সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরি
মেহেদি রাসেল

বাংলাদেশে টিকে থাকতে হলে একটু ‘কায়দা করে’ চলতে হয়। সোজা পথে না চলে কিছুটা বাঁকা রাস্তায় যাওয়াই যেন এখানকার রীতি। এখানে নৈতিকভাবে ভালো লোকদের বলা হয় ‘সহজ-সরল’। এই বলার মধ্যে আবার একটুখানি প্রচ্ছন্ন দরদ থাকে। সৎ লোকদের প্রতি দরদ না দেখিয়েও উপায় নেই, কেননা এরা পদে পদে বিপদে পড়েন। বেশিরভাগ সরকারি অফিসে বৈধ এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোনো কাজ করাতে চাইলে যে কাজটার জন্য যে সময় লাগে সেই একই কাজে যখন অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়, তার অর্ধেক সময় লাগে। অনিয়ম যখন সমস্ত ব্যবস্থাকে গ্রাস করে তখন শিক্ষাব্যবস্থাও এর বাইরে যেতে পারে না। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে এর শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করলেই চলে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি দূরে থাক, এসব শিক্ষার্থী পাস নম্বরও পাচ্ছে না। অর্থাৎ, ধরে নিতে হবে গলদটা গোড়ায়। প্রায় শতভাগ পাস আসলে কতটা সংখ্যাগত আর কতটুকু গুণগত সেটা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। সময় এসেছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই প্রশ্ন করার। নানা সময়ে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে পরীক্ষার খাতা যারা দেখেন তাদের প্রতি এক ধরনের মৌখিক নির্দেশনা আছে শিক্ষার্থীদের যেন ফেল করানো না হয়। নির্দেশনা যেহেতু মৌখিক, তাই এ অভিযোগ প্রমাণ করা শক্ত। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই যে ‘পাস করা’ শিক্ষার্থীদের ঘটে তেমন বিদ্যাবুদ্ধি নেই তার প্রমাণও তো নেহাত কম নয়।
অনেকদিন ধরে ‘সৃজনশীল’ নামক এক ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি বাংলাদেশে চলমান। নামে সৃজনশীল হলেও এটা আসলে প্রকৃত অর্থে সৃজনশীল নয়। প্রশ্নপত্রে আসা ‘উদ্দীপক’ নামক কয়েক লাইনের রচনার সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে থাকা কোনো একটি গদ্যের তুলনামূলক বিচার ছাড়া ‘সৃজনশীল’ শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। তা ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষকরা কতটুকু বোঝেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফলে পাঠদানে রয়ে যাচ্ছে প্রচুর খামতি। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা আবার মুখস্ত করছে ‘সহায়ক’ বই। গাইড বই বন্ধ হয়েছে বেশ আগে। কিন্তু ঠিকই ‘কায়দা করে’ চলছে এসব ‘সহায়ক বই’। শুধু নামেই আলাদা।
সম্প্রতি এইচএসসির প্রশ্নপত্রের কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে কথা উঠেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা। প্রশ্নপত্রে কমপক্ষে তিনটি সমালোচনাযোগ্য উপাদান ছিল। ৬ নভেম্বর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা-২য় প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্ন ছিল এমন ‘প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনিসুল হক লেখালিখি করে সুনাম অর্জন করতে চান। ২১শে বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে আনিসুল হক বই প্রকাশ করেন। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।’ এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে, (ক) ‘যশ’ শব্দের অর্থ কী? (খ) ‘লেখা ভালো হইলে সুনাম আপনি আসিবে।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো। (গ) আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ, তা ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার আলোকে ব্যাখ্যা করো। (ঘ) সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনায় লেখকের পরামর্শ বিশ্লেষণ করো। এই প্রশ্নে প্রথম মূল সমস্যা হলো ব্যক্তি আক্রমণ এবং বিদ্বেষ ছড়ানো। আনিসুল হক লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফলে প্রশ্নকর্তা না জেনেই আনিসুল হকের নাম নিয়েছেন সেটা ভাবার অবকাশ নেই। এ রকম একটা পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে তাকে হেয় করা অত্যন্ত নিম্নরুচির কাজ। তাছাড়া উদ্দীপকের প্রথম বাক্যটিও ভুল। যিনি ‘প্রখ্যাত’ সাহিত্যিক তিনি কেন ‘সুনাম’ অর্জন করতে চাইবেন! প্রখ্যাত মানেই তো যিনি ইতিমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার মতো দায়িত্বশীল লোকজন ভুল বাক্য লিখবেন এটাও মেনে নেওয়া মুশকিল। আরেকটি প্রশ্নে ছড়ানো হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। সেখানকার উদ্দীপকে বলা হয়েছে ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ- বণ্টন মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামের এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমি এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’
সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ও সংকট নিয়ে যখন বাংলাদেশে বহুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তখন এমন প্রশ্ন এইচএসসির শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে সেটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। উল্টোদিকে দেশে অনেক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত আছে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় গিয়ে দেখেছি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান রেখে সেখানকার বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয় না। অথচ প্রশ্নের উদ্দীপকটিতে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাড়াবাড়ি রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যই উদ্দীপকটি অস্বস্তিকর। দায়িত্ববোধ ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব থাকলেই কেবল এমন প্রশ্ন করা সম্ভব। আরেকটি উদ্দীপকে বলা হয়‘ফারজানা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন কলেজ শিক্ষিকা। অনেক আগেই বিয়ের বয়স পেরিয়েছেনতাই তিনি বিয়ে করেননি। ছাত্রজীবনে তিনি ভালোবেসেছিলেন ব্যক্তিত্বহীন একজনকে। কারণ বাবা-মার যৌতুকের চাপের মুখে সে ফারজানাকে বিয়ের কথা অস্বীকৃতি জানায়। এরপর থেকে ফারজানা তার কলেজ আর একাকিত্ব জীবন কাটায়।’ উদ্দীপকটিতে সংবেদনশীলতার লেশমাত্র নেই। নারীশিক্ষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে স্পষ্ট। আলোচ্য তিনটি উদ্দীপকই রচনা হিসেবে খুব নিম্নমানের তো বটেই, এসবের অভিঘাত সম্পর্কেও প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা সচেতন নন।
সৃজনশীল প্রশ্ন নামে বাংলাদেশে যা চালু আছে তাতে কোনো প্রকার সৃজনশীলতা শেখানো সম্ভব না। সত্যিকার অর্থে যদি সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হয় তাহলে যেসব দেশে সৃজনশীল শিক্ষা চালু আছে সেখান থেকে পদ্ধতি দেখে-শুনে-বুঝে প্রথমে আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রকৃত বিদ্বান মানুষদের যুক্ত করতে হবে এসব কাজের সঙ্গে। তারপর ভাবতে হবে এটি চালু করার কথা। গোঁজামিল দেওয়া নামসর্বস্ব শিক্ষাপদ্ধতিকে সৃজনশীল নামে চালিয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়।
বাংলাদেশে যেহেতু ‘কায়দা করে’ অনেক কিছু হওয়া সম্ভব, শিক্ষকতার চাকরিও এর ব্যতিক্রম নয়। সবাই জানে সরকারি চাকরি পেতে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়। মেধাহীন মানুষদের শিক্ষকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় বসালে তার খেসারত পুরো জাতিকেই দিতে হবে। আমরা, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা অন্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করি, কিন্তু তাতে প্রলয় বন্ধ হয় না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরি
মেহেদি রাসেল

বাংলাদেশে টিকে থাকতে হলে একটু ‘কায়দা করে’ চলতে হয়। সোজা পথে না চলে কিছুটা বাঁকা রাস্তায় যাওয়াই যেন এখানকার রীতি। এখানে নৈতিকভাবে ভালো লোকদের বলা হয় ‘সহজ-সরল’। এই বলার মধ্যে আবার একটুখানি প্রচ্ছন্ন দরদ থাকে। সৎ লোকদের প্রতি দরদ না দেখিয়েও উপায় নেই, কেননা এরা পদে পদে বিপদে পড়েন। বেশিরভাগ সরকারি অফিসে বৈধ এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোনো কাজ করাতে চাইলে যে কাজটার জন্য যে সময় লাগে সেই একই কাজে যখন অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়, তার অর্ধেক সময় লাগে। অনিয়ম যখন সমস্ত ব্যবস্থাকে গ্রাস করে তখন শিক্ষাব্যবস্থাও এর বাইরে যেতে পারে না। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে এর শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করলেই চলে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি দূরে থাক, এসব শিক্ষার্থী পাস নম্বরও পাচ্ছে না। অর্থাৎ, ধরে নিতে হবে গলদটা গোড়ায়। প্রায় শতভাগ পাস আসলে কতটা সংখ্যাগত আর কতটুকু গুণগত সেটা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। সময় এসেছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই প্রশ্ন করার। নানা সময়ে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে পরীক্ষার খাতা যারা দেখেন তাদের প্রতি এক ধরনের মৌখিক নির্দেশনা আছে শিক্ষার্থীদের যেন ফেল করানো না হয়। নির্দেশনা যেহেতু মৌখিক, তাই এ অভিযোগ প্রমাণ করা শক্ত। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই যে ‘পাস করা’ শিক্ষার্থীদের ঘটে তেমন বিদ্যাবুদ্ধি নেই তার প্রমাণও তো নেহাত কম নয়।
অনেকদিন ধরে ‘সৃজনশীল’ নামক এক ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি বাংলাদেশে চলমান। নামে সৃজনশীল হলেও এটা আসলে প্রকৃত অর্থে সৃজনশীল নয়। প্রশ্নপত্রে আসা ‘উদ্দীপক’ নামক কয়েক লাইনের রচনার সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে থাকা কোনো একটি গদ্যের তুলনামূলক বিচার ছাড়া ‘সৃজনশীল’ শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। তা ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষকরা কতটুকু বোঝেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফলে পাঠদানে রয়ে যাচ্ছে প্রচুর খামতি। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা আবার মুখস্ত করছে ‘সহায়ক’ বই। গাইড বই বন্ধ হয়েছে বেশ আগে। কিন্তু ঠিকই ‘কায়দা করে’ চলছে এসব ‘সহায়ক বই’। শুধু নামেই আলাদা।
