শিক্ষালয়: আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

তাপস মজুমদার

স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার কথা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। তবু বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল—তাঁদেরই যাঁরা উত্তরসূরি সেই অসংখ্য নির্মলচিত্ত ছাত্রীরা দেশ গড়ার কাজে দুষ্টলোকের অপবাদ-আশঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে দৃঢ়চিত্তে আত্মনিয়োগ করুন।

ফেসবুকের একটি ভিডিও হঠাৎ চোখে পড়ল সেদিন। সেখানে দেখানো হচ্ছে, একজন পিতা তাঁর বিবাহযোগ্য ছেলেকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেছেন এক বাড়িতে। সঙ্গে তাঁর এক মেয়েও আছেন। কথাবার্তা বলে পাত্রী পছন্দ হয়ে যায় এবং বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়। বাজার করতে পাত্রের পিতা এবং তাঁর কন্যা বাইরে গেলে যখন পাত্র ও পাত্রীর মধ্যে কথা হয়, তখন পাত্র জানতে পারেন যে পাত্রী ইডেন কলেজের ছাত্রী। জানার সঙ্গে সঙ্গে পাত্র তীর বেগে বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে যান এবং বহুদূর গিয়ে ক্লান্ত হয়ে থামেন।

ইডেন কলেজের ঘটনা নিয়ে এ রকম বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একাধিক ভিডিও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রয়েছে। সেখানে ইডেন কলেজকে, ইডেন কলেজের ছাত্রীদের কটাক্ষ ও অসম্মান করা হয়েছে। ভিডিও দেখে হতবাক হলাম, আমাদের রুচি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে!

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদকীয়র শেষ বাক্যে ইডেন কলেজ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, মুক্তি কোথায়? অসাধারণ কথা ও সুরের একটি রবীন্দ্রসংগীত আছে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে…’।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো জ্ঞানসৃজন ও জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। কিন্তু সেটা এখন অনেক ক্ষেত্রেই মারপিটের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। ইডেন কলেজে দুই পক্ষের ছাত্রীদের মধ্যে মারপিট এবং নোংরা কথার চালাচালির মতো ঘটনা ঘটেছে। দুই পক্ষই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এসব ঘটনার পেছনের কারণ টাকা ও ক্ষমতার দাপট। সেখানে সিট-বাণিজ্য একটা সাধারণ ঘটনা। বোঝা যায়, এই মারপিটের ঘটনা যে মুহূর্তে ঘটল, তার উৎপত্তি কিন্তু তখনই নয়। এটা দীর্ঘ বঞ্চনা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। একটি পত্রিকায় দেখলাম, ইডেন কলেজে প্রায় ৪০ হাজার ছাত্রী পড়াশোনা করেন। সেখানে হোস্টেল বা ছাত্রীনিবাসে উঠতে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা নেত্রীদের দিতে হয়। এ ছাড়া ছাত্রী নির্যাতন, হল দখল, চাঁদাবাজি—এসব অহরহ ঘটছে। বলা বাহুল্য, এর কোনোটিই পড়াশোনাকেন্দ্রিক ঘটনা নয়; বরং অবৈধ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম। আর এ জন্য সাধারণ ছাত্রীরাই দুর্ভোগে পড়েন সবচেয়ে বেশি। ওই ভিডিওতে যা বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে ইডেন কলেজের প্রত্যেক ছাত্রী অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

সামাজিকভাবে হেনস্তাও হচ্ছেন কেউ কেউ। ইতিমধ্যে সাধারণ ছাত্রীরা কলেজের সামনে মুখ ঢেকে মানববন্ধন করেছেন। কথা হলো, এই সব ঘটনার জন্য তো অল্প কিছু ছাত্রী দায়ী। নেত্রীদের কাদা-ছোড়াছুড়ি কেন সাধারণ ছাত্রীদের সামাজিকভাবে বিব্রত ও হেয় করবে! হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রীর জন্য তো হাজার হাজার মেয়ের দুর্নাম হতে পারে না। অথচ যাঁরা এমন অশ্লীল কথা ছড়াচ্ছেন, তাঁরা মূলত পদ-পদবি বা অর্থের লোভেই করছেন এবং নিজেদের অবস্থানকে পাকা করতে বা ধরে রাখতে চাইছেন।

প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় একটা ঘটনা যে দিনে দিনে জমেছে, কলেজ প্রশাসন সে ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে! আমরা ধারণা করতে চাই, কলেজ প্রশাসন অক্ষম নয়। তাহলে কেন সময়মতো এসব বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি! হোস্টেলের সিট দেওয়ার ব্যাপারে তো একটা নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালার বাইরে যখন সব ক্ষমতা নেত্রীরা হাতে তুলে নেন, তখন সেটা তারা (প্রশাসন) মেনে নেয় কী করে!

ছাত্রীদের ব্যাপারেও এ রকম প্রশ্ন খুবই সংগত যে কেন তাঁরা ছাত্রজীবনেই পদ, ক্ষমতা ও টাকার প্রতি এতটা লালায়িত হয়ে পড়েন? কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে যখন তাঁর সংগঠন সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয়, তখন তাঁরা সাধারণ ছাত্রীদের কল্যাণ চিন্তা নিয়ে দাঁড়াতে পারেন না কেন? মেরুদণ্ড শক্ত করে চলতে পারেন না কেন? দায়িত্বশীলতা তবে কাকে বলে? দেশ তাহলে মুক্ত হবে কাদের দ্বারা?

কীভাবে? পরবর্তী সময়ের জন্য অথবা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী পরিবেশ তাঁরা রেখে যাচ্ছেন?

এই সুবাদে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনার উল্লেখ খুবই প্রাসঙ্গিক হবে। বান্দরবানের আলীকদমের ইউএনও পুরস্কার বিতরণের সভায় পুরস্কারের ট্রফি রাগ করে আছড়ে ভেঙে ফেলেছেন। বিবদমান দুই পক্ষের রাগারাগিতে তিনি তাঁর ধৈর্য ধরে রাখতে পারেননি। বলা যেতেই পারে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা, সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা বা এ রকম আরও ছাত্রী একসময় হয়তো পদস্থ কর্মকর্তা হবেন। অথবা এভাবেও বলা যায়, রিভা-রাজিয়ারা হবেন এমপি আর ইউএনও মেহেরুবা ইসলাম হবেন ডিসি অথবা বিভাগীয় কমিশনার। অতএব, শুরু থেকেই তাঁরা যদি গণতান্ত্রিক আচরণ না করেন, ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না শেখেন, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কারা গড়বে! সত্যিই তো—মুক্তি কোথায়!

এ দেশে নারীর অবস্থান এখনো অনেক নাজুক। পথে-ঘাটে, কর্মস্থলে, পরিবারে তাঁদের প্রতি দরদি মানসিকতার এখনো যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সম-অধিকার তো দূরে থাকুক, ন্যূনতম অধিকারটুকু পাওয়ার জন্যও অনেক সময় লড়াই করতে হয় অথবা অপ্রিয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। মনে রাখতে হবে, দেশে নারী জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ।

নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রত্যেকে দায়িত্বশীল আচরণ না করলে দেশ অন্ধকারে পতিত হবে। প্রতিটি পেশার মানুষকে সহনশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা, তাঁরা সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাই এটা প্রধানত তাদেরই কাজ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য কবিতা, গান, নাটক, রক্তদান, বিতর্ক, বিজ্ঞান ক্লাব—ইত্যাদি নানা রকম এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমের চর্চা হওয়া দরকার। নির্মল আনন্দ প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করা দরকার।

কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতার দাপট অথবা অর্থলোভী মানুষ তৈরির চর্চা বা সুযোগ থাকা নয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার কথা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। তবু বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল—তাঁদেরই যাঁরা উত্তরসূরি, সেই অসংখ্য নির্মলচিত্ত ছাত্রীরা দেশ গড়ার কাজে দুষ্টলোকের অপবাদ-আশঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে দৃঢ়চিত্তে আত্মনিয়োগ করুন। একই সঙ্গে স্বার্থান্বেষী দুষ্টচক্র কোনোভাবেই যেন নারীদের অসম্মানিত করতে না পারে, সেদিকে সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেওয়া আশু কর্তব্য। শুধু ইডেন কলেজ নয়; সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই সে এক আলোকিত দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং ওপরের গানটির সঞ্চারীর অংশের মতো এই আদর্শ বাক্য সবার হৃদয়ে স্থান পাক: ‘আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে…’।

কেননা, আমাদের তো আলোর পথে যেতে হবে। মুক্তি তো সেখানেই।

লেখক: তাপস মজুমদার,সংস্কৃতিকর্মী ও সাবেক ব্যাংকার

শিক্ষালয়: আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

তাপস মজুমদার

স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার কথা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। তবু বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল—তাঁদেরই যাঁরা উত্তরসূরি সেই অসংখ্য নির্মলচিত্ত ছাত্রীরা দেশ গড়ার কাজে দুষ্টলোকের অপবাদ-আশঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে দৃঢ়চিত্তে আত্মনিয়োগ করুন।

ফেসবুকের একটি ভিডিও হঠাৎ চোখে পড়ল সেদিন। সেখানে দেখানো হচ্ছে, একজন পিতা তাঁর বিবাহযোগ্য ছেলেকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেছেন এক বাড়িতে। সঙ্গে তাঁর এক মেয়েও আছেন। কথাবার্তা বলে পাত্রী পছন্দ হয়ে যায় এবং বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়। বাজার করতে পাত্রের পিতা এবং তাঁর কন্যা বাইরে গেলে যখন পাত্র ও পাত্রীর মধ্যে কথা হয়, তখন পাত্র জানতে পারেন যে পাত্রী ইডেন কলেজের ছাত্রী। জানার সঙ্গে সঙ্গে পাত্র তীর বেগে বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে যান এবং বহুদূর গিয়ে ক্লান্ত হয়ে থামেন।

ইডেন কলেজের ঘটনা নিয়ে এ রকম বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একাধিক ভিডিও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রয়েছে। সেখানে ইডেন কলেজকে, ইডেন কলেজের ছাত্রীদের কটাক্ষ ও অসম্মান করা হয়েছে। ভিডিও দেখে হতবাক হলাম, আমাদের রুচি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে!

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদকীয়র শেষ বাক্যে ইডেন কলেজ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, মুক্তি কোথায়? অসাধারণ কথা ও সুরের একটি রবীন্দ্রসংগীত আছে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে…’।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো জ্ঞানসৃজন ও জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। কিন্তু সেটা এখন অনেক ক্ষেত্রেই মারপিটের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। ইডেন কলেজে দুই পক্ষের ছাত্রীদের মধ্যে মারপিট এবং নোংরা কথার চালাচালির মতো ঘটনা ঘটেছে। দুই পক্ষই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এসব ঘটনার পেছনের কারণ টাকা ও ক্ষমতার দাপট। সেখানে সিট-বাণিজ্য একটা সাধারণ ঘটনা। বোঝা যায়, এই মারপিটের ঘটনা যে মুহূর্তে ঘটল, তার উৎপত্তি কিন্তু তখনই নয়। এটা দীর্ঘ বঞ্চনা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। একটি পত্রিকায় দেখলাম, ইডেন কলেজে প্রায় ৪০ হাজার ছাত্রী পড়াশোনা করেন। সেখানে হোস্টেল বা ছাত্রীনিবাসে উঠতে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা নেত্রীদের দিতে হয়। এ ছাড়া ছাত্রী নির্যাতন, হল দখল, চাঁদাবাজি—এসব অহরহ ঘটছে। বলা বাহুল্য, এর কোনোটিই পড়াশোনাকেন্দ্রিক ঘটনা নয়; বরং অবৈধ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম। আর এ জন্য সাধারণ ছাত্রীরাই দুর্ভোগে পড়েন সবচেয়ে বেশি। ওই ভিডিওতে যা বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে ইডেন কলেজের প্রত্যেক ছাত্রী অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

সামাজিকভাবে হেনস্তাও হচ্ছেন কেউ কেউ। ইতিমধ্যে সাধারণ ছাত্রীরা কলেজের সামনে মুখ ঢেকে মানববন্ধন করেছেন। কথা হলো, এই সব ঘটনার জন্য তো অল্প কিছু ছাত্রী দায়ী। নেত্রীদের কাদা-ছোড়াছুড়ি কেন সাধারণ ছাত্রীদের সামাজিকভাবে বিব্রত ও হেয় করবে! হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রীর জন্য তো হাজার হাজার মেয়ের দুর্নাম হতে পারে না। অথচ যাঁরা এমন অশ্লীল কথা ছড়াচ্ছেন, তাঁরা মূলত পদ-পদবি বা অর্থের লোভেই করছেন এবং নিজেদের অবস্থানকে পাকা করতে বা ধরে রাখতে চাইছেন।

প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় একটা ঘটনা যে দিনে দিনে জমেছে, কলেজ প্রশাসন সে ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে! আমরা ধারণা করতে চাই, কলেজ প্রশাসন অক্ষম নয়। তাহলে কেন সময়মতো এসব বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি! হোস্টেলের সিট দেওয়ার ব্যাপারে তো একটা নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালার বাইরে যখন সব ক্ষমতা নেত্রীরা হাতে তুলে নেন, তখন সেটা তারা (প্রশাসন) মেনে নেয় কী করে!

ছাত্রীদের ব্যাপারেও এ রকম প্রশ্ন খুবই সংগত যে কেন তাঁরা ছাত্রজীবনেই পদ, ক্ষমতা ও টাকার প্রতি এতটা লালায়িত হয়ে পড়েন? কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে যখন তাঁর সংগঠন সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয়, তখন তাঁরা সাধারণ ছাত্রীদের কল্যাণ চিন্তা নিয়ে দাঁড়াতে পারেন না কেন? মেরুদণ্ড শক্ত করে চলতে পারেন না কেন? দায়িত্বশীলতা তবে কাকে বলে? দেশ তাহলে মুক্ত হবে কাদের দ্বারা?

কীভাবে? পরবর্তী সময়ের জন্য অথবা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী পরিবেশ তাঁরা রেখে যাচ্ছেন?

এই সুবাদে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনার উল্লেখ খুবই প্রাসঙ্গিক হবে। বান্দরবানের আলীকদমের ইউএনও পুরস্কার বিতরণের সভায় পুরস্কারের ট্রফি রাগ করে আছড়ে ভেঙে ফেলেছেন। বিবদমান দুই পক্ষের রাগারাগিতে তিনি তাঁর ধৈর্য ধরে রাখতে পারেননি। বলা যেতেই পারে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা, সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা বা এ রকম আরও ছাত্রী একসময় হয়তো পদস্থ কর্মকর্তা হবেন। অথবা এভাবেও বলা যায়, রিভা-রাজিয়ারা হবেন এমপি আর ইউএনও মেহেরুবা ইসলাম হবেন ডিসি অথবা বিভাগীয় কমিশনার। অতএব, শুরু থেকেই তাঁরা যদি গণতান্ত্রিক আচরণ না করেন, ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না শেখেন, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কারা গড়বে! সত্যিই তো—মুক্তি কোথায়!

এ দেশে নারীর অবস্থান এখনো অনেক নাজুক। পথে-ঘাটে, কর্মস্থলে, পরিবারে তাঁদের প্রতি দরদি মানসিকতার এখনো যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সম-অধিকার তো দূরে থাকুক, ন্যূনতম অধিকারটুকু পাওয়ার জন্যও অনেক সময় লড়াই করতে হয় অথবা অপ্রিয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। মনে রাখতে হবে, দেশে নারী জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ।

নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রত্যেকে দায়িত্বশীল আচরণ না করলে দেশ অন্ধকারে পতিত হবে। প্রতিটি পেশার মানুষকে সহনশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা, তাঁরা সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাই এটা প্রধানত তাদেরই কাজ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য কবিতা, গান, নাটক, রক্তদান, বিতর্ক, বিজ্ঞান ক্লাব—ইত্যাদি নানা রকম এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমের চর্চা হওয়া দরকার। নির্মল আনন্দ প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করা দরকার।

কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতার দাপট অথবা অর্থলোভী মানুষ তৈরির চর্চা বা সুযোগ থাকা নয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার কথা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। তবু বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল—তাঁদেরই যাঁরা উত্তরসূরি, সেই অসংখ্য নির্মলচিত্ত ছাত্রীরা দেশ গড়ার কাজে দুষ্টলোকের অপবাদ-আশঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে দৃঢ়চিত্তে আত্মনিয়োগ করুন। একই সঙ্গে স্বার্থান্বেষী দুষ্টচক্র কোনোভাবেই যেন নারীদের অসম্মানিত করতে না পারে, সেদিকে সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেওয়া আশু কর্তব্য। শুধু ইডেন কলেজ নয়; সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই সে এক আলোকিত দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং ওপরের গানটির সঞ্চারীর অংশের মতো এই আদর্শ বাক্য সবার হৃদয়ে স্থান পাক: ‘আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে…’।

কেননা, আমাদের তো আলোর পথে যেতে হবে। মুক্তি তো সেখানেই।

লেখক: তাপস মজুমদার,সংস্কৃতিকর্মী ও সাবেক ব্যাংকার