ড্যাফোডিল ভার্সিটির টাকায় সবুরের ওষুধ কোম্পানি

সানাউল হক সানী

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান।ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা বিনিয়োগ করে নিজের এবং স্ত্রী-কন্যার ব্যক্তিগত নামে একটি ওষুধ কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান। এই তিনজনের নামে এরই মধ্যে নভো হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ফার্মা লিমিটেডের ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে, যার মোট মূল্য ১৯ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর এই অর্থের পুরোটাই দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব থেকে। শেয়ার হস্তান্তর-সংক্রান্ত বিভিন্ন নথির সূত্রে কালবেলার অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পরিচালনার জন্য রয়েছে ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড। এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা মো. সবুর খান। পাশাপাশি তার স্ত্রী সাহানা খান ভাইস চেয়ারম্যান এবং কন্যা সামিহা খান ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় হবে অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্ট আইন অনুসারেও ট্রাস্টের কোনো সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা নিতে পারবেন না। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকসহ (অর্থ) বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। যেখান থেকে তারা মাসে বেতন-ভাতা নেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় দামি গাড়ি, সম্মানীর নামে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের নামে। আইন অনুযায়ী তাদের এসব সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই।

বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান এবং তার স্ত্রী-কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ক্ষান্ত হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজেদের নামে কিনেছেন ওষুধ কোম্পানি। নভো হেলথ কেয়ার ফার্মার সিংহভাগ শেয়ারের মালিক এখন এই তিনজন। বিষয়টি অবহিত করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান কালবেলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন, গবেষণা, জমি কেনা, ভবন নির্মাণে ব্যয় করা যায়। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা ব্যয় করার সুযোগ নেই।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও ব্যবহারিক শিক্ষার সুবিধার জন্য একটি ওষুধ কোম্পানির শেয়ার কেনার প্রস্তাব দেন সবুর খান। নভো হেলথ কেয়ারের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায়ও এ বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিল। তবে শেয়ার হস্তান্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে সবুর খান, তার স্ত্রী সাহানা খান এবং মেয়ে সামিহা খানের নামে সব কাগজপত্র তৈরি করেন।

চুক্তিপত্রে দেখা যায়, ওষুধ কোম্পানিটির মোট ৮ লাখ ৬৮ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৪ লাখের মালিক এখন সবুর খান, যা মোট শেয়ারের ৪৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। তার স্ত্রী সাহানা খান এবং মেয়ে সামিহা খানের নামে কেনা হয়েছে ৫০ হাজার করে মোট ১ লাখ শেয়ার। এই দুজন এখন কোম্পানিটির ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ করে মোট ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী। সব মিলিয়ে কোম্পানিটির ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক এখন এই পরিবার।

শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত নথি অনুযায়ী নভো হেলথ কেয়ারের মোট ১১ জন শেয়ারহোল্ডার পৃথক ফরমের (ফরম-১১৭) মাধ্যমে সবুর খান ও তার স্ত্রী-কন্যার নামে নিজেদের শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। ফরমে সাক্ষী হিসেবে দুজন আইনজীবীকে রাখা হয়। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যেএসব শেয়ার হস্তান্তরের আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনযায়ী এসব শেয়ারের মোট মূল্য ধরা হয় ১৯ কোটি ১২ লাখ ৫০ টাকা।নথিপত্রে দেখা যায়, ব্যক্তি নামে ওষুধ কোম্পানির শেয়ার কেনা হলেও এর মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব থেকে। ব্র্যাক ব্যাংক এবং মধুমতী ব্যাংকে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হিসাব থেকে এ-সংক্রান্ত চেক ইস্যু করা হয়। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার বিক্রেতাদের নামে বিভিন্ন তারিখে চেক ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে অগ্রিম হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট ১ কোটি টাকা এবং ১৬ সেপ্টেম্বর একই ব্যাংকের চেকের ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে চুক্তিনামায় উল্লেখ রয়েছে।

পরে পৃথক চেকের মাধ্যমে বাকি অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সব চেকে স্বাক্ষর করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থ ও হিসাব পরিচালক মো. হামিদুল হক খান এবং ট্রেজারার মমিনুল হক মজুমদার। আর টাকা জমা হয় নভো হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ফার্মার নামে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি হিসাবে। কোম্পানিটির আগের পরিচালনা পর্ষদ এবং সবুর খান ও তার পরিবারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিনামায় দেখা গেছে, এর কোথাও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নাম নেই। পুরো চুক্তিটিই করা হয়েছে উল্লেখিত তিনজনের ব্যক্তি নামে।বিশ্ববিদ্যালয়ের তহিবলের টাকায় চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত শেয়ার কেনার বিষয়ে জানতে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার মমিনুল হক মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এটা তো ইউনিভার্সিটির না, চেয়ারম্যান স্যারের নিজের একটি প্রজেক্ট।’ চেয়ারম্যানের নিজের প্রজেক্টের অর্থ কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবের চেকে পরিশোধ করা হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রেজারার বলেন, ‘সেটা তো অন্য জিনিস। প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের কার্যক্রম থাকে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঠিক এইভাবে না বিষয়টা। ভিন্ন বিষয়। অনেক রকম ট্রানজেকশনই তো হয়।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান কালবেলাকে বলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, ইউনিভার্সিটির টাকা দিয়ে কোনো কোম্পানি কেনা যায়! যখন কোনো পেমেন্ট হয়, তখন আমরা পার্টিকে বলি, এভাবে একটু দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি। তাড়াহুড়ার জন্য। কিন্তু এটার তো অডিট আছে। আমাকে কোনো দিন অডিট ছাড়বে? আমি ইউনিভার্সিটির চেক সিগনেটরি অথরিটি নই। অনেক মানুষ এটার সঙ্গে যুক্ত আছেন। ফুল টাইম একজন অডিটর আছেন। একটা ঘষা পয়সা কোথাও যায়, সেটার কি সাধ্য আছে? ড্যাফোডিল ফ্যামিলিতে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সিতে কোনো প্রবলেম হয়নি কখনো। ট্যাক্স ফাইলে সব ঠিক আছে। তিনি আরও বলেন, ড্যাফোডিল ফ্যামিলির মধ্যে যখন ইন্টার কানেকশন হয়, যখন কোনো টাকার দরকার হয়, ইমার্জেন্সি যখন ইউনিভার্সিটির টাকার দরকার হয়, তখন কিন্তু ড্যাফোডিল ফ্যামিলি থেকে টাকাগুলো দেওয়া হয়।ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের আইনবহির্ভূত এই ব্যবহারের বিষয়টি অবহিত করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘যদি এ ধরনেরর ঘটনার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’

উল্লেখ্য, দেশে উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম অনুমোদন দেওয়া হয় ১৯৯২ সালে। ওই সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হতো ফাউন্ডেশনের অধীনে। পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ট্রাস্ট গঠনের বিধান করা হয়।

ড্যাফোডিল ভার্সিটির টাকায় সবুরের ওষুধ কোম্পানি

সানাউল হক সানী

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান।ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা বিনিয়োগ করে নিজের এবং স্ত্রী-কন্যার ব্যক্তিগত নামে একটি ওষুধ কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান। এই তিনজনের নামে এরই মধ্যে নভো হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ফার্মা লিমিটেডের ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে, যার মোট মূল্য ১৯ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর এই অর্থের পুরোটাই দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব থেকে। শেয়ার হস্তান্তর-সংক্রান্ত বিভিন্ন নথির সূত্রে কালবেলার অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পরিচালনার জন্য রয়েছে ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড। এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা মো. সবুর খান। পাশাপাশি তার স্ত্রী সাহানা খান ভাইস চেয়ারম্যান এবং কন্যা সামিহা খান ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় হবে অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্ট আইন অনুসারেও ট্রাস্টের কোনো সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা নিতে পারবেন না। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকসহ (অর্থ) বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। যেখান থেকে তারা মাসে বেতন-ভাতা নেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় দামি গাড়ি, সম্মানীর নামে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের নামে। আইন অনুযায়ী তাদের এসব সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই।

বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান এবং তার স্ত্রী-কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ক্ষান্ত হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজেদের নামে কিনেছেন ওষুধ কোম্পানি। নভো হেলথ কেয়ার ফার্মার সিংহভাগ শেয়ারের মালিক এখন এই তিনজন। বিষয়টি অবহিত করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান কালবেলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন, গবেষণা, জমি কেনা, ভবন নির্মাণে ব্যয় করা যায়। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা ব্যয় করার সুযোগ নেই।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও ব্যবহারিক শিক্ষার সুবিধার জন্য একটি ওষুধ কোম্পানির শেয়ার কেনার প্রস্তাব দেন সবুর খান। নভো হেলথ কেয়ারের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায়ও এ বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিল। তবে শেয়ার হস্তান্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে সবুর খান, তার স্ত্রী সাহানা খান এবং মেয়ে সামিহা খানের নামে সব কাগজপত্র তৈরি করেন।

চুক্তিপত্রে দেখা যায়, ওষুধ কোম্পানিটির মোট ৮ লাখ ৬৮ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৪ লাখের মালিক এখন সবুর খান, যা মোট শেয়ারের ৪৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। তার স্ত্রী সাহানা খান এবং মেয়ে সামিহা খানের নামে কেনা হয়েছে ৫০ হাজার করে মোট ১ লাখ শেয়ার। এই দুজন এখন কোম্পানিটির ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ করে মোট ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী। সব মিলিয়ে কোম্পানিটির ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক এখন এই পরিবার।

শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত নথি অনুযায়ী নভো হেলথ কেয়ারের মোট ১১ জন শেয়ারহোল্ডার পৃথক ফরমের (ফরম-১১৭) মাধ্যমে সবুর খান ও তার স্ত্রী-কন্যার নামে নিজেদের শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। ফরমে সাক্ষী হিসেবে দুজন আইনজীবীকে রাখা হয়। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যেএসব শেয়ার হস্তান্তরের আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনযায়ী এসব শেয়ারের মোট মূল্য ধরা হয় ১৯ কোটি ১২ লাখ ৫০ টাকা।নথিপত্রে দেখা যায়, ব্যক্তি নামে ওষুধ কোম্পানির শেয়ার কেনা হলেও এর মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব থেকে। ব্র্যাক ব্যাংক এবং মধুমতী ব্যাংকে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হিসাব থেকে এ-সংক্রান্ত চেক ইস্যু করা হয়। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার বিক্রেতাদের নামে বিভিন্ন তারিখে চেক ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে অগ্রিম হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট ১ কোটি টাকা এবং ১৬ সেপ্টেম্বর একই ব্যাংকের চেকের ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে চুক্তিনামায় উল্লেখ রয়েছে।

পরে পৃথক চেকের মাধ্যমে বাকি অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সব চেকে স্বাক্ষর করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থ ও হিসাব পরিচালক মো. হামিদুল হক খান এবং ট্রেজারার মমিনুল হক মজুমদার। আর টাকা জমা হয় নভো হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ফার্মার নামে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি হিসাবে। কোম্পানিটির আগের পরিচালনা পর্ষদ এবং সবুর খান ও তার পরিবারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিনামায় দেখা গেছে, এর কোথাও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নাম নেই। পুরো চুক্তিটিই করা হয়েছে উল্লেখিত তিনজনের ব্যক্তি নামে।বিশ্ববিদ্যালয়ের তহিবলের টাকায় চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত শেয়ার কেনার বিষয়ে জানতে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার মমিনুল হক মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এটা তো ইউনিভার্সিটির না, চেয়ারম্যান স্যারের নিজের একটি প্রজেক্ট।’ চেয়ারম্যানের নিজের প্রজেক্টের অর্থ কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবের চেকে পরিশোধ করা হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রেজারার বলেন, ‘সেটা তো অন্য জিনিস। প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের কার্যক্রম থাকে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঠিক এইভাবে না বিষয়টা। ভিন্ন বিষয়। অনেক রকম ট্রানজেকশনই তো হয়।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান কালবেলাকে বলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, ইউনিভার্সিটির টাকা দিয়ে কোনো কোম্পানি কেনা যায়! যখন কোনো পেমেন্ট হয়, তখন আমরা পার্টিকে বলি, এভাবে একটু দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি। তাড়াহুড়ার জন্য। কিন্তু এটার তো অডিট আছে। আমাকে কোনো দিন অডিট ছাড়বে? আমি ইউনিভার্সিটির চেক সিগনেটরি অথরিটি নই। অনেক মানুষ এটার সঙ্গে যুক্ত আছেন। ফুল টাইম একজন অডিটর আছেন। একটা ঘষা পয়সা কোথাও যায়, সেটার কি সাধ্য আছে? ড্যাফোডিল ফ্যামিলিতে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সিতে কোনো প্রবলেম হয়নি কখনো। ট্যাক্স ফাইলে সব ঠিক আছে। তিনি আরও বলেন, ড্যাফোডিল ফ্যামিলির মধ্যে যখন ইন্টার কানেকশন হয়, যখন কোনো টাকার দরকার হয়, ইমার্জেন্সি যখন ইউনিভার্সিটির টাকার দরকার হয়, তখন কিন্তু ড্যাফোডিল ফ্যামিলি থেকে টাকাগুলো দেওয়া হয়।ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের আইনবহির্ভূত এই ব্যবহারের বিষয়টি অবহিত করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘যদি এ ধরনেরর ঘটনার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’

উল্লেখ্য, দেশে উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম অনুমোদন দেওয়া হয় ১৯৯২ সালে। ওই সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হতো ফাউন্ডেশনের অধীনে। পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ট্রাস্ট গঠনের বিধান করা হয়।