিনি সেটা না করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বরাবর ভুল সংশোধনের অনুমোদন চেয়ে পত্র লেখেন। সেই পত্রের আর জবাব মেলেনি। অনুদানের টাকাও আর শিক্ষক-কর্মচারীরা পাননি। টাকাটা জেলা প্রশাসকের কাছেই রয়ে যায়।
দ্বিতীয়বার বিকাশ কিংবা রকেটে সরাসরি অর্থ প্রদানের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের মোবাইল নম্বর সংবলিত তালিকা নেওয়া হয়। এবারে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দু-একজনের মোবাইল অ্যাকাউন্টে অনুদানের টাকা ঢুকলেও অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীর মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকেনি। সারা দেশের চিত্রটা ছিল এরকম। অনুদানবঞ্চিত নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষা অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানিয়ে সদুত্তর পাননি।
আগে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপবৃত্তির টাকা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ব্যাংকের লোকেরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতেন। এখন উপবৃত্তিধারী শিক্ষার্থীদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা প্রেরণের সিস্টেম চালু হয়েছে। উপবৃত্তির কিস্তির টাকা শিক্ষার্থীদের প্রেরণের সময় কেউ বলে টাকা পেয়েছি, আবার কেউ বলে পায়নি। শিক্ষার্থীদের টাকা প্রেরণের পর সেই তালিকা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলে পাওয়া না পাওয়ার হিসাবটা মিলিয়ে নেওয়া যেত। টাকা পাঠানোর ভেতর কোনো গড়বড়ের ঘটনা ঘটছে কি না কে জানে?
দুই
সবশেষ এ বছর জানুয়ারিতে লকডাউন দেওয়া হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময় শিক্ষা বোর্ড থেকে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনি প্রক্রিয়া যেখানে যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় স্থগিত করার নির্দেশনা আসে। আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনি তফশিল অনুযায়ী ম্যানেজিং কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। এ নির্দেশনার কারণে কমিটি গঠনের কাজ আটকে যায়। এক মাস পর লকডাউন উঠে গেলে কমিটি গঠনের কাজ যেখানে যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে আবার শুরু করার নির্দেশনা আসে। আমার প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠনের কাজ সামান্যই বাকি ছিল। প্রিসাইডিং অফিসার যেখানে যে অবস্থায় বলতে পূর্বঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী কমিটির কাজ সম্পাদন করা বুঝেন। তিনি ‘ব্যাক ডেটে’ কমিটি চূড়ান্ত করে দিলে বোর্ডে আটকে যায়। বোর্ড থেকে লকডাউনের সময়কাল পিছিয়ে কমিটি গঠনের বাকি কাজ করার নির্দেশনা এলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ হতো না। কমিটি অনুমোদিত না হওয়ায় আবার এডহক কমিটিতে চলে যেতে হয়। বোর্ড ফিসসহ কমিটি তৈরির কাজে আট হাজারের ওপর টাকা ব্যয় হয়। কমিটি অনুমোদিত না হওয়ায় বিদ্যালয় পরিদর্শককে এডহক কমিটির জন্য ওই ফিস সমন্বয়ের অনুরোধ করলে তিনি আবারও ফিস প্রদানের নিয়মের কথা জানান।
তিন
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত নাম পরিবর্তন করে পূর্ণাঙ্গ নামে রূপান্তরের জরুরিভিত্তিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় পূর্ণাঙ্গ নাম ব্যবহারের প্রমাণস্বরূপ প্রতিষ্ঠানের নামফলক, প্রতিষ্ঠানের প্যাড এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের নামাঙ্কিত সিলগুলো শিক্ষা অফিসে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে নামের এ পূর্ণরূপ ব্যবহার কতটা বাস্তবসম্মত?
নামসংক্ষেপের দুটি ধারা রয়েছে-একটি হলো, ব্যক্তির নামসংক্ষেপ এবং অপরটি হলো স্থানের নামসংক্ষেপ। একজন ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হলে সিল, প্যাড, ফলকে তার নামের পূর্ণরূপ ব্যবহারে তেমন সমস্যা নেই। যদিও যশোরের সরকারি এমএম (মাইকেল মদুসূদন দত্ত) কলেজ, বরিশালের সরকারি বিএম (ব্রজমোহন) কলেজ-এ রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পূর্ণরূপ লিখিত হলেও সাধারণে নামের সংক্ষিপ্ত রূপই উচ্চারিত হবে। তবে স্থানের সংক্ষিপ্ত নামের পূর্র্ণরূপ ব্যবহারে সমস্যা রয়েছে। সাধারণত কোনো একটি জনপদের নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হলে নামের পূর্ণরূপ লেখা হয়ে থাকে। একাধিক স্থানের নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হলে তবেই নাম সংক্ষিপ্ত করার প্রয়োজন পড়ে। মফস্বল এলাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের নাম নিয়ে করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রামগুলোর অংশীদারত্ব দিয়ে সেখান থেকে শিক্ষার্থী আকর্ষণ করা এরকম নামকরণের অন্যতম উদ্দেশ্যে। গ্রামের সংখ্যা একাধিক হওয়ায় এক্ষেত্রে নাম সংক্ষেপণের প্রয়োজন পড়েছে।
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিআরএকেএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পাশাপাশি ৫টি গ্রামের আদ্যাক্ষর নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে। গ্রামগুলো হলো-বলিভদ্রপুর, রামচন্দ্রপুর, আজমপুর, কাশিপুর ও সৈয়দপুর। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পূর্বে এতগুলো নামের পূর্ণরূপ যোগ হলে সিল, প্যাড কী ঢাউস আকার ধারণ করবে, তা সহজেই অনুমেয়। এতগুলো গ্রামের পূর্ণনামসহ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম উচ্চারণ করবে না।
যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় এবিসিডি নামে একটি স্কুল এবং আরেকটি কলেজ রয়েছে। উপজেলার বাইরেও কলেজটির পরিচিতি রয়েছে। এবিসিডি নামকরণ করা হয়েছে আরাজী সুলতানপুর, বকশীপুর, চাকলা এবং দেবীপুর এই চারটি গ্রামের আদ্যাক্ষর নিয়ে। এবিসিডি নামে একটা ছন্দ আছে, শুনতেও শ্রুতিমধুর। এখন নাম পরিবর্তন করে পূর্ণাঙ্গ নাম ব্যবহার করলেও এলাকাবাসী আগের নামেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করবে।
সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রথম রেজুলেশনে নামকরণের বিষয়টি উল্লেখ থাকে। কর্তৃপক্ষ নামকরণের ইতিহাস তদন্তের প্রয়োজনবোধ করলে ওই রেজুলেশনের কপি নিয়েই নামকরণের প্রেক্ষাপট অবহিত হতে পারেন। বর্তমান যুগ অনেক ফাস্ট হয়ে গেছে। অল্প কথায় এখন অধিক বিষয় বোঝাতে হয়। অনেক শব্দই এখন অংশত বলা হয়, বাকি অংশ উহ্য থাকে। ইউনিভার্সিটি না বলে ভার্সিটি কথাটা সাধারণে চল হয়ে গেছে। নামের পূর্ণরূপ লেখা হলেও যদি সেটার প্রচলন না ঘটে, তবে সেই নামকরণের সার্থকতা কোথায়?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম কেবল নিজ প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় না, সরকারি নানা দপ্তরেও নামটা নথিবদ্ধ থাকে। আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে তিনটি গ্রামের আদ্যাক্ষর নিয়ে। পূর্ণনাম ব্যবহারের নির্দেশনা আসার আগে ম্যানেজিং কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। নামের সংক্ষিপ্ত রূপেই নির্বাচনি তফশিল প্রকাশিত হয়। এখন পূর্ণনামের সিল, প্যাডে শিক্ষা বোর্ডে কমিটি অনুমোদনের আবেদন করলে বিদ্যালয় পরিদর্শক বোর্ডের ওয়েবসাইটে বিদ্যমান সংক্ষিপ্ত নামের সিল-প্যাডে আবেদন করতে বলেন। এ বছর একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। যে নামে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হলো, ওই নামেই শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ সম্পন্ন না হলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। নামের পরিবর্তন ঘটাতে হলে শিক্ষা বোর্ড, ব্যানবেইস, ডিডিপিআই, এনটিআরসিএ, মাউশি এসব দপ্তরেও একযোগে সেই পরিবর্তন আনা আবশ্যক।
আশা করি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পূর্ণনাম ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা পুনর্বিবেচনা করবে; আর পূর্ণনাম ব্যবহার করতে হলে সব দপ্তরে ওই নাম প্রতিস্থাপন করবে।
শরীফুজ্জামান আগা খান : শিক্ষক ও গবেষক