উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত উপযোগিতা

ড. কবিরুল বাশার

বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিগত জীবন, সুবিধা-অসুবিধা এবং ক্যারিয়ারের বিষয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করে। একবার আমার এক প্রিয় ছাত্র অফিসে এসে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে। আমি ধৈর্য ধরে তার কথা শুনলাম।জানতে পারলাম তার তিন বছর ধরে চলা গভীর সম্পর্কটি আজ ভেঙে গেছে। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ছেলের প্রেমে পড়েছে তার প্রিয়তমা। আমার ছাত্রের প্রেমিকাকেও আমি চিনি। কারণ তাদের দুজনের সঙ্গে আমার একাধিকবার দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে। বিষয়টি ছাত্রটির জন্য মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। ছাত্রটি মেয়েটিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে মেয়েটির খুব বেশি দোষ নেই। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা মেয়েটিকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে বলে আমি তাকে বোঝালাম। ছাত্রটি সব সময় সৃষ্টিশীল কাজ করতে পছন্দ করত এবং সে বর্তমানে সৃষ্টিশীল কাজে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ।

ফজরের নামাজের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে লাইন ধরে অসংখ্য ব্যাগ রাখার দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টার আগে দেখা যায় লাইব্রেরিতে ঢোকার জন্য বিশাল লাইন। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলতে থাকে অবিরাম পড়াশোনা। প্রাতর্ভ্রমণে বের হওয়া মানুষজন বিষয়টি নিয়ে দারুণ প্রশংসা করে। কিন্তু লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকলে দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই বিসিএস অথবা চাকরির গাইড পড়ছে। শুধু যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন হচ্ছে তা নয়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চালচিত্র একই রকম। এমনকি এদিক দিয়ে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই।

এই প্রবণতার পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাডেমিক পড়াশোনা চাকরি পেতে তেমন কাজে আসছে না। তাহলে কি একাডেমিক লেখাপড়ার পদ্ধতি ভুল, নাকি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা পদ্ধতি ভুল? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত দেখা যায়, সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীরা মেডিক্যালে বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেডিক্যাল বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য সরকারের খরচ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক বেশি, আর এই অর্থ আসে বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের ঘাম ও শ্রমের বিনিময়ে। তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করবে—এমনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের পেশার মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না বিধায় তারা এখন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার অসম প্রতিযোগিতায় নামছে। এর জন্য শিক্ষার সঙ্গে কর্মের মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতাই দায়ী।

গত সপ্তাহজুড়ে ফেসবুক এবং গণমাধ্যমে একটি খবর নানাভাবে উঠে এসেছে যে বিশ্বের প্রথম সারির ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়! এটি নিয়ে নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের গবেষণায় অবহেলার কথাও অনেকে বলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান নির্ভর করে তার ল্যাবরেটরি ক্যাপাসিটি এবং গবেষকদের গবেষণাকর্মের ওপর।

পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে যদি আমরা নজর দিই, তাহলে দেখা যাবে হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের ল্যাবরেটরিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা ছাত্রদের স্কলারশিপের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। আমরা যারা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছি তাঁরা মাসে মোটা অঙ্কের টাকা স্কলারশিপ পেয়েছি। ভালো ফসল পেতে গেলে ভালো মাটিতে উন্নত জাতের বীজ বপন করতে হয়। সেই কাজটি আমরা করতে পেরেছি কি না সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা সুউচ্চ ভবন বা অট্টালিকা নির্মাণের বিষয়ে বেশি আগ্রহী। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধির চেয়ে একাডেমি এবং গবেষণা মানোন্নয়ন বেশি প্রয়োজন। পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাদের আবাসিক সুবিধা তেমন না থাকলেও একাডেমিক সুবিধা বিশ্বমানের। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা এবং গবেষণা সরঞ্জামের স্বল্পতা, অন্যদিকে চাকরির বৈষম্য বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা একাডেমিক শিক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিসিএসের গত্বাঁধা মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার ওপর। বিসিএস ঝড় শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা দেশ ও জাতির জন্য অশনিসংকেত। রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করছে, বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনমুখী শিক্ষার পেছনে না ছুটে চাকরিমুখী পড়াশোনায় মনোনিবিষ্ট।

বর্তমান প্রজন্মের সরকারি চাকরির প্রতি এত ঝোঁকের কারণ বিশ্লেষণ করলে এর  সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি প্রকটভাবে উঠে আসে। সামাজিকভাবে চতুর্থ বা তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিও এখন অনেক বড় বিষয়, আর প্রথম শ্রেণি বা বিসিএস ক্যাডার হলে তো সোনায় সোহাগা।

কেউ বেসরকারি বা কম্পানিতে চাকরি করে এমন পরিচয় দিলে সামাজিকভাবে সেটিকে সাধারণভাবে নেওয়া হয়। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। বেসরকারি চাকরি আকর্ষণীয়, নিরাপদ এবং আধুনিক শ্রম আইন অনুযায়ী হওয়া উচিত। সরকারি চাকরির ওপর চাপ কমাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিরাপত্তার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক এবং সময়োপযোগী করে ঢেলে সাজানো অত্যন্ত জরুরি। প্রাথমিক লেভেল থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা সনদনির্ভর না হয়ে জ্ঞান বা কর্মনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা শেষে কর্মে প্রবেশের পন্থাকেও সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। দেশে উচ্চশিক্ষার এত প্রতিষ্ঠান, এত শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে নজর দিতে হবে।

এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় পছন্দক্রম দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হওয়ার পরও একটা সময় ওই বিষয়ে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। জ্ঞানার্জনের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ অর্জন করাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। নিজেদের বিষয়ের গভীরে ঢুকে পাণ্ডিত্য অর্জনে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা মূলত বিসিএস পরীক্ষার জন্য নিজেদের তৈরিতে ব্যস্ত। তাদেরই বা দোষ কি, তারা জানে বিসিএস পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বিশেষ কোনো কাজে লাগে না, কাজে লাগে মুখস্থবিদ্যা। কাজে লাগে সাধারণ জ্ঞান। যদিও এই সাধারণ জ্ঞানকে আমি অসাধারণ জ্ঞান বলি।

এ প্রসঙ্গে আমার একজন ছাত্রের কথা না বললেই নয়। সে স্নাতক পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। স্নাতক পর্যায়ের গবেষণায়ও সে ভালো কাজ করেছে। আমি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, সে একদিন বড় বিজ্ঞানী হবে। স্নাতকোত্তরে উঠে সে বিভাগের পড়াশোনা এবং গবেষণায় অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের একটি বিষয়ে পড়াশোনা করা, গবেষণা করা একজন শিক্ষার্থী যখন বিসিএস গাইড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তখন পৃথিবী অসীম সম্ভাবনাময় একজন বিজ্ঞানীকে হারায়।

সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও দর্শনের মতো উচ্চমানের বিষয়ে পড়ে, বুঝে পাণ্ডিত্য অর্জন না করে যদি শুধু সরকারি চাকুরে হতে চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিষয়গুলো পড়ানোর দরকার কি? ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি, ফুড টেকনোলজির মতো স্পেশালিস্ট বিষয়গুলো পড়ে যদি প্রশাসক, পুলিশ হতে চায়, তাহলে সেই বিষয়গুলো আমাদের কি প্রয়োজন?

একজন শিক্ষার্থী সব কিছু বাদ দিয়ে বিসিএস বা সরকারি চাকরির সোনার হরিণ ধরার পেছনে ছোটে। যারা ছুটছে তাদের মধ্যে কত শতাংশ সেই হরিণটি ধরতে পারে? হাজারে একজনেরও কম। এমন একটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত যাত্রায় ছুটে চলেছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। যতটুকু মেধা, শ্রম ও সময় বিসিএস বা সরকারি চাকরির পেছনে দিচ্ছে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তার অর্ধেক সময় নিজের বিষয়ের জ্ঞান ও গবেষণায় দিলে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি করার সুযোগ পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মোটা অঙ্কের স্কলারশিপও পাবে। বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেকে বিশ্ববাজারের জন্য যোগ্য করে তুলতে পারলে পৃথিবীর সমৃদ্ধ এবং উন্নত দেশে তার অবস্থান তৈরি হবে।

অনেকে হয়তো বলবে, আমি ব্রেইন ড্রেইনকে উৎসাহিত করছি। আদতে বিষয়টি তা নয়। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা একটু উদারভাবে চিন্তা করতে পারি। বাংলাদেশের একজন নাগরিক যে দেশে গিয়েই তার ভালো অবস্থান তৈরি করুক না কেন, সে বাংলাদেশের পতাকা বহন করবে এবং দেশে অর্থ পাঠাবে। এমন অনেক উদাহরণ এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।

মূল লক্ষ্য যদি থাকে বিসিএস বা সরকারি চাকরি, তাহলে কোনো একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে পড়ে সময়, মেধা এবং অর্থ নষ্ট করার প্রয়োজন কি? বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়গুলো থাকতে পারে শুধুই তাদের জন্য, যারা এসব বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চায় এবং কর্মজীবনে এই পেশাগুলোতে যেতে চায়।

এই বিষয়টির ওপর সুদেব কুমার বিশ্বাসের প্রস্তাবকে সমর্থন বলতে চাই, উচ্চশিক্ষা নয়, বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। ঢেলে সাজানো হোক বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর মতো বিসিএসে নিয়োগ এইচএসসি পাস করার পরই করা হোক।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য এইচএসসি পাস করার পর একটি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেবে পিএসসি। এই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে তারা কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করবে। তাদের কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর মেয়াদি ডিগ্রির নাম হবে ব্যাচেলর অব সিভিল সার্ভিস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস তৈরিতে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে বিসিএসের বিভিন্ন চাকরির কর্মমুখী শিক্ষার বিষয়গুলো।

চার বছর মেয়াদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছর পড়ানো হবে জেনারেল বিষয়াবলি। দুই বছর পর একটি পরীক্ষা নিয়ে ক্যাডার ভাগ করা হবে। পরবর্তী দুই বছর যে যার ক্যাডার অনুযায়ী ওই বিষয়গুলোয় পড়াশোনা করবে এবং তার নিজ নিজ ক্যাডারে কাজের জন্য পাণ্ডিত্য অর্জন করবে। চার বছর পর চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে যারা পাস করবে তাদের সরাসরি নিজ নিজ ক্যাডারে পোস্টিং দেওয়া হবে। প্রতিটি অফিসার যোগ্য হয়ে  চাকরি শুরু করবে। চাকরিতে যোগদানের পর নিজের ক্যাডারে আরো পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য বিদেশে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

তবে যারা বিশেষ কোনো বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করে দার্শনিক, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা বিশেষায়িত পেশায় আসতে চায় তাদের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। এ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ কর্মের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করবে। বিসিএস পরীক্ষার পর সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে ক্যাডারদের আর নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে না।

এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করা হলে একটি অসুবিধা হবে। তখন হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব বেশি ছাত্র ভর্তি হবে না। এতে সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সরকারের অর্থ খরচ করতে হবে না। আর যারা পছন্দ অনুযায়ী এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তারা পড়াশোনা ও গবেষণা করে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ওই ধরনের পেশায় যোগদান করবে। কেউ কেউ স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি করে গবেষণার মাধ্যমে দার্শনিক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে গবেষণায় মনোযোগী হয়ে আন্তর্জাতিক নামকরা জার্নালে তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করবেন।

আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের এই উদ্ভট চিন্তা বিজ্ঞ নীতিনির্ধারকরা হাসির খোরাক হিসেবে না নিয়ে বিবেচনায় নিলে প্রতিবছর সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে এবং শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষায় আগ্রহী হবে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক

উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত উপযোগিতা

ড. কবিরুল বাশার

বরাবরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিগত জীবন, সুবিধা-অসুবিধা এবং ক্যারিয়ারের বিষয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করে। একবার আমার এক প্রিয় ছাত্র অফিসে এসে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে। আমি ধৈর্য ধরে তার কথা শুনলাম।জানতে পারলাম তার তিন বছর ধরে চলা গভীর সম্পর্কটি আজ ভেঙে গেছে। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ছেলের প্রেমে পড়েছে তার প্রিয়তমা। আমার ছাত্রের প্রেমিকাকেও আমি চিনি। কারণ তাদের দুজনের সঙ্গে আমার একাধিকবার দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে। বিষয়টি ছাত্রটির জন্য মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। ছাত্রটি মেয়েটিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে মেয়েটির খুব বেশি দোষ নেই। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা মেয়েটিকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে বলে আমি তাকে বোঝালাম। ছাত্রটি সব সময় সৃষ্টিশীল কাজ করতে পছন্দ করত এবং সে বর্তমানে সৃষ্টিশীল কাজে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ।

ফজরের নামাজের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে লাইন ধরে অসংখ্য ব্যাগ রাখার দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টার আগে দেখা যায় লাইব্রেরিতে ঢোকার জন্য বিশাল লাইন। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলতে থাকে অবিরাম পড়াশোনা। প্রাতর্ভ্রমণে বের হওয়া মানুষজন বিষয়টি নিয়ে দারুণ প্রশংসা করে। কিন্তু লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকলে দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই বিসিএস অথবা চাকরির গাইড পড়ছে। শুধু যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন হচ্ছে তা নয়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চালচিত্র একই রকম। এমনকি এদিক দিয়ে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই।

এই প্রবণতার পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাডেমিক পড়াশোনা চাকরি পেতে তেমন কাজে আসছে না। তাহলে কি একাডেমিক লেখাপড়ার পদ্ধতি ভুল, নাকি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা পদ্ধতি ভুল? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত দেখা যায়, সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীরা মেডিক্যালে বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেডিক্যাল বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য সরকারের খরচ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক বেশি, আর এই অর্থ আসে বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের ঘাম ও শ্রমের বিনিময়ে। তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করবে—এমনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের পেশার মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না বিধায় তারা এখন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার অসম প্রতিযোগিতায় নামছে। এর জন্য শিক্ষার সঙ্গে কর্মের মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতাই দায়ী।

গত সপ্তাহজুড়ে ফেসবুক এবং গণমাধ্যমে একটি খবর নানাভাবে উঠে এসেছে যে বিশ্বের প্রথম সারির ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়! এটি নিয়ে নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের গবেষণায় অবহেলার কথাও অনেকে বলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান নির্ভর করে তার ল্যাবরেটরি ক্যাপাসিটি এবং গবেষকদের গবেষণাকর্মের ওপর।

পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে যদি আমরা নজর দিই, তাহলে দেখা যাবে হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের ল্যাবরেটরিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা ছাত্রদের স্কলারশিপের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। আমরা যারা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছি তাঁরা মাসে মোটা অঙ্কের টাকা স্কলারশিপ পেয়েছি। ভালো ফসল পেতে গেলে ভালো মাটিতে উন্নত জাতের বীজ বপন করতে হয়। সেই কাজটি আমরা করতে পেরেছি কি না সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা সুউচ্চ ভবন বা অট্টালিকা নির্মাণের বিষয়ে বেশি আগ্রহী। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধির চেয়ে একাডেমি এবং গবেষণা মানোন্নয়ন বেশি প্রয়োজন। পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাদের আবাসিক সুবিধা তেমন না থাকলেও একাডেমিক সুবিধা বিশ্বমানের। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা এবং গবেষণা সরঞ্জামের স্বল্পতা, অন্যদিকে চাকরির বৈষম্য বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা একাডেমিক শিক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিসিএসের গত্বাঁধা মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার ওপর। বিসিএস ঝড় শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা দেশ ও জাতির জন্য অশনিসংকেত। রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করছে, বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনমুখী শিক্ষার পেছনে না ছুটে চাকরিমুখী পড়াশোনায় মনোনিবিষ্ট।

বর্তমান প্রজন্মের সরকারি চাকরির প্রতি এত ঝোঁকের কারণ বিশ্লেষণ করলে এর  সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি প্রকটভাবে উঠে আসে। সামাজিকভাবে চতুর্থ বা তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিও এখন অনেক বড় বিষয়, আর প্রথম শ্রেণি বা বিসিএস ক্যাডার হলে তো সোনায় সোহাগা।

কেউ বেসরকারি বা কম্পানিতে চাকরি করে এমন পরিচয় দিলে সামাজিকভাবে সেটিকে সাধারণভাবে নেওয়া হয়। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। বেসরকারি চাকরি আকর্ষণীয়, নিরাপদ এবং আধুনিক শ্রম আইন অনুযায়ী হওয়া উচিত। সরকারি চাকরির ওপর চাপ কমাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিরাপত্তার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক এবং সময়োপযোগী করে ঢেলে সাজানো অত্যন্ত জরুরি। প্রাথমিক লেভেল থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা সনদনির্ভর না হয়ে জ্ঞান বা কর্মনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা শেষে কর্মে প্রবেশের পন্থাকেও সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। দেশে উচ্চশিক্ষার এত প্রতিষ্ঠান, এত শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে নজর দিতে হবে।

এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় পছন্দক্রম দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হওয়ার পরও একটা সময় ওই বিষয়ে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। জ্ঞানার্জনের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ অর্জন করাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। নিজেদের বিষয়ের গভীরে ঢুকে পাণ্ডিত্য অর্জনে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা মূলত বিসিএস পরীক্ষার জন্য নিজেদের তৈরিতে ব্যস্ত। তাদেরই বা দোষ কি, তারা জানে বিসিএস পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বিশেষ কোনো কাজে লাগে না, কাজে লাগে মুখস্থবিদ্যা। কাজে লাগে সাধারণ জ্ঞান। যদিও এই সাধারণ জ্ঞানকে আমি অসাধারণ জ্ঞান বলি।

এ প্রসঙ্গে আমার একজন ছাত্রের কথা না বললেই নয়। সে স্নাতক পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। স্নাতক পর্যায়ের গবেষণায়ও সে ভালো কাজ করেছে। আমি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, সে একদিন বড় বিজ্ঞানী হবে। স্নাতকোত্তরে উঠে সে বিভাগের পড়াশোনা এবং গবেষণায় অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের একটি বিষয়ে পড়াশোনা করা, গবেষণা করা একজন শিক্ষার্থী যখন বিসিএস গাইড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তখন পৃথিবী অসীম সম্ভাবনাময় একজন বিজ্ঞানীকে হারায়।

সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও দর্শনের মতো উচ্চমানের বিষয়ে পড়ে, বুঝে পাণ্ডিত্য অর্জন না করে যদি শুধু সরকারি চাকুরে হতে চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিষয়গুলো পড়ানোর দরকার কি? ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি, ফুড টেকনোলজির মতো স্পেশালিস্ট বিষয়গুলো পড়ে যদি প্রশাসক, পুলিশ হতে চায়, তাহলে সেই বিষয়গুলো আমাদের কি প্রয়োজন?

