কাগজও দামের চূড়ায়

সাব্বির নেওয়াজ ও জসিম উদ্দিন বাদল

কাগজের দাম এখন দারুণ চড়া। এ কারণে বাজারে দেখা দিয়েছে কাগজ সংকট। গেল পাঁচ মাসের মধ্যে পাইকারিতে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শিক্ষার অন্যতম উপকরণ খাতা কিনতে হচ্ছে অস্বাভাবিক দরে। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে কখনোই এমন দেখা যায়নি। চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না মুদ্রণশিল্পের মালিকরা। ফলে নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন বছরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ নিয়েও রয়েছে সংশয়।

এ পটভূমিতে পাইকাররা দোষ চাপাচ্ছেন কাগজকল মালিকদের ওপর। মিল মালিকরা বলছেন, ডলার ও বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির মন্ড বা ভার্জিন পাল্পের দর বাড়ার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদনে ভজঘট তো আছেই। ফলে বাজারে কমেছে সরবরাহ। বাড়ছে কাগজের দাম।

করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে কাগজ উৎপাদন কম হওয়া, ভার্জিন পাল্পের সংকট ও কাগজের আকাশছোঁয়া দরের কারণে আসছে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপাতে প্রয়োজন হয় মোট এক লাখ টন কাগজ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাগজের কাঁচামাল সংকটের কারণে দেশের মিলগুলো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না।

এ ব্যাপারে মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বই ছাপাতে গিয়ে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা তো আছেই। এখন ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ কাগজের দর। দেশে এখন যে পরিমাণ কাগজ আছে তাতে সর্বোচ্চ ৩০-৪০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উৎপাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের পাল্প আছে। ৩৫ কোটি বই ছাপাতে লাগবে ১ লাখ টনের বেশি কাগজ। এখন কাগজ না থাকলে কী করে বই ছাপা হবে? তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কাগজ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। বাজারে এখন পর্যন্ত কাগজের দাম কমেনি। তাই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্ক্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া।

দেশের বৃহত্তম কাগজের মার্কেট রাজধানীর নয়াবাজার, নওয়াব ইউসুফ রোড এবং জিন্দাবাহার লেন ঘুরে দেখা গেছে, চার থেকে পাঁচ মাসের ব্যবধানে পাইকারিতে হোয়াইটপ্রিন্ট প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। বাজারে এ মানের প্রতি টন কাগজ বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ২৮ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। ছয় মাস আগেও এই কাগজ মিলতো ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। এছাড়া ভালো মানের নিউজপ্রিন্ট প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। মাস চারেক আগেও এ মানের কাগজের টন বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। সেই হিসাবে এ ধরনের কাগজের টনে বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের এ সময়ে নতুন বই ছাপানোর জন্য প্রচুর কাগজের প্রয়োজন হয়। ফলে বাংলাবাজারের প্রকাশকরা বিভিন্ন ধরনের বই ছাপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ কারণে এখন কাগজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অথচ কোনো কারণ ছাড়াই কাগজের দাম বাড়ছে। সরবরাহও কমেছে। আগে ১০০ টনের অর্ডার দিলে তিন-চার দিনের মধ্যে সরবরাহ করা হতো। এখন ১০০ টন কাগজ পেতে সময় লাগছে ৮ থেকে ১০ দিন। মিলাররা মূলত ডলার সংকট ও উৎপাদন সমস্যা দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। বর্তমান বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। কাগজকলগুলোও এ সুযোগে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।

নয়াবাজারের ঢাকা পেপার হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. মানিক সমকালকে বলেন, দাম বাড়ার পরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো- টাকা দিয়েও কাগজ না পাওয়া। ২০ টনের অর্ডার দিলে মিলাররা দেয় ৮ থেকে ৯ টন। এ বাজারের মেসার্স রমনা ট্রেডার্সের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, মিলগেটে কাগজের দাম বেড়েছে। গত তিন-চার মাসে দুই থেকে তিন দফায় দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পাইকারি বাজারে।

বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক অনিল দাশ বলেন, আগে বিশ্ববাজারে প্রতি টন কাগজের দাম ১১শ থেকে সাড়ে ১১শ ডলার ছিল। কমে এখন ৯শ ডলারের নেমেছে। জাহাজ ভাড়াও কমেছে। অথচ বিদেশি কাগজের বুকিং কমে গেছে। এর মধ্যেই দেশে অনেক দাম বেড়েছে।

কাগজ উৎপাদন ও ব্যবসায়ীদের তথ্য বলছে, দেশে বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ টন কাগজের প্রয়োজন হয়, যার অধিকাংশই দেশের উৎপাদনকারীরা সরবরাহ করে। এর মধ্যে আর্টপেপারসহ বিশেষ কিছু কাগজ আমদানি হয়। দেশে শতাধিক কাগজ কল ছিল। নানা কারণে ৬০ থেকে ৭০টি বন্ধ হয়ে গেছে।

মুদ্রণশিল্প মালিকরা জানান, নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের দেওয়ার জন্য সরকারের ৩৬ কোটি পিস পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে। কাগজ সংকট ও দাম বাড়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। মুদ্রাকররা বলেন, মাস তিনেক আগে মিলে হোয়াইটপ্রিন্টের প্রতি টন কাগজের বুকিং দেওয়া গেছে ৯৪ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। মিলাররা এখন সেই কাগজের দাম ধরছেন এক লাখ ১৫ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন কাগজে ২১ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেশি চাইছে কাগজ কলগুলো। দাম বাড়ানোর পাশাপাশি কাগজের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে তারা। এতে তৈরি হয়েছে এক ধরনের সংকট। ফলে এবার নির্ধারিত সময়ে সরকারের বিনামূল্যের বই ছাপার কাজ শেষ করা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি শামসুল ইসলাম বাহার সমকালকে বলেন, অস্বাভাবিক দামেও চাহিদামতো কাগজ মিলছে না। সামনে কাগজের আরও টান পড়তে পারে। অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট। মাত্র দুই মাসের মধ্যে সরকারের ৩৫ কোটি বই ছাপার কাজ কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি বলেন, কাগজকলগুলো সাধারণত বই ছাপার মৌসুমের ছয় থেকে সাত মাস আগেই পাল্প আমদানি করে কাগজ উৎপাদন করতে থাকে। এ বছর কেন তারা আগে পাল্প আমদানি করেনি, তা বুঝতে পারছি না।

এদিকে, সরকারের চাপে সরকারি বিনামূল্যের বই ছাপার ক্ষেত্রে সংকট না হলেও বছরের শুরুতে বিভিন্ন একাডেমিক বই ছাপানোর সময় কাগজের কৃত্রিম সংকট হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতারা। তাঁরা বলছেন, সরকারের চাপে হয়তো মিল মালিকরা বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর জন্য কাগজ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখবে। এরপর আবার বাজারে কাগজ সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। এতে বিপদে পড়তে পারেন একাডেমিক ও সৃজনশীল বইসহ অন্য প্রকাশকরা।

গত দেড় বছরে নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম প্রায় ১৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন। তিনি বলেন, গত বছরের জুন-জুলাইয়ে নিউজপ্রিন্ট কাগজের টন ছিল ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। ডিসেম্বরের দিকে তা বেড়ে হয় ৪৭ থেকে ৪৯ হাজার টাকা। এরপর এ বছরের সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৭০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে।

দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে বাড়ার কারণে খুচরা বাজারেও কাগজের দাম লাগামহীন। খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেখার কাগজ প্রতি রিম এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকায়, যা চার থেকে পাঁচ মাস আগেও কেনা গেছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। ফার্মগেটের তমা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আরিফ হোসাইন সমকালকে বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা বড় সিন্ডেকেট তৈরি করে রেখেছেন। এ কারণে কাগজের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। একই সঙ্গে কলমসহ শিক্ষার অন্য উপকরণের দামও বেড়েছে পাইকারি বাজারে। ২০০ পাতার একটি লেখার খাতা আগে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। ফটোকপির জন্য ব্যবহার করা হয়- এমন এ-ফোর আকারের এক রিম কাগজের দাম এখন ২৯০ টাকা, যা তিন-চার মাস আগে ছিল ২১০ থেকে ২২০ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বসুন্ধরা পেপার মিলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কয়েক মাস আগেও বিশ্ববাজারে পাল্পের টন ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ ডলার। দাম এখন এক হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তাঁদের উৎপাদন কমেছে অন্তত ৪০ শতাংশ। এ কারণে কাগজের দাম বেড়েছে।

কাগজও দামের চূড়ায়

সাব্বির নেওয়াজ ও জসিম উদ্দিন বাদল

কাগজের দাম এখন দারুণ চড়া। এ কারণে বাজারে দেখা দিয়েছে কাগজ সংকট। গেল পাঁচ মাসের মধ্যে পাইকারিতে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শিক্ষার অন্যতম উপকরণ খাতা কিনতে হচ্ছে অস্বাভাবিক দরে। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে কখনোই এমন দেখা যায়নি। চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না মুদ্রণশিল্পের মালিকরা। ফলে নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন বছরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ নিয়েও রয়েছে সংশয়।

এ পটভূমিতে পাইকাররা দোষ চাপাচ্ছেন কাগজকল মালিকদের ওপর। মিল মালিকরা বলছেন, ডলার ও বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির মন্ড বা ভার্জিন পাল্পের দর বাড়ার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদনে ভজঘট তো আছেই। ফলে বাজারে কমেছে সরবরাহ। বাড়ছে কাগজের দাম।

করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে কাগজ উৎপাদন কম হওয়া, ভার্জিন পাল্পের সংকট ও কাগজের আকাশছোঁয়া দরের কারণে আসছে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপাতে প্রয়োজন হয় মোট এক লাখ টন কাগজ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাগজের কাঁচামাল সংকটের কারণে দেশের মিলগুলো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না।

এ ব্যাপারে মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বই ছাপাতে গিয়ে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা তো আছেই। এখন ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ কাগজের দর। দেশে এখন যে পরিমাণ কাগজ আছে তাতে সর্বোচ্চ ৩০-৪০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উৎপাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের পাল্প আছে। ৩৫ কোটি বই ছাপাতে লাগবে ১ লাখ টনের বেশি কাগজ। এখন কাগজ না থাকলে কী করে বই ছাপা হবে? তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কাগজ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। বাজারে এখন পর্যন্ত কাগজের দাম কমেনি। তাই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্ক্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া।

দেশের বৃহত্তম কাগজের মার্কেট রাজধানীর নয়াবাজার, নওয়াব ইউসুফ রোড এবং জিন্দাবাহার লেন ঘুরে দেখা গেছে, চার থেকে পাঁচ মাসের ব্যবধানে পাইকারিতে হোয়াইটপ্রিন্ট প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। বাজারে এ মানের প্রতি টন কাগজ বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ২৮ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। ছয় মাস আগেও এই কাগজ মিলতো ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। এছাড়া ভালো মানের নিউজপ্রিন্ট প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। মাস চারেক আগেও এ মানের কাগজের টন বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। সেই হিসাবে এ ধরনের কাগজের টনে বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের এ সময়ে নতুন বই ছাপানোর জন্য প্রচুর কাগজের প্রয়োজন হয়। ফলে বাংলাবাজারের প্রকাশকরা বিভিন্ন ধরনের বই ছাপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ কারণে এখন কাগজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অথচ কোনো কারণ ছাড়াই কাগজের দাম বাড়ছে। সরবরাহও কমেছে। আগে ১০০ টনের অর্ডার দিলে তিন-চার দিনের মধ্যে সরবরাহ করা হতো। এখন ১০০ টন কাগজ পেতে সময় লাগছে ৮ থেকে ১০ দিন। মিলাররা মূলত ডলার সংকট ও উৎপাদন সমস্যা দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। বর্তমান বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। কাগজকলগুলোও এ সুযোগে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।

নয়াবাজারের ঢাকা পেপার হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. মানিক সমকালকে বলেন, দাম বাড়ার পরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো- টাকা দিয়েও কাগজ না পাওয়া। ২০ টনের অর্ডার দিলে মিলাররা দেয় ৮ থেকে ৯ টন। এ বাজারের মেসার্স রমনা ট্রেডার্সের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, মিলগেটে কাগজের দাম বেড়েছে। গত তিন-চার মাসে দুই থেকে তিন দফায় দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পাইকারি বাজারে।

বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক অনিল দাশ বলেন, আগে বিশ্ববাজারে প্রতি টন কাগজের দাম ১১শ থেকে সাড়ে ১১শ ডলার ছিল। কমে এখন ৯শ ডলারের নেমেছে। জাহাজ ভাড়াও কমেছে। অথচ বিদেশি কাগজের বুকিং কমে গেছে। এর মধ্যেই দেশে অনেক দাম বেড়েছে।

কাগজ উৎপাদন ও ব্যবসায়ীদের তথ্য বলছে, দেশে বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ টন কাগজের প্রয়োজন হয়, যার অধিকাংশই দেশের উৎপাদনকারীরা সরবরাহ করে। এর মধ্যে আর্টপেপারসহ বিশেষ কিছু কাগজ আমদানি হয়। দেশে শতাধিক কাগজ কল ছিল। নানা কারণে ৬০ থেকে ৭০টি বন্ধ হয়ে গেছে।

মুদ্রণশিল্প মালিকরা জানান, নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের দেওয়ার জন্য সরকারের ৩৬ কোটি পিস পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে। কাগজ সংকট ও দাম বাড়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। মুদ্রাকররা বলেন, মাস তিনেক আগে মিলে হোয়াইটপ্রিন্টের প্রতি টন কাগজের বুকিং দেওয়া গেছে ৯৪ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। মিলাররা এখন সেই কাগজের দাম ধরছেন এক লাখ ১৫ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন কাগজে ২১ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেশি চাইছে কাগজ কলগুলো। দাম বাড়ানোর পাশাপাশি কাগজের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে তারা। এতে তৈরি হয়েছে এক ধরনের সংকট। ফলে এবার নির্ধারিত সময়ে সরকারের বিনামূল্যের বই ছাপার কাজ শেষ করা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি শামসুল ইসলাম বাহার সমকালকে বলেন, অস্বাভাবিক দামেও চাহিদামতো কাগজ মিলছে না। সামনে কাগজের আরও টান পড়তে পারে। অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট। মাত্র দুই মাসের মধ্যে সরকারের ৩৫ কোটি বই ছাপার কাজ কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি বলেন, কাগজকলগুলো সাধারণত বই ছাপার মৌসুমের ছয় থেকে সাত মাস আগেই পাল্প আমদানি করে কাগজ উৎপাদন করতে থাকে। এ বছর কেন তারা আগে পাল্প আমদানি করেনি, তা বুঝতে পারছি না।

এদিকে, সরকারের চাপে সরকারি বিনামূল্যের বই ছাপার ক্ষেত্রে সংকট না হলেও বছরের শুরুতে বিভিন্ন একাডেমিক বই ছাপানোর সময় কাগজের কৃত্রিম সংকট হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতারা। তাঁরা বলছেন, সরকারের চাপে হয়তো মিল মালিকরা বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর জন্য কাগজ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখবে। এরপর আবার বাজারে কাগজ সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। এতে বিপদে পড়তে পারেন একাডেমিক ও সৃজনশীল বইসহ অন্য প্রকাশকরা।

গত দেড় বছরে নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম প্রায় ১৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন। তিনি বলেন, গত বছরের জুন-জুলাইয়ে নিউজপ্রিন্ট কাগজের টন ছিল ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। ডিসেম্বরের দিকে তা বেড়ে হয় ৪৭ থেকে ৪৯ হাজার টাকা। এরপর এ বছরের সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৭০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে।

দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে বাড়ার কারণে খুচরা বাজারেও কাগজের দাম লাগামহীন। খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেখার কাগজ প্রতি রিম এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকায়, যা চার থেকে পাঁচ মাস আগেও কেনা গেছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। ফার্মগেটের তমা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আরিফ হোসাইন সমকালকে বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা বড় সিন্ডেকেট তৈরি করে রেখেছেন। এ কারণে কাগজের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। একই সঙ্গে কলমসহ শিক্ষার অন্য উপকরণের দামও বেড়েছে পাইকারি বাজারে। ২০০ পাতার একটি লেখার খাতা আগে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। ফটোকপির জন্য ব্যবহার করা হয়- এমন এ-ফোর আকারের এক রিম কাগজের দাম এখন ২৯০ টাকা, যা তিন-চার মাস আগে ছিল ২১০ থেকে ২২০ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বসুন্ধরা পেপার মিলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কয়েক মাস আগেও বিশ্ববাজারে পাল্পের টন ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ ডলার। দাম এখন এক হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তাঁদের উৎপাদন কমেছে অন্তত ৪০ শতাংশ। এ কারণে কাগজের দাম বেড়েছে।