শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক

ড. ছিদ্দিকুর রহমান

প্রতীকী ছবি

একটি বড় রুই মাছকে কেটে সমান তিন ভাগ করে তিনজন রাঁধুনিকে দিয়ে ঝোল রান্না করতে বলা হলো। এ ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে স্বাদে, গন্ধে, খাদ্য মানে তিনজনের রান্নায় বেশ ভিন্নতা। কারও রান্না খুবই সুস্বাদু, কারওটা অখাদ্য। তেমনিভাবে একই বিষয়বস্তু মোটামুটি একই মানের তিনটি ভিন্ন শ্রেণিতে তিনজন ভিন্ন শিক্ষক পড়ালে শিক্ষার্থীরা সমমানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে না। বিষয়বস্তুর ওপর তিনজন শিক্ষকের জ্ঞান সমমানের হলেও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের সহায়তাদান পদ্ধতি ও কৌশলের ভিন্নতার জন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষা লাভের মানের তারতম্য ঘটবে। এখানে শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান হলো রুই মাছ আর শিখনে সহায়তাদান বা শিক্ষণ পদ্ধতি হলো রন্ধন পদ্ধতি।

এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের শ্রেণি শিখনের মান বহুলাংশে শিক্ষকের স্বচ্ছ বিষয়জ্ঞান এবং শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়তাদানের সঠিক পদ্ধতি ও কলাকৌশলের ওপর নির্ভরশীল। ভালো শিক্ষক জন্মগত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশায় উৎকর্ষতা নির্ভর করে শিক্ষক শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের মানের ওপর। এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী শিক্ষা একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানের ক্ষেত্র, যেমন ভৌতবিজ্ঞান, সামাজিকবিজ্ঞান, আইন, মেডিকেল বিজ্ঞান এক-একটি জ্ঞানের ক্ষেত্র। প্রতিটি জ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অর্থাৎ জ্ঞানসম্পর্কিত তত্ত্ব, তথ্য—এদের বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ইত্যাদিসহ আবেগীয় মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিক ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন করে থাকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনোপেশিজ দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা হয়। এখানে লক্ষণীয় বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশিজ সবক’টি ডোমিনই শিক্ষাভুক্ত। মনোপেশিজ দক্ষতা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ উভয় কার্যক্রমভুক্ত।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। ড্রাইভিং শেখার সময় দ্রুত গতিতে ছোট গাড়ি চলার সময় ‘হার্ড ব্রেক’ না করতে শেখানো হয়, এটা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। এখানে ত্বরণ-মন্দন, বেগ ও ভরের মধ্যে সম্পর্ক শেখানো হলো না অর্থাৎ তত্ত্ব শেখানো হলো না, এগুলো শিক্ষার বিষয়। তেমনি স্বল্পমেয়াদি শিক্ষক প্রশিক্ষণে প্রধানত কী পদ্ধতি ও কৌশলে শেখাবে বা শিখন সহায়তা প্রদান করবে তা হাতে-কলমে শেখানো হয়, তত্ত্ব-সূত্র শেখানো হয় না, শিক্ষা বিষয়ে এসবই শেখানো হয়।অতএব শিক্ষার পরিসর ব্যাপক, প্রশিক্ষণ শিক্ষার অন্যতম সোপান বা অংশ। শিক্ষক তৈরির বুনিয়াদি ব্যবস্থা অবশ্যই হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষক শিক্ষা। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই চাকরিকালীন স্বল্পমেয়াদি পৌনঃপুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বছরমেয়াদি বুনিয়াদি শিক্ষার মেয়াদ অপর্যাপ্ত মনে হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক থাকাকালীন এর মেয়াদ বৃদ্ধি করে দুই বছর করার একটি রূপরেখা তৈরি করে সরকারের বিবেচনার জন্য জমা দিই। মেয়াদ বৃদ্ধি করলে চাকরিকালীন অবস্থায় শিক্ষকদের বেশি সময় বিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে হবে। তাতে বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সরকারের খরচ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। এসব কারণে তা গ্রহণ করা হয়নি। পরে এমন একটি উপায় বের করলাম যাতে মেয়াদ কিছুটা বৃদ্ধি করা হলেও বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সরকারেরও খরচ বাড়বে না।

ডিপ-ইন-এড শিরোনামে দেড় বছরমেয়াদি একটি কার্যক্রমের রূপরেখা তৈরি করলাম, যেখানে এক বছর পিটিআইভিত্তিক কার্যক্রম চলবে এবং অবশিষ্ট ছয় মাস শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ (প্র্যাকটিসটিচিং) চলবে। সরকার এ প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। কাজকর্ম শুরু করার পর বিশ্বব্যাংক এবং ইউনিসেফ এ কার্যক্রমকে অধিকতর উন্নত করার জন্য বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হেলেনসহ একাধিক দেশি ও বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেয়। তারা আমার প্রস্তাবের ইন্টার্নশিপকে পরিবর্তন করে তাদের দেশের অনুকরণে এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোনো অবস্থাতেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা দেশীয় পরামর্শকের ওপর আস্থা না রেখে বিদেশি পরামর্শকদের মডেল অনুসারে ইন্টার্নশিপ চালু করে।

এর ফলে বর্তমানে ডিপ-ইন-এড কার্যক্রমের ইন্টার্নশিপ অংশের অবস্থা হ-য-ব-র-ল। কথায় আছে বাড়ির গরু আঙিনার ঘাস খায় না। সচরাচর দেখা যায়, অধিকাংশ নীতিনির্ধারক দেশীয় পরামর্শকদের চেয়ে বিদেশি পরামর্শকদের কথায় অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আমি এখনো দেড় বছরের ডিপ-ইন-এড কার্যক্রমের সমর্থক। একে পরিমার্জন করে ফলপ্রসূভাবে চালু করা যেতে পারে। মাথাব্যথা হলে মাথা না কেটে সঠিক চিকিৎসা করে সুস্থ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির মাধ্যমে যথোপযোগ্য মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে দুই বছরমেয়াদি শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হবে সর্বোত্তম ব্যবস্থা। তা না করা গেলে বর্তমান চালু দেড় বছরমেয়াদি ডিপ-ইন-এড কার্যক্রমকে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে চালু করলেও ভালো ফল পাওয়া যাবে। তাও যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে সুপরিকল্পিত বছরমেয়াদি কার্যক্রম সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমেও সুফল পাওয়া সম্ভব। নিম্নে বছরমেয়াদি শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রস্তাব আকারে তুলে ধরা হলো—

এক. কার্যক্রম ও ডিগ্রির নাম : প্রাথমিক শিক্ষায় স্নাতক।

দুই. কার্যক্রমের মেয়াদ : ১ (এক) বছর এক বছর তিনটি সমান টার্মে বিভক্ত থাকবে; প্রতি টার্মে ন্যূনতম ৯৫ কর্মদিবস থাকবে;

তিন. শিক্ষাক্রম অনুমোদন ও ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়;

চার. কার্যক্রমে ভর্তির যোগ্যতা : স্নাতক ডিগ্রি (এসএসসি থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত যে কোনো দুটি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগ / শ্রেণি বা সমমানের শিক্ষা সনদ।

পাঁচ. কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য : জ্ঞানজাগতিক এবং পেশাগত বিষয়ের সমন্বয়

ক) জ্ঞানজাগতিক বিষয় : বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয় তিনটি থেকে যে কোনো দুটি, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান থেকে একটি এবং ধর্মশিক্ষা (একটি ধর্ম) মোট চারটি বিষয় বাধ্যতামূলক। খ) পেশাগত বিষয় : শিক্ষা বিজ্ঞান (শিক্ষার আধুনিক পরিভাষা পরিচিতি, ধ্যানধারণা, শিক্ষার তত্ত্ব, সূত্র এবং ধারণা) শিক্ষণ শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল (অংশগ্রহণমূলক সক্রিয় পদ্ধতি ও কৌশলাদি) শিশু মনোবিজ্ঞান (শিশুর বৈশিষ্ট্য, মনোযোগ, শিখন মতবাদ থেকে সমগ্রতাবাদ, পিয়াজের কগনেটিভ ডেভেলপমেন্ট তত্ত্ব, গঠনবাদসহ সর্বাধুনিক মতবাদসমূহ শিশু পরিচর্যা ও বিনোদনমূলক শিক্ষা)।

