অনাকাঙ্ক্ষিত ছাত্ররাজনীতি

মাসুদ উর রহমান

এই লেখা যখন লিখছি, তখন ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়ায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। কারণ একটাই—দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া দিলে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। একই দিনের, অর্থাৎ ৩ অক্টোবর আজকের পত্রিকার প্রথম পাতায় আরেকটি শিরোনাম, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ছাত্রলীগের নেতা’। নিয়মিত অফিস তো করেনই না; বরং এই সুবাদে জহুরুল হক হলের ২৬৪ নম্বর কক্ষে তিনি একাই থাকেন।

সাম্প্রতিক ইডেন-কাণ্ডে তো আমরা হতবাক হয়েছি। ইডেনের ছয়টি ছাত্রীনিবাসের ৯০টি কক্ষ ছাত্রলীগ নেত্রীদের দখলে। এসব কক্ষের ছাত্রীদের কাছ থেকে উঠে আসে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা! ভাবা যায়? কারা, কেন ছাত্ররাজনীতি করছে—এ প্রশ্নটি কি সামনে আসে না? নতুন কমিটিতে নেত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাওয়ায় ৯০ কক্ষের দখলের ভাগ নিয়েই তাঁদের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত।

খবর থেকে এটি স্পষ্ট যে কক্ষের ভাগাভাগির জেরেই ইডেন-কাণ্ডের সূত্রপাত। নেত্রীদের চুলোচুলি ও একে অপরের প্রতি কুরুচিপূর্ণ বিষোদ্‌গারের প্রকৃত কারণ বা পেছনের গল্প মোটামুটি এখন সবারই জানা। এগুলোর সব হয়তো সত্যি নয়, তবে পুরোপুরি অসত্যও নয়। নেত্রীদের এমন আয়েশি বেপরোয়া বিলাসী জীবন সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইডেনের মেয়েরা ভয়ানক, তাঁদের বিয়ে করা যাবে না, তাঁরা কুরুচিপূর্ণ কাজে লিপ্ত ইত্যাদি ইত্যাদিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সয়লাব।

কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে এসব মেয়ের বাবা-মায়ের। শুনতে হচ্ছে প্রতিবেশীদের অনেক কটু কথা। অথচ এটি একটি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকার আশপাশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাঁরা ভর্তি হতে ব্যর্থ হন, তাঁরা প্রথম প্রায়োরিটি হিসেবে ইডেন কলেজকে বেছে নেন। সুপরিসর ক্যাম্পাস, শিক্ষার মান এবং আবাসন-সুবিধার কারণে অভিভাবকেরাও থাকেন নিশ্চিন্ত।

এই যে কলঙ্কের তিলক আজ ইডেনে পড়েছে, আত্মীয়-আপনজনের তির্যক মন্তব্যে মাথা নুইয়েছে ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর ৮০ হাজার বাবা-মা। এর দায় কে নেবে? বর্তমান বাস্তবতায় দলীয় ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি কি খুব জরুরি কিছু? জাতীয় রাজনীতিতে এই তথাকথিত নেতা-নেত্রীদের অবদান কি খুব একটা চোখে পড়ে? আর যদি জরুরি হয়েই থাকে, তবে এই বাজে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজা আরও বেশি জরুরি।

দেশের অনেক শিক্ষাবিদ এবং বিশিষ্টজনের মতে, ১৯৯০ সালের পর থেকে দলীয় ছাত্ররাজনীতি দেশের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনেনি। ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং সোনালি অতীত নিয়ে যতই জপ করি না কেন, এটি এখন বিষফোড়া! আবরার হত্যার মতো আরও অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে তা এখন রীতিমতো অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

এই মুহূর্তে দেশের সব সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বহাল আছে, কিন্তু কার্যকর ছাত্র সংসদ কি একটিও আছে? ছাত্র সংসদ নির্বাচনই তো হয় না। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য যে প্ল্যাটফর্ম দরকার, সেটিকে অনুপস্থিত রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি চালু রাখা কি তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন, বিলাসী জীবনযাপন এবং আসন-বাণিজ্যের জন্য?

ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আমিও অনুভব করি, তবে সেটি এই রূপে থাকা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে আদর্শিক মানদণ্ড বজায় রেখে ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম—এমন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা গেলেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে ছাত্ররাজনীতি। সেটি সম্ভব না হলে বুয়েটের মতো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি অন্তত কয়েক বছরের জন্য হলেও যেন বন্ধ রাখা হয়।

ইডেনে অল্পসংখ্যক তথাকথিত ছাত্রী নামধারী নেত্রীর জন্য সিংহভাগ শিক্ষার্থীর মাথা হেঁট হতে পারে না, বদনাম হতে পারে না নারীশিক্ষা প্রসারের বাতিঘর হিসেবে বিবেচিত ইডেনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির।

লেখক: কলেজশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

অনাকাঙ্ক্ষিত ছাত্ররাজনীতি

মাসুদ উর রহমান

এই লেখা যখন লিখছি, তখন ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়ায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। কারণ একটাই—দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া দিলে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। একই দিনের, অর্থাৎ ৩ অক্টোবর আজকের পত্রিকার প্রথম পাতায় আরেকটি শিরোনাম, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ছাত্রলীগের নেতা’। নিয়মিত অফিস তো করেনই না; বরং এই সুবাদে জহুরুল হক হলের ২৬৪ নম্বর কক্ষে তিনি একাই থাকেন।

সাম্প্রতিক ইডেন-কাণ্ডে তো আমরা হতবাক হয়েছি। ইডেনের ছয়টি ছাত্রীনিবাসের ৯০টি কক্ষ ছাত্রলীগ নেত্রীদের দখলে। এসব কক্ষের ছাত্রীদের কাছ থেকে উঠে আসে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা! ভাবা যায়? কারা, কেন ছাত্ররাজনীতি করছে—এ প্রশ্নটি কি সামনে আসে না? নতুন কমিটিতে নেত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাওয়ায় ৯০ কক্ষের দখলের ভাগ নিয়েই তাঁদের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত।

খবর থেকে এটি স্পষ্ট যে কক্ষের ভাগাভাগির জেরেই ইডেন-কাণ্ডের সূত্রপাত। নেত্রীদের চুলোচুলি ও একে অপরের প্রতি কুরুচিপূর্ণ বিষোদ্‌গারের প্রকৃত কারণ বা পেছনের গল্প মোটামুটি এখন সবারই জানা। এগুলোর সব হয়তো সত্যি নয়, তবে পুরোপুরি অসত্যও নয়। নেত্রীদের এমন আয়েশি বেপরোয়া বিলাসী জীবন সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইডেনের মেয়েরা ভয়ানক, তাঁদের বিয়ে করা যাবে না, তাঁরা কুরুচিপূর্ণ কাজে লিপ্ত ইত্যাদি ইত্যাদিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সয়লাব।

কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে এসব মেয়ের বাবা-মায়ের। শুনতে হচ্ছে প্রতিবেশীদের অনেক কটু কথা। অথচ এটি একটি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকার আশপাশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাঁরা ভর্তি হতে ব্যর্থ হন, তাঁরা প্রথম প্রায়োরিটি হিসেবে ইডেন কলেজকে বেছে নেন। সুপরিসর ক্যাম্পাস, শিক্ষার মান এবং আবাসন-সুবিধার কারণে অভিভাবকেরাও থাকেন নিশ্চিন্ত।

এই যে কলঙ্কের তিলক আজ ইডেনে পড়েছে, আত্মীয়-আপনজনের তির্যক মন্তব্যে মাথা নুইয়েছে ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর ৮০ হাজার বাবা-মা। এর দায় কে নেবে? বর্তমান বাস্তবতায় দলীয় ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি কি খুব জরুরি কিছু? জাতীয় রাজনীতিতে এই তথাকথিত নেতা-নেত্রীদের অবদান কি খুব একটা চোখে পড়ে? আর যদি জরুরি হয়েই থাকে, তবে এই বাজে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজা আরও বেশি জরুরি।

দেশের অনেক শিক্ষাবিদ এবং বিশিষ্টজনের মতে, ১৯৯০ সালের পর থেকে দলীয় ছাত্ররাজনীতি দেশের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনেনি। ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং সোনালি অতীত নিয়ে যতই জপ করি না কেন, এটি এখন বিষফোড়া! আবরার হত্যার মতো আরও অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে তা এখন রীতিমতো অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

এই মুহূর্তে দেশের সব সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বহাল আছে, কিন্তু কার্যকর ছাত্র সংসদ কি একটিও আছে? ছাত্র সংসদ নির্বাচনই তো হয় না। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য যে প্ল্যাটফর্ম দরকার, সেটিকে অনুপস্থিত রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি চালু রাখা কি তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন, বিলাসী জীবনযাপন এবং আসন-বাণিজ্যের জন্য?

ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আমিও অনুভব করি, তবে সেটি এই রূপে থাকা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে আদর্শিক মানদণ্ড বজায় রেখে ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম—এমন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা গেলেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে ছাত্ররাজনীতি। সেটি সম্ভব না হলে বুয়েটের মতো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি অন্তত কয়েক বছরের জন্য হলেও যেন বন্ধ রাখা হয়।

ইডেনে অল্পসংখ্যক তথাকথিত ছাত্রী নামধারী নেত্রীর জন্য সিংহভাগ শিক্ষার্থীর মাথা হেঁট হতে পারে না, বদনাম হতে পারে না নারীশিক্ষা প্রসারের বাতিঘর হিসেবে বিবেচিত ইডেনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির।

লেখক: কলেজশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী