বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে শিক্ষা ও ক্যারিয়ার

অমিত সরদার।

জীববিজ্ঞানের একটি অত্যাধুনিক শাখা হলো বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। বর্তমান বিশ্বে মানবকল্যাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে এটি। বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিএসসি ইন বায়োটেকনোলজি’ প্রোগ্রাম চালুর মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিষয়টি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করলে ২০০৩ সালে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে প্রোগ্রামটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’, ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি’ বা ‘বায়োটেকনোলজি’ নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো হয়। এ বিভাগে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের প্রভাষক অমিত সরদার।

পড়ার যোগ্যতা কী
‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিষয়ে পড়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অবশ্যই বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করতে হবে। তবে এ বিষয়ে পড়তে চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বা সমমান পর্যায়ে ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫০ সহ মোট জিপিএ ৭.৫০-৮. ০০ প্রয়োজন হতে পারে। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পছন্দের বিষয় হিসেবে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নির্বাচন করে ভর্তি হওয়া যাবে। তবে বর্তমানে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রথম দিকের হওয়ায় এ বিষয়ে পড়তে হলে ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় ভালো অবস্থানে থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে পড়তে হলে অবশ্যই জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ভালো দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।

কোথায় কোথায় ভর্তি হওয়া যায়
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে।

এর পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম এবং খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে পড়াশোনা করা যায়। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামেও ভর্তির সুযোগ রয়েছে।

এ প্রোগ্রামে কী কী বিষয়ে পড়ানো হয়
বায়োটেকনোলজি মূলত একটি মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি বিষয়। এটি মূলত বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ইমিউনোলজি ও জেনেটিকস ইত্যাদি বিষয়ের একটি সমন্বিত রূপ। ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ প্রোগ্রামে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন উচ্চতর বিষয় যেমন অ্যানিমেল সেল কালচার, প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার, ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং, রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি, জিন থেরাপি, জেনোম সিকুয়েন্সিং, ডেভেলপমেন্ট বায়োলজি, স্টেম সেল থেরাপি, ক্যানসার বায়োলজি, রিজেনারেটিভ মেডিসিন, ন্যানোটেকনোলজি, ড্রাগ ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়। এ ছাড়া পিসিআর, আরটিপিসিআর, এনএমআর, স্পেকট্রসকপি, মাইক্রোঅ্যারে, ফ্লো সাইটোমেট্রির মতো বিশেষায়িত প্রযুক্তি সম্পর্কেও পড়ানো হয়।

চাকরির সুযোগ কেমন
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং একটি অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী বিষয়। বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক বিভাগ, বায়োটেকনোলজি বেইজড ইন্ডাস্ট্রি, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি ও এনজিওগুলোতে বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে ‘বায়োটেক ডিভিশন’ নামে আলাদা একটি ডিভিশনই রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজির জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের গবেষণা ও চাকরির সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি একাডেমিক ক্ষেত্রেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন অসংখ্য বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েট। এ ছাড়া বিশ্বের নামকরা বিভিন্ন বায়োটেকনোলজি কোম্পানিতেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার মডার্নার মতো বিখ্যাত বিভিন্ন বায়োটেকনোলজি কোম্পানিতে কাজ করছেন বাংলাদেশের অনেক গ্র্যাজুয়েট। পাশাপাশি বায়োটেকনোলজির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে সহজেই নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।

বায়োটেকনোলজিস্ট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের প্রয়োজনীয়তা
বলা হয়ে থাকে, একবিংশ শতাব্দী হবে বায়োটেকনোলজিস্টদের। তাই বায়োটেকনোলজিস্ট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে গবেষণার গুরুত্ব কতখানি। একটি ভ্যাকসিন ডেভেলপ করে বাজারজাত করার জন্য ৮-১০ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এই ফিল্ডের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে এত অল্প সময়ে ভ্যাকসিন ডেভেলপ করা সম্ভব হয়েছিল। সর্বোপরি একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজিস্টরা যথেষ্ট অবহেলিত। বাংলাদেশে যথেষ্টসংখ্যক বায়োটেকনোলজিস্ট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার থাকা সত্ত্বেও এবং কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান রাখার সুযোগ থাকলেও সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণে, স্বাস্থ্যসেবায়, পরিবেশ সংরক্ষণে এবং একুশ শতকের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বায়োটেকনোলজিস্টরা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এককথায়, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেন বায়োটেকনোলজিস্টরা।

পড়ার খরচ কেমন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে পড়ার জন্য তেমন খরচ নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির সময় ১৫-২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। ভর্তির পর স্নাতক কোর্স সম্পন্ন করার জন্য সেমিস্টার ফি ও পরীক্ষার ফি হিসাবে ৪০-৫০ হাজার টাকার মতো প্রয়োজন হতে পারে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে খরচের পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক কোর্সে পড়ার জন্য ৮-১২ লাখ টাকার মতো খরচ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় টাকার পরিমাণ কম বেশি হতে পারে।

উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কেমন
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অবারিত সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বিষয়টি অবহেলিত হলেও উন্নত বিশ্বে এটির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। যেকোনো টপ র‍্যাংকড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ব্রাউজ করলেই বুঝতে পারা যাবে, সে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বায়োটেকনোলজি গবেষণায় কতটা সমৃদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ প্রতিবছর বায়োটেকনোলজি বা বায়োটেকনোলজি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচুর স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী ওপরের দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন।

অনুলিখন: আনিসুল ইসলাম নাঈম

অমিত সরদারপ্রভাষক, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। 

বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে শিক্ষা ও ক্যারিয়ার

অমিত সরদার।

জীববিজ্ঞানের একটি অত্যাধুনিক শাখা হলো বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। বর্তমান বিশ্বে মানবকল্যাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে এটি। বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিএসসি ইন বায়োটেকনোলজি’ প্রোগ্রাম চালুর মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিষয়টি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করলে ২০০৩ সালে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে প্রোগ্রামটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’, ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি’ বা ‘বায়োটেকনোলজি’ নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো হয়। এ বিভাগে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের প্রভাষক অমিত সরদার।

পড়ার যোগ্যতা কী
‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিষয়ে পড়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অবশ্যই বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করতে হবে। তবে এ বিষয়ে পড়তে চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বা সমমান পর্যায়ে ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫০ সহ মোট জিপিএ ৭.৫০-৮. ০০ প্রয়োজন হতে পারে। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পছন্দের বিষয় হিসেবে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নির্বাচন করে ভর্তি হওয়া যাবে। তবে বর্তমানে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রথম দিকের হওয়ায় এ বিষয়ে পড়তে হলে ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় ভালো অবস্থানে থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে পড়তে হলে অবশ্যই জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ভালো দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।

কোথায় কোথায় ভর্তি হওয়া যায়
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে।

এর পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম এবং খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে পড়াশোনা করা যায়। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামেও ভর্তির সুযোগ রয়েছে।

এ প্রোগ্রামে কী কী বিষয়ে পড়ানো হয়
বায়োটেকনোলজি মূলত একটি মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি বিষয়। এটি মূলত বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ইমিউনোলজি ও জেনেটিকস ইত্যাদি বিষয়ের একটি সমন্বিত রূপ। ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ প্রোগ্রামে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন উচ্চতর বিষয় যেমন অ্যানিমেল সেল কালচার, প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার, ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং, রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজি, জিন থেরাপি, জেনোম সিকুয়েন্সিং, ডেভেলপমেন্ট বায়োলজি, স্টেম সেল থেরাপি, ক্যানসার বায়োলজি, রিজেনারেটিভ মেডিসিন, ন্যানোটেকনোলজি, ড্রাগ ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়। এ ছাড়া পিসিআর, আরটিপিসিআর, এনএমআর, স্পেকট্রসকপি, মাইক্রোঅ্যারে, ফ্লো সাইটোমেট্রির মতো বিশেষায়িত প্রযুক্তি সম্পর্কেও পড়ানো হয়।

চাকরির সুযোগ কেমন
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং একটি অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী বিষয়। বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক বিভাগ, বায়োটেকনোলজি বেইজড ইন্ডাস্ট্রি, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি ও এনজিওগুলোতে বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে ‘বায়োটেক ডিভিশন’ নামে আলাদা একটি ডিভিশনই রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজির জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের গবেষণা ও চাকরির সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি একাডেমিক ক্ষেত্রেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন অসংখ্য বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েট। এ ছাড়া বিশ্বের নামকরা বিভিন্ন বায়োটেকনোলজি কোম্পানিতেও বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার মডার্নার মতো বিখ্যাত বিভিন্ন বায়োটেকনোলজি কোম্পানিতে কাজ করছেন বাংলাদেশের অনেক গ্র্যাজুয়েট। পাশাপাশি বায়োটেকনোলজির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে সহজেই নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।

বায়োটেকনোলজিস্ট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের প্রয়োজনীয়তা
বলা হয়ে থাকে, একবিংশ শতাব্দী হবে বায়োটেকনোলজিস্টদের। তাই বায়োটেকনোলজিস্ট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে গবেষণার গুরুত্ব কতখানি। একটি ভ্যাকসিন ডেভেলপ করে বাজারজাত করার জন্য ৮-১০ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এই ফিল্ডের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে এত অল্প সময়ে ভ্যাকসিন ডেভেলপ করা সম্ভব হয়েছিল। সর্বোপরি একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজিস্টরা যথেষ্ট অবহেলিত। বাংলাদেশে যথেষ্টসংখ্যক বায়োটেকনোলজিস্ট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার থাকা সত্ত্বেও এবং কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান রাখার সুযোগ থাকলেও সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণে, স্বাস্থ্যসেবায়, পরিবেশ সংরক্ষণে এবং একুশ শতকের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বায়োটেকনোলজিস্টরা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এককথায়, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেন বায়োটেকনোলজিস্টরা।

পড়ার খরচ কেমন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে পড়ার জন্য তেমন খরচ নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির সময় ১৫-২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। ভর্তির পর স্নাতক কোর্স সম্পন্ন করার জন্য সেমিস্টার ফি ও পরীক্ষার ফি হিসাবে ৪০-৫০ হাজার টাকার মতো প্রয়োজন হতে পারে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে খরচের পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক কোর্সে পড়ার জন্য ৮-১২ লাখ টাকার মতো খরচ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় টাকার পরিমাণ কম বেশি হতে পারে।

উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কেমন
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অবারিত সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বিষয়টি অবহেলিত হলেও উন্নত বিশ্বে এটির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। যেকোনো টপ র‍্যাংকড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ব্রাউজ করলেই বুঝতে পারা যাবে, সে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বায়োটেকনোলজি গবেষণায় কতটা সমৃদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ প্রতিবছর বায়োটেকনোলজি বা বায়োটেকনোলজি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচুর স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী ওপরের দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন।

অনুলিখন: আনিসুল ইসলাম নাঈম

অমিত সরদারপ্রভাষক, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।