৬৬ বছর ধরে এক ঘরে বন্দি স্কুলটি

হাসান তানভীর
ওয়ারীর লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষেই চলে সব কার্যক্রমছবি : নাসির উদ্দিন

পুরান ঢাকার ওয়ারীর ২১৯ লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের সরু গলিতে টিনের ছাউনি দেওয়া জরাজীর্ণ একটি ঘর। প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই, এটি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২০ ফুট প্রস্থের এক কক্ষেই চলছে বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম। কক্ষের এক কোণে একটি টেবিলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুমা চৌধুরীর দপ্তর। অন্য কোনায় টয়লেট। এ ছাড়া বাকি জায়গায় শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য কয়েক ভাগে সাজানো ১০ থেকে ১২টি পুরোনো চেয়ার-টেবিল। সেখানেই একসঙ্গে চলছে দুটি শ্রেণির পাঠদান। সম্প্রতি সরেজমিন পুরান ঢাকার ওয়ারীর লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেল এমন চিত্র। ৬৬ বছরের পুরোনো বিদ্যালয়টির এমন বেহাল দশায় দিন দিন কমছে শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। টিনের ছাউনি দেওয়া একটি মাত্র কক্ষ। সেখানে চলে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম। অল্প কয়েকজন শিক্ষক আর শিক্ষার্থী নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের সহায়তায় বিদ্যালয়ের টুকটাক উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়।

জানা গেছে, ১৯৫৭ সালে স্থাপিত বিদ্যালয়টি ১৯৭৩ সালে সরকারি হয়। ১৯৯১ সাল থেকে স্কুলের জমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আদালতে মামলা চলে। পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালে জমির মালিকানা পায় বিদ্যালয়।

এর আগে থেকেই এক কক্ষের মধ্যেই পাঠদান চলে আসছিল বিদ্যালয়টিতে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে এটি পরিদর্শন করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। তখন তিনি বিদ্যালয়টির জন্য একটি বহুতল ভবন করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর ৭ বছর পার হলেও বিদ্যালয়টির উন্নয়ন কার্যক্রম আলোর মুখ দেখেনি।

বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, তারা ছয়টি শ্রেণির ক্লাস দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। সকাল ৮টা থেকে ১০.৩০টা পর্যন্ত শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ে মোট ৪৮ জন ছাত্-ছাত্রী রয়েছে। এদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে। বিদ্যালয়টিতে চারজন শিক্ষক রয়েছেন।

তিনি জানান, বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ অবকাঠামোর কারণে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের এখানে ভর্তি করাতে চান না। দরিদ্র পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরাই বেশি আসে; কিন্তু করোনা মহামারির পর এই শ্রেণির শিক্ষার্থীও কমে গেছে। মহামারির আগে বিদ্যালয়ে প্রায় ১৭০ শিক্ষার্থী ছিল।

বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মুক্তা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। সে অভিমানের সুরে বলে, অন্য স্কুল কত সুন্দর হয়। আমাদের খেলার জায়গা নেই, একটু ঘোরাঘুরির জায়গা নেই।

স্থানীয় ব্যবসায়ী শিমন বলেন, এই স্কুলে একসময় তার বাপ-চাচারা পড়ালেখা করেছেন; কিন্তু দিনে দিনে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি বিলীন হওয়ার পথে। আগে স্কুলে টয়লেট ছিল না, টিনের ছাউনি দিয়ে পানি পড়ত। কিছুদিন আগে স্থানীয়ারা মিলে নতুন টিন লাগিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকারিভাবে বিদ্যালয়টি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে সূত্রাপুর থানা শিক্ষা কর্মকর্তা মঈনুল হোসেন কালবেলাকে বলেন, এক কক্ষেই বিদ্যালয়টির যাবতীয় কার্যক্রম করতে হচ্ছে। এভাবে একটি বিদ্যালয় চলতে পারে না। আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে দুটি সুপারিশ পাঠিয়েছি। এক জায়গায় একটি বহুতল ভবন করা যেতে পারে অথবা পাশের অন্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি একীভূত করা। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এখনো কোনো সিদ্বান্ত আসেনি।

