জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নে ‘খেয়ালখুশি’

১,৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১টি স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পে অনিয়ম ও যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২১টি স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব স্থাপনার স্থান নির্বাচন করা হচ্ছে ‘খেয়ালখুশিমতো’। এতে কাটা পড়েছে প্রায় ৭০০ গাছ। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পেছনেছবি: আশরাফুল আলম

শামসুজ্জামান ও মো. মাইদুল ইসলাম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘অধিকতর উন্নয়ন’। কিন্তু এই উন্নয়নকাজকে অনেকে অভিহিত করছেন ‘খেয়ালখুশি’র প্রকল্প হিসেবে। কারণ দুটি: ১. এই উন্নয়নকাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মানা হয়নি গণখাতে ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর)। ২. মহাপরিকল্পনা না মেনে নিজেদের ‘ইচ্ছেমতো’ জায়গায় ভবন তৈরি করা হচ্ছে। কাটা হচ্ছে গাছপালা।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২১টি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালে ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের এই প্রকল্প নেওয়া হয়। এর আওতায় শিক্ষার্থীদের জন্য হল, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবনের সম্প্রসারণ, খেলার কমপ্লেক্স নির্মাণসহ নানা কাজ করা হচ্ছে।

মোট তিন ধাপের এ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছেলে ও মেয়েদের জন্য তিনটি করে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। ১৪টি স্থাপনার নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়েছে গত ৮ জুন। যদিও সব কাজ গত বছরের মার্চের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেটা না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে দেখা যাচ্ছে, ‘অধিকতর উন্নয়নকাজে’ সময়ও লাগছে অধিক। যেহেতু নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছে, তাই এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এটি একটি খেয়ালখুশির প্রকল্প। কতটুকু পরিকল্পনা করে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে, তা নির্মাণকাজের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। স্থাপনা নির্মাণে অসামঞ্জস্য সুস্পষ্ট।

আদিল মুহম্মদ খান, অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগ, জাবি

২০১৯ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরুর পর নির্মাণকাজে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তৎকালীন উপাচার্যের মধ্যস্থতায় ছাত্রলীগের নেতাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যদিও ওই বছরের ১ অক্টোবর তৎকালীন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগটি অস্বীকার করেন। অবশ্য ওই দিন রাতেই ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রকল্পে ‘খেয়ালখুশি’

২০১৮ সালের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, প্রকল্প অনুমোদনের আগে প্রকল্প পরিচালক কে হবেন, তা নির্ধারণের সুযোগ নেই। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই প্রকল্প অনুমোদনের আগেই ডিপিপিতে নাসির উদ্দিনকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করে।

নাসির উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিপিআর অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম আছে। প্রকল্পের সামগ্রিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকায় আমাকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’

অবশ্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, ৫০ কোটি বা এর বেশি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি সভা করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের জন্য কমপক্ষে তিনজনের বৃত্তান্ত বিবেচনা করবে। এই প্রকল্পে কোনো কমিটি না করে একজনকেই বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রকল্পটির অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী, শুধু একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে নকশা প্রণয়ন ও তদারকির কাজ করার কথা। কিন্তু এই প্রকল্পে একাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত বছরের এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় পরামর্শক নিয়োগের জন্য অনুমোদিত ডিপিপিতে একটিমাত্র প্যাকেজের সংস্থান থাকলেও বাস্তবায়নকারী সংস্থা পৃথক প্যাকেজে চারটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। একই কার্যাদেশের আওতায় মূল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমেও কাজ করানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে কয়েক ধাপে সভা করে একাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবগত করা আছে।

অবশ্য আইএমইডির প্রতিবেদনে পরামর্শক নিয়োগে পিপিআর যথাযথভাবে অনুসরণ না হওয়ার বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের খতিয়ে দেখা উচিত বলে মত দেওয়া হয়।

পিপিআর ২০০৮-এর উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি অনুযায়ী, দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর কমপক্ষে ২৮ দিন সময় দেওয়ার কথা। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে উন্নয়নকাজে ২০১৯ সালের ৩ মে পত্রিকায় দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। দরপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয় ২৮ মে পর্যন্ত। ওই সময় ঠিকাদারেরা অভিযোগ করেছিলেন, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রথম ১৪ দিন অগ্রণী ব্যাংকে (শিডিউল সংগ্রহের নির্ধারিত জায়গা) কোনো দরপত্র শিডিউল পাওয়া যায়নি। আগ্রহী ঠিকাদারেরা কোনো আবেদনপত্র ছাড়াই নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে দরপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক তাঁর কাছ থেকে আবেদনপত্র নিয়ে পূর্বানুমতি সাপেক্ষে অগ্রণী ব্যাংক থেকে দরপত্র সংগ্রহের শর্ত আরোপ করেন, যা পিপিআরের লঙ্ঘন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন করে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের শেষ দিকের কাজ চলছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পাশে নির্মাণাধীন ১৭ নম্বর ছাত্রী হলের সামনে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন করে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের শেষ দিকের কাজ চলছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পাশে নির্মাণাধীন ১৭ নম্বর ছাত্রী হলের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

এ ছাড়া প্রকল্পের কাজগুলো ছয়টি লটে ভাগ করা হয়। সেখানে শর্ত দেওয়া হয়, একজন ঠিকাদার একটি মাত্র লটের দরপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে পূর্বানুমতি নিয়ে ছয়জন ঠিকাদার ছয়টি লটের দরপত্র সংগ্রহ করেন। এমন অবস্থায় প্রতিটি লটের বিপরীতে একটি করে দরপত্র দাখিলের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ অবস্থায় প্রকল্প পরিচালক দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ঠিকাদারদের একাধিক দরপত্র শিডিউল সংগ্রহের সুযোগ দেন, যা দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করেছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এটি ২০১৯ সালের কথা। আমি পেছনের বিষয়ে কোনো আলাপ করতে চাচ্ছি না।’

প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে আছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আইএমইডির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ফেরদৌস জামান প্রথম আলোকে বলেন, একসময় ইউজিসির জোরালো তদারক করার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এখন নেই। কারণ, আগে ইউজিসির মাধ্যমে টাকা দেওয়া হতো। এখন সরাসরি প্রকল্প পরিচালকের নামে টাকা পাঠানো হয়। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে প্রকল্প তদারক করে কী করবেন?

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নে ‘খেয়ালখুশি’

১,৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১টি স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পে অনিয়ম ও যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২১টি স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব স্থাপনার স্থান নির্বাচন করা হচ্ছে ‘খেয়ালখুশিমতো’। এতে কাটা পড়েছে প্রায় ৭০০ গাছ। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পেছনেছবি: আশরাফুল আলম

শামসুজ্জামান ও মো. মাইদুল ইসলাম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘অধিকতর উন্নয়ন’। কিন্তু এই উন্নয়নকাজকে অনেকে অভিহিত করছেন ‘খেয়ালখুশি’র প্রকল্প হিসেবে। কারণ দুটি: ১. এই উন্নয়নকাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মানা হয়নি গণখাতে ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর)। ২. মহাপরিকল্পনা না মেনে নিজেদের ‘ইচ্ছেমতো’ জায়গায় ভবন তৈরি করা হচ্ছে। কাটা হচ্ছে গাছপালা।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২১টি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালে ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের এই প্রকল্প নেওয়া হয়। এর আওতায় শিক্ষার্থীদের জন্য হল, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবনের সম্প্রসারণ, খেলার কমপ্লেক্স নির্মাণসহ নানা কাজ করা হচ্ছে।

মোট তিন ধাপের এ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছেলে ও মেয়েদের জন্য তিনটি করে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। ১৪টি স্থাপনার নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়েছে গত ৮ জুন। যদিও সব কাজ গত বছরের মার্চের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেটা না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে দেখা যাচ্ছে, ‘অধিকতর উন্নয়নকাজে’ সময়ও লাগছে অধিক। যেহেতু নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছে, তাই এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এটি একটি খেয়ালখুশির প্রকল্প। কতটুকু পরিকল্পনা করে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে, তা নির্মাণকাজের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। স্থাপনা নির্মাণে অসামঞ্জস্য সুস্পষ্ট।

আদিল মুহম্মদ খান, অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগ, জাবি

২০১৯ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরুর পর নির্মাণকাজে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তৎকালীন উপাচার্যের মধ্যস্থতায় ছাত্রলীগের নেতাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যদিও ওই বছরের ১ অক্টোবর তৎকালীন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগটি অস্বীকার করেন। অবশ্য ওই দিন রাতেই ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রকল্পে ‘খেয়ালখুশি’

২০১৮ সালের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, প্রকল্প অনুমোদনের আগে প্রকল্প পরিচালক কে হবেন, তা নির্ধারণের সুযোগ নেই। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই প্রকল্প অনুমোদনের আগেই ডিপিপিতে নাসির উদ্দিনকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করে।

নাসির উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিপিআর অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম আছে। প্রকল্পের সামগ্রিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকায় আমাকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’

অবশ্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, ৫০ কোটি বা এর বেশি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি সভা করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের জন্য কমপক্ষে তিনজনের বৃত্তান্ত বিবেচনা করবে। এই প্রকল্পে কোনো কমিটি না করে একজনকেই বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রকল্পটির অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী, শুধু একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে নকশা প্রণয়ন ও তদারকির কাজ করার কথা। কিন্তু এই প্রকল্পে একাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত বছরের এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় পরামর্শক নিয়োগের জন্য অনুমোদিত ডিপিপিতে একটিমাত্র প্যাকেজের সংস্থান থাকলেও বাস্তবায়নকারী সংস্থা পৃথক প্যাকেজে চারটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। একই কার্যাদেশের আওতায় মূল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমেও কাজ করানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে কয়েক ধাপে সভা করে একাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবগত করা আছে।

অবশ্য আইএমইডির প্রতিবেদনে পরামর্শক নিয়োগে পিপিআর যথাযথভাবে অনুসরণ না হওয়ার বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের খতিয়ে দেখা উচিত বলে মত দেওয়া হয়।

পিপিআর ২০০৮-এর উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি অনুযায়ী, দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর কমপক্ষে ২৮ দিন সময় দেওয়ার কথা। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে উন্নয়নকাজে ২০১৯ সালের ৩ মে পত্রিকায় দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। দরপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয় ২৮ মে পর্যন্ত। ওই সময় ঠিকাদারেরা অভিযোগ করেছিলেন, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রথম ১৪ দিন অগ্রণী ব্যাংকে (শিডিউল সংগ্রহের নির্ধারিত জায়গা) কোনো দরপত্র শিডিউল পাওয়া যায়নি। আগ্রহী ঠিকাদারেরা কোনো আবেদনপত্র ছাড়াই নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে দরপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক তাঁর কাছ থেকে আবেদনপত্র নিয়ে পূর্বানুমতি সাপেক্ষে অগ্রণী ব্যাংক থেকে দরপত্র সংগ্রহের শর্ত আরোপ করেন, যা পিপিআরের লঙ্ঘন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন করে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের শেষ দিকের কাজ চলছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পাশে নির্মাণাধীন ১৭ নম্বর ছাত্রী হলের সামনে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন করে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের শেষ দিকের কাজ চলছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পাশে নির্মাণাধীন ১৭ নম্বর ছাত্রী হলের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

এ ছাড়া প্রকল্পের কাজগুলো ছয়টি লটে ভাগ করা হয়। সেখানে শর্ত দেওয়া হয়, একজন ঠিকাদার একটি মাত্র লটের দরপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে পূর্বানুমতি নিয়ে ছয়জন ঠিকাদার ছয়টি লটের দরপত্র সংগ্রহ করেন। এমন অবস্থায় প্রতিটি লটের বিপরীতে একটি করে দরপত্র দাখিলের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ অবস্থায় প্রকল্প পরিচালক দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ঠিকাদারদের একাধিক দরপত্র শিডিউল সংগ্রহের সুযোগ দেন, যা দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করেছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এটি ২০১৯ সালের কথা। আমি পেছনের বিষয়ে কোনো আলাপ করতে চাচ্ছি না।’

প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে আছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আইএমইডির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ফেরদৌস জামান প্রথম আলোকে বলেন, একসময় ইউজিসির জোরালো তদারক করার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এখন নেই। কারণ, আগে ইউজিসির মাধ্যমে টাকা দেওয়া হতো। এখন সরাসরি প্রকল্প পরিচালকের নামে টাকা পাঠানো হয়। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে প্রকল্প তদারক করে কী করবেন?