বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন

মমতাজ লতিফ

কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ডিরোজিও ১৮২৬ সালে

কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ডিরোজিও ১৮২৬ সালে সে সময়ের বাঙালি যুবসমাজের মধ্যে মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদের অনুশীলনের লক্ষ্যে এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এ সময় ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার অমানবিক কৃত্রিম বর্ণ বিভাগ নি¤œবর্ণের মানুষ ও নারীদের যে নিষ্ঠুর নিয়মনীতি দ্বারা বন্দি করেছিল, সেসব বন্ধনকে ছিন্ন করে সেদিন কয়েকজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি মানবাধিকার অনুশীলনের সূচনা করেছিলেন। শ্রী চৈতন্য এ সময় শ্রেণি-বর্ণ-হীনভাব আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন। আবার বাঙালি কবিও লিখে গেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

উনবিংশ শতাব্দীতে ডিরোজিওর পাশে ইয়ং বেঙ্গল, রাম মোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ধর্মের নামে অমানবিক প্রথা বন্ধ- যেমন: সতীদাহ বন্ধ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, নারী শিক্ষার সূচনা করেছিলেন এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মানবিক যুক্তির অনুশীলনের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এদের তীব্র প্রতিবাদী রচনা ও বাস্তব পদক্ষেপ হিন্দু সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল এবং সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়েছিল। বিধবা বিবাহ ও বালিকা শিক্ষা প্রবর্তন করার ফল সমাজকে অনেক মানবিক ও অগ্রসর করেছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই।
আশ্চর্য এই যে, ডিরোজিও ও উক্ত যুক্তিবাদীদের উত্থানের ঠিক একশ’ বছর পর ১৯২৬ সালে ঢাকার বাঙালি মুসলিম সমাজকে মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদ অনুশীলনের লক্ষ্যে ‘শিখা’ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই কাজী আব্দুল ওদুদ এবং আবুল হুসেনের নেতৃত্বে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র জন্ম হয়। এর বার্ষিক মুখপত্রের নাম ছিল ‘শিখা’। ‘শিখা’র মূল বাণীটি ছিল এ মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের মূলমন্ত্র- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’

এই ‘শিখা’ গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব ও প্রগতিশীল চিন্তা চর্চায় ভূমিকা রেখেছেন কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী আনোয়ারুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আব্দুল কাদির, কাজী ইমদাদুল হক, খান বাহাদুর তসদ্দুক আহমদ প্রমুখ। ‘শিখা’ পত্রিকাটি প্রধানত আবুল হুসেন সাহেবের অর্থ ও শ্রমে প্রকাশিত হতো। আবুল হুসেনের বক্তব্য অনুযায়ী ‘গতিহীন মুসলমান সমাজকে গতিশীল ও সংস্কারাবদ্ধ সমাজকে সংস্কার মুক্ত করা’ ছিল তার সারা জীবনের সাধনা। কাজী আব্দুল ওদুদও বুদ্ধির মুক্তি অর্থাৎ বিচারবুদ্ধিকে অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত থেকে মুক্তি দানের লক্ষ্যকে তার রচনায় প্রাধান্য দিয়েছেন।

কবি নজরুল ইসলাম মুসলিম সাহিত্য সমাজ-এর অধিবেশনে যোগ দিয়ে বলেছেন, মুসলমানের নতুন ঐ অভিযাত্রার বার্তা নিয়ে তিনি চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াবেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘আমরা চক্ষু বুঁজিয়া পরের কথা শুনিতে চাইনা, বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাইনা, আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাইনা। আমরা চাই জ্ঞান শিক্ষা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকামুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তমান করিতে।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘… শাস্ত্র ও ধর্ম বিশ্বাসকে অপরিবর্তনীয় মনে করিলে যে সান্ত¡না লাভ ধর্ম প্রবৃত্তির মূল উদ্দেশ্য, তাহাই নষ্ট হইয়া যায়। বিজ্ঞান ও যুক্তির সহিত সংঘর্ষে অর্থাৎ জ্ঞান, বিচার ও বুদ্ধির ক্রমিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের আনুষঙ্গিক বিশ্বাসগুলির যদি একটু পরিবর্তন হয়, তবে তাহা দূষণীয় নহে, বরং সেইটিই প্রয়োজন। এরূপ পরিবর্তনে প্রকৃত ধর্মের গায়ে আঁচড় লাগেনা।’
মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী অসামান্য বিদুষী নারী শিক্ষার প্রধান নেত্রী বেগম রোকেয়া অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ধর্মের নামে মনুষ্যত্বের নিগ্রহ বিশেষত নারীদের সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে পারি নাই।

