প্রশ্ন ভুলের দায় কার

সাব্বির নেওয়াজ

উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিন গত রোববার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি বাংলা প্রথম পত্রে সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে হতবাক হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। কিছু লিখতেই পারছিলেন না তাঁরা। এক ঘণ্টা চলার পর সংশ্নিষ্টদের নজরে এলে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। একই দিন অঘটন ঘটে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রেও। সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক উদ্দীপক তুলে হয় বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নে। এতে ব্যাপক ভোগান্তি ও সমস্যায় পড়েন পরীক্ষার্থীরা। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় নেন না কেউ। ফলে ভুলের ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে।

এ দুটি ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষায় দুটি শিক্ষা বোর্ডের গাফিলতি ধরা পড়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনাও। গত ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া চলতি বছরের মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কুড়িগ্রামে কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ওই পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্রে গুরুতর বানান ভুল, পরীক্ষা কক্ষে ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ, বিলম্বে প্রশ্ন বিতরণসহ পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে। সে সময় তিন শিক্ষককে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় আটক করেছিল পুলিশ।

বরাবরের মতো এবারও প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় শিক্ষকদের ওপরেই চাপাচ্ছে অভিযুক্ত দুই শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তাদের কথা, প্রশ্নপত্র বোর্ডের কারও দেখার সুযোগ নেই। প্রণয়ন ও মডারেশনের পর তা সিলগালা অবস্থায় চলে যায় বিজি প্রেসে। সেখানে ছাপার পর প্যাকেটজাত হয়ে কেন্দ্রে যায়। পরীক্ষার দিন প্যাকেট খোলা হয়। কোনো ভুল থাকলে আগে তা জানার সুযোগ থাকে না বোর্ড কর্তৃপক্ষের। অন্যদিকে, কয়েকজন প্রশ্ন সেটার ও মডারেটর শিক্ষক সমকালকে বলেন, প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে বোর্ডসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা সম্মানী নেন। তাঁরা বছরে ছয়টি বোনাস নেন। তাহলে প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় কেন তাঁরা নেবেন না?

জানা গেছে, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় কারিগরি বোর্ডে ভুল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উপাদান থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। গতকাল সোমবার বিকেলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং পরীক্ষাসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয়ে ডেকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করা হয়েছে। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়- কেন, কীভাবে এ ঘটনা ঘটল। বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়. সংশ্নিষ্ট শিক্ষকরাই (প্রশ্ন সেটার ও মডারেটর) এ জন্য দায়ী। তবে এ জবাবে সন্তুষ্ট নয় মন্ত্রণালয়। তাদেরকে এ ঘটনায় কার কী দায় তা নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়কে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দেশের একাধিক বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত রোববার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিএম) বাংলা প্রথম পত্রে সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষকরা জানান, সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে দুই বছরব্যাপী এইচএসসির শিক্ষাক্রম শেষ হলে ফাইনাল পরীক্ষা বোর্ডগুলো একবারই নেয়। তবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিএম) কোর্সে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পৃথক দুটি বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়া হয়। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এ বছরের প্রথম বর্ষের বাংলা-১ বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সিলেবাসের বাইরে থেকে করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা-২ এবং বাংলা-১ মিলে প্রশ্নটি করা হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে সারাদেশে হইচই হলে বাংলা-১ বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ৯৩১ পরীক্ষার্থী। এ ছাড়া আবার পরীক্ষা নিতে নতুন করে প্রশ্নপত্র তৈরিসহ বিপুল টাকার ক্ষতি হবে সরকারের।

