শিক্ষায় আসবে যেসব পরিবর্তন

নিজামুল হক

শুরু হলো নতুন শিক্ষাবর্ষ। নতুন এই শিক্ষাবর্ষের জন্য আলোচিত বিষয় ‘নতুন শিক্ষাক্রম’। চলমান ‘শিক্ষাক্রম’ থেকে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে এই ‘শিক্ষাক্রমে’। তবে সব শ্রেণির জন্য এই পরিবর্তন একই সঙ্গে নয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে এটি বাস্তবায়ন হবে। একই সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই পাবে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে এসে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মাত্রার জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা বিকাশের ধারাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য যে পরিবর্তন : নতুন শিক্ষাক্রমে উল্লেখযোগ্য অনেক পরিবর্তন রয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন—পরীক্ষা পদ্ধতিতে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো প্রথাগত পরীক্ষা থাকবে না। সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন ধরনের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে শতভাগ শিক্ষার্থী মূল্যায়ন হবে। এরপর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ‘মূল্যায়ন’ থাকলেও শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে ‘শিখন-কালীন মূল্যায়ন’ ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে ‘সামষ্টিক মূল্যায়ন’ এই দুই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হবে।

কবে কোন শ্রেণিতে : সিদ্ধান্ত অনুসারে, ২০২৩ সালে তিনটি শ্রেণিতে বাস্তবায়নের পর ২০২৪ সালে চালু হবে  দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালু হবে।

পরীক্ষা পদ্ধতি : ২০২৩ সাল নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন হবে দুই ভাগে। এক ভাগের মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিখনকালীন নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে। শুধু কাগজ-কলমনির্ভর পরীক্ষা হবে না। এসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে-কলমের কাজ ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।

প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনটি বই থাকবে। তবে কোনো পরীক্ষা হবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে চতুর্থ ও ৫ম শ্রেণিতে ৮ বিষয় আছে। এর মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান) হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। বাকি তিনটি বিষয়ে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্পকলা রয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এগুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে।

৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন ১০টি বিষয় রয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা (প্রত্যকে ধর্ম অনুযায়ী) এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।  এগুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।  আর নবম দশম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় থাকবে। যার ৫০ শতাংশ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন, বাকি ৫০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।

আর একাদশ ও দ্বাদশে গিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ। আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ।  একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির পর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।

 প্রথম পাবলিক পরীক্ষা দশম শ্রেণিতে : বর্তমানে প্রচলিত ৫ম শ্রেণির প্রাথমিক/ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণির জেএসসি ও জেডিসি থাকবে না। প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হবে দশম শ্রেনিতে গিয়ে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পরীক্ষার সমন্বয়ে দ্বিতীয় পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে।

পরীক্ষার ফল যেভাবে : এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মসিউজ্জামান বলেন, ‘পরীক্ষার ফলে প্রচলিত নম্বর বা গ্রেড থাকবে না। তিন শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। বর্তমানে জিপিএ ভিত্তিতে ফল প্রকাশ করা হয়। ‘এ’ প্লাস, এ মাইনাস, বিপ্লাস, বি মাইনাস—এভাবে।  কিন্তু নতুন পদ্ধতির মূল্যায়নে এখনকার মতো নিয়ম থাকছে না। তিন স্তরে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা মূল্যায়নের প্রাথমিক স্তরে থাকবে তাদের এলিমেন্টারি লেভেল (প্রাথমিক স্তর),  পরের স্তর হবে মিডেল লেভেল ( মধ্যম স্তর)। যারা সবচেয়ে ভালো করবে, তাদের এক্সপার্ট লেভেল (পারদর্শী স্তর)-এর সনদ দেওয়া হবে।  বিষয়গুলো নিয়ে আরো কাজ চলছে বলে মসিউজ্জামান জানান।

মাধ্যমিকে থাকছে না বিভাগ : নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিকে থাকছে না বিভাগ। এতদিন শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের মধ্যে পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করত। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা নবম-দশম শ্রেণিতে পড়বে সব বিষয়। এর বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২৩ সাল থেকে। নতুন কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত ও জ্ঞান লাভ করবে। অর্থাত্ সব ধরনের শিক্ষা বা অভিন্ন শিক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর শেষ করতে হবে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি থেকে বিভাগ নির্বাচন শুরু হবে।

বাদ সৃজনশীল : এর আগে ২০০৮ সালে দেশে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেননি। ফলে এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়, বাতিলের দাবি তোলা হয়। শেষ পর্যন্তও সরকার ঐ সৃজনশীল বাতিল করেনি।  তবে নতুন শিক্ষাক্রমে এই পদ্ধতিটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

পুরোপুরি সুফল পেতে লাগবে ১০ বছর : নতুন শিক্ষাক্রমের পুরোপুরি সুফল পেতে ১০ বছর লাগবে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি সম্প্রতি একটি অনষ্ঠান বলেছেন, যদি নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে আগামী পাঁচ বছর পর থেকে একটু পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যাবে। আর ১০ বছর পর বড় পরিবর্তন দেখা যাবে।

কতটা প্রস্তুত শিক্ষকরা : শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াই নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে ১৬ হাজার ৪০০ এবং জেলা পর্যায়ে ১ হাজার ৫৬ জন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তারা আগামী ৬ জানুয়ারি থেকে অন্যান্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।  দেশে ৪ লাখ শিক্ষক রয়েছেন যারা এই শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণ দরকার হবে।

এর আগে ডিসেম্বরে  পৗনে ২ লাখ শিক্ষককে অনলাইনে এক ঘণ্টার ‘ওরিয়েন্টেশন’ দেওয়া শুরু হলেও সার্ভার জটিলতার কারণে এটি শেষ করতে পারেননি সবাই। যদি প্রশিক্ষণের অবস্থা এই হয় তাহলে সেখানে  যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই কতটা সফলতার সঙ্গে পাঠদান সম্ভব হবে—সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

২০০৮ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল, ১৪ বছর পরও শিক্ষকদের একটি বড় অংশ তা বোঝে না। শেষ পর্যন্ত ঐ সৃজনশীল থেকে সরে এসেছে মন্ত্রণালয়।

প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা, যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি, যথাসময়ে শিক্ষকদের অবহিত না করা, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও সময় বিভ্রাটের কারণে অনলাইনে ১ লাখের মতো শিক্ষক ‘নামকাওয়াস্তে’ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন পদ্ধতি ও নতুন পাঠ্যবই অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান সম্পর্কে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে ইতিপূর্বে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। এক পদ্ধতি চালুর কিছুদিন পর অন্য পদ্ধতি আনা হয়েছে।

প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ ) প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য বলেন,  ১৭ হাজারের মতো মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তারা অন্যান্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।

শিক্ষায় আসবে যেসব পরিবর্তন

নিজামুল হক

শুরু হলো নতুন শিক্ষাবর্ষ। নতুন এই শিক্ষাবর্ষের জন্য আলোচিত বিষয় ‘নতুন শিক্ষাক্রম’। চলমান ‘শিক্ষাক্রম’ থেকে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে এই ‘শিক্ষাক্রমে’। তবে সব শ্রেণির জন্য এই পরিবর্তন একই সঙ্গে নয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে এটি বাস্তবায়ন হবে। একই সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই পাবে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে মুখস্থবিদ্যা ভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে এসে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মাত্রার জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা বিকাশের ধারাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য যে পরিবর্তন : নতুন শিক্ষাক্রমে উল্লেখযোগ্য অনেক পরিবর্তন রয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন—পরীক্ষা পদ্ধতিতে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো প্রথাগত পরীক্ষা থাকবে না। সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন ধরনের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে শতভাগ শিক্ষার্থী মূল্যায়ন হবে। এরপর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ‘মূল্যায়ন’ থাকলেও শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে ‘শিখন-কালীন মূল্যায়ন’ ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে ‘সামষ্টিক মূল্যায়ন’ এই দুই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হবে।

কবে কোন শ্রেণিতে : সিদ্ধান্ত অনুসারে, ২০২৩ সালে তিনটি শ্রেণিতে বাস্তবায়নের পর ২০২৪ সালে চালু হবে  দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালু হবে।

পরীক্ষা পদ্ধতি : ২০২৩ সাল নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন হবে দুই ভাগে। এক ভাগের মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিখনকালীন নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে। শুধু কাগজ-কলমনির্ভর পরীক্ষা হবে না। এসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে-কলমের কাজ ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।

প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনটি বই থাকবে। তবে কোনো পরীক্ষা হবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে চতুর্থ ও ৫ম শ্রেণিতে ৮ বিষয় আছে। এর মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান) হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। বাকি তিনটি বিষয়ে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্পকলা রয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এগুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে।

৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন ১০টি বিষয় রয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা (প্রত্যকে ধর্ম অনুযায়ী) এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।  এগুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।  আর নবম দশম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় থাকবে। যার ৫০ শতাংশ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন, বাকি ৫০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।

আর একাদশ ও দ্বাদশে গিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ। আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ।  একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির পর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।

 প্রথম পাবলিক পরীক্ষা দশম শ্রেণিতে : বর্তমানে প্রচলিত ৫ম শ্রেণির প্রাথমিক/ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণির জেএসসি ও জেডিসি থাকবে না। প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হবে দশম শ্রেনিতে গিয়ে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পরীক্ষার সমন্বয়ে দ্বিতীয় পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে।

পরীক্ষার ফল যেভাবে : এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মসিউজ্জামান বলেন, ‘পরীক্ষার ফলে প্রচলিত নম্বর বা গ্রেড থাকবে না। তিন শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। বর্তমানে জিপিএ ভিত্তিতে ফল প্রকাশ করা হয়। ‘এ’ প্লাস, এ মাইনাস, বিপ্লাস, বি মাইনাস—এভাবে।  কিন্তু নতুন পদ্ধতির মূল্যায়নে এখনকার মতো নিয়ম থাকছে না। তিন স্তরে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা মূল্যায়নের প্রাথমিক স্তরে থাকবে তাদের এলিমেন্টারি লেভেল (প্রাথমিক স্তর),  পরের স্তর হবে মিডেল লেভেল ( মধ্যম স্তর)। যারা সবচেয়ে ভালো করবে, তাদের এক্সপার্ট লেভেল (পারদর্শী স্তর)-এর সনদ দেওয়া হবে।  বিষয়গুলো নিয়ে আরো কাজ চলছে বলে মসিউজ্জামান জানান।

মাধ্যমিকে থাকছে না বিভাগ : নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিকে থাকছে না বিভাগ। এতদিন শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের মধ্যে পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করত। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা নবম-দশম শ্রেণিতে পড়বে সব বিষয়। এর বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২৩ সাল থেকে। নতুন কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত ও জ্ঞান লাভ করবে। অর্থাত্ সব ধরনের শিক্ষা বা অভিন্ন শিক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর শেষ করতে হবে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি থেকে বিভাগ নির্বাচন শুরু হবে।

বাদ সৃজনশীল : এর আগে ২০০৮ সালে দেশে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেননি। ফলে এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়, বাতিলের দাবি তোলা হয়। শেষ পর্যন্তও সরকার ঐ সৃজনশীল বাতিল করেনি।  তবে নতুন শিক্ষাক্রমে এই পদ্ধতিটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

পুরোপুরি সুফল পেতে লাগবে ১০ বছর : নতুন শিক্ষাক্রমের পুরোপুরি সুফল পেতে ১০ বছর লাগবে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি সম্প্রতি একটি অনষ্ঠান বলেছেন, যদি নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে আগামী পাঁচ বছর পর থেকে একটু পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যাবে। আর ১০ বছর পর বড় পরিবর্তন দেখা যাবে।

কতটা প্রস্তুত শিক্ষকরা : শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াই নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে ১৬ হাজার ৪০০ এবং জেলা পর্যায়ে ১ হাজার ৫৬ জন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তারা আগামী ৬ জানুয়ারি থেকে অন্যান্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।  দেশে ৪ লাখ শিক্ষক রয়েছেন যারা এই শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণ দরকার হবে।

এর আগে ডিসেম্বরে  পৗনে ২ লাখ শিক্ষককে অনলাইনে এক ঘণ্টার ‘ওরিয়েন্টেশন’ দেওয়া শুরু হলেও সার্ভার জটিলতার কারণে এটি শেষ করতে পারেননি সবাই। যদি প্রশিক্ষণের অবস্থা এই হয় তাহলে সেখানে  যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই কতটা সফলতার সঙ্গে পাঠদান সম্ভব হবে—সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

২০০৮ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল, ১৪ বছর পরও শিক্ষকদের একটি বড় অংশ তা বোঝে না। শেষ পর্যন্ত ঐ সৃজনশীল থেকে সরে এসেছে মন্ত্রণালয়।

প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা, যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি, যথাসময়ে শিক্ষকদের অবহিত না করা, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও সময় বিভ্রাটের কারণে অনলাইনে ১ লাখের মতো শিক্ষক ‘নামকাওয়াস্তে’ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন পদ্ধতি ও নতুন পাঠ্যবই অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান সম্পর্কে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে ইতিপূর্বে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। এক পদ্ধতি চালুর কিছুদিন পর অন্য পদ্ধতি আনা হয়েছে।

প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ ) প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য বলেন,  ১৭ হাজারের মতো মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তারা অন্যান্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।