৬৬ বছর ধরে এক ঘরে বন্দি স্কুলটি

হাসান তানভীর
ওয়ারীর লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষেই চলে সব কার্যক্রমছবি : নাসির উদ্দিন

পুরান ঢাকার ওয়ারীর ২১৯ লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের সরু গলিতে টিনের ছাউনি দেওয়া জরাজীর্ণ একটি ঘর। প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই, এটি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২০ ফুট প্রস্থের এক কক্ষেই চলছে বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম। কক্ষের এক কোণে একটি টেবিলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুমা চৌধুরীর দপ্তর। অন্য কোনায় টয়লেট। এ ছাড়া বাকি জায়গায় শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য কয়েক ভাগে সাজানো ১০ থেকে ১২টি পুরোনো চেয়ার-টেবিল। সেখানেই একসঙ্গে চলছে দুটি শ্রেণির পাঠদান। সম্প্রতি সরেজমিন পুরান ঢাকার ওয়ারীর লাল মোহন সাহা স্ট্রিটের মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেল এমন চিত্র। ৬৬ বছরের পুরোনো বিদ্যালয়টির এমন বেহাল দশায় দিন দিন কমছে শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। টিনের ছাউনি দেওয়া একটি মাত্র কক্ষ। সেখানে চলে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম। অল্প কয়েকজন শিক্ষক আর শিক্ষার্থী নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের সহায়তায় বিদ্যালয়ের টুকটাক উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়।

জানা গেছে, ১৯৫৭ সালে স্থাপিত বিদ্যালয়টি ১৯৭৩ সালে সরকারি হয়। ১৯৯১ সাল থেকে স্কুলের জমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আদালতে মামলা চলে। পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালে জমির মালিকানা পায় বিদ্যালয়।

এর আগে থেকেই এক কক্ষের মধ্যেই পাঠদান চলে আসছিল বিদ্যালয়টিতে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে এটি পরিদর্শন করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। তখন তিনি বিদ্যালয়টির জন্য একটি বহুতল ভবন করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর ৭ বছর পার হলেও বিদ্যালয়টির উন্নয়ন কার্যক্রম আলোর মুখ দেখেনি।

বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, তারা ছয়টি শ্রেণির ক্লাস দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। সকাল ৮টা থেকে ১০.৩০টা পর্যন্ত শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ে মোট ৪৮ জন ছাত্-ছাত্রী রয়েছে। এদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে। বিদ্যালয়টিতে চারজন শিক্ষক রয়েছেন।

তিনি জানান, বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ অবকাঠামোর কারণে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের এখানে ভর্তি করাতে চান না। দরিদ্র পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরাই বেশি আসে; কিন্তু করোনা মহামারির পর এই শ্রেণির শিক্ষার্থীও কমে গেছে। মহামারির আগে বিদ্যালয়ে প্রায় ১৭০ শিক্ষার্থী ছিল।

বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মুক্তা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। সে অভিমানের সুরে বলে, অন্য স্কুল কত সুন্দর হয়। আমাদের খেলার জায়গা নেই, একটু ঘোরাঘুরির জায়গা নেই।

স্থানীয় ব্যবসায়ী শিমন বলেন, এই স্কুলে একসময় তার বাপ-চাচারা পড়ালেখা করেছেন; কিন্তু দিনে দিনে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি বিলীন হওয়ার পথে। আগে স্কুলে টয়লেট ছিল না, টিনের ছাউনি দিয়ে পানি পড়ত। কিছুদিন আগে স্থানীয়ারা মিলে নতুন টিন লাগিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকারিভাবে বিদ্যালয়টি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে সূত্রাপুর থানা শিক্ষা কর্মকর্তা মঈনুল হোসেন কালবেলাকে বলেন, এক কক্ষেই বিদ্যালয়টির যাবতীয় কার্যক্রম করতে হচ্ছে। এভাবে একটি বিদ্যালয় চলতে পারে না। আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে দুটি সুপারিশ পাঠিয়েছি। এক জায়গায় একটি বহুতল ভবন করা যেতে পারে অথবা পাশের অন্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি একীভূত করা। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এখনো কোনো সিদ্বান্ত আসেনি।