অদক্ষ শিক্ষিত প্রজন্মের ভবিষ্যৎ

মো. রেজোয়ান হোসেন

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। যে কোনো বিষয় মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। ফলে এখনকার যুবসমাজের মধ্যে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকরি না পেয়ে দেশের সিস্টেমকে দোষারোপ করে কিছুদিন আগে এক যুবক ফেসবুক লাইভে এসে তাঁর সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেছে। এর আগেও চাকরি না পেয়ে সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেছে। অথচ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তারা দক্ষ কর্মী পাচ্ছে না। দক্ষ কর্মীর অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। দেশে শিক্ষিত জনশক্তি পর্যাপ্ত থাকলেও দক্ষ জনশক্তির অভাব দিন দিন বাড়ছে। সবাই শুধু প্রথাগত পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করতে চাইছে। এর বাইরে নিজেকে কাজের মাধ্যমে দক্ষ করার প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে তরুণ-তরুণীরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে; দেশ ও জাতির কাজে খুব একটা লাগছে না।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী অনেক আশা নিয়ে লেখাপড়া করে, যেন পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ না দেওয়ার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করার পর তাদের দীর্ঘদিন বেকার থাকতে হচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬৬ শতাংশ শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকার। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক বিভাগ রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে চাকরির বাজারের কোনো মিল নেই। ফলে এসব বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষিত বেকার হিসেবে ঘুরে বেড়ায় দিনের পর দিন। চাকরি না পেয়ে হতাশায় দিন কাটায়। আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর দুই-তৃতীয়াংশ বেকার থাকছে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও ভিন্ন নয়। দেশের বাজারে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা একদিকে যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করছে। এতে শুধু ব্যক্তির লোকসান হচ্ছে না; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্রও।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করা চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থেকে যাচ্ছে এবং চাহিদামতো চাকরি পাচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যায় এগিয়ে বাংলাদেশ। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৩৩ শতাংশ; বাংলাদেশে এই হার ৪৭ শতাংশ। পাকিস্তানে শিক্ষিত বেকারের হার ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৮ শতাংশ। আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় চাকরি করে ৩০ হাজার টাকা বেতন পাওয়াকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলে। অথচ ব্যবসা করে ৫০ হাজার টাকা মাসে আয় করলেও সমাজের মানুষ বলবে, লেখাপড়া করে কিছু করতে না পেরে এখন এসব করে বেড়াচ্ছে! এই প্রবণতার ফলে দেশে নতুন করে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না।

আমাদের দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে চাইলে এখনই সময় দেশের উচ্চশিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে নতুন করে ভাবার। ভালো চাকরির উদ্দেশ্যেই যখন লেখাপড়া করা, তখন চাকরির বাজারে যে শিক্ষার চাহিদা নেই, সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কী লাভ! একজন স্নাতক ডিগ্রিধারীর পেছনে শুধু তাঁর পরিবারই ব্যয় করে, এমনটি নয়। সেখানে রাষ্ট্রেরও ব্যয় থাকে। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারের ব্যয় ২ লাখ ১২ হাজার এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ১ লাখ ৪ হাজার ৯৬ টাকা। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। সেখানে শিক্ষার্থীপ্রতি ৭ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৭ টাকা ব্যয় করা হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য এই ব্যয়ের পরও যদি দেশের বাইরে থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করতে হয়, সে ক্ষেত্রে এই ব্যয়কে অপচয় বলতে হবে। কেননা, এই ব্যয় দেশের উন্নয়নে কোনো অবদান রাখবে না।

মো. রেজোয়ান হোসেন: সাবেক শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

অদক্ষ শিক্ষিত প্রজন্মের ভবিষ্যৎ

মো. রেজোয়ান হোসেন

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। যে কোনো বিষয় মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। ফলে এখনকার যুবসমাজের মধ্যে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকরি না পেয়ে দেশের সিস্টেমকে দোষারোপ করে কিছুদিন আগে এক যুবক ফেসবুক লাইভে এসে তাঁর সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেছে। এর আগেও চাকরি না পেয়ে সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেছে। অথচ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তারা দক্ষ কর্মী পাচ্ছে না। দক্ষ কর্মীর অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। দেশে শিক্ষিত জনশক্তি পর্যাপ্ত থাকলেও দক্ষ জনশক্তির অভাব দিন দিন বাড়ছে। সবাই শুধু প্রথাগত পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করতে চাইছে। এর বাইরে নিজেকে কাজের মাধ্যমে দক্ষ করার প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে তরুণ-তরুণীরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে; দেশ ও জাতির কাজে খুব একটা লাগছে না।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী অনেক আশা নিয়ে লেখাপড়া করে, যেন পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ না দেওয়ার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করার পর তাদের দীর্ঘদিন বেকার থাকতে হচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬৬ শতাংশ শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকার। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক বিভাগ রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে চাকরির বাজারের কোনো মিল নেই। ফলে এসব বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষিত বেকার হিসেবে ঘুরে বেড়ায় দিনের পর দিন। চাকরি না পেয়ে হতাশায় দিন কাটায়। আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর দুই-তৃতীয়াংশ বেকার থাকছে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও ভিন্ন নয়। দেশের বাজারে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা একদিকে যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করছে। এতে শুধু ব্যক্তির লোকসান হচ্ছে না; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্রও।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করা চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থেকে যাচ্ছে এবং চাহিদামতো চাকরি পাচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যায় এগিয়ে বাংলাদেশ। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৩৩ শতাংশ; বাংলাদেশে এই হার ৪৭ শতাংশ। পাকিস্তানে শিক্ষিত বেকারের হার ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৮ শতাংশ। আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় চাকরি করে ৩০ হাজার টাকা বেতন পাওয়াকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলে। অথচ ব্যবসা করে ৫০ হাজার টাকা মাসে আয় করলেও সমাজের মানুষ বলবে, লেখাপড়া করে কিছু করতে না পেরে এখন এসব করে বেড়াচ্ছে! এই প্রবণতার ফলে দেশে নতুন করে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না।

আমাদের দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে চাইলে এখনই সময় দেশের উচ্চশিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে নতুন করে ভাবার। ভালো চাকরির উদ্দেশ্যেই যখন লেখাপড়া করা, তখন চাকরির বাজারে যে শিক্ষার চাহিদা নেই, সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কী লাভ! একজন স্নাতক ডিগ্রিধারীর পেছনে শুধু তাঁর পরিবারই ব্যয় করে, এমনটি নয়। সেখানে রাষ্ট্রেরও ব্যয় থাকে। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারের ব্যয় ২ লাখ ১২ হাজার এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপ্রতি ১ লাখ ৪ হাজার ৯৬ টাকা। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। সেখানে শিক্ষার্থীপ্রতি ৭ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৭ টাকা ব্যয় করা হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য এই ব্যয়ের পরও যদি দেশের বাইরে থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করতে হয়, সে ক্ষেত্রে এই ব্যয়কে অপচয় বলতে হবে। কেননা, এই ব্যয় দেশের উন্নয়নে কোনো অবদান রাখবে না।

মো. রেজোয়ান হোসেন: সাবেক শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