কোন পথে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাবি ক্যাম্পাস। ফাইল ছবি

ড. মো. কামরুজ্জামান

বিশ্ববিদ্যালয় হলো উন্নত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি দেশের জন্য নয়, বিশ্বসমাজের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উল্লিখিত লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়েছে। এসব লক্ষ্য থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অবস্থান করছে যোজন যোজন দূরে। বিপরীতমুখী স্রোতের অনুকূলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ পেয়েছে। এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একেবারে হয় না বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য রাজনৈতিক পরিচয়েই তার পদ অলংকৃত করে থাকেন। এ কারণে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের সময় কিছু শিক্ষকের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। এ পদে নিয়োগ পেতে একজন উপাচার্যকে সর্বপ্রথম দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হয়। এতে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি আর নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করতে পারেন না। বাকি সময় তাকে সরকারকে তোয়াজ করেই চলতে হয়।শুধু উপাচার্য নিয়োগই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পদ-পদবি পেতেও যোগ্যতা হিসাবে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা ইত্যাদি পদে নিয়োগ পেতে একমাত্র যোগ্যতা হলো ক্ষমতাসীন দলের ‘অন্ধকর্মী’ হওয়া। এসব পদ পেতেও দলীয় প্রভাব থাকতে হয়। দাঙ্গাবাজ ছাড়া সাধারণ নিরীহ কর্মীদের ভাগ্যে এসব পদ জোটে না। ভালো শিক্ষক হওয়ার একমাত্র গুণাবলি হলো রাজনৈতিকভাবে পেশিশক্তির অধিকারী হওয়া। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছে অর্থ, স্বার্থ ও ক্ষমতা। সম্মানিত অধ্যাপকরা শিক্ষা ও গবেষণা বাদ দিয়ে এসব পদ পেতে ব্যস্ত সময় পার করেন সর্বক্ষণ। অথচ একজন অধ্যাপকের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের ক্লাস গ্রহণের মাধ্যমে মোটিভেশনাল কার্যক্রমে মনোযোগী হওয়া। তাদের দায়িত্ব হলো শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতিকে নতুন পথের সন্ধান দেওয়া; কিন্তু এসব কাজ বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপকরা বর্তমানে বিভিন্ন দলীয় বৃত্তে বন্দি হয়ে আছেন। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার লোভে সংকীর্ণ দলীয় বন্দিত্ব থেকে তারা বের হয়ে আসেন না। এ কারণে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো ধরনের সাফল্য নেই। দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, উপাচার্য হতে বাংলাদেশের অনেক অধ্যাপক মন্ত্রী, আমলা ও এমপিকে তোয়াজ করে বেড়ান! এসব কারণে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এগিয়ে আসতে পারেনি।

আমরা কথায় কথায় উন্নত দেশের উদাহরণ তুলে ধরি। আমাদের দেশকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, জাপান-আমেরিকার মতো উন্নত রাষ্ট্র বানাতে চাই। অথচ সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সামনে এনে তুলে ধরি না। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের জীবন অত্যন্ত কষ্টময়। সে দেশে একজন অধ্যাপক দিন-রাত পরিশ্রম করেন। তারা নিত্যনতুন গবেষণা উপহার দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ‘রিলাক্সড মুডে’ চাকরি করেন। এ কারণে এখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি চুটিয়ে রাজনীতি করা যায়। অনেকে নামকাওয়াস্তে দায়সারা গোছের কিছু ক্লাস আর টিউটোরিয়াল নেন। বাকি সময়জুড়ে তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী বৈ কিছুই নন। রাজনৈতিক পদ ও সুযোগ-সুবিধা অর্জন করে একজন অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের সামনে দাপট জাহির করেন। এ দাপট দেখাতে তাকে বেশ পুলকিত, আনন্দিত ও আহ্লাদে গদগদ হতে দেখা যায়। ক্ষমতা জাহিরের মাধ্যমে তিনি নিজের মধ্যে বেশ বাহাদুরি মনোভাব পোষণ করেন।

আমাদের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের জার্নাল প্রকাশনা ব্যবস্থা চালু আছে। এ জার্নালে আমরা অতি সহজে প্রমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্টিকেল প্রকাশ করতে পারি। সব প্রমোশন শেষ তো প্রকাশনাও শেষ। আমরা অবশিষ্ট সময় চুটিয়ে রাজনীতি করি। রাজনীতির বিপরীতে যারা একটু-আধটু গবেষণা করতে চান, তারা উপেক্ষিত ও চাপের মধ্যে থাকেন। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কর্নার্ড’ করে রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর কাছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় আবেগের জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানে হাজারও জল্পনা-কল্পনায় সাজানো একটি স্বপ্ন। সে স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার নিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু বেশির ভাগ স্বপ্ন এখানে অসমাপ্ত থেকে যায়। আমরা বাঙালিরা কথায় কথায় একটু ঐতিহ্য খুঁজে ফিরে চলি। আর এক্ষেত্রে আমরা ঘুরেফিরে ১৯৬২, ’৬৯, ’৭১ আর ’৯০-এর গণ-আন্দোলনকেই সামনে আনি। পরবর্তী দিনগুলোর ব্যর্থতার কথা আমরা তেমন একটা বলি না!

শিক্ষা যে কোনো দেশ ও জাতির মেরুদণ্ড। আর এর চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ কেন্দ্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেটিকে আমরা ব্যক্তিগত ও কিংবা দলীয় সম্পদে পরিণত করে ফেলেছি। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এটাকে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন। আর এ কারণেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। এখন এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় যতটা সফল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে ততটা সফল নয়। অবশ্য রাজনীতি শব্দটি অতি পবিত্র এক শব্দ। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মনীতিকে রাজনীতি বলা হয়। কিন্তু সে নিয়মনীতি আজ নোংরা নীতিতে পরিণত হয়েছে। এ রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একাডেমিক পরিবেশকে আজ নষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ব্যবস্থাটাকে আমরা একটি শিক্ষাবিরোধী ব্যবস্থাপনার ওপর দাঁড় করিয়ে নিয়েছি। এ ব্যবস্থাপনা শুধু নিজেদের চাকরি বাঁচাতে ও পেট মোটা করতেই তৎপর। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দল-উপদল গঠন করেছি। নিত্যনতুন বিভাগ খুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর বৃদ্ধি করছি। শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছি। অথচ সে বিভাগ থেকে শিক্ষিত বেকারের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছি না। আর এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ন্যূনতম কোনো মাথাব্যথাও নেই। গাদাগাদা বিভাগ খুলে আমলাতান্ত্রিকতা ও স্বজনপ্রীতি চর্চা করছি। অথচ তাদের শাসন ও শোষণের জাঁতাকলে অগণিত শিক্ষার্থী নিষ্পেসিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের হাতে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হররোজ গুমরে মরছে, সে খবর কেউ রাখে না। সময়ের পরিক্রমায় এখানে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় শুধু এর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, যে কারণে মুখ্য উদ্দেশ্য শিক্ষা ও গবেষণা থেকে শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণরূপে ছিটকে পড়ে।

গ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্ত পরিবার থেকে একজন শিক্ষার্থী সৎ, যৌক্তিক আর স্বার্থহীন চিন্তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্তদ্বারে প্রবেশ করে; কিন্তু তার এ সহজসরল চিন্তা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নোংরা রাজনীতি। সাম্প্রতিকালে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ইডেন কলেজ। সেখানে নিরীহ শিক্ষার্থীদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীনদের নোংরা রাজনীতি। ১৮ বছর ধরে একজন মেয়ের অর্জিত ভদ্রতা ইডেনে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিমিষেই হারিয়ে যায়! তারা রাজনীতির জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে অঘোষিত দাসীতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। গ্রামের সহজসরল শিক্ষার্থী একটি মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। একসময় সর্বস্বান্ত হয়ে ভদ্র বেশ ধারণ করে সে নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। সর্বস্বান্ত হওয়ার বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেও রাজনীতির চালকরা মুখে কলুপ মেরে বসে থাকেন। এ জাতীয় নানা সমস্যা অতিক্রম করা একজন শিক্ষার্থীর জন্য রীতিমতো অসম্ভব একটি ব্যাপার। চলমান এসব সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, নীতিনির্ধারক ও সুশীল সমাজের কেউ কোনো কথা বলেন না। আর তৃতীয় কেউ বলতে গেলে রাজনীতিকদের রোষানলে পতিত হয়ে তিনি পিষ্ট হন।

বাবা-মায়ের ইচ্ছা আর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছুটে আসা ছেলেমেয়েরা আজ অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক যন্ত্র হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রই হলো বিশ্বময় বিচরণের ক্ষেত্র। অথচ বইয়ের পাতার বাইরেই তারা বেরোতে পারছে না! এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক-এ কেমন জ্ঞানার্জনের ধারা? এ কেমন জাতি গঠনের অঙ্গীকার? এ কেমন সোনার বাংলা গড়ার পদক্ষেপ? এটা কেমন উন্নয়নশীল বাংলাদেশ? আজ এ প্রশ্নের উত্তর নেই। উত্তর খোঁজারও কেউ নেই। আর বর্তমানে এসব প্রশ্ন তোলার সাহসও কারও নেই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পেরেক হিসাবে সম্ভবত গুচ্ছ পরীক্ষার আগমন ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে গুচ্ছপদ্ধতির আবিষ্কার হলেও এটি এখন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২০ আগস্ট গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি প্রক্রিয়া করতে যত সময় নিয়েছে, স্বতন্ত্র ২৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ও এত বেশি সময় নেয়নি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে ক্লাসের তারিখ ঘোষণা করেছে। কিন্তু গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা দুই মাস আগে শেষ হলেও ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতেই পারেনি! গুচ্ছতে যতজন শিক্ষার্থী ৫০ নম্বর পেয়েছে, আসন সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম। অথচ ৫০ পাওয়া সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন দেখছে। লেখকের সঙ্গে ৪০ পাওয়া শিক্ষার্থীর বেশ কয়েকজন অভিভাবক ফোনে যুক্ত হয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন প্রকাশ করছেন! এটা স্পষ্ট যে, অসংখ্য শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। তাদের অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাদের অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন ভয়ানক হুমকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় অভিভাবকরা এটাকে জাতীয় অসচেতনতা, সমন্বয়হীনতা ও শিক্ষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলে মতপ্রকাশ করেছেন।

যে ব্যক্তি আদর্শের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে না; সে কখনো সমাজে দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারবে না। আর যখন সে রাষ্ট্রের কোনো পদে সমাসীন হবে, তখনো সে দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করবে। সে ফাঁকিবাজির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ তছরুপ করবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রতিবছরই আমরা শিক্ষার হার বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। লোক দেখানো শিক্ষার এ হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা আমাদের ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে করে শুধু বছর ঘুরে গড়পড়তা শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘ননপ্রোডাক্টিভ’ এ বৃদ্ধি বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। অন্তত শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবধর্মী পাঠদানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নোংরা রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত করা। আর এজন্য প্রয়োজন একটি বাস্তবধর্মী পরিবেশ, যেখানে সৃষ্টিশীল বিদ্যাকে স্বচক্ষে দেখা যাবে। আর তার বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে জাতি নতুন পথের দিশা পাবে। তাতে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই ব্যক্তি তার উপযোগী কর্মপরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট হবে। প্রথাগত বিদ্যার্জন নামক ভয়াবহ হতাশা থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাবে। এতে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সম্মান ও আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ধীরে ধীরে আজকের অগোছাল ছেলেমেয়েরা নিজেকে পরিপাটি করে গড়ে তুলবে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসাবে বিশ্বের কাতারে নাম লেখাবে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ তখন মাথা উঁচু করে গৌরব প্রকাশ করবে। কেবল তখনই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কষ্টকর জ্ঞানার্জন সার্থক হবে।

একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও নিজের অক্ষমতার সঙ্গে তীব্র মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি একটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের আশায় কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ চালান সর্বক্ষণ। অথচ সুস্থ শরীর ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হয়ে আমরা অনিয়মগুলোকে ‘নিয়ম’ বানিয়ে নিয়েছি। আর সেটাকে এমন অনৈতিক চর্চার বৃত্তে বন্দি করেছি, যেন সেটা এক ধ্রুব সত্য! এ অসত্যের কাছে আমরা মাথা নত করে রেখেছি। ভাবতে লজ্জা লাগে, আমরা একজন প্রতিবন্ধীর তীব্র ইচ্ছাশক্তির কাছেও হার মেনেছি। প্রবৃত্তির এক ঘৃণ্য দাসে আমরা পরিণত হয়েছি। জাতি হিসাবে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!

কোন পথে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাবি ক্যাম্পাস। ফাইল ছবি

ড. মো. কামরুজ্জামান

বিশ্ববিদ্যালয় হলো উন্নত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি দেশের জন্য নয়, বিশ্বসমাজের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উল্লিখিত লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়েছে। এসব লক্ষ্য থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অবস্থান করছে যোজন যোজন দূরে। বিপরীতমুখী স্রোতের অনুকূলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ পেয়েছে। এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একেবারে হয় না বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য রাজনৈতিক পরিচয়েই তার পদ অলংকৃত করে থাকেন। এ কারণে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের সময় কিছু শিক্ষকের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। এ পদে নিয়োগ পেতে একজন উপাচার্যকে সর্বপ্রথম দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হয়। এতে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি আর নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করতে পারেন না। বাকি সময় তাকে সরকারকে তোয়াজ করেই চলতে হয়।শুধু উপাচার্য নিয়োগই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পদ-পদবি পেতেও যোগ্যতা হিসাবে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা ইত্যাদি পদে নিয়োগ পেতে একমাত্র যোগ্যতা হলো ক্ষমতাসীন দলের ‘অন্ধকর্মী’ হওয়া। এসব পদ পেতেও দলীয় প্রভাব থাকতে হয়। দাঙ্গাবাজ ছাড়া সাধারণ নিরীহ কর্মীদের ভাগ্যে এসব পদ জোটে না। ভালো শিক্ষক হওয়ার একমাত্র গুণাবলি হলো রাজনৈতিকভাবে পেশিশক্তির অধিকারী হওয়া। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছে অর্থ, স্বার্থ ও ক্ষমতা। সম্মানিত অধ্যাপকরা শিক্ষা ও গবেষণা বাদ দিয়ে এসব পদ পেতে ব্যস্ত সময় পার করেন সর্বক্ষণ। অথচ একজন অধ্যাপকের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের ক্লাস গ্রহণের মাধ্যমে মোটিভেশনাল কার্যক্রমে মনোযোগী হওয়া। তাদের দায়িত্ব হলো শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতিকে নতুন পথের সন্ধান দেওয়া; কিন্তু এসব কাজ বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপকরা বর্তমানে বিভিন্ন দলীয় বৃত্তে বন্দি হয়ে আছেন। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার লোভে সংকীর্ণ দলীয় বন্দিত্ব থেকে তারা বের হয়ে আসেন না। এ কারণে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো ধরনের সাফল্য নেই। দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, উপাচার্য হতে বাংলাদেশের অনেক অধ্যাপক মন্ত্রী, আমলা ও এমপিকে তোয়াজ করে বেড়ান! এসব কারণে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এগিয়ে আসতে পারেনি।

আমরা কথায় কথায় উন্নত দেশের উদাহরণ তুলে ধরি। আমাদের দেশকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, জাপান-আমেরিকার মতো উন্নত রাষ্ট্র বানাতে চাই। অথচ সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সামনে এনে তুলে ধরি না। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের জীবন অত্যন্ত কষ্টময়। সে দেশে একজন অধ্যাপক দিন-রাত পরিশ্রম করেন। তারা নিত্যনতুন গবেষণা উপহার দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ‘রিলাক্সড মুডে’ চাকরি করেন। এ কারণে এখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি চুটিয়ে রাজনীতি করা যায়। অনেকে নামকাওয়াস্তে দায়সারা গোছের কিছু ক্লাস আর টিউটোরিয়াল নেন। বাকি সময়জুড়ে তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী বৈ কিছুই নন। রাজনৈতিক পদ ও সুযোগ-সুবিধা অর্জন করে একজন অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের সামনে দাপট জাহির করেন। এ দাপট দেখাতে তাকে বেশ পুলকিত, আনন্দিত ও আহ্লাদে গদগদ হতে দেখা যায়। ক্ষমতা জাহিরের মাধ্যমে তিনি নিজের মধ্যে বেশ বাহাদুরি মনোভাব পোষণ করেন।

আমাদের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের জার্নাল প্রকাশনা ব্যবস্থা চালু আছে। এ জার্নালে আমরা অতি সহজে প্রমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্টিকেল প্রকাশ করতে পারি। সব প্রমোশন শেষ তো প্রকাশনাও শেষ। আমরা অবশিষ্ট সময় চুটিয়ে রাজনীতি করি। রাজনীতির বিপরীতে যারা একটু-আধটু গবেষণা করতে চান, তারা উপেক্ষিত ও চাপের মধ্যে থাকেন। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কর্নার্ড’ করে রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর কাছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় আবেগের জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানে হাজারও জল্পনা-কল্পনায় সাজানো একটি স্বপ্ন। সে স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার নিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু বেশির ভাগ স্বপ্ন এখানে অসমাপ্ত থেকে যায়। আমরা বাঙালিরা কথায় কথায় একটু ঐতিহ্য খুঁজে ফিরে চলি। আর এক্ষেত্রে আমরা ঘুরেফিরে ১৯৬২, ’৬৯, ’৭১ আর ’৯০-এর গণ-আন্দোলনকেই সামনে আনি। পরবর্তী দিনগুলোর ব্যর্থতার কথা আমরা তেমন একটা বলি না!

শিক্ষা যে কোনো দেশ ও জাতির মেরুদণ্ড। আর এর চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ কেন্দ্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেটিকে আমরা ব্যক্তিগত ও কিংবা দলীয় সম্পদে পরিণত করে ফেলেছি। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এটাকে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন। আর এ কারণেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। এখন এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় যতটা সফল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে ততটা সফল নয়। অবশ্য রাজনীতি শব্দটি অতি পবিত্র এক শব্দ। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মনীতিকে রাজনীতি বলা হয়। কিন্তু সে নিয়মনীতি আজ নোংরা নীতিতে পরিণত হয়েছে। এ রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একাডেমিক পরিবেশকে আজ নষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ব্যবস্থাটাকে আমরা একটি শিক্ষাবিরোধী ব্যবস্থাপনার ওপর দাঁড় করিয়ে নিয়েছি। এ ব্যবস্থাপনা শুধু নিজেদের চাকরি বাঁচাতে ও পেট মোটা করতেই তৎপর। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দল-উপদল গঠন করেছি। নিত্যনতুন বিভাগ খুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর বৃদ্ধি করছি। শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছি। অথচ সে বিভাগ থেকে শিক্ষিত বেকারের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছি না। আর এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ন্যূনতম কোনো মাথাব্যথাও নেই। গাদাগাদা বিভাগ খুলে আমলাতান্ত্রিকতা ও স্বজনপ্রীতি চর্চা করছি। অথচ তাদের শাসন ও শোষণের জাঁতাকলে অগণিত শিক্ষার্থী নিষ্পেসিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের হাতে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হররোজ গুমরে মরছে, সে খবর কেউ রাখে না। সময়ের পরিক্রমায় এখানে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় শুধু এর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, যে কারণে মুখ্য উদ্দেশ্য শিক্ষা ও গবেষণা থেকে শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণরূপে ছিটকে পড়ে।

গ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্ত পরিবার থেকে একজন শিক্ষার্থী সৎ, যৌক্তিক আর স্বার্থহীন চিন্তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্তদ্বারে প্রবেশ করে; কিন্তু তার এ সহজসরল চিন্তা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নোংরা রাজনীতি। সাম্প্রতিকালে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ইডেন কলেজ। সেখানে নিরীহ শিক্ষার্থীদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীনদের নোংরা রাজনীতি। ১৮ বছর ধরে একজন মেয়ের অর্জিত ভদ্রতা ইডেনে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিমিষেই হারিয়ে যায়! তারা রাজনীতির জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে অঘোষিত দাসীতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। গ্রামের সহজসরল শিক্ষার্থী একটি মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। একসময় সর্বস্বান্ত হয়ে ভদ্র বেশ ধারণ করে সে নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। সর্বস্বান্ত হওয়ার বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেও রাজনীতির চালকরা মুখে কলুপ মেরে বসে থাকেন। এ জাতীয় নানা সমস্যা অতিক্রম করা একজন শিক্ষার্থীর জন্য রীতিমতো অসম্ভব একটি ব্যাপার। চলমান এসব সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, নীতিনির্ধারক ও সুশীল সমাজের কেউ কোনো কথা বলেন না। আর তৃতীয় কেউ বলতে গেলে রাজনীতিকদের রোষানলে পতিত হয়ে তিনি পিষ্ট হন।

বাবা-মায়ের ইচ্ছা আর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছুটে আসা ছেলেমেয়েরা আজ অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক যন্ত্র হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রই হলো বিশ্বময় বিচরণের ক্ষেত্র। অথচ বইয়ের পাতার বাইরেই তারা বেরোতে পারছে না! এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক-এ কেমন জ্ঞানার্জনের ধারা? এ কেমন জাতি গঠনের অঙ্গীকার? এ কেমন সোনার বাংলা গড়ার পদক্ষেপ? এটা কেমন উন্নয়নশীল বাংলাদেশ? আজ এ প্রশ্নের উত্তর নেই। উত্তর খোঁজারও কেউ নেই। আর বর্তমানে এসব প্রশ্ন তোলার সাহসও কারও নেই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পেরেক হিসাবে সম্ভবত গুচ্ছ পরীক্ষার আগমন ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে গুচ্ছপদ্ধতির আবিষ্কার হলেও এটি এখন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২০ আগস্ট গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি প্রক্রিয়া করতে যত সময় নিয়েছে, স্বতন্ত্র ২৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ও এত বেশি সময় নেয়নি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে ক্লাসের তারিখ ঘোষণা করেছে। কিন্তু গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা দুই মাস আগে শেষ হলেও ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতেই পারেনি! গুচ্ছতে যতজন শিক্ষার্থী ৫০ নম্বর পেয়েছে, আসন সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম। অথচ ৫০ পাওয়া সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন দেখছে। লেখকের সঙ্গে ৪০ পাওয়া শিক্ষার্থীর বেশ কয়েকজন অভিভাবক ফোনে যুক্ত হয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন প্রকাশ করছেন! এটা স্পষ্ট যে, অসংখ্য শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। তাদের অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাদের অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন ভয়ানক হুমকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় অভিভাবকরা এটাকে জাতীয় অসচেতনতা, সমন্বয়হীনতা ও শিক্ষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলে মতপ্রকাশ করেছেন।

যে ব্যক্তি আদর্শের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে না; সে কখনো সমাজে দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারবে না। আর যখন সে রাষ্ট্রের কোনো পদে সমাসীন হবে, তখনো সে দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করবে। সে ফাঁকিবাজির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ তছরুপ করবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রতিবছরই আমরা শিক্ষার হার বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। লোক দেখানো শিক্ষার এ হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা আমাদের ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে করে শুধু বছর ঘুরে গড়পড়তা শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘ননপ্রোডাক্টিভ’ এ বৃদ্ধি বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। অন্তত শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবধর্মী পাঠদানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নোংরা রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত করা। আর এজন্য প্রয়োজন একটি বাস্তবধর্মী পরিবেশ, যেখানে সৃষ্টিশীল বিদ্যাকে স্বচক্ষে দেখা যাবে। আর তার বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে জাতি নতুন পথের দিশা পাবে। তাতে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই ব্যক্তি তার উপযোগী কর্মপরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট হবে। প্রথাগত বিদ্যার্জন নামক ভয়াবহ হতাশা থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাবে। এতে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সম্মান ও আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ধীরে ধীরে আজকের অগোছাল ছেলেমেয়েরা নিজেকে পরিপাটি করে গড়ে তুলবে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসাবে বিশ্বের কাতারে নাম লেখাবে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ তখন মাথা উঁচু করে গৌরব প্রকাশ করবে। কেবল তখনই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কষ্টকর জ্ঞানার্জন সার্থক হবে।

একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও নিজের অক্ষমতার সঙ্গে তীব্র মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি একটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের আশায় কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ চালান সর্বক্ষণ। অথচ সুস্থ শরীর ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হয়ে আমরা অনিয়মগুলোকে ‘নিয়ম’ বানিয়ে নিয়েছি। আর সেটাকে এমন অনৈতিক চর্চার বৃত্তে বন্দি করেছি, যেন সেটা এক ধ্রুব সত্য! এ অসত্যের কাছে আমরা মাথা নত করে রেখেছি। ভাবতে লজ্জা লাগে, আমরা একজন প্রতিবন্ধীর তীব্র ইচ্ছাশক্তির কাছেও হার মেনেছি। প্রবৃত্তির এক ঘৃণ্য দাসে আমরা পরিণত হয়েছি। জাতি হিসাবে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!