তার প্রধান কারণ বোধ হয় এই যে, যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে …. এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানের নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ-সতীদাহ …. যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল (অর্থাৎ পাশ্চাত্যে), সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এ স্থলে ধর্ম অর্থে সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।
বাঙালি পাঠক জানেন, কবি নজরুল ধর্মের অন্ধ ভক্তি, মিথ্যা আনুষ্ঠানিকতা, নানা অযৌক্তিক রীতি, নীতি যা সমাজের ধর্ম নেতাদের তৈরি যা হৃদয়ের আবেগ, অনুভূতিকে উপেক্ষা করে ধর্মের খোলস নিয়ে পড়ে থাকে, বুদ্ধিকে, যুক্তি বোধকে আচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলিত করে, তা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য যেসব লেখনি লিখেছেন, তার জন্য তাকে উগ্র, ধর্মান্ধ মোল্লারা ‘কাফের’ আখ্যা দিয়েছিলেন! এমন কি তার ওপর দৈহিক হামলাও করা হয়! তবে, বিদ্রোহী কবি, দুঃখীর, অসহায়ের বন্ধু কবি সেসব অপমান গায়ে মাখেননি। মানব হৃদয়েই সব দেবতা, ঈশ^র-আল্লাহ বাস করেন বলে তিনি বার বার লিখেছেন,
‘এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধগয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা কাবা ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয় …..’
তিনি আরও লিখেছেন-
‘…. যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভ-ের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
যুগে যুগে মনীষীরা মানুষের সাম্যে, সমাজে ন্যায়বিচার, দয়াদাক্ষিণ্য এবং দুঃখী মানুষকে সুখ দেওয়ার, তাদের কল্যাণ করার প্রয়াসকেই মানবধর্ম বিবেচনা করে গেছেন। আমাদের দেশের লালন সাঁই, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিমসহ হাজার হাজার মানবপ্রেমী, ভেদাভেদহীন মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার হাজার গান রচনা করেছেন। অথচ ধর্মচর্চাকারীরা ধর্মের মূল- মানবপ্রেম থেকে বহুদূরে সরে এসে নানা অন্ধ বিশ^াস ও ধর্মান্ধতা দ্বারা সমাজের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মানুষকে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ আখ্যা দেয়। এমন কি বাংলাদেশে এই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকারীদের হত্যার জন্য জঙ্গিগোষ্ঠী পর্যন্ত জন্ম দেওয়া হয়েছে!
‘শিখা’ গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক আবুল ফজল লিখেছিলেন- ‘….. ব্যক্তিবিশেষ মৃত্যুর পর স্বর্গে গেল কি নরকে গেল তা মানবজাতির কিছুমাত্র দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে লোকটা সৎ ও সামাজিক ছিল কিনা তা সব মানুষেরই ভাবনার বিষয়।’ বর্তমান সময়ে তো ব্যক্তিটি ছুরি নিয়ে কোনো মানুষকে হামলা করতে আসছে কিনা, তা সর্বোচ্চ মনোযোগ দাবি করে! তিনি আরও বলেন, ‘…. বুদ্ধি ও চিন্তার চর্চা মানুষকে যুক্তিবাদী ও বিবেকী করে তোলে। যে কোন অবস্থায় বিবেকী মানুষ হিরোশিমা ও নাগাসাকি ঘটাতে পারেনা। …. আজ এই মহাসংকটের দিনে বাঁচতে হলে মানবসভ্যতাকে একটা নীতি ও সত্যের উপর দাঁড় করাতে হবে। আর তা করাতে হলে মানুষকে ভাবতে হবে, করতে হবে চিন্তা ও যুক্তির চর্চা, হতে হবে বিবেকী।’আজ পর্যন্ত তারা যাদের ওপর হামলা করেছে, দেখা যায় তারা সবাই যুক্তিবাদী, সাম্যে বিশ^াসী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ^াসী। তাহলে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, ঐ খুনি জঙ্গিদের জন্মদাতারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং বাংলাদেশের উন্নয়নবিরোধী। যারা এই গোষ্ঠী ’৭১-এ যেমন মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধপন্থি রাজনীতিক, হিন্দু সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, তরুণ লেখক, ব্লগারদের হত্যা করেছে, তারাই আবার দেশের উন্নয়ন সহযোগী জাপানি ও ইতালীয় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের হত্যা করেছে। এরাই আবার আমাদের লালনভক্তদের ওপর হামলা করেছে।