শিক্ষায় মূল্যায়ন : (গঠনকালীন মূল্যায়ন ও নিরাময়মূলক সহায়তা, সামষ্টিক মূল্যায়ন, আবেগীয় ক্ষেত্রের মূল্যায়ন, বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করার কৌশল, বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল প্রশ্ন করার কৌশল

গ) ইন্টার্নশিপ : প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে তাত্ত্বিক (জ্ঞানজাগতিক ও পেশাগত) বিষয়গুলোর মূল্যায়নসহ শিক্ষাকার্যক্রম শেষ করতে হবে। তৃতীয় পর্বে হবে ইন্টার্নশিপ। তৃতীয় পর্বে ৯৫ কর্মদিবসের মধ্যে ৩০ দিন স্কুলে শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন। এর পর পাঁচ দিন কলেজে আসবেন, তখন তারা অর্জিত জ্ঞান-দক্ষতা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তা তুলে ধরবেন, শিক্ষক ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করবেন। পরবর্তী সময়ে ৩০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করবেন এবং ৫ দিন কলেজে। এভাবে তিনবারে ৯০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ১৫ দিন কলেজে।

তৃতীয় পর্বে শিক্ষার্থীরা যতদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়বে তাদের শিক্ষকরাও পূর্ণকালীন নির্ধারিত প্রাথমিক অবস্থান করবেন, শ্রেণি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন, একান্তে পরামর্শ দেবেন, প্রয়োজনে ক্লাস নিয়ে দেখাবেন, বিদ্যালয়ে বসেই পাঠ পরিকল্পনা অনুমোদন করবেন। সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনা করাবেন। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের জন্য বছরমেয়াদি বিএড কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বিএড শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে বা অনুমোদন করে এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ই পরীক্ষা পরিচালনা করে এবং ডিগ্রি প্রদান করে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায়ও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। বিএড যেমন ওই শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় স্নাতক ডিগ্রি, এ ক্ষেত্রে বিপিএড ও শিক্ষার্থীদের একই মানের দ্বিতীয় স্নাতক ডিগ্রি হবে। এখানে একটি অসংগতির কথা উল্লেখ করতে হয়।

সাত-আট দশক আগে বর্তমান প্রচলিত বিএড ডিগ্রির নাম ছিল বিটি। দুনিয়াব্যাপী শিক্ষাকে জ্ঞানের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বিটি ডিগ্রির নাম পরিবর্তে বিএড ডিগ্রি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশেও কলেজের নাম পরিবর্তন করে ‘কলেজ অব এডুকেশন’ রাখা হয়। একইভাবে আমাদের দেশে কার্যক্রমের নাম ও ডিগ্রির নাম পরিবর্তন করে বিএড করা হয় কিন্তু কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়নি, টিটি কলেজই চলছে। প্রস্তাবিত কার্যক্রমটি একটি স্নাতক পর্যায়ের কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের শিক্ষাক্রম অনুমোদন করবে যে কোনো একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ডিগ্রিও প্রদান করবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়।

যেহেতু প্রস্তাবিত কার্যক্রমটি স্নাতক পর্যায়ের, তাই সবকটি পিটিআইকে কলেজ পর্যায়ে উন্নত করে এদের নাম ‘কলেজ অব প্রাইমারি এডুকেশন’ রাখা যুক্তিযুক্ত হবে। এসব কলেজের শিক্ষকদের পদসমূহ উন্নীত করে প্রভাষক, সরকারি অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ করা যায়। প্রভাষক হওয়ার জন্য পিটিআইর কোনো শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতায় ঘাটতি থাকলে তাদের ডেপুটেশনে প্রাথমিক শিক্ষায় এমএড গ্রহণের জন্য পাঠানো যেতে পারে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের পরিসর নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হয় বিধায় প্রস্তাবিত কার্যক্রমের রূপরেখায় অনেক কিছু যেমন শিক্ষক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিচালন পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি সংযোজন করা সম্ভব হলো না।

সবশেষে বলতেই হবে, ছয় মাসমেয়াদি বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষা চালু করা হবে আত্মঘাতী; এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব জাতিকে দীর্ঘদিন ভোগ করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক (অব.) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক

ড. ছিদ্দিকুর রহমান

প্রতীকী ছবি

একটি বড় রুই মাছকে কেটে সমান তিন ভাগ করে তিনজন রাঁধুনিকে দিয়ে ঝোল রান্না করতে বলা হলো। এ ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে স্বাদে, গন্ধে, খাদ্য মানে তিনজনের রান্নায় বেশ ভিন্নতা। কারও রান্না খুবই সুস্বাদু, কারওটা অখাদ্য। তেমনিভাবে একই বিষয়বস্তু মোটামুটি একই মানের তিনটি ভিন্ন শ্রেণিতে তিনজন ভিন্ন শিক্ষক পড়ালে শিক্ষার্থীরা সমমানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে না। বিষয়বস্তুর ওপর তিনজন শিক্ষকের জ্ঞান সমমানের হলেও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের সহায়তাদান পদ্ধতি ও কৌশলের ভিন্নতার জন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষা লাভের মানের তারতম্য ঘটবে। এখানে শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান হলো রুই মাছ আর শিখনে সহায়তাদান বা শিক্ষণ পদ্ধতি হলো রন্ধন পদ্ধতি।

এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের শ্রেণি শিখনের মান বহুলাংশে শিক্ষকের স্বচ্ছ বিষয়জ্ঞান এবং শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়তাদানের সঠিক পদ্ধতি ও কলাকৌশলের ওপর নির্ভরশীল। ভালো শিক্ষক জন্মগত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশায় উৎকর্ষতা নির্ভর করে শিক্ষক শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের মানের ওপর। এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী শিক্ষা একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানের ক্ষেত্র, যেমন ভৌতবিজ্ঞান, সামাজিকবিজ্ঞান, আইন, মেডিকেল বিজ্ঞান এক-একটি জ্ঞানের ক্ষেত্র। প্রতিটি জ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অর্থাৎ জ্ঞানসম্পর্কিত তত্ত্ব, তথ্য—এদের বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ইত্যাদিসহ আবেগীয় মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিক ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন করে থাকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনোপেশিজ দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা হয়। এখানে লক্ষণীয় বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশিজ সবক’টি ডোমিনই শিক্ষাভুক্ত। মনোপেশিজ দক্ষতা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ উভয় কার্যক্রমভুক্ত।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। ড্রাইভিং শেখার সময় দ্রুত গতিতে ছোট গাড়ি চলার সময় ‘হার্ড ব্রেক’ না করতে শেখানো হয়, এটা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। এখানে ত্বরণ-মন্দন, বেগ ও ভরের মধ্যে সম্পর্ক শেখানো হলো না অর্থাৎ তত্ত্ব শেখানো হলো না, এগুলো শিক্ষার বিষয়। তেমনি স্বল্পমেয়াদি শিক্ষক প্রশিক্ষণে প্রধানত কী পদ্ধতি ও কৌশলে শেখাবে বা শিখন সহায়তা প্রদান করবে তা হাতে-কলমে শেখানো হয়, তত্ত্ব-সূত্র শেখানো হয় না, শিক্ষা বিষয়ে এসবই শেখানো হয়।অতএব শিক্ষার পরিসর ব্যাপক, প্রশিক্ষণ শিক্ষার অন্যতম সোপান বা অংশ। শিক্ষক তৈরির বুনিয়াদি ব্যবস্থা অবশ্যই হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষক শিক্ষা। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই চাকরিকালীন স্বল্পমেয়াদি পৌনঃপুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বছরমেয়াদি বুনিয়াদি শিক্ষার মেয়াদ অপর্যাপ্ত মনে হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক থাকাকালীন এর মেয়াদ বৃদ্ধি করে দুই বছর করার একটি রূপরেখা তৈরি করে সরকারের বিবেচনার জন্য জমা দিই। মেয়াদ বৃদ্ধি করলে চাকরিকালীন অবস্থায় শিক্ষকদের বেশি সময় বিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে হবে। তাতে বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সরকারের খরচ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। এসব কারণে তা গ্রহণ করা হয়নি। পরে এমন একটি উপায় বের করলাম যাতে মেয়াদ কিছুটা বৃদ্ধি করা হলেও বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সরকারেরও খরচ বাড়বে না।

ডিপ-ইন-এড শিরোনামে দেড় বছরমেয়াদি একটি কার্যক্রমের রূপরেখা তৈরি করলাম, যেখানে এক বছর পিটিআইভিত্তিক কার্যক্রম চলবে এবং অবশিষ্ট ছয় মাস শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ (প্র্যাকটিসটিচিং) চলবে। সরকার এ প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। কাজকর্ম শুরু করার পর বিশ্বব্যাংক এবং ইউনিসেফ এ কার্যক্রমকে অধিকতর উন্নত করার জন্য বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হেলেনসহ একাধিক দেশি ও বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেয়। তারা আমার প্রস্তাবের ইন্টার্নশিপকে পরিবর্তন করে তাদের দেশের অনুকরণে এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোনো অবস্থাতেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা দেশীয় পরামর্শকের ওপর আস্থা না রেখে বিদেশি পরামর্শকদের মডেল অনুসারে ইন্টার্নশিপ চালু করে।

এর ফলে বর্তমানে ডিপ-ইন-এড কার্যক্রমের ইন্টার্নশিপ অংশের অবস্থা হ-য-ব-র-ল। কথায় আছে বাড়ির গরু আঙিনার ঘাস খায় না। সচরাচর দেখা যায়, অধিকাংশ নীতিনির্ধারক দেশীয় পরামর্শকদের চেয়ে বিদেশি পরামর্শকদের কথায় অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আমি এখনো দেড় বছরের ডিপ-ইন-এড কার্যক্রমের সমর্থক। একে পরিমার্জন করে ফলপ্রসূভাবে চালু করা যেতে পারে। মাথাব্যথা হলে মাথা না কেটে সঠিক চিকিৎসা করে সুস্থ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির মাধ্যমে যথোপযোগ্য মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে দুই বছরমেয়াদি শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হবে সর্বোত্তম ব্যবস্থা। তা না করা গেলে বর্তমান চালু দেড় বছরমেয়াদি ডিপ-ইন-এড কার্যক্রমকে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে চালু করলেও ভালো ফল পাওয়া যাবে। তাও যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে সুপরিকল্পিত বছরমেয়াদি কার্যক্রম সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমেও সুফল পাওয়া সম্ভব। নিম্নে বছরমেয়াদি শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রস্তাব আকারে তুলে ধরা হলো—

এক. কার্যক্রম ও ডিগ্রির নাম : প্রাথমিক শিক্ষায় স্নাতক।

দুই. কার্যক্রমের মেয়াদ : ১ (এক) বছর এক বছর তিনটি সমান টার্মে বিভক্ত থাকবে; প্রতি টার্মে ন্যূনতম ৯৫ কর্মদিবস থাকবে;

তিন. শিক্ষাক্রম অনুমোদন ও ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়;

চার. কার্যক্রমে ভর্তির যোগ্যতা : স্নাতক ডিগ্রি (এসএসসি থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত যে কোনো দুটি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগ / শ্রেণি বা সমমানের শিক্ষা সনদ।

পাঁচ. কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য : জ্ঞানজাগতিক এবং পেশাগত বিষয়ের সমন্বয়

ক) জ্ঞানজাগতিক বিষয় : বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয় তিনটি থেকে যে কোনো দুটি, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান থেকে একটি এবং ধর্মশিক্ষা (একটি ধর্ম) মোট চারটি বিষয় বাধ্যতামূলক। খ) পেশাগত বিষয় : শিক্ষা বিজ্ঞান (শিক্ষার আধুনিক পরিভাষা পরিচিতি, ধ্যানধারণা, শিক্ষার তত্ত্ব, সূত্র এবং ধারণা) শিক্ষণ শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল (অংশগ্রহণমূলক সক্রিয় পদ্ধতি ও কৌশলাদি) শিশু মনোবিজ্ঞান (শিশুর বৈশিষ্ট্য, মনোযোগ, শিখন মতবাদ থেকে সমগ্রতাবাদ, পিয়াজের কগনেটিভ ডেভেলপমেন্ট তত্ত্ব, গঠনবাদসহ সর্বাধুনিক মতবাদসমূহ শিশু পরিচর্যা ও বিনোদনমূলক শিক্ষা)।

শিক্ষায় মূল্যায়ন : (গঠনকালীন মূল্যায়ন ও নিরাময়মূলক সহায়তা, সামষ্টিক মূল্যায়ন, আবেগীয় ক্ষেত্রের মূল্যায়ন, বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করার কৌশল, বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল প্রশ্ন করার কৌশল

গ) ইন্টার্নশিপ : প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে তাত্ত্বিক (জ্ঞানজাগতিক ও পেশাগত) বিষয়গুলোর মূল্যায়নসহ শিক্ষাকার্যক্রম শেষ করতে হবে। তৃতীয় পর্বে হবে ইন্টার্নশিপ। তৃতীয় পর্বে ৯৫ কর্মদিবসের মধ্যে ৩০ দিন স্কুলে শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন। এর পর পাঁচ দিন কলেজে আসবেন, তখন তারা অর্জিত জ্ঞান-দক্ষতা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তা তুলে ধরবেন, শিক্ষক ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করবেন। পরবর্তী সময়ে ৩০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করবেন এবং ৫ দিন কলেজে। এভাবে তিনবারে ৯০ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ১৫ দিন কলেজে।

তৃতীয় পর্বে শিক্ষার্থীরা যতদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়বে তাদের শিক্ষকরাও পূর্ণকালীন নির্ধারিত প্রাথমিক অবস্থান করবেন, শ্রেণি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন, একান্তে পরামর্শ দেবেন, প্রয়োজনে ক্লাস নিয়ে দেখাবেন, বিদ্যালয়ে বসেই পাঠ পরিকল্পনা অনুমোদন করবেন। সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনা করাবেন। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের জন্য বছরমেয়াদি বিএড কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বিএড শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে বা অনুমোদন করে এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ই পরীক্ষা পরিচালনা করে এবং ডিগ্রি প্রদান করে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায়ও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। বিএড যেমন ওই শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় স্নাতক ডিগ্রি, এ ক্ষেত্রে বিপিএড ও শিক্ষার্থীদের একই মানের দ্বিতীয় স্নাতক ডিগ্রি হবে। এখানে একটি অসংগতির কথা উল্লেখ করতে হয়।

সাত-আট দশক আগে বর্তমান প্রচলিত বিএড ডিগ্রির নাম ছিল বিটি। দুনিয়াব্যাপী শিক্ষাকে জ্ঞানের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বিটি ডিগ্রির নাম পরিবর্তে বিএড ডিগ্রি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশেও কলেজের নাম পরিবর্তন করে ‘কলেজ অব এডুকেশন’ রাখা হয়। একইভাবে আমাদের দেশে কার্যক্রমের নাম ও ডিগ্রির নাম পরিবর্তন করে বিএড করা হয় কিন্তু কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়নি, টিটি কলেজই চলছে। প্রস্তাবিত কার্যক্রমটি একটি স্নাতক পর্যায়ের কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের শিক্ষাক্রম অনুমোদন করবে যে কোনো একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ডিগ্রিও প্রদান করবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়।

যেহেতু প্রস্তাবিত কার্যক্রমটি স্নাতক পর্যায়ের, তাই সবকটি পিটিআইকে কলেজ পর্যায়ে উন্নত করে এদের নাম ‘কলেজ অব প্রাইমারি এডুকেশন’ রাখা যুক্তিযুক্ত হবে। এসব কলেজের শিক্ষকদের পদসমূহ উন্নীত করে প্রভাষক, সরকারি অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ করা যায়। প্রভাষক হওয়ার জন্য পিটিআইর কোনো শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতায় ঘাটতি থাকলে তাদের ডেপুটেশনে প্রাথমিক শিক্ষায় এমএড গ্রহণের জন্য পাঠানো যেতে পারে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের পরিসর নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হয় বিধায় প্রস্তাবিত কার্যক্রমের রূপরেখায় অনেক কিছু যেমন শিক্ষক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিচালন পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি সংযোজন করা সম্ভব হলো না।

সবশেষে বলতেই হবে, ছয় মাসমেয়াদি বুনিয়াদি শিক্ষক শিক্ষা চালু করা হবে আত্মঘাতী; এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব জাতিকে দীর্ঘদিন ভোগ করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক (অব.) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়