মাউশিতে অদ্ভুত অনুমতি বাণিজ্য

শরীফুল আলম সুমন

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এবং সরকারি স্কুল-কলেজের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য শুরু হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের প্রেষণে (চাকরিরত রেখেই সরকারি এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সংযুক্তি বা পড়ালেখার অনুমতি) ছাড়া নিয়মিত কোর্সে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই। মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা সে নিয়ম মেনে চললেও তা মানছে না প্রশাসন শাখা। নিয়ম ভেঙে প্রেষণ ছাড়াই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কোর্স করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আর এ কাজে অধিদপ্তরের কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কর্মচারীরা চাইলে উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে বিএডসহ অন্যান্য কোর্স করতে পারেন। কারণ সেখানে ছুটির দিনে ক্লাস ও পরীক্ষা হয়। এর বাইরে সাধারণত নিয়মিত কোনো কোর্সে তাদের ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয় না। এরপরও যদি কেউ কোনো ধরনের অনুমতি নিয়ে থাকে, তাহলে আমরা খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, এত দিন কর্মচারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার তেমন কোনো আগ্রহই ছিল না। কিন্তু ২০২১ সালের ২২ আগস্ট নতুন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা প্রকাশিত হয়। সেখানে সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়। এতে ১৩তম পদভুক্ত প্রধান সহকারী, হিসাবরক্ষক কাম প্রধান সহকারী, অডিটর, প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক বা সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং ১৪তম গ্রেডভুক্ত উচ্চমান সহকারী, প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক, প্রধান সহকারী, হিসাবরক্ষক-কাম-ক্লার্ক বা হিসাবরক্ষক, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর বা ব্যক্তিগত সহকারী কাম স্ট্যানোটাইপিস্টরা পদোন্নতি পাবেন। তারা ১০ম গ্রেডভুক্ত সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মোট পদের শতকরা ২০ ভাগ পদে এই পদোন্নতি পাবেন। তবে ওই পদে পদোন্নতির জন্য সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ডিগ্রি থাকতে হবে। এই বিধিমালা জারির কথা জানতে পেরে এর কিছুদিন আগে থেকেই মূলত কর্মচারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের তোড়জোড় শুরু হয়। যারা স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণি, তারা বিএড করছেন। আর যারা স্নাতকে তৃতীয় শ্রেণি, তারা বিএডের পাশাপাশি মাস্টার্স কোর্স করছেন।

মাউশি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মোট সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের ২০ শতাংশ হিসাব করলে ৯৯টি পদে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, ১০ম গ্রেডভুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ আরও ১৭টি পদে কর্মচারীদের একই ধরনের পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের কারোরই সাধারণত বিএড ডিগ্রি নেই। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের প্রেষণ ছাড়া যেহেতু নিয়মিত কোর্সে ভর্তির সুযোগ নেই, তাই এ নিয়ে একটি সিন্ডিকেটের সৃষ্টি হয়েছে। তারা প্রশাসন শাখার মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও নিয়মিত কোর্সে ভর্তির অনুমতি নিয়ে দেয়। এভাবে ইতিমধ্যে প্রায় এক শর ওপরে কর্মচারী উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিয়েছেন। আর এ জন্য প্রত্যেক কর্মচারীকে দুই লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত ওই সিন্ডিকেটকে দিতে হয়েছে। তবে ওই সিন্ডিকেট কর্মচারীদের জানিয়েছে, উচ্চশিক্ষার অনুমতি পাওয়া মানেই পদোন্নতি অনেকটা নিশ্চিত। কারণ পদোন্নতির জন্য যতগুলো পদ আছে, তার কাছাকাছি সংখ্যককে উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে। সিন্ডিকেটের কথামতোই দুই-আড়াই মাস ধরে নিয়মিত কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন শুধু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএড করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে আগে যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিয়েছেন, তাদেরই শুধু পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, উচ্চশিক্ষার অনুমতি বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রশাসন শাখার পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকের চারজন ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ)। এ ছাড়া প্রশাসন শাখার আরও দু-একজন কর্মচারী এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন। তারাই মূলত অর্থের লেনদেন করেছেন।

নাম প্রকাশ না করে সম্প্রতি উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিতে আসা একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত দুই-তিন বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে বিএড করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে মূলত ভর্তি হলেই পাস করা যায়। আর এখন যদি আবার অনুমতি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে যারা অনুমতি পেয়েছে, তাদের পদোন্নতিই নিশ্চিত করে দেওয়া হলো। তাই আমাদের দাবি, নিয়মবহির্ভূতভাবে আগে যত অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে।’

২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর জারি করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক নীতিমালার ধারা ৬-এ বলা হয়েছে, প্রচলিত বিধান অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষাছুটি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত মঞ্জুর করা যাবে। এই ছুটি প্রেষণের সঙ্গেও যেকোনো মেয়াদে দেওয়া যাবে। প্রেষণ শেষ হওয়ার পরেও প্রয়োজন হলে প্রেষণের সঙ্গে সংযুক্ত করে শিক্ষাছুটি মঞ্জুর করা যাবে; অর্থাৎ এতে বোঝা যায়, প্রেষণ বা শিক্ষাছুটি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়মিত কোর্সে পড়ালেখার সুযোগ নেই। অথচ দেশ রূপান্তরের হাতে প্রেষণ বা শিক্ষাছুটি ছাড়াই মাউশি অধিদপ্তরের কর্মচারীদের নিয়মিত কোর্সে উচ্চশিক্ষার একাধিক আদেশ রয়েছে। এ বছরের ৬ জুলাই মাউশি অধিদপ্তরের সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. হাইদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর মুহাম্মদ আবুল কালাম ও মোহাম্মদ আব্দুস ছালামকে প্রাইম ইউনিভার্সিটির সামার সেমিস্টার-২০২২-এ বিএড প্রোগ্রামে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। সেখানে তিনটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। তা হলো অধ্যয়নকালে কর্মস্থলে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে কোনোরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারবে না, পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য কোনো প্রকার টিএ/ডিএ পাবেন না এবং শুধু পরীক্ষার দিনগুলোতে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি বা ছুটি নিতে হবে। এই আদেশে স্বাক্ষর করেন অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস।

এ বছরের ২৪ মার্চ একই শর্তে মাউশি অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মোতাহের হোসেন, সাঁটলিপিকার আছমা পারভীন ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পারভীন আকতারকে দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিয়াউল হক আকন্দ ও করণিক-কাম-মুদ্রাক্ষরিক শিকদার আরিফুজ্জামানকে উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে এমএ কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হিসাবরক্ষক মো. হাসিবুল আলম মির্জা, মো. আব্দুর রাজ্জাক ম-ল, মো. মাহবুবুল আলম ও মো. রজব আলী খন্দকারকে পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বগুড়ায় বিএড কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৪ জুলাই হিসাবরক্ষক রঘুনাথ পাল, ১২ জুলাই সঞ্জয় কুমার পালকে পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বগুড়ায় বিএড কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়।

এ ছাড়া ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. জামাল হোসেন, হিসাবরক্ষক ইসমাইল হোসেন, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. মোবারক হোসেন, হিসাবরক্ষক-কাম-ক্লার্ক আবদুল কাইয়ুম, হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ ইয়াজুল হক, হিসাবরক্ষক মো. রেজাউল করিম ও কাজী মো. আরমিনকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে বিএড কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। এভাবে আরও একাধিক কর্মচারীকে নিয়ম ভেঙে নিয়মিত কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২-এর ৪৬ নম্বর ধারা মোতাবেক প্রণীত ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) কোর্সটিকে সম্পূর্ণ পূর্ণকালীন কোর্স বলা হয়।

মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেয়। কিন্তু তারা নিয়মিত কোর্সে কোনো শিক্ষককে ভর্তির অনুমতি দেন না। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর এক আদেশে, শেরপুরের শ্রীবরদী সরকারি কলেজের সহকারী শিক্ষক মো. মোরশেদুজ্জামানকে উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে এমপিএড কোর্সে ভর্তির আবেদন বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে জানানো হয়। আদেশের মন্তব্যে বলা হয়, বেসরকারি (উত্তরা ইউনিভার্সিটি) হতে এমপিএড কোর্স করার সুযোগ নেই।

মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি দিই। তবে চাকরিরত অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের কোর্স করার সুযোগ নেই। আমাদের শিক্ষকদের যাদের বিএড নেই, তাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএড করার জন্য প্রেষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্য কোনো কোর্সে ফেলোশিপ পেলেও তাদের প্রেষণের ব্যাপারটি বিবেচনা করা হয়।’

মাউশিতে অদ্ভুত অনুমতি বাণিজ্য

শরীফুল আলম সুমন

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এবং সরকারি স্কুল-কলেজের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য শুরু হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের প্রেষণে (চাকরিরত রেখেই সরকারি এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সংযুক্তি বা পড়ালেখার অনুমতি) ছাড়া নিয়মিত কোর্সে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই। মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা সে নিয়ম মেনে চললেও তা মানছে না প্রশাসন শাখা। নিয়ম ভেঙে প্রেষণ ছাড়াই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কোর্স করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আর এ কাজে অধিদপ্তরের কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কর্মচারীরা চাইলে উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে বিএডসহ অন্যান্য কোর্স করতে পারেন। কারণ সেখানে ছুটির দিনে ক্লাস ও পরীক্ষা হয়। এর বাইরে সাধারণত নিয়মিত কোনো কোর্সে তাদের ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয় না। এরপরও যদি কেউ কোনো ধরনের অনুমতি নিয়ে থাকে, তাহলে আমরা খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, এত দিন কর্মচারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার তেমন কোনো আগ্রহই ছিল না। কিন্তু ২০২১ সালের ২২ আগস্ট নতুন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা প্রকাশিত হয়। সেখানে সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়। এতে ১৩তম পদভুক্ত প্রধান সহকারী, হিসাবরক্ষক কাম প্রধান সহকারী, অডিটর, প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক বা সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং ১৪তম গ্রেডভুক্ত উচ্চমান সহকারী, প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক, প্রধান সহকারী, হিসাবরক্ষক-কাম-ক্লার্ক বা হিসাবরক্ষক, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর বা ব্যক্তিগত সহকারী কাম স্ট্যানোটাইপিস্টরা পদোন্নতি পাবেন। তারা ১০ম গ্রেডভুক্ত সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মোট পদের শতকরা ২০ ভাগ পদে এই পদোন্নতি পাবেন। তবে ওই পদে পদোন্নতির জন্য সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ডিগ্রি থাকতে হবে। এই বিধিমালা জারির কথা জানতে পেরে এর কিছুদিন আগে থেকেই মূলত কর্মচারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের তোড়জোড় শুরু হয়। যারা স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণি, তারা বিএড করছেন। আর যারা স্নাতকে তৃতীয় শ্রেণি, তারা বিএডের পাশাপাশি মাস্টার্স কোর্স করছেন।

মাউশি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মোট সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের ২০ শতাংশ হিসাব করলে ৯৯টি পদে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, ১০ম গ্রেডভুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ আরও ১৭টি পদে কর্মচারীদের একই ধরনের পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের কারোরই সাধারণত বিএড ডিগ্রি নেই। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের প্রেষণ ছাড়া যেহেতু নিয়মিত কোর্সে ভর্তির সুযোগ নেই, তাই এ নিয়ে একটি সিন্ডিকেটের সৃষ্টি হয়েছে। তারা প্রশাসন শাখার মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও নিয়মিত কোর্সে ভর্তির অনুমতি নিয়ে দেয়। এভাবে ইতিমধ্যে প্রায় এক শর ওপরে কর্মচারী উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিয়েছেন। আর এ জন্য প্রত্যেক কর্মচারীকে দুই লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত ওই সিন্ডিকেটকে দিতে হয়েছে। তবে ওই সিন্ডিকেট কর্মচারীদের জানিয়েছে, উচ্চশিক্ষার অনুমতি পাওয়া মানেই পদোন্নতি অনেকটা নিশ্চিত। কারণ পদোন্নতির জন্য যতগুলো পদ আছে, তার কাছাকাছি সংখ্যককে উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে। সিন্ডিকেটের কথামতোই দুই-আড়াই মাস ধরে নিয়মিত কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন শুধু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএড করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে আগে যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিয়েছেন, তাদেরই শুধু পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, উচ্চশিক্ষার অনুমতি বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রশাসন শাখার পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকের চারজন ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ)। এ ছাড়া প্রশাসন শাখার আরও দু-একজন কর্মচারী এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন। তারাই মূলত অর্থের লেনদেন করেছেন।

নাম প্রকাশ না করে সম্প্রতি উচ্চশিক্ষার অনুমতি নিতে আসা একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত দুই-তিন বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে বিএড করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে মূলত ভর্তি হলেই পাস করা যায়। আর এখন যদি আবার অনুমতি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে যারা অনুমতি পেয়েছে, তাদের পদোন্নতিই নিশ্চিত করে দেওয়া হলো। তাই আমাদের দাবি, নিয়মবহির্ভূতভাবে আগে যত অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে।’

২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর জারি করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক নীতিমালার ধারা ৬-এ বলা হয়েছে, প্রচলিত বিধান অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষাছুটি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত মঞ্জুর করা যাবে। এই ছুটি প্রেষণের সঙ্গেও যেকোনো মেয়াদে দেওয়া যাবে। প্রেষণ শেষ হওয়ার পরেও প্রয়োজন হলে প্রেষণের সঙ্গে সংযুক্ত করে শিক্ষাছুটি মঞ্জুর করা যাবে; অর্থাৎ এতে বোঝা যায়, প্রেষণ বা শিক্ষাছুটি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়মিত কোর্সে পড়ালেখার সুযোগ নেই। অথচ দেশ রূপান্তরের হাতে প্রেষণ বা শিক্ষাছুটি ছাড়াই মাউশি অধিদপ্তরের কর্মচারীদের নিয়মিত কোর্সে উচ্চশিক্ষার একাধিক আদেশ রয়েছে। এ বছরের ৬ জুলাই মাউশি অধিদপ্তরের সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. হাইদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর মুহাম্মদ আবুল কালাম ও মোহাম্মদ আব্দুস ছালামকে প্রাইম ইউনিভার্সিটির সামার সেমিস্টার-২০২২-এ বিএড প্রোগ্রামে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। সেখানে তিনটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। তা হলো অধ্যয়নকালে কর্মস্থলে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে কোনোরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারবে না, পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য কোনো প্রকার টিএ/ডিএ পাবেন না এবং শুধু পরীক্ষার দিনগুলোতে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি বা ছুটি নিতে হবে। এই আদেশে স্বাক্ষর করেন অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস।

এ বছরের ২৪ মার্চ একই শর্তে মাউশি অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মোতাহের হোসেন, সাঁটলিপিকার আছমা পারভীন ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পারভীন আকতারকে দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিয়াউল হক আকন্দ ও করণিক-কাম-মুদ্রাক্ষরিক শিকদার আরিফুজ্জামানকে উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে এমএ কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হিসাবরক্ষক মো. হাসিবুল আলম মির্জা, মো. আব্দুর রাজ্জাক ম-ল, মো. মাহবুবুল আলম ও মো. রজব আলী খন্দকারকে পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বগুড়ায় বিএড কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৪ জুলাই হিসাবরক্ষক রঘুনাথ পাল, ১২ জুলাই সঞ্জয় কুমার পালকে পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বগুড়ায় বিএড কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়।

এ ছাড়া ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. জামাল হোসেন, হিসাবরক্ষক ইসমাইল হোসেন, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. মোবারক হোসেন, হিসাবরক্ষক-কাম-ক্লার্ক আবদুল কাইয়ুম, হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ ইয়াজুল হক, হিসাবরক্ষক মো. রেজাউল করিম ও কাজী মো. আরমিনকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে বিএড কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। এভাবে আরও একাধিক কর্মচারীকে নিয়ম ভেঙে নিয়মিত কোর্সে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২-এর ৪৬ নম্বর ধারা মোতাবেক প্রণীত ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) কোর্সটিকে সম্পূর্ণ পূর্ণকালীন কোর্স বলা হয়।

মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেয়। কিন্তু তারা নিয়মিত কোর্সে কোনো শিক্ষককে ভর্তির অনুমতি দেন না। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর এক আদেশে, শেরপুরের শ্রীবরদী সরকারি কলেজের সহকারী শিক্ষক মো. মোরশেদুজ্জামানকে উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে এমপিএড কোর্সে ভর্তির আবেদন বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে জানানো হয়। আদেশের মন্তব্যে বলা হয়, বেসরকারি (উত্তরা ইউনিভার্সিটি) হতে এমপিএড কোর্স করার সুযোগ নেই।

মাউশি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি দিই। তবে চাকরিরত অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের কোর্স করার সুযোগ নেই। আমাদের শিক্ষকদের যাদের বিএড নেই, তাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএড করার জন্য প্রেষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্য কোনো কোর্সে ফেলোশিপ পেলেও তাদের প্রেষণের ব্যাপারটি বিবেচনা করা হয়।’