অর্থাৎ মানবিকতা, মানবধর্ম ও যুক্তিচর্চাকারীরাই বারবার ধর্মান্ধ, গোঁড়া, ধর্মের নামে হিংসা, হত্যা, বিদ্বেষ যাদের হাতিয়ার, তাদের হামলার শিকার হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ধর্মান্ধ মানুষ কোনোভাবে যুক্তিবাদ ও মানবিকতাকে সহ্য করতে পারে না। বরং তারা  উদার মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষকে শত্রু গণ্য করে। ওরা আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞানকে ভয় পায়। কেননা, বিজ্ঞান সত্যকে যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে প্রকাশ করে। অথচ ওরা প্রতিদিন বিজ্ঞানের দান- করোনা টিকা, শিশুদের সুরক্ষা টিকা, ঔষধ, চশমা, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ভিডিও, এ্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে চলেছে যা বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার।

যারা দিনরাত মানবকল্যাণে রোগের ঔষধ, টিকা থেকে নানা প্রযুক্তি আবিষ্কার করে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর করছে। অর্থাৎ বিজ্ঞান ছাড়া জঙ্গি, মৌলবাদীরাও চলতে পারবে না। সাম্প্রতিক নতুন পাঠ্যবইয়ের বিরুদ্ধে যারা গুজব, প্রচারণা চালাচ্ছে, তারা ঐ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীর ইন্ধনে এ কাজ করছে বলে অনেকের ধারণা। দেখা যাচ্ছে পাঠ্যবইয়ে আছে, মানুষ বানর থেকে জন্ম লাভ করেনি। কিন্তু গুজব ছড়ানো হচ্ছে- পাঠ্যবইয়ে আছে মানুষ বানর থেকে জন্ম নিয়েছে।

বাদ দেওয়া ছবিগুলো এনসিটিবি’তে কর্মরত মৌলবাদী, সরকারবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের কাজ বলেও সবার ধারণা। এনসিটিবি ও সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তারা এ কাজ করেছে, এটি বলা বাহুল্য। বইগুলোর ফাইনাল প্রুফ কপি এবং এনসিটিবি’র ঐ বিষয় বিশেষজ্ঞদের কেউ এ কাজে সম্পৃক্ত- এটি স্পষ্ট।
সবশেষে বলা যায়, বিবর্তনবাদ বা মানুষ, প্রাণির জন্মরহস্য পাঠ্যবইয়ে থাকবে কি, থাকবে না, তার চাইতে বড় কথা এ যুগের সব ধরনের শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে বিজ্ঞান থাকতে হবে। দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিরাও বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে বোমা, গ্রেনেড, বন্দুক বানানোর কৌশল শিখছে। অর্থাৎ তাদেরকেও বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়। এটা তো বাস্তব সত্য- করোনার জীবাণু যদি বারবার তার জিনের পরিবর্তন ঘটায়, তাহলে প্রাণি, জীবের দেহের জিনেও লক্ষ, কোটি বছরে পরিবর্তন ঘটবে।

এটাই বিবর্তন যা বাস্তব এবং বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে কেউ মানল কি মানল না, তাতে বিজ্ঞানের বা বিবর্তনবাদের কিছুই আসে যায় না। করোনা জীবাণু যেমন তার রূপ পরিবর্তন করছে, তেমনি মাছ, পশু, পাখি, মানবদেহও লক্ষ-কোটি বছরে বদলাচ্ছে। এ বদল আমার পছন্দ-অপছন্দের ধার ধারে না। আমরা মহাশূন্যে নক্ষত্রের জন্মের অপরূপ ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। যাদের অপছন্দ, তারা দেখবে না। তাতে নক্ষত্রের জন্ম, গ্রহের জন্ম, ব্ল্যাকহোলের জন্ম বন্ধ হয়ে যাবে না। মহাশূন্যে মানুষের অভিযানও থামবে না।

পাঠ্যবইয়ের বাইরে হাজার হাজার বই পড়ে, ইন্টারনেটে পড়ে যে কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব এবং সে ব্যবস্থা পৃথিবীর কোনো শক্তি বন্ধ রাখতে পারবে না। একটা ছোট পাঠ্যবই সব কিছু শেখায় না। এটি আসলে শিখতে বা জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াগুলো শেখায় আর শেখার আনন্দ উপভোগ করতে শেখায়। বিবর্তনবাদ জ্ঞান ভা-ারের একটি মাইলফলক।
সম্প্রতি দেখলাম, যারা বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত জানে না, তারা আমাদের সাধারণ শিক্ষার বর্তমান পাঠ্য সব বাতিল করার ভয়ংকর আহ্বান করেছে। তদুপরি, আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর যাবৎ যে জ্ঞান ও শিক্ষার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, সেসব নাকি আধুনিক। এসব বিষয়ে অজ্ঞদের সহযোগে নতুন করে তৈরি করতে হবে। পাঠ্যবই নয়, আসলে আসছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ, আধুনিক বিজ্ঞানবিরোধীরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতার মতো করে মোকাবিলা করতে চাইছে। জনগণও এ পটভূমিতে বসে থাকবে না, যেমন থাকেনি ’৭১-এ। আশ্চর্য! শিখা গোষ্ঠীর জন্মের পর এখন একশ’ বছর প্রায়। ওল্টানো পায়ের পাতা নিয়ে ভূতেরা পেছন দিকে চলেছে!

লেখক : শিক্ষাবিদ

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন

মমতাজ লতিফ

কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ডিরোজিও ১৮২৬ সালে

কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ডিরোজিও ১৮২৬ সালে সে সময়ের বাঙালি যুবসমাজের মধ্যে মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদের অনুশীলনের লক্ষ্যে এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এ সময় ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার অমানবিক কৃত্রিম বর্ণ বিভাগ নি¤œবর্ণের মানুষ ও নারীদের যে নিষ্ঠুর নিয়মনীতি দ্বারা বন্দি করেছিল, সেসব বন্ধনকে ছিন্ন করে সেদিন কয়েকজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি মানবাধিকার অনুশীলনের সূচনা করেছিলেন। শ্রী চৈতন্য এ সময় শ্রেণি-বর্ণ-হীনভাব আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন। আবার বাঙালি কবিও লিখে গেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

উনবিংশ শতাব্দীতে ডিরোজিওর পাশে ইয়ং বেঙ্গল, রাম মোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ধর্মের নামে অমানবিক প্রথা বন্ধ- যেমন: সতীদাহ বন্ধ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, নারী শিক্ষার সূচনা করেছিলেন এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মানবিক যুক্তির অনুশীলনের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এদের তীব্র প্রতিবাদী রচনা ও বাস্তব পদক্ষেপ হিন্দু সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল এবং সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়েছিল। বিধবা বিবাহ ও বালিকা শিক্ষা প্রবর্তন করার ফল সমাজকে অনেক মানবিক ও অগ্রসর করেছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই।
আশ্চর্য এই যে, ডিরোজিও ও উক্ত যুক্তিবাদীদের উত্থানের ঠিক একশ’ বছর পর ১৯২৬ সালে ঢাকার বাঙালি মুসলিম সমাজকে মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদ অনুশীলনের লক্ষ্যে ‘শিখা’ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই কাজী আব্দুল ওদুদ এবং আবুল হুসেনের নেতৃত্বে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র জন্ম হয়। এর বার্ষিক মুখপত্রের নাম ছিল ‘শিখা’। ‘শিখা’র মূল বাণীটি ছিল এ মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের মূলমন্ত্র- ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’

