সহকর্মীকে সহযোদ্ধা ভাবুন

কে এম মাহমুদুল হক
কে এম মাহমুদুল হক।

প্রতিটি মানুষের একধরনের নিজস্বতা রয়েছে, একধরনের স্বকীয়তা রয়েছে। সেই স্বকীয়তার পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনকে রাঙিয়ে তোলাটাই সফলতা। সফল শব্দের প্রথম স যুক্ত ব দিয়ে আলোচনা করি, তাহলে এই নিজস্বতা বা স্বকীয়তার বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট হবে। অর্থাৎ স্ব ফল। স্বীয় কর্মফল। যে কর্ম সুন্দর ফল উপহার দেয়। আমার-আপনার কর্মটি ফলযুক্ত, ফলবান হবে। মানুষের উপকারে আসবে। কতগুলো কালো কালো হরফ স্মৃতিতে ধারণ করে অথবা পরীক্ষার খাতায় উগলে দিয়ে নজরুল সফল হননি, শুধু রাজনীতি করলেই সবাই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠে না, আঙুলের ইশারায় অর্ধপৃথিবী শাসন করলেই সবাই ওমর হয়ে ওঠে না, কেউ কেউ স্বৈরাচারীও হয়ে ওঠে। এমনটাও ভাবার কোনো কারণ নেই যে যুদ্ধে পরাজিত হলেই কেউ ব্যর্থ হয়ে যায়, ইতিহাস থেকে নাম মুছে যায়।

মানবসেবাই ব্রত হওয়া উচিত 
একজনের তেমন কোনো নেটওয়ার্কই নেই, কিন্তু সে ঘরে বসে অনেক গবেষণার পরে মানবকল্যাণে কাজে লাগে এমন একটি আবিষ্কার করল, সে ক্ষেত্রে সে বেশি সফল নাকি অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় যার আছে কিন্তু সে মানুষের কল্যাণে কোনো কাজ করে না, সে বেশি সফল? আবার এমন একজন মানুষ, যার অনেক অনেক ‘পাবলিকেশন’ করেছেন, যিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে এসেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর নিজের শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন, এমনকি আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি বেশি সফল, নাকি একজন পলান সরকার সফল? আমি তাই বলি, মানুষের জীবনে ভালো থাকা আর ভালো রাখাটা মুখ্য। নিজে ভালো থাকতে গিয়ে অন্যের ভালো থাকাকে নষ্ট করা যাবে না। বরং অন্যের ভালো থাকাটাকে গুরুত্ব দিয়ে সেই লক্ষ্যে কাজ করার আনন্দ যিনি বেশি উপভোগ করবেন, তিনিই বেশি সফল। আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ হতে চাই, কারণ আমি দেশের সেবা করতে চাই—ব্যাপারটা এমন না হয়ে বরং আমি কিছু হতে পারি  আর না পারি, মানুষের সেবা আমি করবই—এটিই আমাদের ব্রত হওয়া উচিত।

নিজেকে জানান দিন
ব্যক্তিজীবনে কারও জীবনকে অনুসরণ করে নয়, কারও মতো হতে হবে তা নয়; নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করার মধ্য দিয়েই আপনি আপনি হয়ে উঠুন। নিজেকে জানান দিন। যেমনটি বলা হয়—পৃথিবীতে যেহেতু এসেই পড়েছিস, দাগ কেটে যা। আপনার জীবনকে রাঙিয়ে তুলুন আর আপনার কর্মের মধ্য দিয়ে অন্যের জীবনে সুন্দর বয়ে আনুন। যেমনটি করে ফুল-পাখি-মৌমাছিরা।

কৌশল নির্ধারণ করুন
যেহেতু আমাদের সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত, সেহেতু যদি কেউ আমায় প্রশ্ন করে যে শিক্ষাজীবনে আমি কীভাবে সফল হতে পারি, তাহলে আমি বলব, নিবিষ্ট মনে কাজ করুন, পূর্ণ বিকশিত হওয়া পর্যন্ত কাজটি চালিয়ে যান এবং সর্বশেষ আপনার শিক্ষাকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য লোকে কী বলল সেদিকে খেয়াল না করে যা যা করণীয়, আপনি তাই তা-ই করুন। ছাত্রাবস্থায় মজা করুন, কিন্তু সেই মজা আপনার এবং অন্যের জীবনে সাজা হিসেবে যেন ফিরে না আসে। মোটিভেশন শুনে শুনে রাত কাটিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সস্তা বেসনের ফুলে-ফেঁপে ওঠা প্রলেপ থাকে, ভেতরে কিছু থাকে না। তাই শিখতে এসে মোটিভেশন না খুঁজে প্রতিটি অবস্থা থেকেই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করুন এবং সেটিকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিনের কৌশল নির্ধারণ করুন। দিন শেষে কাজটা আপনাকেই করতে হবে। স্বীয় তাড়না না থাকলে বাইরের প্রবর্তনা খুব বেশি দূরে নিয়ে যাবে না।

সহকর্মীকে সহযোদ্ধা ভাবুন
যদি কেউ কর্মজীবনের কথা বলেন, তাহলে আমি বলব যে সহকর্মীকে সহযোদ্ধা ভাবুন। সহকর্মী আপনার শত্রু নন। আপনি তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না। বরং আপনি সহযোগিতায় এগিয়ে যাবেন ৷ আমি প্রায়সই বিভিন্ন যুদ্ধের ছবি দেখে মুগ্ধ হই। বুলেটের আঘাতে সহযোদ্ধা মারা গেছেন। তবু কত সম্মানের সঙ্গে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর স্মৃতি চিরকাল বয়ে বেড়ানোর জন্য একটা জিনিস সঙ্গে নিয়ে রাখা হয়। পরিবারের কাছে তাঁর শেষ চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। অথচ আমরা আমাদের কর্মপরিবেশে দেখি একজন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই তাঁর নামে কুৎসা রটনা করে অন্যের কোলে হাসিতে ঢলে পড়তে। কর্মক্ষেত্রে আমি বলব, ‘অ্যাক্ট’ করুন, তবু ‘রিঅ্যাক্ট’ করবেন না।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল , ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন:  মো. আশিকুর রহমান

সহকর্মীকে সহযোদ্ধা ভাবুন

কে এম মাহমুদুল হক
কে এম মাহমুদুল হক।

প্রতিটি মানুষের একধরনের নিজস্বতা রয়েছে, একধরনের স্বকীয়তা রয়েছে। সেই স্বকীয়তার পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনকে রাঙিয়ে তোলাটাই সফলতা। সফল শব্দের প্রথম স যুক্ত ব দিয়ে আলোচনা করি, তাহলে এই নিজস্বতা বা স্বকীয়তার বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট হবে। অর্থাৎ স্ব ফল। স্বীয় কর্মফল। যে কর্ম সুন্দর ফল উপহার দেয়। আমার-আপনার কর্মটি ফলযুক্ত, ফলবান হবে। মানুষের উপকারে আসবে। কতগুলো কালো কালো হরফ স্মৃতিতে ধারণ করে অথবা পরীক্ষার খাতায় উগলে দিয়ে নজরুল সফল হননি, শুধু রাজনীতি করলেই সবাই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠে না, আঙুলের ইশারায় অর্ধপৃথিবী শাসন করলেই সবাই ওমর হয়ে ওঠে না, কেউ কেউ স্বৈরাচারীও হয়ে ওঠে। এমনটাও ভাবার কোনো কারণ নেই যে যুদ্ধে পরাজিত হলেই কেউ ব্যর্থ হয়ে যায়, ইতিহাস থেকে নাম মুছে যায়।

মানবসেবাই ব্রত হওয়া উচিত 
একজনের তেমন কোনো নেটওয়ার্কই নেই, কিন্তু সে ঘরে বসে অনেক গবেষণার পরে মানবকল্যাণে কাজে লাগে এমন একটি আবিষ্কার করল, সে ক্ষেত্রে সে বেশি সফল নাকি অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় যার আছে কিন্তু সে মানুষের কল্যাণে কোনো কাজ করে না, সে বেশি সফল? আবার এমন একজন মানুষ, যার অনেক অনেক ‘পাবলিকেশন’ করেছেন, যিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে এসেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর নিজের শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন, এমনকি আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি বেশি সফল, নাকি একজন পলান সরকার সফল? আমি তাই বলি, মানুষের জীবনে ভালো থাকা আর ভালো রাখাটা মুখ্য। নিজে ভালো থাকতে গিয়ে অন্যের ভালো থাকাকে নষ্ট করা যাবে না। বরং অন্যের ভালো থাকাটাকে গুরুত্ব দিয়ে সেই লক্ষ্যে কাজ করার আনন্দ যিনি বেশি উপভোগ করবেন, তিনিই বেশি সফল। আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ হতে চাই, কারণ আমি দেশের সেবা করতে চাই—ব্যাপারটা এমন না হয়ে বরং আমি কিছু হতে পারি  আর না পারি, মানুষের সেবা আমি করবই—এটিই আমাদের ব্রত হওয়া উচিত।

নিজেকে জানান দিন
ব্যক্তিজীবনে কারও জীবনকে অনুসরণ করে নয়, কারও মতো হতে হবে তা নয়; নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করার মধ্য দিয়েই আপনি আপনি হয়ে উঠুন। নিজেকে জানান দিন। যেমনটি বলা হয়—পৃথিবীতে যেহেতু এসেই পড়েছিস, দাগ কেটে যা। আপনার জীবনকে রাঙিয়ে তুলুন আর আপনার কর্মের মধ্য দিয়ে অন্যের জীবনে সুন্দর বয়ে আনুন। যেমনটি করে ফুল-পাখি-মৌমাছিরা।

কৌশল নির্ধারণ করুন
যেহেতু আমাদের সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত, সেহেতু যদি কেউ আমায় প্রশ্ন করে যে শিক্ষাজীবনে আমি কীভাবে সফল হতে পারি, তাহলে আমি বলব, নিবিষ্ট মনে কাজ করুন, পূর্ণ বিকশিত হওয়া পর্যন্ত কাজটি চালিয়ে যান এবং সর্বশেষ আপনার শিক্ষাকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য লোকে কী বলল সেদিকে খেয়াল না করে যা যা করণীয়, আপনি তাই তা-ই করুন। ছাত্রাবস্থায় মজা করুন, কিন্তু সেই মজা আপনার এবং অন্যের জীবনে সাজা হিসেবে যেন ফিরে না আসে। মোটিভেশন শুনে শুনে রাত কাটিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সস্তা বেসনের ফুলে-ফেঁপে ওঠা প্রলেপ থাকে, ভেতরে কিছু থাকে না। তাই শিখতে এসে মোটিভেশন না খুঁজে প্রতিটি অবস্থা থেকেই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করুন এবং সেটিকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিনের কৌশল নির্ধারণ করুন। দিন শেষে কাজটা আপনাকেই করতে হবে। স্বীয় তাড়না না থাকলে বাইরের প্রবর্তনা খুব বেশি দূরে নিয়ে যাবে না।

সহকর্মীকে সহযোদ্ধা ভাবুন
যদি কেউ কর্মজীবনের কথা বলেন, তাহলে আমি বলব যে সহকর্মীকে সহযোদ্ধা ভাবুন। সহকর্মী আপনার শত্রু নন। আপনি তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না। বরং আপনি সহযোগিতায় এগিয়ে যাবেন ৷ আমি প্রায়সই বিভিন্ন যুদ্ধের ছবি দেখে মুগ্ধ হই। বুলেটের আঘাতে সহযোদ্ধা মারা গেছেন। তবু কত সম্মানের সঙ্গে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর স্মৃতি চিরকাল বয়ে বেড়ানোর জন্য একটা জিনিস সঙ্গে নিয়ে রাখা হয়। পরিবারের কাছে তাঁর শেষ চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। অথচ আমরা আমাদের কর্মপরিবেশে দেখি একজন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই তাঁর নামে কুৎসা রটনা করে অন্যের কোলে হাসিতে ঢলে পড়তে। কর্মক্ষেত্রে আমি বলব, ‘অ্যাক্ট’ করুন, তবু ‘রিঅ্যাক্ট’ করবেন না।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল , ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন:  মো. আশিকুর রহমান