শিক্ষকরা জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন এবং মুদ্রণের জন্য একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে, যার নাম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। এ বিভাগের একজন উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন এবং মুদ্রণের দায়িত্বে রয়েছেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশনের কাজটি অত্যন্ত গোপনীয়, গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়ও বটে। একাধিক শিক্ষক জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিএম) শিক্ষাক্রমের জন্য রয়েছে আলাদা কোর্স কারিকুলাম। এ জন্য আলাদা জনবল কাঠামোও রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি বিএম কোর্সের শিক্ষক ছাড়া সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষককে দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশনের কাজ করা হলে পরীক্ষার প্রশ্নে এ ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। শিক্ষকদের ধারণা, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি বিএম কোর্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন শিক্ষক দিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি ও মডারেশনের কাজ করা হয়েছে। যে কারণে প্রশ্নপত্রে এ ধরনের ত্রুটির ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (বিএম) মো. সুলতান হোসেন সোমবার সমকালকে বলেন, আমি কোনো দপ্তরপ্রধান নই। তাই কথা বলতে পারছি না। কথা বলতে চাননি এ বোর্ডের চেয়ারম্যান কেপায়েত উল্লাহও।
অপরদিকে, রোববার অনুষ্ঠিত ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র সৃজনশীল ১১ নম্বর প্রশ্নে নাটক সিরাজউদ্দৌলা অংশের প্রশ্নপত্রে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে প্রশ্ন উঠেছে। বিশিষ্টজন বলছেন, এটি রীতিমতো ধর্মীয় উস্কানির শামিল। প্রণীত প্রশ্নে একটি উদ্দীপকে বলা হয়- ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’

শিক্ষাবিদ ও সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও প্রশ্নপত্রে ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের বাস্তবিক চিত্রও এমন নয়। ধর্মীয় নানা উৎসবে দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ সবাই অংশগ্রহণ করে।
শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ধর্মকে সামনাসামনি করা ঠিক হয়নি। মুসলমানের কাছে জমি বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করছে- এ ধরনের তথ্য সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ঘটনা কখনও কাম্য নয়।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ কোনো বক্তব্য যেন না থাকে- সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে ওরিয়েন্টেশন করানো হয়। তবে প্রশ্নপত্র দেখার কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি জানান, বিজি প্রেসে প্রশ্নের পাণ্ডুলিপি জমা আছে। সেখান থেকে মঙ্গলবারের মধ্যে ওই প্রশ্ন তৈরিতে সংশ্নিষ্ট প্রশ্নকর্তা ও মডারেটরদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।

শিক্ষামন্ত্রী যা বললেন :পুরো ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে সাম্প্রদায়িক ‘উস্কানিদাতাকে’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গতকাল রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, খুবই দুঃখজনক যে, কোনো একজন প্রশ্নকর্তা হয়তো এই প্রশ্নটি করেছেন এবং যিনি মডারেট করেছেন; কোনোভাবে সেটি তাঁর দৃষ্টিও এড়িয়ে গেছে।

দীপু মনি বলেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। যাঁরা চিহ্নিত হবেন এবং যাঁরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে এ ধরনের বীজ বপন করবেন, তাঁদের এ ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত রাখার প্রশ্ন আসবে না।
আর কারিগরি বোর্ডের বাংলা-১ বিষয়ের পরীক্ষায় ভুল প্রশ্নের বিষয়ে তিনি বলেন, নতুন-পুরাতন সিলেবাস গুলিয়ে ফেলায় ওই ভুল হয়েছে। ভুলটা শিক্ষা বোর্ড করেছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রশ্ন যখন ছাপা হয়েছে, ছাপা হওয়ার ক্ষেত্রে একটা ত্রুটি থেকে যেতে পারে। আরেকটি হচ্ছে ছাপা হওয়ার পরে প্যাকেজিং।

প্রশ্নে ভুল ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রশ্ন সেটিং, প্রশ্ন মডারেটিং- এ কাজগুলো এমনভাবে হয় যে, যিনি প্রশ্ন সেট করে যান, তিনি আর প্রশ্ন দেখতে পারেন না। তার পর যিনি প্রশ্ন মডারেট করে যান, তিনিও প্রশ্ন দেখতে পারেন না। তাঁরা ছাড়া প্রশ্নের একটা অক্ষরও কারও দেখার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন ভুলের দায় কার

সাব্বির নেওয়াজ

উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিন গত রোববার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি বাংলা প্রথম পত্রে সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে হতবাক হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। কিছু লিখতেই পারছিলেন না তাঁরা। এক ঘণ্টা চলার পর সংশ্নিষ্টদের নজরে এলে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। একই দিন অঘটন ঘটে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রেও। সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক উদ্দীপক তুলে হয় বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নে। এতে ব্যাপক ভোগান্তি ও সমস্যায় পড়েন পরীক্ষার্থীরা। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় নেন না কেউ। ফলে ভুলের ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে।

এ দুটি ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষায় দুটি শিক্ষা বোর্ডের গাফিলতি ধরা পড়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনাও। গত ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া চলতি বছরের মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কুড়িগ্রামে কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ওই পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্রে গুরুতর বানান ভুল, পরীক্ষা কক্ষে ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ, বিলম্বে প্রশ্ন বিতরণসহ পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে। সে সময় তিন শিক্ষককে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় আটক করেছিল পুলিশ।

বরাবরের মতো এবারও প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় শিক্ষকদের ওপরেই চাপাচ্ছে অভিযুক্ত দুই শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তাদের কথা, প্রশ্নপত্র বোর্ডের কারও দেখার সুযোগ নেই। প্রণয়ন ও মডারেশনের পর তা সিলগালা অবস্থায় চলে যায় বিজি প্রেসে। সেখানে ছাপার পর প্যাকেটজাত হয়ে কেন্দ্রে যায়। পরীক্ষার দিন প্যাকেট খোলা হয়। কোনো ভুল থাকলে আগে তা জানার সুযোগ থাকে না বোর্ড কর্তৃপক্ষের। অন্যদিকে, কয়েকজন প্রশ্ন সেটার ও মডারেটর শিক্ষক সমকালকে বলেন, প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে বোর্ডসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা সম্মানী নেন। তাঁরা বছরে ছয়টি বোনাস নেন। তাহলে প্রশ্নপত্রে ভুলের দায় কেন তাঁরা নেবেন না?

জানা গেছে, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় কারিগরি বোর্ডে ভুল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উপাদান থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। গতকাল সোমবার বিকেলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং পরীক্ষাসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয়ে ডেকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করা হয়েছে। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়- কেন, কীভাবে এ ঘটনা ঘটল। বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়. সংশ্নিষ্ট শিক্ষকরাই (প্রশ্ন সেটার ও মডারেটর) এ জন্য দায়ী। তবে এ জবাবে সন্তুষ্ট নয় মন্ত্রণালয়। তাদেরকে এ ঘটনায় কার কী দায় তা নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়কে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দেশের একাধিক বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত রোববার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিএম) বাংলা প্রথম পত্রে সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষকরা জানান, সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে দুই বছরব্যাপী এইচএসসির শিক্ষাক্রম শেষ হলে ফাইনাল পরীক্ষা বোর্ডগুলো একবারই নেয়। তবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিএম) কোর্সে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পৃথক দুটি বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়া হয়। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এ বছরের প্রথম বর্ষের বাংলা-১ বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সিলেবাসের বাইরে থেকে করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা-২ এবং বাংলা-১ মিলে প্রশ্নটি করা হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে সারাদেশে হইচই হলে বাংলা-১ বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ৯৩১ পরীক্ষার্থী। এ ছাড়া আবার পরীক্ষা নিতে নতুন করে প্রশ্নপত্র তৈরিসহ বিপুল টাকার ক্ষতি হবে সরকারের।

শিক্ষকরা জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন এবং মুদ্রণের জন্য একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে, যার নাম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। এ বিভাগের একজন উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন এবং মুদ্রণের দায়িত্বে রয়েছেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশনের কাজটি অত্যন্ত গোপনীয়, গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়ও বটে। একাধিক শিক্ষক জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিএম) শিক্ষাক্রমের জন্য রয়েছে আলাদা কোর্স কারিকুলাম। এ জন্য আলাদা জনবল কাঠামোও রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি বিএম কোর্সের শিক্ষক ছাড়া সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষককে দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশনের কাজ করা হলে পরীক্ষার প্রশ্নে এ ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। শিক্ষকদের ধারণা, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি বিএম কোর্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন শিক্ষক দিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি ও মডারেশনের কাজ করা হয়েছে। যে কারণে প্রশ্নপত্রে এ ধরনের ত্রুটির ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (বিএম) মো. সুলতান হোসেন সোমবার সমকালকে বলেন, আমি কোনো দপ্তরপ্রধান নই। তাই কথা বলতে পারছি না। কথা বলতে চাননি এ বোর্ডের চেয়ারম্যান কেপায়েত উল্লাহও।
অপরদিকে, রোববার অনুষ্ঠিত ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র সৃজনশীল ১১ নম্বর প্রশ্নে নাটক সিরাজউদ্দৌলা অংশের প্রশ্নপত্রে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে প্রশ্ন উঠেছে। বিশিষ্টজন বলছেন, এটি রীতিমতো ধর্মীয় উস্কানির শামিল। প্রণীত প্রশ্নে একটি উদ্দীপকে বলা হয়- ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’

শিক্ষাবিদ ও সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও প্রশ্নপত্রে ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের বাস্তবিক চিত্রও এমন নয়। ধর্মীয় নানা উৎসবে দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ সবাই অংশগ্রহণ করে।
শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ধর্মকে সামনাসামনি করা ঠিক হয়নি। মুসলমানের কাছে জমি বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করছে- এ ধরনের তথ্য সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ঘটনা কখনও কাম্য নয়।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ কোনো বক্তব্য যেন না থাকে- সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে ওরিয়েন্টেশন করানো হয়। তবে প্রশ্নপত্র দেখার কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি জানান, বিজি প্রেসে প্রশ্নের পাণ্ডুলিপি জমা আছে। সেখান থেকে মঙ্গলবারের মধ্যে ওই প্রশ্ন তৈরিতে সংশ্নিষ্ট প্রশ্নকর্তা ও মডারেটরদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।

শিক্ষামন্ত্রী যা বললেন :পুরো ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে সাম্প্রদায়িক ‘উস্কানিদাতাকে’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গতকাল রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, খুবই দুঃখজনক যে, কোনো একজন প্রশ্নকর্তা হয়তো এই প্রশ্নটি করেছেন এবং যিনি মডারেট করেছেন; কোনোভাবে সেটি তাঁর দৃষ্টিও এড়িয়ে গেছে।

দীপু মনি বলেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। যাঁরা চিহ্নিত হবেন এবং যাঁরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে এ ধরনের বীজ বপন করবেন, তাঁদের এ ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত রাখার প্রশ্ন আসবে না।
আর কারিগরি বোর্ডের বাংলা-১ বিষয়ের পরীক্ষায় ভুল প্রশ্নের বিষয়ে তিনি বলেন, নতুন-পুরাতন সিলেবাস গুলিয়ে ফেলায় ওই ভুল হয়েছে। ভুলটা শিক্ষা বোর্ড করেছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রশ্ন যখন ছাপা হয়েছে, ছাপা হওয়ার ক্ষেত্রে একটা ত্রুটি থেকে যেতে পারে। আরেকটি হচ্ছে ছাপা হওয়ার পরে প্যাকেজিং।

প্রশ্নে ভুল ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রশ্ন সেটিং, প্রশ্ন মডারেটিং- এ কাজগুলো এমনভাবে হয় যে, যিনি প্রশ্ন সেট করে যান, তিনি আর প্রশ্ন দেখতে পারেন না। তার পর যিনি প্রশ্ন মডারেট করে যান, তিনিও প্রশ্ন দেখতে পারেন না। তাঁরা ছাড়া প্রশ্নের একটা অক্ষরও কারও দেখার সুযোগ নেই।