উপাচার্য একাই একশ

মিজান শাজাহান

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ছাড় দেন না। উপাচার্যের পাশাপাশি তিনি একাই দখল করে রেখেছেন আরও আটটি পদ। আইন, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ব্যবসায় প্রশাসন ও চারুকলা অনুষদের ডিন, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজের পরিচালক এবং কেন্দ্রীয় জার্নাল কমিটির সম্পাদক উপাচার্য নিজেই।

উপাচার্য সৌমিত্র শেখর সমকালকে বলেছেন, ‘আমার আগে উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি যেসব দায়িত্বে ছিলেন, আমি যোগদানের পর আপনাআপনি সেসব দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে। আমি আগ্রহভরে দায়িত্বগুলো নিইনি। এসব দায়িত্ব আমি ছাড়তে পারলেই বাঁচি।’ আগ্রহভরে নেননি, এ কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ১০ মাস পরও আটটি গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে না পারাটা তাঁর ব্যর্থতা। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ও সদিচ্ছার ঘাটতি ছিল অন্তত সেখানকার শিক্ষকদের কথা শুনলে এটিই মনে হয়। শিক্ষকদের অভিযোগ, নিয়োগ কমিটির ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার জন্যই তিনি এটি করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম সমকালকে বলেছেন, ‘এসব অনুষদে অধ্যাপক থাকতেও তিনি কেন দায়িত্ব পালন করছেন, তা জানি না।’ প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেছেন, সৌমিত্র যা করেছেন, তা অনিয়ম ও আইনবহির্ভূত। ‘জানি না’ বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এতদিন জানত না, এখন যেহেতু জানল, অবিলম্বে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। দখলদারকে দিনের পর দিন প্রশ্রয় দেওয়া হলে তা হবে তদারক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার পরিচয়। কতিপয় ব্যক্তির অনিয়ম ও আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের দায় সরকার, মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিতে পারে না।

উপাচার্য সৌমিত্র শেখর নিজেকে অলরাউন্ডার মনে করতে পারেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর সব দায়িত্ব একাই সামলাতে চান; নিজেকে তিনি একাই একশ মনে করতে পারেন। বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় আইন দ্বারা। তিনি গায়ের জোর খাটিয়ে সব পদ দখল করতে পারেন না। খাই খাই স্বভাবের অনেক রাজনীতিকের কথা আমরা শুনি। ব্যক্তিগত স্বার্থে একই সঙ্গে একাধিক পদ দখল করে রেখেছেন তাঁরা। প্রশাসনেও এমন হীনমানসিকতার অনেক আমলার কথা আমরা জানি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তুলনা করে উপাচার্যের মতো একটি সম্মানজনক পদের সমালোচনা করতে চাই না। অভিযোগ উঠেছে, সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এসব পদ দখল করে রেখেছেন উপাচার্য। এ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের লড়াইয়ে একজন শিক্ষাবিদ যেভাবে সমালোচিত হচ্ছেন, তা কাম্য ছিল না।

নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঢাকায় বসে ৪০০ কিলোমিটার দূরের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাসহ নানা অভিযোগে দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিতর্কিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সম্মান নিয়ে দায়িত্ব থেকে বিদায় নিতে পারেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে আইকন। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তির কারণে পদটি বারবার বিতর্কিত হচ্ছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরই গবেষণার পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেক উপাচার্য। দায়িত্ব দেওয়ার আগে এসব শিক্ষকের যোগ্যতার মাপকাঠি কীভাবে নির্ধারণ করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

পূর্বসূরিদের অপকর্ম ও পরিণতি জেনেও অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর একাই এতগুলো পদ দখল করে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এ দায়িত্বহীনতার দায় শুধু উপাচার্যের একার নয়; বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সিনেট ও সিন্ডিকেটের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা দরকার।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল

উপাচার্য একাই একশ

মিজান শাজাহান

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ছাড় দেন না। উপাচার্যের পাশাপাশি তিনি একাই দখল করে রেখেছেন আরও আটটি পদ। আইন, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ব্যবসায় প্রশাসন ও চারুকলা অনুষদের ডিন, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজের পরিচালক এবং কেন্দ্রীয় জার্নাল কমিটির সম্পাদক উপাচার্য নিজেই।

উপাচার্য সৌমিত্র শেখর সমকালকে বলেছেন, ‘আমার আগে উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি যেসব দায়িত্বে ছিলেন, আমি যোগদানের পর আপনাআপনি সেসব দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে। আমি আগ্রহভরে দায়িত্বগুলো নিইনি। এসব দায়িত্ব আমি ছাড়তে পারলেই বাঁচি।’ আগ্রহভরে নেননি, এ কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ১০ মাস পরও আটটি গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে না পারাটা তাঁর ব্যর্থতা। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ও সদিচ্ছার ঘাটতি ছিল অন্তত সেখানকার শিক্ষকদের কথা শুনলে এটিই মনে হয়। শিক্ষকদের অভিযোগ, নিয়োগ কমিটির ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার জন্যই তিনি এটি করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম সমকালকে বলেছেন, ‘এসব অনুষদে অধ্যাপক থাকতেও তিনি কেন দায়িত্ব পালন করছেন, তা জানি না।’ প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেছেন, সৌমিত্র যা করেছেন, তা অনিয়ম ও আইনবহির্ভূত। ‘জানি না’ বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এতদিন জানত না, এখন যেহেতু জানল, অবিলম্বে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। দখলদারকে দিনের পর দিন প্রশ্রয় দেওয়া হলে তা হবে তদারক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার পরিচয়। কতিপয় ব্যক্তির অনিয়ম ও আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের দায় সরকার, মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিতে পারে না।

উপাচার্য সৌমিত্র শেখর নিজেকে অলরাউন্ডার মনে করতে পারেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর সব দায়িত্ব একাই সামলাতে চান; নিজেকে তিনি একাই একশ মনে করতে পারেন। বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় আইন দ্বারা। তিনি গায়ের জোর খাটিয়ে সব পদ দখল করতে পারেন না। খাই খাই স্বভাবের অনেক রাজনীতিকের কথা আমরা শুনি। ব্যক্তিগত স্বার্থে একই সঙ্গে একাধিক পদ দখল করে রেখেছেন তাঁরা। প্রশাসনেও এমন হীনমানসিকতার অনেক আমলার কথা আমরা জানি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তুলনা করে উপাচার্যের মতো একটি সম্মানজনক পদের সমালোচনা করতে চাই না। অভিযোগ উঠেছে, সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এসব পদ দখল করে রেখেছেন উপাচার্য। এ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের লড়াইয়ে একজন শিক্ষাবিদ যেভাবে সমালোচিত হচ্ছেন, তা কাম্য ছিল না।

নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঢাকায় বসে ৪০০ কিলোমিটার দূরের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাসহ নানা অভিযোগে দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিতর্কিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সম্মান নিয়ে দায়িত্ব থেকে বিদায় নিতে পারেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে আইকন। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তির কারণে পদটি বারবার বিতর্কিত হচ্ছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরই গবেষণার পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেক উপাচার্য। দায়িত্ব দেওয়ার আগে এসব শিক্ষকের যোগ্যতার মাপকাঠি কীভাবে নির্ধারণ করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

পূর্বসূরিদের অপকর্ম ও পরিণতি জেনেও অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর একাই এতগুলো পদ দখল করে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এ দায়িত্বহীনতার দায় শুধু উপাচার্যের একার নয়; বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সিনেট ও সিন্ডিকেটের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা দরকার।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল