শিক্ষার্থীরা বাকি খেয়ে দেন না টাকা, বন্ধ ৩২ বছরের হোটেল

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হোটেল ব্যবসায়ী অলিমুদ্দীন

জীবিকার তাগিদে ১৯৮৮ সালে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আসেন মোহাম্মদ অলিমুদ্দীন। তারপর ‘প্রয়াস’ নাম দিয়ে ১৯৯০ সালে চবি ক্যাম্পাসে খোলেন একটি খাবারের হোটেল। আর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি পেয়ে যান ‘অলি ভাই’ নামে। তার দোকানে এসে টাকার অভাবে কেউ খেতে পারেননি এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। অথচ সেই টাকার অভাবেই বন্ধ করতে হয়েছে ৩২ বছর ধরে চবি ক্যাম্পাসে চলা সেই হোটেল। গত ২৩ অক্টোবর অলিমুদ্দীনের হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায়।

হোটেল বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে অলিমুদ্দীন বলেন, হোটেল খোলার পর থেকে সব শিক্ষার্থীকেই নিজের সন্তান মনে করতাম। কখনো টাকার জন্য খেতে না করতাম না। ভাবতাম হয়তো সবসময় টাকা থাকে না। এখন খেয়ে নিক, পরে পরিশোধ করবে। অনেকে বাকি টাকা পরিশোধ করেছে, অনেকে করেনি। আমিও দাবি-দাওয়া রাখিনি। কিন্তু ২০১০ সালের পরে বাকির চাপ অনেক বেশি বেড়ে যায়। তাও অনেক কষ্টে হোটেল চালাইছি। আমার ছেলে বিদেশ থাকে। তার থেকে টাকা নিয়ে স্টাফদের বেতন দিছি। কিন্তু করোনার কারণে বেশি সমস্যায় পড়ে যাই।তিনি বলেন, করোনার সময় শিক্ষার্থীদের বাকিতে খাওয়ার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। অনেক অনুরোধ করছি বাকি খাইয়েন না, ব্যবসার অবস্থা খারাপ। কিন্তু অনেকেই শুনতো না। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় এদের কিছু বলতেও পারতাম না। আমার দোকানে বাকি খেয়ে অনেকে এখন লন্ডন, ঢাকায় ভালো চাকরি করে। কিন্তু আমার টাকা ফেরত দেয়নি। গত বছরে পাশের মুদি দোকানে দেড় লাখ টাকা বাকি হয় আমার। পোলাপান টাকা না দেওয়ায় হোটেলও চলতো না। তাই শেষে সিদ্ধান্ত নিই, আর চালাবো না। এভাবে তো আর ব্যবসা করা সম্ভব না। আনুমানিক এখনো সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার ওপরে বাকির টাকা পাই। আখিরাতের কথা চিন্তা করে হলেও যেন আমার টাকাগুলো ফেরত দেয়।

অলিমুদ্দীনের হোটেল বন্ধের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পেরে চবির অনেক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। একই সঙ্গে তার টাকা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী কাজি শরিফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা এক পোস্টে লিখেছেন, অলি সাহেব ঢাকা কোর্টে গিয়েও তার পাওনাদার খুঁজছেন। তার কাছে টাকা বাকি রেখে অনেকেই এখন বাসমতি চাল দিয়ে ভাত খান। কিন্তু তিনি মোটা চালের ভাতও খেতে না পেরে আজ অভাবে দিন গুজরান করতে করতে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। কী নিষ্ঠুর আমাদের ছাত্রদের মন।

আরেক সাবেক শিক্ষার্থী এম টি উল্লাহ লেখেন, ২০১০ সালের দিকে অলি ভাইয়ের দোকানের একটি ঘটনা মনে আছে। আমি তখন দোকানের পাশের কটেজে থাকতাম। রাত প্রায় দেড়টায় অলি ভাইয়ের এক স্টাফকে এক ছাত্রনেতা মারধর করেছে। অলি ভাইয়ের চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙে। গিয়ে শুনি মারার কারণ তার স্টাফ সেই ছাত্রনেতার থেকে খাবারের বিল চেয়েছিলেন। অলি ভাই তখন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, আমার মতো ছোট হোটেলে যদি এভাবে নিয়মিত বাকি পড়ে তাহলে ব্যবসা করবো কীভাবে? স্টাফদের বেতনই দেবো কেমনে?নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের এক দোকানদার বলেন, অলি ভাই যাদের থেকে টাকা পান অধিকাংশই সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের কর্মী। অনেকবার হলে তাদের রুমে গিয়ে অলি ভাই টাকা চেয়েছেন। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি। কেউ আজ দেবে, কাল দেবে বলে ঘুরিয়েছে।

এদিকে, বিষয়টিকে অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ বলছেন ছাত্রনেতারা। ছাত্র ইউনিয়ন চবি সংসদের সভাপতি প্রত্যয় নাফাক বলেন, আপনি খোঁজ নিলে দেখবেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে সরকারদলীয় সংগঠনের কর্মীদের বাকি বেশি। তারা তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ এই ছোটখাটো দোকানদারদের ওপর দেখাতেও ছাড়েন না। যা কখনোই কাম্য নয়।

চবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আমরা বলি, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার। অর্থাৎ তারা অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কিন্তু আফসোসের বিষয় সেই শিক্ষার্থীরা এখন ছোট পুঁজির দোকানদারের পাওনা টাকা দিচ্ছে না। এটি যেমন হতাশার ঠিক তেমনি লজ্জার।

জেএস/এমআরআর/জিকেএস

শিক্ষার্থীরা বাকি খেয়ে দেন না টাকা, বন্ধ ৩২ বছরের হোটেল

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হোটেল ব্যবসায়ী অলিমুদ্দীন

জীবিকার তাগিদে ১৯৮৮ সালে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আসেন মোহাম্মদ অলিমুদ্দীন। তারপর ‘প্রয়াস’ নাম দিয়ে ১৯৯০ সালে চবি ক্যাম্পাসে খোলেন একটি খাবারের হোটেল। আর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি পেয়ে যান ‘অলি ভাই’ নামে। তার দোকানে এসে টাকার অভাবে কেউ খেতে পারেননি এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। অথচ সেই টাকার অভাবেই বন্ধ করতে হয়েছে ৩২ বছর ধরে চবি ক্যাম্পাসে চলা সেই হোটেল। গত ২৩ অক্টোবর অলিমুদ্দীনের হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায়।

হোটেল বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে অলিমুদ্দীন বলেন, হোটেল খোলার পর থেকে সব শিক্ষার্থীকেই নিজের সন্তান মনে করতাম। কখনো টাকার জন্য খেতে না করতাম না। ভাবতাম হয়তো সবসময় টাকা থাকে না। এখন খেয়ে নিক, পরে পরিশোধ করবে। অনেকে বাকি টাকা পরিশোধ করেছে, অনেকে করেনি। আমিও দাবি-দাওয়া রাখিনি। কিন্তু ২০১০ সালের পরে বাকির চাপ অনেক বেশি বেড়ে যায়। তাও অনেক কষ্টে হোটেল চালাইছি। আমার ছেলে বিদেশ থাকে। তার থেকে টাকা নিয়ে স্টাফদের বেতন দিছি। কিন্তু করোনার কারণে বেশি সমস্যায় পড়ে যাই।তিনি বলেন, করোনার সময় শিক্ষার্থীদের বাকিতে খাওয়ার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। অনেক অনুরোধ করছি বাকি খাইয়েন না, ব্যবসার অবস্থা খারাপ। কিন্তু অনেকেই শুনতো না। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় এদের কিছু বলতেও পারতাম না। আমার দোকানে বাকি খেয়ে অনেকে এখন লন্ডন, ঢাকায় ভালো চাকরি করে। কিন্তু আমার টাকা ফেরত দেয়নি। গত বছরে পাশের মুদি দোকানে দেড় লাখ টাকা বাকি হয় আমার। পোলাপান টাকা না দেওয়ায় হোটেলও চলতো না। তাই শেষে সিদ্ধান্ত নিই, আর চালাবো না। এভাবে তো আর ব্যবসা করা সম্ভব না। আনুমানিক এখনো সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার ওপরে বাকির টাকা পাই। আখিরাতের কথা চিন্তা করে হলেও যেন আমার টাকাগুলো ফেরত দেয়।

অলিমুদ্দীনের হোটেল বন্ধের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পেরে চবির অনেক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। একই সঙ্গে তার টাকা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী কাজি শরিফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা এক পোস্টে লিখেছেন, অলি সাহেব ঢাকা কোর্টে গিয়েও তার পাওনাদার খুঁজছেন। তার কাছে টাকা বাকি রেখে অনেকেই এখন বাসমতি চাল দিয়ে ভাত খান। কিন্তু তিনি মোটা চালের ভাতও খেতে না পেরে আজ অভাবে দিন গুজরান করতে করতে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। কী নিষ্ঠুর আমাদের ছাত্রদের মন।

আরেক সাবেক শিক্ষার্থী এম টি উল্লাহ লেখেন, ২০১০ সালের দিকে অলি ভাইয়ের দোকানের একটি ঘটনা মনে আছে। আমি তখন দোকানের পাশের কটেজে থাকতাম। রাত প্রায় দেড়টায় অলি ভাইয়ের এক স্টাফকে এক ছাত্রনেতা মারধর করেছে। অলি ভাইয়ের চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙে। গিয়ে শুনি মারার কারণ তার স্টাফ সেই ছাত্রনেতার থেকে খাবারের বিল চেয়েছিলেন। অলি ভাই তখন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, আমার মতো ছোট হোটেলে যদি এভাবে নিয়মিত বাকি পড়ে তাহলে ব্যবসা করবো কীভাবে? স্টাফদের বেতনই দেবো কেমনে?নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের এক দোকানদার বলেন, অলি ভাই যাদের থেকে টাকা পান অধিকাংশই সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের কর্মী। অনেকবার হলে তাদের রুমে গিয়ে অলি ভাই টাকা চেয়েছেন। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি। কেউ আজ দেবে, কাল দেবে বলে ঘুরিয়েছে।

এদিকে, বিষয়টিকে অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ বলছেন ছাত্রনেতারা। ছাত্র ইউনিয়ন চবি সংসদের সভাপতি প্রত্যয় নাফাক বলেন, আপনি খোঁজ নিলে দেখবেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে সরকারদলীয় সংগঠনের কর্মীদের বাকি বেশি। তারা তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ এই ছোটখাটো দোকানদারদের ওপর দেখাতেও ছাড়েন না। যা কখনোই কাম্য নয়।

চবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আমরা বলি, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার। অর্থাৎ তারা অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কিন্তু আফসোসের বিষয় সেই শিক্ষার্থীরা এখন ছোট পুঁজির দোকানদারের পাওনা টাকা দিচ্ছে না। এটি যেমন হতাশার ঠিক তেমনি লজ্জার।

জেএস/এমআরআর/জিকেএস