একজন শিক্ষার্থী সব কিছু বাদ দিয়ে বিসিএস বা সরকারি চাকরির সোনার হরিণ ধরার পেছনে ছোটে। যারা ছুটছে তাদের মধ্যে কত শতাংশ সেই হরিণটি ধরতে পারে? হাজারে একজনেরও কম। এমন একটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত যাত্রায় ছুটে চলেছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। যতটুকু মেধা, শ্রম ও সময় বিসিএস বা সরকারি চাকরির পেছনে দিচ্ছে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তার অর্ধেক সময় নিজের বিষয়ের জ্ঞান ও গবেষণায় দিলে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি করার সুযোগ পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মোটা অঙ্কের স্কলারশিপও পাবে। বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেকে বিশ্ববাজারের জন্য যোগ্য করে তুলতে পারলে পৃথিবীর সমৃদ্ধ এবং উন্নত দেশে তার অবস্থান তৈরি হবে।

অনেকে হয়তো বলবে, আমি ব্রেইন ড্রেইনকে উৎসাহিত করছি। আদতে বিষয়টি তা নয়। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা একটু উদারভাবে চিন্তা করতে পারি। বাংলাদেশের একজন নাগরিক যে দেশে গিয়েই তার ভালো অবস্থান তৈরি করুক না কেন, সে বাংলাদেশের পতাকা বহন করবে এবং দেশে অর্থ পাঠাবে। এমন অনেক উদাহরণ এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।

মূল লক্ষ্য যদি থাকে বিসিএস বা সরকারি চাকরি, তাহলে কোনো একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে পড়ে সময়, মেধা এবং অর্থ নষ্ট করার প্রয়োজন কি? বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়গুলো থাকতে পারে শুধুই তাদের জন্য, যারা এসব বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চায় এবং কর্মজীবনে এই পেশাগুলোতে যেতে চায়।

এই বিষয়টির ওপর সুদেব কুমার বিশ্বাসের প্রস্তাবকে সমর্থন বলতে চাই, উচ্চশিক্ষা নয়, বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। ঢেলে সাজানো হোক বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর মতো বিসিএসে নিয়োগ এইচএসসি পাস করার পরই করা হোক।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য এইচএসসি পাস করার পর একটি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেবে পিএসসি। এই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে তারা কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করবে। তাদের কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর মেয়াদি ডিগ্রির নাম হবে ব্যাচেলর অব সিভিল সার্ভিস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস তৈরিতে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে বিসিএসের বিভিন্ন চাকরির কর্মমুখী শিক্ষার বিষয়গুলো।

চার বছর মেয়াদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছর পড়ানো হবে জেনারেল বিষয়াবলি। দুই বছর পর একটি পরীক্ষা নিয়ে ক্যাডার ভাগ করা হবে। পরবর্তী দুই বছর যে যার ক্যাডার অনুযায়ী ওই বিষয়গুলোয় পড়াশোনা করবে এবং তার নিজ নিজ ক্যাডারে কাজের জন্য পাণ্ডিত্য অর্জন করবে। চার বছর পর চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে যারা পাস করবে তাদের সরাসরি নিজ নিজ ক্যাডারে পোস্টিং দেওয়া হবে। প্রতিটি অফিসার যোগ্য হয়ে  চাকরি শুরু করবে। চাকরিতে যোগদানের পর নিজের ক্যাডারে আরো পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য বিদেশে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

তবে যারা বিশেষ কোনো বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করে দার্শনিক, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা বিশেষায়িত পেশায় আসতে চায় তাদের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। এ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ কর্মের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করবে। বিসিএস পরীক্ষার পর সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে ক্যাডারদের আর নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে না।

এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করা হলে একটি অসুবিধা হবে। তখন হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব বেশি ছাত্র ভর্তি হবে না। এতে সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সরকারের অর্থ খরচ করতে হবে না। আর যারা পছন্দ অনুযায়ী এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তারা পড়াশোনা ও গবেষণা করে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ওই ধরনের পেশায় যোগদান করবে। কেউ কেউ স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি করে গবেষণার মাধ্যমে দার্শনিক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে গবেষণায় মনোযোগী হয়ে আন্তর্জাতিক নামকরা জার্নালে তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করবেন।

আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের এই উদ্ভট চিন্তা বিজ্ঞ নীতিনির্ধারকরা হাসির খোরাক হিসেবে না নিয়ে বিবেচনায় নিলে প্রতিবছর সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে এবং শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষায় আগ্রহী হবে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক