ক্যাডার হওয়ার আগে

নুসরাত নওশীন

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে গত ১০ নভেম্বর ৪১তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। ১৩ হাজার প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষার জন্য উত্তীর্ণ হয়েছেন। অন্যান্য বিসিএসের তুলনায় সংখ্যাটা বিশালই বলা যায়। লিখিত আর মৌখিক পরীক্ষার নম্বর মিলিয়েই বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয়। মোট ২০০ নম্বর থাকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ, কাজেই মৌখিক পরীক্ষাকে হেলাফেলা করার কোনোই সুযোগ নেই। যারা লিখিত পরীক্ষায় নম্বরে একটু পিছিয়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন, তাদের জন্য পাশার দান উল্টে দেয়ার এটিই মোক্ষম সুযোগ!

মৌখিক পরীক্ষার একটা বড় অসুবিধা আছে। প্রিলিমিনারি বা লিখিত পরীক্ষার মতো এর কোনো নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা সিলেবাস নেই। মৌখিক পরীক্ষায় শুধু আপনার জ্ঞানের পরিধি দেখা হয় না, কারণ, আপনি ইতিমধ্যে প্রিলিমিনারি আর লিখিত পরীক্ষাতেই তা প্রমাণ করে এসেছেন। এখানে পিএসসির বিজ্ঞ সদস্যরা আপনার ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ থেকে শুরু করে আপনার পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি, ভাষা, উচ্চারণ, চলাফেরা, ওঠা-বসা, উপস্থিত বুদ্ধি অর্থাৎ একজন সিভিল সার্ভেন্ট হতে গেলে যেসব গুণ থাকা উচিত তা আপনার মধ্যে আছে কি না সব যাচাই করে থাকেন।

পোশাক

কথায় আছে- আগে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। আপনার পোশাক আপনার ব্যক্তিত্ব এবং রুচির পরিচায়ক। ভাইভা বোর্ডে প্রবেশ করার আগে নিজেকে একজন সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে কল্পনা করুন, সেই মতো নিজেকে উপস্থাপন করুন। আপনাকে দেখেই যেন বোর্ডে আপনার সম্পর্কে একটা পজিটিভ ধারণা জন্মায়। ছেলেরা যেকোনো হালকা রঙের ফুল স্লিভ ফরমাল শার্ট, মানানসই টাই আর ফরমাল প্যান্ট, আর যেহেতু এবার ভাইভা শীতকালে হচ্ছে তাই ব্লেজার অথবা কমপ্লিট স্যুট পরে যেতে পারেন। মেয়েদের জন্য যেকোনো ধরনের অফিসে পরার উপযুক্ত মার্জিত শাড়ি অথবা সালোয়ার-কামিজ যেকোনোটাই পরা যাবে। ধর্মীয় কারণে অনেকে বোরকা আর হিজাব পরেও ভাইভা যান। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। মেয়েরা চাইলে হালকা গয়না যেমন কানে ছোট টপ, হাতে ব্রেসলেট আর ঘড়ি, গলায় ছোট মালা বা চেইন পরতে পারেন। হালকা প্রসাধনীও ব্যবহার করতে পারেন, তবে তা যেন অবশ্যই দৃষ্টিকটু না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর এমন কোনো জুতা পরা যাবে না যেন হাঁটার সময় শব্দ হয়। ছেলেরা ফরমাল জুতা আর মেয়েরা অল্প হিলের স্যান্ডেল বা শু কিনতে পারেন। অনেক আগে থেকেই ভাইভার দিনের পোশাক তৈরি করে রেখে দিন, পারলে একবার পুরোটা ট্রায়াল দিয়ে দেখুন। আর যে পোশাকই পরেন না কেন, আত্মবিশ্বাসী থাকবেন। মনে রাখবেন, আপনার আত্মবিশ্বাস-ই আপনার সেরা পোশাক।

ভাইভা বোর্ডে করণীয়

প্রথমেই বললাম, ভাইভা বোর্ডে আপনার ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করা হয়। কাজেই এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যা বোর্ডের বিজ্ঞ সদস্যদের মধ্যে আপনার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করে। বোর্ডে ঢোকার সময় অনুমতি নিয়ে ঢোকা, ভেতরে গিয়ে সবাইকে সালাম/আদাব দেয়া, অনুমতি নিয়ে বসা এগুলো কম-বেশি সবাই জানেন। সেই সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে যেমন সব সময় বিনীত থাকতে হবে, কোনো অবস্থাতেই তর্কে জড়ানো যাবে না, কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলে বিনয়ের সঙ্গে অপারগতা প্রকাশ করতে হবে, পাল্টা প্রশ্ন করা যাবে না, ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে আর বাংলায় প্রশ্ন করলে বাংলায় উত্তর দিতে হবে, খুব জোরে বা খুব আস্তে কথা বলা যাবে না, কথা বলার সময় অবশ্যই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে, আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করা যাবে না, কারও মুদ্রাদোষ থাকলে তা পরিহার করতে হবে ইত্যাদি। এ ব্যাপারগুলো আসলে দুই-এক দিনে রপ্ত হয় না। এখন থেকেই নিজে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার অনুশীলন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে মক ভাইভা দিয়ে দেখতে পারেন কারোর সামনে, তাহলে কথা বলার জড়তা দূর হবে। এখন ভাইভাতে ইংরেজিতে প্রচুর প্রশ্ন করা হয়। আগে থেকেই ইংরেজি বলার অভ্যাস না থাকলে ভাইভা বোর্ডে অনর্গল ইংরেজি বলাটা কঠিন। তাই বাসায়, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কথা বলার সময় ইংরেজিতে কথা বলার অভ্যাস করুন। আর ভাইভা বোর্ডে সব সময়ই চেষ্টা করবেন হাসিখুশি থাকতে। নার্ভাস আপনি হতেই পারেন, কিন্তু আপনার নার্ভাসনেস যেন বাইরে থেকে আপনার মুখ দেখে বোঝা না যায়!

পড়াশোনার প্রস্তুতি

এবারে আসি মূল জায়গায়। ভাইভার যেহেতু নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই, তাই ভাইভার জন্য মূলত প্রিলিমিনারি আর লিখিত পরীক্ষার পড়াগুলোই একনজর দেখে নেয়া যায়। পাশাপাশি আর যা যা জেনে যাবেন-

১. নিজেকে জানুন: নিজের সম্পর্কে, নিজ নামের অর্থ, প্রিয় শখ, নিজের পরিবার, নিজ জেলা, নিজ গ্রাম, জেলার বিখ্যাত-কুখ্যাত ব্যক্তি, জেলার ব্র্যান্ডিং, নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এসব ব্যাপারে সম্যক ধারণা নিয়ে যেতে হবে। অনেক বোর্ডেই ‘Introduce Yourself’ জিজ্ঞেস করা হয়। আবার পছন্দের ক্যাডার ক্রম বা অমুক ক্যাডার কেন হতে চান এই জাতীয় প্রশ্নও করা হয়ে থাকে। এই উত্তরগুলো একদম নিজের মতো করে দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন মুখস্থ বা বানোয়াট মনে না হয়। চাইলে এই উত্তরগুলো নিজে নিজে আগে থেকেই বাংলা এবং ইংরেজিতে তৈরি করে রাখুন। সত্যি কথাটাই তুলে ধরুন, গাইড বই থেকে এসব কপি করবেন না। কোচিং সেন্টার বা গাইড বইয়ের শেখানো কথা বোর্ডের বিজ্ঞ সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেলেন!

২. পঠিত বিষয়: আপনি জেনারেল বা টেকনিক্যাল যে ক্যাডারেরই প্রার্থী হন না কেন, আপনার স্নাতক পর্যায়ে পঠিত বিষয় নিয়ে অবশ্যই ভালোভাবে ধারণা নিয়ে যেতে হবে। নিজ বিষয়ের বেসিক দুর্বল থাকলে তা ভাইভা বোর্ডে খুবই খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. বাংলাদেশ, সংবিধান ও বঙ্গবন্ধু: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাস, এগারোটা সেক্টর এবং সেক্টর কমান্ডার, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর লেখা বই, জাতীয় চারনেতা, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস, সংবিধানের মূলনীতি, প্রস্তাবনা, গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো, বাংলাদেশের মানচিত্র, বাংলাদেশের মনোগ্রাম, ভৌগোলিক পরিচিতি, বাংলাদেশের নদ-নদী, বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে যেতে হবে।

৪. সাম্প্রতিক বিষয়াবলি: ভাইভার জন্য সাম্প্রতিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে। এ জন্য প্রতিদিন অন্তত দুটি বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ার ও টেলিভিশনে দিনে অন্তত একবার খবর দেখার অভ্যাসের বিকল্প নেই। ভাইভার দিন সকালের পত্রিকায় অবশ্যই একবার চোখ বুলিয়ে যেতে হবে।

৫. পছন্দের ক্যাডার: পছন্দক্রম অনুযায়ী প্রথম ২-৩টি ক্যাডার সম্পর্কে, তাদের পদসোপান, কার্যাবলি, আইন-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে হবে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও গৃহীত প্রকল্প, মেগা প্রজেক্টগুলো, প্রধানমন্ত্রীর প্রাপ্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার, বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও তাদের কিছু বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু গান-কবিতা এসবও দেখে যেতে হবে।

মৌখিক পরীক্ষা বিসিএস পরীক্ষার তৃতীয় এবং সর্বশেষ ধাপ। এখানেই পরীক্ষক প্রার্থীকে প্রথম সামনাসামনি দেখে এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে প্রার্থীর যোগ্যতার মূল্যায়ন করে থাকে। তাই এর জন্য প্রস্তুতিটাও হওয়া চাই এমন যেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন যোগ্য কর্মকর্তা নিজেকে দেশসেবার জন্য প্রস্তুত করছে। খুব দ্রুতই পিএসসি ভাইভার দিন তারিখ প্রকাশ করবে। তাই আর সময়ক্ষেপণ না করে এখন থেকেই শুরু হোক নিজেকে প্রস্তুত করা।

লেখক: সহকারী কমিশনার এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, ৪০তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার

ক্যাডার হওয়ার আগে

নুসরাত নওশীন

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে গত ১০ নভেম্বর ৪১তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। ১৩ হাজার প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষার জন্য উত্তীর্ণ হয়েছেন। অন্যান্য বিসিএসের তুলনায় সংখ্যাটা বিশালই বলা যায়। লিখিত আর মৌখিক পরীক্ষার নম্বর মিলিয়েই বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয়। মোট ২০০ নম্বর থাকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ, কাজেই মৌখিক পরীক্ষাকে হেলাফেলা করার কোনোই সুযোগ নেই। যারা লিখিত পরীক্ষায় নম্বরে একটু পিছিয়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন, তাদের জন্য পাশার দান উল্টে দেয়ার এটিই মোক্ষম সুযোগ!

মৌখিক পরীক্ষার একটা বড় অসুবিধা আছে। প্রিলিমিনারি বা লিখিত পরীক্ষার মতো এর কোনো নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা সিলেবাস নেই। মৌখিক পরীক্ষায় শুধু আপনার জ্ঞানের পরিধি দেখা হয় না, কারণ, আপনি ইতিমধ্যে প্রিলিমিনারি আর লিখিত পরীক্ষাতেই তা প্রমাণ করে এসেছেন। এখানে পিএসসির বিজ্ঞ সদস্যরা আপনার ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ থেকে শুরু করে আপনার পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি, ভাষা, উচ্চারণ, চলাফেরা, ওঠা-বসা, উপস্থিত বুদ্ধি অর্থাৎ একজন সিভিল সার্ভেন্ট হতে গেলে যেসব গুণ থাকা উচিত তা আপনার মধ্যে আছে কি না সব যাচাই করে থাকেন।

পোশাক

কথায় আছে- আগে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। আপনার পোশাক আপনার ব্যক্তিত্ব এবং রুচির পরিচায়ক। ভাইভা বোর্ডে প্রবেশ করার আগে নিজেকে একজন সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে কল্পনা করুন, সেই মতো নিজেকে উপস্থাপন করুন। আপনাকে দেখেই যেন বোর্ডে আপনার সম্পর্কে একটা পজিটিভ ধারণা জন্মায়। ছেলেরা যেকোনো হালকা রঙের ফুল স্লিভ ফরমাল শার্ট, মানানসই টাই আর ফরমাল প্যান্ট, আর যেহেতু এবার ভাইভা শীতকালে হচ্ছে তাই ব্লেজার অথবা কমপ্লিট স্যুট পরে যেতে পারেন। মেয়েদের জন্য যেকোনো ধরনের অফিসে পরার উপযুক্ত মার্জিত শাড়ি অথবা সালোয়ার-কামিজ যেকোনোটাই পরা যাবে। ধর্মীয় কারণে অনেকে বোরকা আর হিজাব পরেও ভাইভা যান। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। মেয়েরা চাইলে হালকা গয়না যেমন কানে ছোট টপ, হাতে ব্রেসলেট আর ঘড়ি, গলায় ছোট মালা বা চেইন পরতে পারেন। হালকা প্রসাধনীও ব্যবহার করতে পারেন, তবে তা যেন অবশ্যই দৃষ্টিকটু না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর এমন কোনো জুতা পরা যাবে না যেন হাঁটার সময় শব্দ হয়। ছেলেরা ফরমাল জুতা আর মেয়েরা অল্প হিলের স্যান্ডেল বা শু কিনতে পারেন। অনেক আগে থেকেই ভাইভার দিনের পোশাক তৈরি করে রেখে দিন, পারলে একবার পুরোটা ট্রায়াল দিয়ে দেখুন। আর যে পোশাকই পরেন না কেন, আত্মবিশ্বাসী থাকবেন। মনে রাখবেন, আপনার আত্মবিশ্বাস-ই আপনার সেরা পোশাক।

ভাইভা বোর্ডে করণীয়

প্রথমেই বললাম, ভাইভা বোর্ডে আপনার ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করা হয়। কাজেই এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যা বোর্ডের বিজ্ঞ সদস্যদের মধ্যে আপনার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করে। বোর্ডে ঢোকার সময় অনুমতি নিয়ে ঢোকা, ভেতরে গিয়ে সবাইকে সালাম/আদাব দেয়া, অনুমতি নিয়ে বসা এগুলো কম-বেশি সবাই জানেন। সেই সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে যেমন সব সময় বিনীত থাকতে হবে, কোনো অবস্থাতেই তর্কে জড়ানো যাবে না, কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলে বিনয়ের সঙ্গে অপারগতা প্রকাশ করতে হবে, পাল্টা প্রশ্ন করা যাবে না, ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে আর বাংলায় প্রশ্ন করলে বাংলায় উত্তর দিতে হবে, খুব জোরে বা খুব আস্তে কথা বলা যাবে না, কথা বলার সময় অবশ্যই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে, আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করা যাবে না, কারও মুদ্রাদোষ থাকলে তা পরিহার করতে হবে ইত্যাদি। এ ব্যাপারগুলো আসলে দুই-এক দিনে রপ্ত হয় না। এখন থেকেই নিজে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার অনুশীলন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে মক ভাইভা দিয়ে দেখতে পারেন কারোর সামনে, তাহলে কথা বলার জড়তা দূর হবে। এখন ভাইভাতে ইংরেজিতে প্রচুর প্রশ্ন করা হয়। আগে থেকেই ইংরেজি বলার অভ্যাস না থাকলে ভাইভা বোর্ডে অনর্গল ইংরেজি বলাটা কঠিন। তাই বাসায়, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কথা বলার সময় ইংরেজিতে কথা বলার অভ্যাস করুন। আর ভাইভা বোর্ডে সব সময়ই চেষ্টা করবেন হাসিখুশি থাকতে। নার্ভাস আপনি হতেই পারেন, কিন্তু আপনার নার্ভাসনেস যেন বাইরে থেকে আপনার মুখ দেখে বোঝা না যায়!

পড়াশোনার প্রস্তুতি

এবারে আসি মূল জায়গায়। ভাইভার যেহেতু নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই, তাই ভাইভার জন্য মূলত প্রিলিমিনারি আর লিখিত পরীক্ষার পড়াগুলোই একনজর দেখে নেয়া যায়। পাশাপাশি আর যা যা জেনে যাবেন-

১. নিজেকে জানুন: নিজের সম্পর্কে, নিজ নামের অর্থ, প্রিয় শখ, নিজের পরিবার, নিজ জেলা, নিজ গ্রাম, জেলার বিখ্যাত-কুখ্যাত ব্যক্তি, জেলার ব্র্যান্ডিং, নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এসব ব্যাপারে সম্যক ধারণা নিয়ে যেতে হবে। অনেক বোর্ডেই ‘Introduce Yourself’ জিজ্ঞেস করা হয়। আবার পছন্দের ক্যাডার ক্রম বা অমুক ক্যাডার কেন হতে চান এই জাতীয় প্রশ্নও করা হয়ে থাকে। এই উত্তরগুলো একদম নিজের মতো করে দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন মুখস্থ বা বানোয়াট মনে না হয়। চাইলে এই উত্তরগুলো নিজে নিজে আগে থেকেই বাংলা এবং ইংরেজিতে তৈরি করে রাখুন। সত্যি কথাটাই তুলে ধরুন, গাইড বই থেকে এসব কপি করবেন না। কোচিং সেন্টার বা গাইড বইয়ের শেখানো কথা বোর্ডের বিজ্ঞ সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেলেন!

২. পঠিত বিষয়: আপনি জেনারেল বা টেকনিক্যাল যে ক্যাডারেরই প্রার্থী হন না কেন, আপনার স্নাতক পর্যায়ে পঠিত বিষয় নিয়ে অবশ্যই ভালোভাবে ধারণা নিয়ে যেতে হবে। নিজ বিষয়ের বেসিক দুর্বল থাকলে তা ভাইভা বোর্ডে খুবই খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. বাংলাদেশ, সংবিধান ও বঙ্গবন্ধু: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাস, এগারোটা সেক্টর এবং সেক্টর কমান্ডার, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর লেখা বই, জাতীয় চারনেতা, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস, সংবিধানের মূলনীতি, প্রস্তাবনা, গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো, বাংলাদেশের মানচিত্র, বাংলাদেশের মনোগ্রাম, ভৌগোলিক পরিচিতি, বাংলাদেশের নদ-নদী, বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে যেতে হবে।

৪. সাম্প্রতিক বিষয়াবলি: ভাইভার জন্য সাম্প্রতিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে। এ জন্য প্রতিদিন অন্তত দুটি বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ার ও টেলিভিশনে দিনে অন্তত একবার খবর দেখার অভ্যাসের বিকল্প নেই। ভাইভার দিন সকালের পত্রিকায় অবশ্যই একবার চোখ বুলিয়ে যেতে হবে।

৫. পছন্দের ক্যাডার: পছন্দক্রম অনুযায়ী প্রথম ২-৩টি ক্যাডার সম্পর্কে, তাদের পদসোপান, কার্যাবলি, আইন-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে হবে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও গৃহীত প্রকল্প, মেগা প্রজেক্টগুলো, প্রধানমন্ত্রীর প্রাপ্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার, বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও তাদের কিছু বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু গান-কবিতা এসবও দেখে যেতে হবে।

মৌখিক পরীক্ষা বিসিএস পরীক্ষার তৃতীয় এবং সর্বশেষ ধাপ। এখানেই পরীক্ষক প্রার্থীকে প্রথম সামনাসামনি দেখে এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে প্রার্থীর যোগ্যতার মূল্যায়ন করে থাকে। তাই এর জন্য প্রস্তুতিটাও হওয়া চাই এমন যেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন যোগ্য কর্মকর্তা নিজেকে দেশসেবার জন্য প্রস্তুত করছে। খুব দ্রুতই পিএসসি ভাইভার দিন তারিখ প্রকাশ করবে। তাই আর সময়ক্ষেপণ না করে এখন থেকেই শুরু হোক নিজেকে প্রস্তুত করা।

লেখক: সহকারী কমিশনার এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, ৪০তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার