সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যবস্থাপত্রে শিক্ষক মুক্তি

ড. এম এ মোমেন

২০ জুন ২০২২ দেশ রূপান্তর পত্রিকায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রাণহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাণের সঞ্চার করতে সবিনয়ে অনুরোধ করেছেন ‘রাজনীতিকরা কি শিক্ষকদের অব্যাহতি দেবেন!’ রাজনীতিবিদরা শিক্ষককে সম্মান যেমন করেছেন অসম্মানও তার চেয়ে কম করেননি, শিক্ষকরা নিজেদের অসম্মান করেছেন আরও বেশি। তার লেখা থেকে উদ্ধৃত : ‘আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দল সব পেশাতেই দলীয় বিভাজন নিয়ে এসেছেন, শিক্ষকতার পেশাকে যদি তারা অব্যাহতি দেন তবে জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’

অধ্যাপক চৌধুরী প্রকৃতপক্ষে তিনটি মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলেছেন : শিক্ষাকে দল-বাণিজ্যের গ্রাস থেকে মুক্ত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করা। শিক্ষার মূলধারাকে বেগবান ও শক্তিশালী করা। প্রত্যেকটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবায়নের কৌশলগত প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আমি কেবল প্রথম প্রতিপাদ্য শিক্ষাকে দল ও বাণিজ্যের গ্রাস থেকে মুক্ত করার অর্ধাংশ অর্থাৎ ‘দল’-এ আমার আলোচনা সীমিত রাখব। শিক্ষাকে দল এবং দলীয় নেতৃত্বের আছরমুক্ত করতে তিনি শুভ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যেন রাজনীতিকরা শিক্ষকদের অব্যাহতি দেন। এটাকে তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, পলিটিসাইজেশন থেকে শিক্ষকদের (এবং শিক্ষাকেও, সে আলোচনা না হয় বাদই যাক) অব্যাহতি দিতে হবে। আমি আমার মাঠভিত্তিক কর্মজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই রাজনীতিবিদরা শিক্ষকদের পলিটিসাইজ করেন না। শিক্ষকরা ‘পলিটিসাইজড’ হতে রাজনীতিবিদদের কাছে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের দরজায় অবিরাম করা নাড়তে থাকেন। শুধু শিক্ষকতা কেন, অন্য পেশার বেলায়ও তাই। কড়া নাড়া শুনেই তারা দরজা খোলেন না, বুজে-শুনে দর-কষাকষি করে অতঃপর দরজা খুলে থাকেন। রাজনীতিকীকরণের দায় কি রাজনীতিবিদদের নয়? একসময় এই প্রশ্নের উত্তরে আমি অবশ্যই জোর দিয়ে হ্যাঁ বলতাম, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ আমাকে সে অবস্থান থেকে সরিয়ে এনেছে।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের জমানায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এনএসএফ তৈরি হয়েছিল, এনএসএফ লালন করার মতো কজন শিক্ষকও নিজেদের প্রস্তুত এবং যোগ্য করে তুলেছিলেন। মোনায়েম খান উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে দলে দলে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তার ও তার দলের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে বলেননি। তবুও দেখা গেল অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বয়োজ্যেষ্ঠ একজন শিক্ষক ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে গিয়ে গভর্নরকে কদমবুসি করলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ যারা সামনে ছিলেন তারা বিব্রতবোধ করলেন। এই কাহিনী একটি ইংরেজি গ্রন্থে এবং একটি ইংরেজি পত্রিকায় পড়েছি। সেই শিক্ষকের এই কদমবুসির অর্থ কোনো রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রকাশ নয় বরং আপনি গভর্নর, আপনি মা-বাপ, আপনি চাইলেই তো আমাকে বদলি করে আপনার জেলায় নিয়ে আসতে পারেন। বিনিময়ে যদি আপনার কিছু হুকুম-আহকাম শুনতে হয়, না হয় শুনলাম। এ রকম কদমবুসি করা শিক্ষকের অভাব হয়নি সেকালেও। তাদের চাওয়াটা মূলত অরাজনৈতিক, পরিমাণেও সামান্য। আমি জাতীয় পার্টি আমল, বিএনপি আমল এবং আওয়ামী লীগ আমল এবং মাঝে দু-তিনবার তত্ত্বাবধায়ক আমলে সরকারি চাকরি করেছি এবং কাছে থেকেই মাঠের শিক্ষাব্যবস্থা দেখেছি, আমার সীমিত দায়িত্বে যতটা সম্ভব ভূমিকা রাখতেও চেষ্টা করেছি। কয়েকটি ছোট অভিজ্ঞতার কথা জানাতে চাই।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কেমন হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই দেখতে গিয়েছি। কলেজের প্রিন্সিপাল তার একটা বিজনেস কার্ড এগিয়ে দিলেন। তাতে বিএ (অনার্স), এমএর পর মুদ্রিত হয়েছে পিএইচডি (অ্যাডমিটেড)। স্বভাবতই কার্ডটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি করছেন? তিনি বললেন, এত তাড়াহুড়ো কীসের? বিষয় এখনো ঠিক করিনি। দেখি কিছু একটা নিয়ে করব। কিছু একটা নিয়ে পিএইচডি করবেন। ঠিক করেননি কিন্তু অ্যাডমিশন হয়ে গেছে এ কথা বিজনেস কার্ডে লিখেছেন। পরীক্ষায় নকল চলছে দেদার। দুজনকে বাড়াবাড়ি রকমের নকলে লিপ্ত দেখে এক্সপেল করাতে প্রিন্সিপাল ক্ষিপ্ত হলেন এবং বিড় বিড় করে বললেন, এর পরিণতি কি জানেন? দুজনের জন্য আমরা আগামী বছর দুশ ছাত্রছাত্রী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হব। তিনি বলেই চললেন, পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধাই যদি না পায় তাহলে এই কলেজে ভর্তি হবে কেন? এটা জানলে আমাদের এমপি সাহেব খুব অসন্তুষ্ট হবেন। অপর একটি কক্ষে পরীক্ষার্থীদের কাউকে এক্সপেল না করে বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন শিক্ষককে প্রত্যাহার করার কথা বলেছি। এবার প্রিন্সিপাল সাহেব বিড় বিড় করে না বলে সশব্দেই বললেন। এজন্যই কি আমরা একাত্তরে বুকের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি? খুবই কঠিন প্রশ্ন। বুকের রক্ত দিয়ে যারা দেশ স্বাধীন করেছেন, তাদের হাজার সালাম। দেশ কেন তারা স্বাধীন করছেন তার যদি লিখিত ও অলিখিত হাজারটা কারণের কথাও বলা থাকে এটা তো নিশ্চিত পরীক্ষায় নকলের সুবিধা দিতে নকলের সুবন্দোবস্ত করতে তারা দেশ স্বাধীন করবেন এ কথা কোথাও থাকবে না। অন্যায় কাজকে যৌক্তিকীকরণ করার জন্য স্বাধীনতার কথা বলব। বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার কথা বলব এ আমাদের কোন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।

গত শতকের একেবারে শেষ প্রান্তে আমি একটি উপকূলীয় জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। একজন ভাইস চ্যান্সেলর এলেন। আমাদের যৌক্তিক জ্ঞানবুদ্ধি খাটিয়েই তাকে সার্কিট হাউজের এক নম্বর ভিআইপি রুমে ওঠালাম। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পূর্বপরিচয় ছিল। পরদিন বেলা ১১টার দিকে সার্কিট হাউজের একজন কর্মচারী আমাকে ফোনে জানালেন, অবস্থা খারাপ। একজন এমপি সাহেব এসে এক নম্বর ভিআইপি রুমের দরজায় দমাদম লাথি মারছেন। আমি জানতে চাই, ভিসি স্যার কোথায়? জবাব পাই, স্যার ভেতরেই আছেন। আমি দ্রুত সার্কিট হাউজে আসি, ততক্ষণে এমপি সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং বেরোতে বেরোতে আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন, এমপি বড় না ভিসি বড়? বললাম, খুবই কঠিন প্রশ্ন। আমার কাছে আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আরও বেশি বড়। এমপি সাহেব যে দলের সদস্য সে দলের সরকারই ভিসি সাহেবকে নিয়োগ দিয়েছেন। ভিসি সাহেবও সেই দল-ভাবাপন্ন এমন কথাও প্রচলিত ছিল। তার পরও তিনি রেহাই পেলেন না। আমি তার সঙ্গে দেখা করে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করলাম যে আমরা তার সার্কিট হাউজে অবস্থান নিরাপদ ও নিরুপদ্রব রাখতে পারলাম না। অতি বিনয়ী ভিসি সাহেব ততক্ষণে জেনে গেছেন কার পদাঘাত তার দরজায় পড়েছে। তিনি দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন, বললেন, এমপি সাহেব আমার কিংবা আমার মতো কোনো না কোনো শিক্ষকেরই ছাত্র। আমরাই শেখাতে পারিনি কিংবা ভুল শিখিয়েছি। মনে করার কিছুই নেই, দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ঘাড় ধরে তো আর বের করে দেননি। চিন্তা করো না, সামনে মাস্টারদের আরও খারাপ সময় দেখতে পাচ্ছি।

হালে একজন অধ্যক্ষ এমপির কিল-ঘুষি খেয়ে কান্নাকাটি করেছেন, এ ঘটনার ভিডিও ক্লিপ দেখেননি এমন মানুষ দুর্লভ হওয়ার কথা। সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে অধ্যক্ষ জানালেন, ও কিছু না। আমাদের নিজেদের মধ্যে একটু ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। আমাদের মানে আমার আর মাননীয় এমপির মধ্যে নয়, মানে আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে। সপ্তাহ না গড়াতেই অধ্যক্ষ বলেছেন, প্রশ্নই আসে না, আমার আর মাননীয় এমপির মধ্যে কিছুই হয়নি, তিনি আমাকে কিছুই করেননি। এমপি মারপিট করবেন এটা কারও চাওয়া নয়, যিনি মার খান তার তো নয়ই। কিন্তু মার খেয়েও যদি তাকে বলতে হয়, কই না তো? কে কাকে মেরেছে কে জানেতাহলে বুঝতে হবে সংকট আরও গভীরে। আর তা হচ্ছে অস্তিত্বের সংকট।

গাজীপুরের একটি কলেজের ছবি সম্প্রতি খবরের কাগজে এসেছে, দূর থেকে কেন কাছে এসেও অজস্র পোস্টারে আবৃত ভবনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না নির্বাচনের অতিকায় বুথ বোঝার উপায় নেই। শত কেলেঙ্কারির নায়ক ভিসিদের কি কোনো প্রধানমন্ত্রী, কোনো মন্ত্রী ডেকে তাদের দলে যোগ দিতে বলেছেন? বাধ্য করেছেন? করেননি। সে ক্ষেত্রে ভিসি পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে ইঁদুর-দৌড় শুরু হয়ে যায়। কে আগে পৌঁছাবেন, চাটুকারবৃত্তিতে কে কাকে হারাবেন? বরং আমি এভাবে বলব এটাই রাজনীতিবিদদের সাফল্য যে চাটুকারিতার রাজনৈতিক অর্থনীতি যে গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষকদের মধ্যে তারা সেই সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের হাতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের কিংবা বন্ধ করে দেওয়ার কন্ট্রোল মেকানিজম থাকে, তার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। শিক্ষকদের মধ্যে যারা লেজুড়বৃত্তি করতে চান না শুধুই শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চান তাদের মৌনতাকে তাদেরই দলনকর সহকর্মীরা বিরোধিতা হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে তুলে ধরেন। পড়াশোনা যতটাই করুন ভিসির চেয়ারের পেছনে বুকশেলফ থাকবে, স্টিল ছবি, পেছনের বইগুলো তার বইপত্রের প্রতি আগ্রহ ও বিদ্যার অনুরাগ প্রকাশ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকেই লক্ষ করেছেন ক্যামেরা বরাবর পেছন দিকটাতে নেতা-নেত্রীর বড় ছবি স্থাপন করা থাকে। তারা ধরে নেন এটা তাদের আনুগত্য প্রকাশের একটা কৌশল। তারা জানেন না যে তাদের এসব ছবি কিংবা সাক্ষাৎকারের ভিডিও নেতা-নেত্রীরা দেখেন না, যদিবা দেখেন তাদের এই ছবি দেখানোর মাজেজানিগূঢ় কারণ তারা আরও ভালো জানেন।

টিভি ভার্কের ‘দ্য ভাইস চ্যান্সেলর’ যারা পড়েছেন তারা জানেন হাই-রেঞ্জ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরের শূন্যপদ পূরণের জন্য যে ১৩ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তাদের মধ্যে একজন শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি শিক্ষক। প্রার্থীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাবেক আমলা আছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন প্রার্থীও আছেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষক অবশ্যই একটু সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তিনি শিক্ষক ছিলেন এ কারণে নয়, বরং ছাত্রনেতা হিসেবে আগামীদিনের শিক্ষামন্ত্রী এই অধ্যাপককে বেদম পিটিয়েছিলেন সে কারণে। যখন এ ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, যখন তদন্ত কমিটি প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে এগিয়ে আসে অধ্যাপক বললেন, না তো কিছুই হয়নি। আমাকে মারার প্রশ্নই আসে না। ছাত্র হয়ে শিক্ষককে মারার মতো বেয়াদব সে নয়। সুতরাং পুরো বিষয়টিই চাপা পড়ে যায়। অধ্যাপক ভাবেন, কত শিক্ষকই মন্ত্রীর জীবনে এসেছেন কিন্তু আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে তিনি অনুগ্রহ করে পেটাননি। কাজেই আমার কথা তার মনে থাকবেই। এটিই তার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট। এক ভোরে তিনি এই প্লাস পয়েন্টের সুখস্মৃতি নিয়ে মন্ত্রীর বাসায় হাজির হলেন। মন্ত্রীর কন্যাশিশু হাসতে হাসতে তাকে বললেন, তুমি গাধা হও, আমি তোমার পিঠে উঠব। তিনি হাঁটু ও হাতে ভর দিয়ে গাধা হলেন। মন্ত্রী যখন অবাক হয়ে বললেন, স্যার এত ভোরে আপনি! তার অন্তর বিগলিত হয়ে গেল। দেশের শিক্ষামন্ত্রী তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করেছেন। তিনি তার আগমনের কারণটা জানালেনহাই-রেঞ্জ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হতে চান। শিক্ষামন্ত্রী কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই বললেন, স্যার আমি আপনার কাছে ঋণী। অধ্যাপক বুঝে নিলেন তদন্ত কমিটির কাছে মিথ্যে বলার সুফলটা তিনি তাহলে পেতে যাচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী আশ^াস দিলেন যত বড় তদবিরই থাকুক, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ক্যান্ডিডেটও যদি থাকেন, আপনি যদি আমার কথামতো কাজ করেন, তাহলে আপনিই নেক্সট ভাইস চ্যান্সেলর। এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। স্বপ্নটা সফল হলো। কিন্তু প্রিয় ছাত্রের আদেশ শুনতে শুনতে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। মন্ত্রী তাকে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলে গাল দিলেন। ভিসির কথা : তিনি যতবার আমাকে ‘স্যার’ বলেছেন, আমি ততবার কুঁচকে উঠছি। শব্দটি কাবাবের মাংসে শিক ঢোকানোর মতো আমার হৃৎপি-ে বিঁধছে। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন বরখাস্ত হলেন, অনুভব করলেন মুখের ওপর এসে পড়েছে ভয়ংকর এক ঘুষি, যে ঘুষি তিনি আগেও একবার খেয়েছিলেন।

ব্যাপারটা তাই, একটা বড় ধরনের ‘প্যারাডাইম শিফট’ ঘটে গেছে। রাজনীতিবিদরা তো শিক্ষকদের ধরছেন না, কীসের তবে অব্যাহতি। বরং চলুন, শিক্ষকদের বলি, দয়া করে রাজনীতিবিদদের অব্যাহতি দিন। অন্য এক পর্বে প্যারাডাইম শিফট নিয়ে বিস্তারিত লেখা যাবে।

পাদটীকা : ১৯৬৫ সালে ঢাকা শহরের রাজাবাজার রোটারি প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার জীবনের প্রথম চিঠিটি পাই। পত্রলেখক আমারই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ‘ছোটদের বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’ গ্রন্থের লেখক আসগর আলী স্যার। চিঠির প্রথম পঙ্ক্তি ছিল ‘আশা করি খোদার ফজলে ভালো আছ।’ এবং শেষ পঙ্ক্তি ‘পত্রের সহিত পাঠানো পোস্টকার্ডে কুশলাদি জানাইবা।’ রমজানের ছুটিতে তিনি তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। অনেক পরে বুঝতে পারি গাঁটের পয়সা খরচ করে একজন শিশুছাত্রকে চিঠি লেখা, চিঠি পোস্ট করা শেখানোটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। এখন যদি আমাকে সেই চিঠির জবাব লিখতে হতো, লিখতাম, শ্রদ্ধেয় স্যার, আপনি ভাগ্যবান অর্ধশতক আগে প্রয়াত হয়েছেন। দেশজুড়ে শিক্ষকদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং বাধ্য হওয়া স্খলন আপনাকে দেখে যেতে হয়নি। আপনি কষ্ট পাওয়া থেকে বেঁচে গেছেন।

লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যবস্থাপত্রে শিক্ষক মুক্তি

ড. এম এ মোমেন

২০ জুন ২০২২ দেশ রূপান্তর পত্রিকায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রাণহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাণের সঞ্চার করতে সবিনয়ে অনুরোধ করেছেন ‘রাজনীতিকরা কি শিক্ষকদের অব্যাহতি দেবেন!’ রাজনীতিবিদরা শিক্ষককে সম্মান যেমন করেছেন অসম্মানও তার চেয়ে কম করেননি, শিক্ষকরা নিজেদের অসম্মান করেছেন আরও বেশি। তার লেখা থেকে উদ্ধৃত : ‘আমাদের বড় দুই রাজনৈতিক দল সব পেশাতেই দলীয় বিভাজন নিয়ে এসেছেন, শিক্ষকতার পেশাকে যদি তারা অব্যাহতি দেন তবে জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’

অধ্যাপক চৌধুরী প্রকৃতপক্ষে তিনটি মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলেছেন : শিক্ষাকে দল-বাণিজ্যের গ্রাস থেকে মুক্ত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করা। শিক্ষার মূলধারাকে বেগবান ও শক্তিশালী করা। প্রত্যেকটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবায়নের কৌশলগত প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আমি কেবল প্রথম প্রতিপাদ্য শিক্ষাকে দল ও বাণিজ্যের গ্রাস থেকে মুক্ত করার অর্ধাংশ অর্থাৎ ‘দল’-এ আমার আলোচনা সীমিত রাখব। শিক্ষাকে দল এবং দলীয় নেতৃত্বের আছরমুক্ত করতে তিনি শুভ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যেন রাজনীতিকরা শিক্ষকদের অব্যাহতি দেন। এটাকে তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, পলিটিসাইজেশন থেকে শিক্ষকদের (এবং শিক্ষাকেও, সে আলোচনা না হয় বাদই যাক) অব্যাহতি দিতে হবে। আমি আমার মাঠভিত্তিক কর্মজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই রাজনীতিবিদরা শিক্ষকদের পলিটিসাইজ করেন না। শিক্ষকরা ‘পলিটিসাইজড’ হতে রাজনীতিবিদদের কাছে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের দরজায় অবিরাম করা নাড়তে থাকেন। শুধু শিক্ষকতা কেন, অন্য পেশার বেলায়ও তাই। কড়া নাড়া শুনেই তারা দরজা খোলেন না, বুজে-শুনে দর-কষাকষি করে অতঃপর দরজা খুলে থাকেন। রাজনীতিকীকরণের দায় কি রাজনীতিবিদদের নয়? একসময় এই প্রশ্নের উত্তরে আমি অবশ্যই জোর দিয়ে হ্যাঁ বলতাম, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ আমাকে সে অবস্থান থেকে সরিয়ে এনেছে।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের জমানায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এনএসএফ তৈরি হয়েছিল, এনএসএফ লালন করার মতো কজন শিক্ষকও নিজেদের প্রস্তুত এবং যোগ্য করে তুলেছিলেন। মোনায়েম খান উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে দলে দলে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তার ও তার দলের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে বলেননি। তবুও দেখা গেল অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বয়োজ্যেষ্ঠ একজন শিক্ষক ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে গিয়ে গভর্নরকে কদমবুসি করলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ যারা সামনে ছিলেন তারা বিব্রতবোধ করলেন। এই কাহিনী একটি ইংরেজি গ্রন্থে এবং একটি ইংরেজি পত্রিকায় পড়েছি। সেই শিক্ষকের এই কদমবুসির অর্থ কোনো রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রকাশ নয় বরং আপনি গভর্নর, আপনি মা-বাপ, আপনি চাইলেই তো আমাকে বদলি করে আপনার জেলায় নিয়ে আসতে পারেন। বিনিময়ে যদি আপনার কিছু হুকুম-আহকাম শুনতে হয়, না হয় শুনলাম। এ রকম কদমবুসি করা শিক্ষকের অভাব হয়নি সেকালেও। তাদের চাওয়াটা মূলত অরাজনৈতিক, পরিমাণেও সামান্য। আমি জাতীয় পার্টি আমল, বিএনপি আমল এবং আওয়ামী লীগ আমল এবং মাঝে দু-তিনবার তত্ত্বাবধায়ক আমলে সরকারি চাকরি করেছি এবং কাছে থেকেই মাঠের শিক্ষাব্যবস্থা দেখেছি, আমার সীমিত দায়িত্বে যতটা সম্ভব ভূমিকা রাখতেও চেষ্টা করেছি। কয়েকটি ছোট অভিজ্ঞতার কথা জানাতে চাই।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কেমন হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই দেখতে গিয়েছি। কলেজের প্রিন্সিপাল তার একটা বিজনেস কার্ড এগিয়ে দিলেন। তাতে বিএ (অনার্স), এমএর পর মুদ্রিত হয়েছে পিএইচডি (অ্যাডমিটেড)। স্বভাবতই কার্ডটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি করছেন? তিনি বললেন, এত তাড়াহুড়ো কীসের? বিষয় এখনো ঠিক করিনি। দেখি কিছু একটা নিয়ে করব। কিছু একটা নিয়ে পিএইচডি করবেন। ঠিক করেননি কিন্তু অ্যাডমিশন হয়ে গেছে এ কথা বিজনেস কার্ডে লিখেছেন। পরীক্ষায় নকল চলছে দেদার। দুজনকে বাড়াবাড়ি রকমের নকলে লিপ্ত দেখে এক্সপেল করাতে প্রিন্সিপাল ক্ষিপ্ত হলেন এবং বিড় বিড় করে বললেন, এর পরিণতি কি জানেন? দুজনের জন্য আমরা আগামী বছর দুশ ছাত্রছাত্রী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হব। তিনি বলেই চললেন, পরীক্ষা দেওয়ার সুবিধাই যদি না পায় তাহলে এই কলেজে ভর্তি হবে কেন? এটা জানলে আমাদের এমপি সাহেব খুব অসন্তুষ্ট হবেন। অপর একটি কক্ষে পরীক্ষার্থীদের কাউকে এক্সপেল না করে বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন শিক্ষককে প্রত্যাহার করার কথা বলেছি। এবার প্রিন্সিপাল সাহেব বিড় বিড় করে না বলে সশব্দেই বললেন। এজন্যই কি আমরা একাত্তরে বুকের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি? খুবই কঠিন প্রশ্ন। বুকের রক্ত দিয়ে যারা দেশ স্বাধীন করেছেন, তাদের হাজার সালাম। দেশ কেন তারা স্বাধীন করছেন তার যদি লিখিত ও অলিখিত হাজারটা কারণের কথাও বলা থাকে এটা তো নিশ্চিত পরীক্ষায় নকলের সুবিধা দিতে নকলের সুবন্দোবস্ত করতে তারা দেশ স্বাধীন করবেন এ কথা কোথাও থাকবে না। অন্যায় কাজকে যৌক্তিকীকরণ করার জন্য স্বাধীনতার কথা বলব। বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার কথা বলব এ আমাদের কোন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।

গত শতকের একেবারে শেষ প্রান্তে আমি একটি উপকূলীয় জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। একজন ভাইস চ্যান্সেলর এলেন। আমাদের যৌক্তিক জ্ঞানবুদ্ধি খাটিয়েই তাকে সার্কিট হাউজের এক নম্বর ভিআইপি রুমে ওঠালাম। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পূর্বপরিচয় ছিল। পরদিন বেলা ১১টার দিকে সার্কিট হাউজের একজন কর্মচারী আমাকে ফোনে জানালেন, অবস্থা খারাপ। একজন এমপি সাহেব এসে এক নম্বর ভিআইপি রুমের দরজায় দমাদম লাথি মারছেন। আমি জানতে চাই, ভিসি স্যার কোথায়? জবাব পাই, স্যার ভেতরেই আছেন। আমি দ্রুত সার্কিট হাউজে আসি, ততক্ষণে এমপি সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং বেরোতে বেরোতে আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন, এমপি বড় না ভিসি বড়? বললাম, খুবই কঠিন প্রশ্ন। আমার কাছে আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আরও বেশি বড়। এমপি সাহেব যে দলের সদস্য সে দলের সরকারই ভিসি সাহেবকে নিয়োগ দিয়েছেন। ভিসি সাহেবও সেই দল-ভাবাপন্ন এমন কথাও প্রচলিত ছিল। তার পরও তিনি রেহাই পেলেন না। আমি তার সঙ্গে দেখা করে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করলাম যে আমরা তার সার্কিট হাউজে অবস্থান নিরাপদ ও নিরুপদ্রব রাখতে পারলাম না। অতি বিনয়ী ভিসি সাহেব ততক্ষণে জেনে গেছেন কার পদাঘাত তার দরজায় পড়েছে। তিনি দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন, বললেন, এমপি সাহেব আমার কিংবা আমার মতো কোনো না কোনো শিক্ষকেরই ছাত্র। আমরাই শেখাতে পারিনি কিংবা ভুল শিখিয়েছি। মনে করার কিছুই নেই, দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ঘাড় ধরে তো আর বের করে দেননি। চিন্তা করো না, সামনে মাস্টারদের আরও খারাপ সময় দেখতে পাচ্ছি।

হালে একজন অধ্যক্ষ এমপির কিল-ঘুষি খেয়ে কান্নাকাটি করেছেন, এ ঘটনার ভিডিও ক্লিপ দেখেননি এমন মানুষ দুর্লভ হওয়ার কথা। সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে অধ্যক্ষ জানালেন, ও কিছু না। আমাদের নিজেদের মধ্যে একটু ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। আমাদের মানে আমার আর মাননীয় এমপির মধ্যে নয়, মানে আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে। সপ্তাহ না গড়াতেই অধ্যক্ষ বলেছেন, প্রশ্নই আসে না, আমার আর মাননীয় এমপির মধ্যে কিছুই হয়নি, তিনি আমাকে কিছুই করেননি। এমপি মারপিট করবেন এটা কারও চাওয়া নয়, যিনি মার খান তার তো নয়ই। কিন্তু মার খেয়েও যদি তাকে বলতে হয়, কই না তো? কে কাকে মেরেছে কে জানেতাহলে বুঝতে হবে সংকট আরও গভীরে। আর তা হচ্ছে অস্তিত্বের সংকট।

গাজীপুরের একটি কলেজের ছবি সম্প্রতি খবরের কাগজে এসেছে, দূর থেকে কেন কাছে এসেও অজস্র পোস্টারে আবৃত ভবনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না নির্বাচনের অতিকায় বুথ বোঝার উপায় নেই। শত কেলেঙ্কারির নায়ক ভিসিদের কি কোনো প্রধানমন্ত্রী, কোনো মন্ত্রী ডেকে তাদের দলে যোগ দিতে বলেছেন? বাধ্য করেছেন? করেননি। সে ক্ষেত্রে ভিসি পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে ইঁদুর-দৌড় শুরু হয়ে যায়। কে আগে পৌঁছাবেন, চাটুকারবৃত্তিতে কে কাকে হারাবেন? বরং আমি এভাবে বলব এটাই রাজনীতিবিদদের সাফল্য যে চাটুকারিতার রাজনৈতিক অর্থনীতি যে গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষকদের মধ্যে তারা সেই সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের হাতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের কিংবা বন্ধ করে দেওয়ার কন্ট্রোল মেকানিজম থাকে, তার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। শিক্ষকদের মধ্যে যারা লেজুড়বৃত্তি করতে চান না শুধুই শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চান তাদের মৌনতাকে তাদেরই দলনকর সহকর্মীরা বিরোধিতা হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে তুলে ধরেন। পড়াশোনা যতটাই করুন ভিসির চেয়ারের পেছনে বুকশেলফ থাকবে, স্টিল ছবি, পেছনের বইগুলো তার বইপত্রের প্রতি আগ্রহ ও বিদ্যার অনুরাগ প্রকাশ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকেই লক্ষ করেছেন ক্যামেরা বরাবর পেছন দিকটাতে নেতা-নেত্রীর বড় ছবি স্থাপন করা থাকে। তারা ধরে নেন এটা তাদের আনুগত্য প্রকাশের একটা কৌশল। তারা জানেন না যে তাদের এসব ছবি কিংবা সাক্ষাৎকারের ভিডিও নেতা-নেত্রীরা দেখেন না, যদিবা দেখেন তাদের এই ছবি দেখানোর মাজেজানিগূঢ় কারণ তারা আরও ভালো জানেন।

টিভি ভার্কের ‘দ্য ভাইস চ্যান্সেলর’ যারা পড়েছেন তারা জানেন হাই-রেঞ্জ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরের শূন্যপদ পূরণের জন্য যে ১৩ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তাদের মধ্যে একজন শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি শিক্ষক। প্রার্থীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাবেক আমলা আছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন প্রার্থীও আছেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষক অবশ্যই একটু সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তিনি শিক্ষক ছিলেন এ কারণে নয়, বরং ছাত্রনেতা হিসেবে আগামীদিনের শিক্ষামন্ত্রী এই অধ্যাপককে বেদম পিটিয়েছিলেন সে কারণে। যখন এ ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, যখন তদন্ত কমিটি প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে এগিয়ে আসে অধ্যাপক বললেন, না তো কিছুই হয়নি। আমাকে মারার প্রশ্নই আসে না। ছাত্র হয়ে শিক্ষককে মারার মতো বেয়াদব সে নয়। সুতরাং পুরো বিষয়টিই চাপা পড়ে যায়। অধ্যাপক ভাবেন, কত শিক্ষকই মন্ত্রীর জীবনে এসেছেন কিন্তু আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে তিনি অনুগ্রহ করে পেটাননি। কাজেই আমার কথা তার মনে থাকবেই। এটিই তার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট। এক ভোরে তিনি এই প্লাস পয়েন্টের সুখস্মৃতি নিয়ে মন্ত্রীর বাসায় হাজির হলেন। মন্ত্রীর কন্যাশিশু হাসতে হাসতে তাকে বললেন, তুমি গাধা হও, আমি তোমার পিঠে উঠব। তিনি হাঁটু ও হাতে ভর দিয়ে গাধা হলেন। মন্ত্রী যখন অবাক হয়ে বললেন, স্যার এত ভোরে আপনি! তার অন্তর বিগলিত হয়ে গেল। দেশের শিক্ষামন্ত্রী তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করেছেন। তিনি তার আগমনের কারণটা জানালেনহাই-রেঞ্জ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হতে চান। শিক্ষামন্ত্রী কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই বললেন, স্যার আমি আপনার কাছে ঋণী। অধ্যাপক বুঝে নিলেন তদন্ত কমিটির কাছে মিথ্যে বলার সুফলটা তিনি তাহলে পেতে যাচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী আশ^াস দিলেন যত বড় তদবিরই থাকুক, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ক্যান্ডিডেটও যদি থাকেন, আপনি যদি আমার কথামতো কাজ করেন, তাহলে আপনিই নেক্সট ভাইস চ্যান্সেলর। এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। স্বপ্নটা সফল হলো। কিন্তু প্রিয় ছাত্রের আদেশ শুনতে শুনতে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। মন্ত্রী তাকে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলে গাল দিলেন। ভিসির কথা : তিনি যতবার আমাকে ‘স্যার’ বলেছেন, আমি ততবার কুঁচকে উঠছি। শব্দটি কাবাবের মাংসে শিক ঢোকানোর মতো আমার হৃৎপি-ে বিঁধছে। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন বরখাস্ত হলেন, অনুভব করলেন মুখের ওপর এসে পড়েছে ভয়ংকর এক ঘুষি, যে ঘুষি তিনি আগেও একবার খেয়েছিলেন।

ব্যাপারটা তাই, একটা বড় ধরনের ‘প্যারাডাইম শিফট’ ঘটে গেছে। রাজনীতিবিদরা তো শিক্ষকদের ধরছেন না, কীসের তবে অব্যাহতি। বরং চলুন, শিক্ষকদের বলি, দয়া করে রাজনীতিবিদদের অব্যাহতি দিন। অন্য এক পর্বে প্যারাডাইম শিফট নিয়ে বিস্তারিত লেখা যাবে।

পাদটীকা : ১৯৬৫ সালে ঢাকা শহরের রাজাবাজার রোটারি প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার জীবনের প্রথম চিঠিটি পাই। পত্রলেখক আমারই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ‘ছোটদের বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’ গ্রন্থের লেখক আসগর আলী স্যার। চিঠির প্রথম পঙ্ক্তি ছিল ‘আশা করি খোদার ফজলে ভালো আছ।’ এবং শেষ পঙ্ক্তি ‘পত্রের সহিত পাঠানো পোস্টকার্ডে কুশলাদি জানাইবা।’ রমজানের ছুটিতে তিনি তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। অনেক পরে বুঝতে পারি গাঁটের পয়সা খরচ করে একজন শিশুছাত্রকে চিঠি লেখা, চিঠি পোস্ট করা শেখানোটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। এখন যদি আমাকে সেই চিঠির জবাব লিখতে হতো, লিখতাম, শ্রদ্ধেয় স্যার, আপনি ভাগ্যবান অর্ধশতক আগে প্রয়াত হয়েছেন। দেশজুড়ে শিক্ষকদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং বাধ্য হওয়া স্খলন আপনাকে দেখে যেতে হয়নি। আপনি কষ্ট পাওয়া থেকে বেঁচে গেছেন।

লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট