শতভাগ পাস টানা তিনবার

মাহফুজ নান্টু, কুমিল্লা

চা বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। সেই সঙ্গে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন এক টুকরা জমি। একদিন সেই জমিটিও দান করে দিলেন স্কুলের জন্য। সেই স্কুল এখন জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে পুরো এলাকায়। স্কুলের সাফল্য আর সেখানকার শিক্ষার্থীদের প্রাণোচ্ছ্বাস দেখে আনন্দে অশ্রু মোছেন বৃদ্ধ আবদুল খালেক।

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া গ্রামে অবস্থিত এই নলুয়া চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয়। চলতি বছরসহ টানা তিনবার স্কুলটিতে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া সব শিক্ষার্থী পান করেছে। স্কুলটির এমন সাফল্য সবার মুখে মুখে।

সরেজমিনে নলুয়া চাঁদপুর স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষকরা ক্লাসে পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা স্কুলের বেঞ্চে বসে শৃঙ্খলার সঙ্গে পাঠ নিচ্ছে। আরেক দিকে শিক্ষার্থীদের ভিন্নভাবে লেখাপড়ার স্বাদ দেয়ার জন্য স্কুলের মাঠেই পাঠদান করছেন একজন শিক্ষক।

স্কুলের মাঠে লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার এমন দৃশ্য উপভোগ করছেন চা বিক্রেতা আবদুল খালেক। তিনি নলুয়া চাঁদপুর এলাকার মাক্কু মিয়ার ছেলে।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন এখন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে স্কুল প্রতিষ্ঠার গল্পটি শোনালেন। জানালেন, স্বাধীনতার আগে থেকে চা বিক্রি করতেন। অল্প আয়ে চা দোকানের পাশে ৩০ শতাংশ জমি কেনেন। নব্বই দশকের শেষের দিকে আবদুল খালেক এক রাতে তার দুই ভাতিজাকে বললেন, তিনি একটি স্কুল নির্মাণ করতে চান। সেই থেকে শুরু। তার কেনা জমিতে শুরু হয় স্কুল নির্মাণের কাজ। ওই সময় এত মূল্যবান জমি স্কুলের জন্য দেয়ার কারণে অনেক কটু কথা শুনতে হয় আবদুল খালেককে।

পাঁচজন শিক্ষক ও দেড়শ শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি কাঠ-টিন-বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মিত নলুয়া-চাঁদপুর হাইস্কুল যাত্রা শুরু করে। ২২ বছর পর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হয়। এর পরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এ সংবাদ। প্রশংসায় ভাসেন আবদুল খালেক।

কেন স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন- এমন প্রশ্নে আবদুল খালেক বলেন, ‘আমি ব্রিটিশ আমলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। পাশের চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি হেঁটে গিয়ে লেখাপড়া করেছি। তখন আমি দেখেছি, আমার এলাকার সবাই অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কারণ লেখাপড়া জানতো না তারা। এটি আমার ভালো লাগেনি। প্রতিজনকে ধরে ধরে শুদ্ধ ভাষা শেখানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করলাম একটি স্কুল করব। সবাই আসবে। সবাই শিখবে শুদ্ধ ভাষা। সেই পরিকল্পনা থেকেই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করি।’

গেল তিন বছর এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ পাস করেছে নলুয়া চাঁদপুর হাইস্কুল। চলতি বছর ৮১ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮ জন।

এমন ফলাফলে খুশি নিঃসন্তান আবদুল খালেক বলেন, ‘আজ যদি আমার স্ত্রী বেঁচে থাকত তাহলে কত খুশি হতো!’

১৯৯৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান আবদুল খালেকের স্ত্রী। বৃদ্ধের নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী এখন এই স্কুল। স্কুলটি নিয়ে এখনো স্বপ্ন দেখছেন আবদুল খালেক। তার স্বপ্ন, একদিন এখানে কলেজ হবে।

১৪ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম নলুয়া স্কুলের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘একজন চা বিক্রেতা হয়েও শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিজের সঞ্চিত সব সম্পদ দান করেছেন আবদুল খালেক। এর মাধ্যমে নিজের মহানুভবতা, দূরদর্শিতা আর নির্লোভ মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। শিক্ষা প্রসারের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা অনুসরণীয়।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষকতা জীবনে আবদুল খালেকের মতো এত ভালো মানুষ এবং শিক্ষা অন্তঃপ্রাণ মানুষ আর দেখিনি। আমি চাই সরকার যেন এই মানুষটির অবদানকে স্মরণ রেখে তার নামেই স্কুলটির নামকরণ করে। আর স্কুলের বেষ্টনী নির্মাণে সহযোগিতা করে।’

বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি স্কুলটির নিরাপত্তা বেষ্টনী করার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। তবে নামকরণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে।’

শতভাগ পাস টানা তিনবার

মাহফুজ নান্টু, কুমিল্লা

চা বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। সেই সঙ্গে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন এক টুকরা জমি। একদিন সেই জমিটিও দান করে দিলেন স্কুলের জন্য। সেই স্কুল এখন জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে পুরো এলাকায়। স্কুলের সাফল্য আর সেখানকার শিক্ষার্থীদের প্রাণোচ্ছ্বাস দেখে আনন্দে অশ্রু মোছেন বৃদ্ধ আবদুল খালেক।

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া গ্রামে অবস্থিত এই নলুয়া চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয়। চলতি বছরসহ টানা তিনবার স্কুলটিতে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া সব শিক্ষার্থী পান করেছে। স্কুলটির এমন সাফল্য সবার মুখে মুখে।

সরেজমিনে নলুয়া চাঁদপুর স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষকরা ক্লাসে পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা স্কুলের বেঞ্চে বসে শৃঙ্খলার সঙ্গে পাঠ নিচ্ছে। আরেক দিকে শিক্ষার্থীদের ভিন্নভাবে লেখাপড়ার স্বাদ দেয়ার জন্য স্কুলের মাঠেই পাঠদান করছেন একজন শিক্ষক।

স্কুলের মাঠে লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার এমন দৃশ্য উপভোগ করছেন চা বিক্রেতা আবদুল খালেক। তিনি নলুয়া চাঁদপুর এলাকার মাক্কু মিয়ার ছেলে।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন এখন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে স্কুল প্রতিষ্ঠার গল্পটি শোনালেন। জানালেন, স্বাধীনতার আগে থেকে চা বিক্রি করতেন। অল্প আয়ে চা দোকানের পাশে ৩০ শতাংশ জমি কেনেন। নব্বই দশকের শেষের দিকে আবদুল খালেক এক রাতে তার দুই ভাতিজাকে বললেন, তিনি একটি স্কুল নির্মাণ করতে চান। সেই থেকে শুরু। তার কেনা জমিতে শুরু হয় স্কুল নির্মাণের কাজ। ওই সময় এত মূল্যবান জমি স্কুলের জন্য দেয়ার কারণে অনেক কটু কথা শুনতে হয় আবদুল খালেককে।

পাঁচজন শিক্ষক ও দেড়শ শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি কাঠ-টিন-বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মিত নলুয়া-চাঁদপুর হাইস্কুল যাত্রা শুরু করে। ২২ বছর পর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হয়। এর পরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এ সংবাদ। প্রশংসায় ভাসেন আবদুল খালেক।

কেন স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন- এমন প্রশ্নে আবদুল খালেক বলেন, ‘আমি ব্রিটিশ আমলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। পাশের চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি হেঁটে গিয়ে লেখাপড়া করেছি। তখন আমি দেখেছি, আমার এলাকার সবাই অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কারণ লেখাপড়া জানতো না তারা। এটি আমার ভালো লাগেনি। প্রতিজনকে ধরে ধরে শুদ্ধ ভাষা শেখানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করলাম একটি স্কুল করব। সবাই আসবে। সবাই শিখবে শুদ্ধ ভাষা। সেই পরিকল্পনা থেকেই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করি।’

গেল তিন বছর এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ পাস করেছে নলুয়া চাঁদপুর হাইস্কুল। চলতি বছর ৮১ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮ জন।

এমন ফলাফলে খুশি নিঃসন্তান আবদুল খালেক বলেন, ‘আজ যদি আমার স্ত্রী বেঁচে থাকত তাহলে কত খুশি হতো!’

১৯৯৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান আবদুল খালেকের স্ত্রী। বৃদ্ধের নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী এখন এই স্কুল। স্কুলটি নিয়ে এখনো স্বপ্ন দেখছেন আবদুল খালেক। তার স্বপ্ন, একদিন এখানে কলেজ হবে।

১৪ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম নলুয়া স্কুলের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘একজন চা বিক্রেতা হয়েও শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিজের সঞ্চিত সব সম্পদ দান করেছেন আবদুল খালেক। এর মাধ্যমে নিজের মহানুভবতা, দূরদর্শিতা আর নির্লোভ মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। শিক্ষা প্রসারের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা অনুসরণীয়।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষকতা জীবনে আবদুল খালেকের মতো এত ভালো মানুষ এবং শিক্ষা অন্তঃপ্রাণ মানুষ আর দেখিনি। আমি চাই সরকার যেন এই মানুষটির অবদানকে স্মরণ রেখে তার নামেই স্কুলটির নামকরণ করে। আর স্কুলের বেষ্টনী নির্মাণে সহযোগিতা করে।’

বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি স্কুলটির নিরাপত্তা বেষ্টনী করার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। তবে নামকরণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে।’