এই ‘শিখা’ গোষ্ঠীতে নেতৃত্ব ও প্রগতিশীল চিন্তা চর্চায় ভূমিকা রেখেছেন কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী আনোয়ারুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আব্দুল কাদির, কাজী ইমদাদুল হক, খান বাহাদুর তসদ্দুক আহমদ প্রমুখ। ‘শিখা’ পত্রিকাটি প্রধানত আবুল হুসেন সাহেবের অর্থ ও শ্রমে প্রকাশিত হতো। আবুল হুসেনের বক্তব্য অনুযায়ী ‘গতিহীন মুসলমান সমাজকে গতিশীল ও সংস্কারাবদ্ধ সমাজকে সংস্কার মুক্ত করা’ ছিল তার সারা জীবনের সাধনা। কাজী আব্দুল ওদুদও বুদ্ধির মুক্তি অর্থাৎ বিচারবুদ্ধিকে অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত থেকে মুক্তি দানের লক্ষ্যকে তার রচনায় প্রাধান্য দিয়েছেন।

কবি নজরুল ইসলাম মুসলিম সাহিত্য সমাজ-এর অধিবেশনে যোগ দিয়ে বলেছেন, মুসলমানের নতুন ঐ অভিযাত্রার বার্তা নিয়ে তিনি চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াবেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘আমরা চক্ষু বুঁজিয়া পরের কথা শুনিতে চাইনা, বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাইনা, আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাইনা। আমরা চাই জ্ঞান শিক্ষা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকামুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তমান করিতে।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘… শাস্ত্র ও ধর্ম বিশ্বাসকে অপরিবর্তনীয় মনে করিলে যে সান্ত¡না লাভ ধর্ম প্রবৃত্তির মূল উদ্দেশ্য, তাহাই নষ্ট হইয়া যায়। বিজ্ঞান ও যুক্তির সহিত সংঘর্ষে অর্থাৎ জ্ঞান, বিচার ও বুদ্ধির ক্রমিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের আনুষঙ্গিক বিশ্বাসগুলির যদি একটু পরিবর্তন হয়, তবে তাহা দূষণীয় নহে, বরং সেইটিই প্রয়োজন। এরূপ পরিবর্তনে প্রকৃত ধর্মের গায়ে আঁচড় লাগেনা।’
মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী অসামান্য বিদুষী নারী শিক্ষার প্রধান নেত্রী বেগম রোকেয়া অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ধর্মের নামে মনুষ্যত্বের নিগ্রহ বিশেষত নারীদের সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে পারি নাই।

তার প্রধান কারণ বোধ হয় এই যে, যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে …. এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানের নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ-সতীদাহ …. যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল (অর্থাৎ পাশ্চাত্যে), সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এ স্থলে ধর্ম অর্থে সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।
বাঙালি পাঠক জানেন, কবি নজরুল ধর্মের অন্ধ ভক্তি, মিথ্যা আনুষ্ঠানিকতা, নানা অযৌক্তিক রীতি, নীতি যা সমাজের ধর্ম নেতাদের তৈরি যা হৃদয়ের আবেগ, অনুভূতিকে উপেক্ষা করে ধর্মের খোলস নিয়ে পড়ে থাকে, বুদ্ধিকে, যুক্তি বোধকে আচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলিত করে, তা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য যেসব লেখনি লিখেছেন, তার জন্য তাকে উগ্র, ধর্মান্ধ মোল্লারা ‘কাফের’ আখ্যা দিয়েছিলেন! এমন কি তার ওপর দৈহিক হামলাও করা হয়! তবে, বিদ্রোহী কবি, দুঃখীর, অসহায়ের বন্ধু কবি সেসব অপমান গায়ে মাখেননি। মানব হৃদয়েই সব দেবতা, ঈশ^র-আল্লাহ বাস করেন বলে তিনি বার বার লিখেছেন,
‘এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধগয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা কাবা ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয় …..’
তিনি আরও লিখেছেন-
‘…. যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভ-ের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
যুগে যুগে মনীষীরা মানুষের সাম্যে, সমাজে ন্যায়বিচার, দয়াদাক্ষিণ্য এবং দুঃখী মানুষকে সুখ দেওয়ার, তাদের কল্যাণ করার প্রয়াসকেই মানবধর্ম বিবেচনা করে গেছেন। আমাদের দেশের লালন সাঁই, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিমসহ হাজার হাজার মানবপ্রেমী, ভেদাভেদহীন মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার হাজার গান রচনা করেছেন। অথচ ধর্মচর্চাকারীরা ধর্মের মূল- মানবপ্রেম থেকে বহুদূরে সরে এসে নানা অন্ধ বিশ^াস ও ধর্মান্ধতা দ্বারা সমাজের মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মানুষকে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ আখ্যা দেয়। এমন কি বাংলাদেশে এই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকারীদের হত্যার জন্য জঙ্গিগোষ্ঠী পর্যন্ত জন্ম দেওয়া হয়েছে!
‘শিখা’ গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক আবুল ফজল লিখেছিলেন- ‘….. ব্যক্তিবিশেষ মৃত্যুর পর স্বর্গে গেল কি নরকে গেল তা মানবজাতির কিছুমাত্র দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে লোকটা সৎ ও সামাজিক ছিল কিনা তা সব মানুষেরই ভাবনার বিষয়।’ বর্তমান সময়ে তো ব্যক্তিটি ছুরি নিয়ে কোনো মানুষকে হামলা করতে আসছে কিনা, তা সর্বোচ্চ মনোযোগ দাবি করে! তিনি আরও বলেন, ‘…. বুদ্ধি ও চিন্তার চর্চা মানুষকে যুক্তিবাদী ও বিবেকী করে তোলে। যে কোন অবস্থায় বিবেকী মানুষ হিরোশিমা ও নাগাসাকি ঘটাতে পারেনা। …. আজ এই মহাসংকটের দিনে বাঁচতে হলে মানবসভ্যতাকে একটা নীতি ও সত্যের উপর দাঁড় করাতে হবে। আর তা করাতে হলে মানুষকে ভাবতে হবে, করতে হবে চিন্তা ও যুক্তির চর্চা, হতে হবে বিবেকী।’আজ পর্যন্ত তারা যাদের ওপর হামলা করেছে, দেখা যায় তারা সবাই যুক্তিবাদী, সাম্যে বিশ^াসী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ^াসী। তাহলে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, ঐ খুনি জঙ্গিদের জন্মদাতারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং বাংলাদেশের উন্নয়নবিরোধী। যারা এই গোষ্ঠী ’৭১-এ যেমন মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধপন্থি রাজনীতিক, হিন্দু সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, তরুণ লেখক, ব্লগারদের হত্যা করেছে, তারাই আবার দেশের উন্নয়ন সহযোগী জাপানি ও ইতালীয় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের হত্যা করেছে। এরাই আবার আমাদের লালনভক্তদের ওপর হামলা করেছে।

অর্থাৎ মানবিকতা, মানবধর্ম ও যুক্তিচর্চাকারীরাই বারবার ধর্মান্ধ, গোঁড়া, ধর্মের নামে হিংসা, হত্যা, বিদ্বেষ যাদের হাতিয়ার, তাদের হামলার শিকার হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ধর্মান্ধ মানুষ কোনোভাবে যুক্তিবাদ ও মানবিকতাকে সহ্য করতে পারে না। বরং তারা  উদার মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষকে শত্রু গণ্য করে। ওরা আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞানকে ভয় পায়। কেননা, বিজ্ঞান সত্যকে যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে প্রকাশ করে। অথচ ওরা প্রতিদিন বিজ্ঞানের দান- করোনা টিকা, শিশুদের সুরক্ষা টিকা, ঔষধ, চশমা, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ভিডিও, এ্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে চলেছে যা বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার।

যারা দিনরাত মানবকল্যাণে রোগের ঔষধ, টিকা থেকে নানা প্রযুক্তি আবিষ্কার করে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর করছে। অর্থাৎ বিজ্ঞান ছাড়া জঙ্গি, মৌলবাদীরাও চলতে পারবে না। সাম্প্রতিক নতুন পাঠ্যবইয়ের বিরুদ্ধে যারা গুজব, প্রচারণা চালাচ্ছে, তারা ঐ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীর ইন্ধনে এ কাজ করছে বলে অনেকের ধারণা। দেখা যাচ্ছে পাঠ্যবইয়ে আছে, মানুষ বানর থেকে জন্ম লাভ করেনি। কিন্তু গুজব ছড়ানো হচ্ছে- পাঠ্যবইয়ে আছে মানুষ বানর থেকে জন্ম নিয়েছে।

বাদ দেওয়া ছবিগুলো এনসিটিবি’তে কর্মরত মৌলবাদী, সরকারবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের কাজ বলেও সবার ধারণা। এনসিটিবি ও সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তারা এ কাজ করেছে, এটি বলা বাহুল্য। বইগুলোর ফাইনাল প্রুফ কপি এবং এনসিটিবি’র ঐ বিষয় বিশেষজ্ঞদের কেউ এ কাজে সম্পৃক্ত- এটি স্পষ্ট।
সবশেষে বলা যায়, বিবর্তনবাদ বা মানুষ, প্রাণির জন্মরহস্য পাঠ্যবইয়ে থাকবে কি, থাকবে না, তার চাইতে বড় কথা এ যুগের সব ধরনের শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে বিজ্ঞান থাকতে হবে। দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিরাও বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে বোমা, গ্রেনেড, বন্দুক বানানোর কৌশল শিখছে। অর্থাৎ তাদেরকেও বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়। এটা তো বাস্তব সত্য- করোনার জীবাণু যদি বারবার তার জিনের পরিবর্তন ঘটায়, তাহলে প্রাণি, জীবের দেহের জিনেও লক্ষ, কোটি বছরে পরিবর্তন ঘটবে।

এটাই বিবর্তন যা বাস্তব এবং বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে কেউ মানল কি মানল না, তাতে বিজ্ঞানের বা বিবর্তনবাদের কিছুই আসে যায় না। করোনা জীবাণু যেমন তার রূপ পরিবর্তন করছে, তেমনি মাছ, পশু, পাখি, মানবদেহও লক্ষ-কোটি বছরে বদলাচ্ছে। এ বদল আমার পছন্দ-অপছন্দের ধার ধারে না। আমরা মহাশূন্যে নক্ষত্রের জন্মের অপরূপ ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। যাদের অপছন্দ, তারা দেখবে না। তাতে নক্ষত্রের জন্ম, গ্রহের জন্ম, ব্ল্যাকহোলের জন্ম বন্ধ হয়ে যাবে না। মহাশূন্যে মানুষের অভিযানও থামবে না।

পাঠ্যবইয়ের বাইরে হাজার হাজার বই পড়ে, ইন্টারনেটে পড়ে যে কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব এবং সে ব্যবস্থা পৃথিবীর কোনো শক্তি বন্ধ রাখতে পারবে না। একটা ছোট পাঠ্যবই সব কিছু শেখায় না। এটি আসলে শিখতে বা জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াগুলো শেখায় আর শেখার আনন্দ উপভোগ করতে শেখায়। বিবর্তনবাদ জ্ঞান ভা-ারের একটি মাইলফলক।
সম্প্রতি দেখলাম, যারা বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত জানে না, তারা আমাদের সাধারণ শিক্ষার বর্তমান পাঠ্য সব বাতিল করার ভয়ংকর আহ্বান করেছে। তদুপরি, আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর যাবৎ যে জ্ঞান ও শিক্ষার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, সেসব নাকি আধুনিক। এসব বিষয়ে অজ্ঞদের সহযোগে নতুন করে তৈরি করতে হবে। পাঠ্যবই নয়, আসলে আসছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ, আধুনিক বিজ্ঞানবিরোধীরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতার মতো করে মোকাবিলা করতে চাইছে। জনগণও এ পটভূমিতে বসে থাকবে না, যেমন থাকেনি ’৭১-এ। আশ্চর্য! শিখা গোষ্ঠীর জন্মের পর এখন একশ’ বছর প্রায়। ওল্টানো পায়ের পাতা নিয়ে ভূতেরা পেছন দিকে চলেছে!

লেখক : শিক্ষাবিদ