বই উৎসবে বই পাবে না সব শিক্ষার্থী

আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের

পিকআপে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নতুন বইছবি: কালবেলা

শিক্ষাবর্ষের শুরুতে নানা কারণে নতুন বই পাবে না অনেক শিক্ষার্থী। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—কাগজ ও কালির সংকট, ঊর্ধ্বমুখী দাম, ছাপা সরঞ্জামের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং, দুটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম ও জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কার্যাদেশে দেরি। যদিও সংকট  সমাধানে এনসিটিবির তাড়া রয়েছে। তবু ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপাতে পারবে না প্রেসগুলো।

এদিকে কাগজ সংকটে নিম্নমানের রিসাইকেল কাগজে ছাপানোয় বেশিরভাগ বই কাঙ্ক্ষিত মানের হয়নি। অন্যদিকে, মান কমিয়ে দেওয়ায় ডিসেম্বরের শেষার্ধে বই ছাপার কাজে গতি বেড়েছে বলে জানা গেছে। এনসিটিবির ভাষ্য, এই হারে বই ছাপলে ১ জানুয়ারির আগে ৮০ শতাংশ বই স্কুলে চলে যাবে। তবে মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, মাধ্যমিকের বেশিরভাগ বই নতুন বছরের শুরুর আগে গেলেও প্রাথমিকের বই যাবে কম।

এনসিটিবির তথ্যানুসারে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ৩৩ কোটি ৯৬ লাখ ৯ হাজার কপি বই ছাপানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকে ৯ কোটি ৯২ লাখ ৮৩ হাজার, মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮, ইবতেদায়ি শ্রেণিতে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার, দাখিলে ৪ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার কপি বই ছাপা হচ্ছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই ছাপা হচ্ছে ২ লাখ ১২ হাজার ১৭৭ কপি।

সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর দেরি করে বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেয় এনসিটিবি। আগের বছরগুলোতে প্রথমে প্রাথমিক ও পরে মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেওয়া হলেও এবার হয়েছে তার উল্টো। শুরুর দিকে ছাপানো মাধ্যমিকের বইগুলো মানসম্মত হলেও কাগজ সংকটের কারণে এখন ছাপানো হচ্ছে নিম্নমানের বই। এসব বই ছাপা হচ্ছে রিসাইকেল করে পাওয়া কাগজ দিয়ে। প্রাথমিকের বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ৬ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর থেকে বই ছাপানোর কাজ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকের বইগুলোও ছাপানো হচ্ছে নিম্নমানের কাগজে।

এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, এবার বছরের শুরুতে কিছু উপজেলা ছাড়া বাকি সবাই শতভাগ বই পাবে। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব বই আসবে সেগুলো ১ জানুয়ারির আগে বিতরণ হয়ে যাবে। এর পর যেসব বই আসবে তা বিতরণ হবে ১ জানুয়ারির পর।

জানা যায়, সম্প্রতি এনসিটিবির সঙ্গে বৈঠক হয় মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টদের। সেখানে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বাতিল কাগজ না থাকায় সংকট কাটাতে এনসিটিবির পুরোনো বই দিয়ে রিসাইকেল কাগজ তৈরি করার পরামর্শ দেন। এরপর এনসিটিবি বাফার স্টকে থাকা ৪ হাজার টন বই রিসাইকেল কাগজ তৈরির জন্য বিক্রি করে দেয়। কাগজের মিলগুলো সেসব বই থেকে রিসাইকেল কাগজ উৎপাদন করে। এ ছাড়া জেলা-উপজেলা থেকে কিছু বই এসেছে। এর ফলে এখন বাজারে কিছু রিসাইকেল কাগজ পাওয়া যাচ্ছে। গত ১০-১৫ দিনে বই ছাপার কাজে গতি বেড়েছে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সোমবার বিকেলে কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশ বই ১ জানুয়ারির আগে চলে যাবে। প্রাথমিকের বইয়ের কার্যাদেশে দেরি হওয়ায় মাধ্যমিকের বই ছাপানোর গতি কমিয়ে প্রাথমিকের বই ছাপাতে হয়েছে। এটি না করলে এতদিনে মাধ্যমিকে শতভাগ বই চলে যেত। আর প্রাথমিকে প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির ৯৮ লটের মধ্যে ৪১ লটের বই উপজেলায় চলে গেছে। তৃতীয়-পঞ্চম শ্রেণির ৯৮ লটের মধ্যে ৬০ লটের বই উপজেলায় চলে গেছে। বাকিগুলোও দ্রুত চলে যাবে। গত রোববার পর্যন্ত ২১ উপজেলায় বই পাঠানো যায়নি। আগামী চার দিনে এসব উপজেলায় বই চলে যাবে। আনন্দঘন পরিবেশেই বই উৎসব হবে। আশা করছি, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সবগুলো বই পাঠিয়ে দিতে পারব।

তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যানের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এনসিটিবি অনেক কিছুই বাড়িয়ে বলে। সারা জীবন তারা বইয়ের ভালো মানের কথা বলেছে। কিন্তু উজ্জ্বলতায় ছাড় দেওয়ায় এবার সর্বনিম্ন মানের বই পাচ্ছে। এটি জাতির জন্য কলঙ্কজনক। বই এতটা নিম্নমানের হয়েছে যে, নিউজপ্রিন্টের হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান কালবেলাকে বলেন, একদিক বিবেচনায় এনসিটিবি চেয়ারম্যান সত্যি বলেছেন, অন্যদিক বিবেচনায় তথ্যবিভ্রাট আছে। ৭টি বইয়ের মধ্যে ৫টি ছাপানোর পর যদি আমাকে ছাড়পত্র দিয়ে বলা হয় তুমি বই পাঠিয়ে দাও। কিন্তু বাকি দুইটা বই ছাপানো না হলে তো আমি ট্রাক মেলাতে পারব না। এটি নিয়মও না। তার (এনসিটিবি চেয়ারম্যান) হিসাবে বই চলে গেছে, কিন্তু আমার হিসাবে বই গুদামে রয়ে গেছে, জমা দেওয়া হয়নি। তাই তিনিও মিথ্যে বলেননি, প্রেস মালিকরাও মিথ্যা বলছেন না। তিনি আরও বলেন, এনসিটিবি চেয়ারম্যানের হিসাবে মাধ্যমিকে ১ জানুয়ারির মধ্যে ৮০ শতাংশ বই যাবে। এটি এভাবে হবে—অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে ৯০ শতাংশ, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ৬০-৭০ শতাংশ। এর সঙ্গে কারিগরি ও মাদ্রাসার বই মিলিয়ে ৮০ শতাংশ হবে। আমাদের ধারণা, ১ জানুয়ারির মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৮০-৯০ শতাংশ, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে ৫০-৬০ শতাংশ বই যাবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপানোর জন্য ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ওয়ার্কঅর্ডার আছে। তাহলে প্রেসমালিক কীভাবে ১ জানুয়ারির আগে বই দেবেন!

মুদ্রণ শিল্প সমিতি সূত্র জানায়, প্রাথমিকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ৬০ শতাংশ কাজ দিয়েছে এনসিটিবি। এরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়ে গুদামে রেখে দিয়েছে। তারা শেষ মুহূর্তে বইগুলো সরবরাহ করবে। কী পরিমাণ বই তারা গুদামজাত করে রেখেছে তার তথ্য নেই। প্রাথমিকের বইয়ের পৃষ্ঠা কম থাকায় ছাপায় সময় কম লাগে। ধারণা  করা হচ্ছে, বছরের শেষ দিন পর্যন্ত চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ৮০-৯০ শতাংশ, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির লটের ৬০-৭০ শতাংশ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৫০-৬০ শতাংশ বই চলে যাবে।

সূত্র জানায়, সরকারের একজন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত কয়েকটি প্রেসের কাছে মোট কাজের ৩০ শতাংশ রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠান পরিচয় পাওয়ায় এনসিটিবিও জানে না তাদের কাছ থেকে কতগুলো বই আসছে, আর কতগুলো বই ছাপা বাকি রয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার বাইরে কাজ দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে কম দর দেওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়নি তাদের সক্ষমতা নেই বলে। কিন্তু অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস, বারতোপা প্রিন্টার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ঠিকই কাজ দেওয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি বলছে, ওপরের চাপ আছে।

জানতে চাইলে বারতোপা প্রিন্টার্স লিমিটেডের স্বত্বধিকারী অনুপ কুমার দে বলেন, এবার আমরা এনসিটিবি থেকে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই ছাপানোর কাজ পেয়েছি। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই ছাপানোর কাজ শেষে সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কাগজ আর কালির সংকটের কারণে এখনো মাধ্যমিকের ৫০ শতাংশ বই ছাপানো যায়নি। বেশি দামে কাগজ কিনতে চেয়েও পাচ্ছি না। তবে এনসিটিবি আমাদের সহযোগিতা করছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে আশা করছি, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বাকি বইগুলো পাঠিয়ে দিতে পারব।

তবে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের মালিক কাউসার-উজ-জামান রুবেলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রাথমিকের বই ছাপানোর পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে সোমবার বিকেলে একটি প্রেসের মালিক কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিকের বই ছাপানো নিয়ে জটিলতা মোটামুটি কেটেছে। বাচ্চাদের সবাই যাতে বই পায়, কেউ যাতে খালি হাতে না যায়, সেই লক্ষ্যেই এনসিটিবি আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে। আমরাও কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি, যেসব লটের কাজ পেয়েছি সবগুলো যেন নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে পারি।

বই উৎসবে বই পাবে না সব শিক্ষার্থী

আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের

পিকআপে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নতুন বইছবি: কালবেলা

শিক্ষাবর্ষের শুরুতে নানা কারণে নতুন বই পাবে না অনেক শিক্ষার্থী। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—কাগজ ও কালির সংকট, ঊর্ধ্বমুখী দাম, ছাপা সরঞ্জামের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং, দুটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম ও জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কার্যাদেশে দেরি। যদিও সংকট  সমাধানে এনসিটিবির তাড়া রয়েছে। তবু ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপাতে পারবে না প্রেসগুলো।

এদিকে কাগজ সংকটে নিম্নমানের রিসাইকেল কাগজে ছাপানোয় বেশিরভাগ বই কাঙ্ক্ষিত মানের হয়নি। অন্যদিকে, মান কমিয়ে দেওয়ায় ডিসেম্বরের শেষার্ধে বই ছাপার কাজে গতি বেড়েছে বলে জানা গেছে। এনসিটিবির ভাষ্য, এই হারে বই ছাপলে ১ জানুয়ারির আগে ৮০ শতাংশ বই স্কুলে চলে যাবে। তবে মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, মাধ্যমিকের বেশিরভাগ বই নতুন বছরের শুরুর আগে গেলেও প্রাথমিকের বই যাবে কম।

এনসিটিবির তথ্যানুসারে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ৩৩ কোটি ৯৬ লাখ ৯ হাজার কপি বই ছাপানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকে ৯ কোটি ৯২ লাখ ৮৩ হাজার, মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮, ইবতেদায়ি শ্রেণিতে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার, দাখিলে ৪ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার কপি বই ছাপা হচ্ছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই ছাপা হচ্ছে ২ লাখ ১২ হাজার ১৭৭ কপি।

সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর দেরি করে বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেয় এনসিটিবি। আগের বছরগুলোতে প্রথমে প্রাথমিক ও পরে মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেওয়া হলেও এবার হয়েছে তার উল্টো। শুরুর দিকে ছাপানো মাধ্যমিকের বইগুলো মানসম্মত হলেও কাগজ সংকটের কারণে এখন ছাপানো হচ্ছে নিম্নমানের বই। এসব বই ছাপা হচ্ছে রিসাইকেল করে পাওয়া কাগজ দিয়ে। প্রাথমিকের বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ৬ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর থেকে বই ছাপানোর কাজ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকের বইগুলোও ছাপানো হচ্ছে নিম্নমানের কাগজে।

এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, এবার বছরের শুরুতে কিছু উপজেলা ছাড়া বাকি সবাই শতভাগ বই পাবে। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব বই আসবে সেগুলো ১ জানুয়ারির আগে বিতরণ হয়ে যাবে। এর পর যেসব বই আসবে তা বিতরণ হবে ১ জানুয়ারির পর।

জানা যায়, সম্প্রতি এনসিটিবির সঙ্গে বৈঠক হয় মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টদের। সেখানে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বাতিল কাগজ না থাকায় সংকট কাটাতে এনসিটিবির পুরোনো বই দিয়ে রিসাইকেল কাগজ তৈরি করার পরামর্শ দেন। এরপর এনসিটিবি বাফার স্টকে থাকা ৪ হাজার টন বই রিসাইকেল কাগজ তৈরির জন্য বিক্রি করে দেয়। কাগজের মিলগুলো সেসব বই থেকে রিসাইকেল কাগজ উৎপাদন করে। এ ছাড়া জেলা-উপজেলা থেকে কিছু বই এসেছে। এর ফলে এখন বাজারে কিছু রিসাইকেল কাগজ পাওয়া যাচ্ছে। গত ১০-১৫ দিনে বই ছাপার কাজে গতি বেড়েছে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সোমবার বিকেলে কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশ বই ১ জানুয়ারির আগে চলে যাবে। প্রাথমিকের বইয়ের কার্যাদেশে দেরি হওয়ায় মাধ্যমিকের বই ছাপানোর গতি কমিয়ে প্রাথমিকের বই ছাপাতে হয়েছে। এটি না করলে এতদিনে মাধ্যমিকে শতভাগ বই চলে যেত। আর প্রাথমিকে প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির ৯৮ লটের মধ্যে ৪১ লটের বই উপজেলায় চলে গেছে। তৃতীয়-পঞ্চম শ্রেণির ৯৮ লটের মধ্যে ৬০ লটের বই উপজেলায় চলে গেছে। বাকিগুলোও দ্রুত চলে যাবে। গত রোববার পর্যন্ত ২১ উপজেলায় বই পাঠানো যায়নি। আগামী চার দিনে এসব উপজেলায় বই চলে যাবে। আনন্দঘন পরিবেশেই বই উৎসব হবে। আশা করছি, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সবগুলো বই পাঠিয়ে দিতে পারব।

তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যানের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এনসিটিবি অনেক কিছুই বাড়িয়ে বলে। সারা জীবন তারা বইয়ের ভালো মানের কথা বলেছে। কিন্তু উজ্জ্বলতায় ছাড় দেওয়ায় এবার সর্বনিম্ন মানের বই পাচ্ছে। এটি জাতির জন্য কলঙ্কজনক। বই এতটা নিম্নমানের হয়েছে যে, নিউজপ্রিন্টের হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান কালবেলাকে বলেন, একদিক বিবেচনায় এনসিটিবি চেয়ারম্যান সত্যি বলেছেন, অন্যদিক বিবেচনায় তথ্যবিভ্রাট আছে। ৭টি বইয়ের মধ্যে ৫টি ছাপানোর পর যদি আমাকে ছাড়পত্র দিয়ে বলা হয় তুমি বই পাঠিয়ে দাও। কিন্তু বাকি দুইটা বই ছাপানো না হলে তো আমি ট্রাক মেলাতে পারব না। এটি নিয়মও না। তার (এনসিটিবি চেয়ারম্যান) হিসাবে বই চলে গেছে, কিন্তু আমার হিসাবে বই গুদামে রয়ে গেছে, জমা দেওয়া হয়নি। তাই তিনিও মিথ্যে বলেননি, প্রেস মালিকরাও মিথ্যা বলছেন না। তিনি আরও বলেন, এনসিটিবি চেয়ারম্যানের হিসাবে মাধ্যমিকে ১ জানুয়ারির মধ্যে ৮০ শতাংশ বই যাবে। এটি এভাবে হবে—অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে ৯০ শতাংশ, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ৬০-৭০ শতাংশ। এর সঙ্গে কারিগরি ও মাদ্রাসার বই মিলিয়ে ৮০ শতাংশ হবে। আমাদের ধারণা, ১ জানুয়ারির মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৮০-৯০ শতাংশ, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে ৫০-৬০ শতাংশ বই যাবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপানোর জন্য ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ওয়ার্কঅর্ডার আছে। তাহলে প্রেসমালিক কীভাবে ১ জানুয়ারির আগে বই দেবেন!

মুদ্রণ শিল্প সমিতি সূত্র জানায়, প্রাথমিকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ৬০ শতাংশ কাজ দিয়েছে এনসিটিবি। এরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়ে গুদামে রেখে দিয়েছে। তারা শেষ মুহূর্তে বইগুলো সরবরাহ করবে। কী পরিমাণ বই তারা গুদামজাত করে রেখেছে তার তথ্য নেই। প্রাথমিকের বইয়ের পৃষ্ঠা কম থাকায় ছাপায় সময় কম লাগে। ধারণা  করা হচ্ছে, বছরের শেষ দিন পর্যন্ত চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ৮০-৯০ শতাংশ, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির লটের ৬০-৭০ শতাংশ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৫০-৬০ শতাংশ বই চলে যাবে।

সূত্র জানায়, সরকারের একজন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত কয়েকটি প্রেসের কাছে মোট কাজের ৩০ শতাংশ রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠান পরিচয় পাওয়ায় এনসিটিবিও জানে না তাদের কাছ থেকে কতগুলো বই আসছে, আর কতগুলো বই ছাপা বাকি রয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার বাইরে কাজ দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে কম দর দেওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়নি তাদের সক্ষমতা নেই বলে। কিন্তু অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস, বারতোপা প্রিন্টার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ঠিকই কাজ দেওয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি বলছে, ওপরের চাপ আছে।

জানতে চাইলে বারতোপা প্রিন্টার্স লিমিটেডের স্বত্বধিকারী অনুপ কুমার দে বলেন, এবার আমরা এনসিটিবি থেকে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই ছাপানোর কাজ পেয়েছি। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই ছাপানোর কাজ শেষে সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কাগজ আর কালির সংকটের কারণে এখনো মাধ্যমিকের ৫০ শতাংশ বই ছাপানো যায়নি। বেশি দামে কাগজ কিনতে চেয়েও পাচ্ছি না। তবে এনসিটিবি আমাদের সহযোগিতা করছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে আশা করছি, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বাকি বইগুলো পাঠিয়ে দিতে পারব।

তবে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের মালিক কাউসার-উজ-জামান রুবেলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রাথমিকের বই ছাপানোর পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে সোমবার বিকেলে একটি প্রেসের মালিক কালবেলাকে বলেন, প্রাথমিকের বই ছাপানো নিয়ে জটিলতা মোটামুটি কেটেছে। বাচ্চাদের সবাই যাতে বই পায়, কেউ যাতে খালি হাতে না যায়, সেই লক্ষ্যেই এনসিটিবি আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে। আমরাও কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি, যেসব লটের কাজ পেয়েছি সবগুলো যেন নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে পারি।