সম্প্রতি এইচএসসির প্রশ্নপত্রের কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে কথা উঠেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা। প্রশ্নপত্রে কমপক্ষে তিনটি সমালোচনাযোগ্য উপাদান ছিল। ৬ নভেম্বর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা-২য় প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্ন ছিল এমন ‘প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনিসুল হক লেখালিখি করে সুনাম অর্জন করতে চান। ২১শে বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে আনিসুল হক বই প্রকাশ করেন। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।’ এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে, (ক) ‘যশ’ শব্দের অর্থ কী? (খ) ‘লেখা ভালো হইলে সুনাম আপনি আসিবে।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো। (গ) আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ, তা ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার আলোকে ব্যাখ্যা করো। (ঘ) সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনায় লেখকের পরামর্শ বিশ্লেষণ করো। এই প্রশ্নে প্রথম মূল সমস্যা হলো ব্যক্তি আক্রমণ এবং বিদ্বেষ ছড়ানো। আনিসুল হক লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফলে প্রশ্নকর্তা না জেনেই আনিসুল হকের নাম নিয়েছেন সেটা ভাবার অবকাশ নেই। এ রকম একটা পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে তাকে হেয় করা অত্যন্ত নিম্নরুচির কাজ। তাছাড়া উদ্দীপকের প্রথম বাক্যটিও ভুল। যিনি ‘প্রখ্যাত’ সাহিত্যিক তিনি কেন ‘সুনাম’ অর্জন করতে চাইবেন! প্রখ্যাত মানেই তো যিনি ইতিমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার মতো দায়িত্বশীল লোকজন ভুল বাক্য লিখবেন এটাও মেনে নেওয়া মুশকিল। আরেকটি প্রশ্নে ছড়ানো হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। সেখানকার উদ্দীপকে বলা হয়েছে ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ- বণ্টন মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামের এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমি এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’
সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ও সংকট নিয়ে যখন বাংলাদেশে বহুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তখন এমন প্রশ্ন এইচএসসির শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে সেটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। উল্টোদিকে দেশে অনেক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত আছে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় গিয়ে দেখেছি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান রেখে সেখানকার বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয় না। অথচ প্রশ্নের উদ্দীপকটিতে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাড়াবাড়ি রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যই উদ্দীপকটি অস্বস্তিকর। দায়িত্ববোধ ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব থাকলেই কেবল এমন প্রশ্ন করা সম্ভব। আরেকটি উদ্দীপকে বলা হয়‘ফারজানা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন কলেজ শিক্ষিকা। অনেক আগেই বিয়ের বয়স পেরিয়েছেনতাই তিনি বিয়ে করেননি। ছাত্রজীবনে তিনি ভালোবেসেছিলেন ব্যক্তিত্বহীন একজনকে। কারণ বাবা-মার যৌতুকের চাপের মুখে সে ফারজানাকে বিয়ের কথা অস্বীকৃতি জানায়। এরপর থেকে ফারজানা তার কলেজ আর একাকিত্ব জীবন কাটায়।’ উদ্দীপকটিতে সংবেদনশীলতার লেশমাত্র নেই। নারীশিক্ষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে স্পষ্ট। আলোচ্য তিনটি উদ্দীপকই রচনা হিসেবে খুব নিম্নমানের তো বটেই, এসবের অভিঘাত সম্পর্কেও প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা সচেতন নন।
সৃজনশীল প্রশ্ন নামে বাংলাদেশে যা চালু আছে তাতে কোনো প্রকার সৃজনশীলতা শেখানো সম্ভব না। সত্যিকার অর্থে যদি সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হয় তাহলে যেসব দেশে সৃজনশীল শিক্ষা চালু আছে সেখান থেকে পদ্ধতি দেখে-শুনে-বুঝে প্রথমে আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রকৃত বিদ্বান মানুষদের যুক্ত করতে হবে এসব কাজের সঙ্গে। তারপর ভাবতে হবে এটি চালু করার কথা। গোঁজামিল দেওয়া নামসর্বস্ব শিক্ষাপদ্ধতিকে সৃজনশীল নামে চালিয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়।
বাংলাদেশে যেহেতু ‘কায়দা করে’ অনেক কিছু হওয়া সম্ভব, শিক্ষকতার চাকরিও এর ব্যতিক্রম নয়। সবাই জানে সরকারি চাকরি পেতে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়। মেধাহীন মানুষদের শিক্ষকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় বসালে তার খেসারত পুরো জাতিকেই দিতে হবে। আমরা, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা অন্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করি, কিন্তু তাতে প্রলয় বন্ধ হয় না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক