আমার কলেজজীবনের শিক্ষকেরা

তিনজন অসাধারণ ইংরেজির অধ্যাপককে পেয়েছিলাম কলেজে—পরেশ ব্যানার্জি, খুদা নেওয়াজ আর আব্বা। পরেশ ব্যানার্জির স্নিগ্ধ ভরাট কণ্ঠস্বর সেদিনের ক্লাসঘরগুলো ছাপিয়ে আমার ভেতর এখনো গমগম করে বাজে। মাঝারি উচ্চতা, দোহারা শরীর ও প্রৌঢ়ত্ব-মাখানো সুদর্শন চেহারার পরেশ ব্যানার্জির দাঁড়ানোর দৃপ্ত ভঙ্গিতে একটা সম্পন্ন রাজকীয়তা ছিল—তাঁর কথাগুলো হৃদয়কে আলোড়িত করে জীবনের ভেতর মহল পর্যন্ত অনুরণিত হতো। কবিকে তিনি মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সেই অভিভূত বিশ্বাস থেকে আজও আমি বেরোতে পারিনি। শেলির ‘দ্য স্কাইলার্ক’ কবিতাটি পড়িয়েছিলেন তিনি আমাদের। কী অসাধারণ আর বৈভবময় সেই পড়ানো। তাঁর পড়ানোর ভেতর দিয়ে কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব এবং সৌন্দর্য আমার জীবনের গভীর জগৎকে আলোকিত করে দিয়েছিল।

আব্বার সঙ্গে পরেশ ব্যানার্জির একটা জায়গায় মিল ছিল। পরেশ ব্যানার্জি সারা বছর ধরে আমাদের মাত্র একটা কবিতা পড়িয়েছিলেন, আব্বা দুই বছর ধরে কোলরিজের ‘এনশ্যিয়েন্ট মেরিনার’-এর অর্ধেকের বেশি পড়াতে পারেননি। কিন্তু কিছু না-পড়িয়ে কতটা পড়ানো যায়, তার উদাহরণ ছিল এই দুজনের ক্লাস। পাঠ্যবইয়ের কয়েক পৃষ্ঠার বেশি পড়াননি তাঁরা, হয়তো চানওনি। কিন্তু হৃদয়ের ভেতর যেন হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়িয়ে ফেলেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের ঐশ্বর্যের সমস্ত হীরা-জহরতকে যেন উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন আমাদের জীবনের ওপর।

এই দুই শিক্ষকের প্রভাবেই কি না জানি না আমার নিজের শিক্ষকতার জীবনেও তড়িঘড়ি করে সিলেবাস শেষ করার ব্যাপারটাকে সব সময়ই অর্থহীন মনে হয়েছে। কাজটাকে মনে হয়েছে জ্ঞানের সঙ্গে বিরোধিতা, শিক্ষকতার বৈভবময় ও উচ্চতর দায়িত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, বৈষয়িক দরকারের সংকীর্ণ রাস্তায় শিক্ষকের সম্মানকে লাঞ্ছিত করা। তাঁদের দেখে আমি জেনেছি শিক্ষকের জীবন-ঐশ্বর্য কীভাবে ছাত্রকে তার জীবনের উৎকর্ণ উন্মুখ ও প্রাথমিক দিনগুলোয় সারা জীবনের জন্য তিলে তিলে রচনা করে। সত্যিকার শিক্ষক হতে গেলে এই বড় জিনিসগুলো ছাত্রকে দিতেই হয় তাঁর। ছাত্রদের জীবনকে আলোময় কিছু না দিয়ে দিনগত পাপক্ষয়ের মতো কেবলই রুটিনমাফিক সিলেবাস শেষ আর নোট মুখস্থ করিয়ে যাওয়াকে, এঁদের কাছে পড়ার পর, আমি কখনো আর শিক্ষকতা বলে ভাবতে পারিনি। পাঠ্যবইসর্বস্ব ওই ব্যাপারটিকে আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে টিউটরের কাজ—কোচিং—নেহাতই একটা চাকরি—প্রাণহীন আলোহীন চাকরি। যে দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষক ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তা থেকে এ অনেক দূরে।

আমার কলেজজীবনের শিক্ষকেরা

তিনজন অসাধারণ ইংরেজির অধ্যাপককে পেয়েছিলাম কলেজে—পরেশ ব্যানার্জি, খুদা নেওয়াজ আর আব্বা। পরেশ ব্যানার্জির স্নিগ্ধ ভরাট কণ্ঠস্বর সেদিনের ক্লাসঘরগুলো ছাপিয়ে আমার ভেতর এখনো গমগম করে বাজে। মাঝারি উচ্চতা, দোহারা শরীর ও প্রৌঢ়ত্ব-মাখানো সুদর্শন চেহারার পরেশ ব্যানার্জির দাঁড়ানোর দৃপ্ত ভঙ্গিতে একটা সম্পন্ন রাজকীয়তা ছিল—তাঁর কথাগুলো হৃদয়কে আলোড়িত করে জীবনের ভেতর মহল পর্যন্ত অনুরণিত হতো। কবিকে তিনি মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সেই অভিভূত বিশ্বাস থেকে আজও আমি বেরোতে পারিনি। শেলির ‘দ্য স্কাইলার্ক’ কবিতাটি পড়িয়েছিলেন তিনি আমাদের। কী অসাধারণ আর বৈভবময় সেই পড়ানো। তাঁর পড়ানোর ভেতর দিয়ে কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব এবং সৌন্দর্য আমার জীবনের গভীর জগৎকে আলোকিত করে দিয়েছিল।

আব্বার সঙ্গে পরেশ ব্যানার্জির একটা জায়গায় মিল ছিল। পরেশ ব্যানার্জি সারা বছর ধরে আমাদের মাত্র একটা কবিতা পড়িয়েছিলেন, আব্বা দুই বছর ধরে কোলরিজের ‘এনশ্যিয়েন্ট মেরিনার’-এর অর্ধেকের বেশি পড়াতে পারেননি। কিন্তু কিছু না-পড়িয়ে কতটা পড়ানো যায়, তার উদাহরণ ছিল এই দুজনের ক্লাস। পাঠ্যবইয়ের কয়েক পৃষ্ঠার বেশি পড়াননি তাঁরা, হয়তো চানওনি। কিন্তু হৃদয়ের ভেতর যেন হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়িয়ে ফেলেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের ঐশ্বর্যের সমস্ত হীরা-জহরতকে যেন উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন আমাদের জীবনের ওপর।

এই দুই শিক্ষকের প্রভাবেই কি না জানি না আমার নিজের শিক্ষকতার জীবনেও তড়িঘড়ি করে সিলেবাস শেষ করার ব্যাপারটাকে সব সময়ই অর্থহীন মনে হয়েছে। কাজটাকে মনে হয়েছে জ্ঞানের সঙ্গে বিরোধিতা, শিক্ষকতার বৈভবময় ও উচ্চতর দায়িত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, বৈষয়িক দরকারের সংকীর্ণ রাস্তায় শিক্ষকের সম্মানকে লাঞ্ছিত করা। তাঁদের দেখে আমি জেনেছি শিক্ষকের জীবন-ঐশ্বর্য কীভাবে ছাত্রকে তার জীবনের উৎকর্ণ উন্মুখ ও প্রাথমিক দিনগুলোয় সারা জীবনের জন্য তিলে তিলে রচনা করে। সত্যিকার শিক্ষক হতে গেলে এই বড় জিনিসগুলো ছাত্রকে দিতেই হয় তাঁর। ছাত্রদের জীবনকে আলোময় কিছু না দিয়ে দিনগত পাপক্ষয়ের মতো কেবলই রুটিনমাফিক সিলেবাস শেষ আর নোট মুখস্থ করিয়ে যাওয়াকে, এঁদের কাছে পড়ার পর, আমি কখনো আর শিক্ষকতা বলে ভাবতে পারিনি। পাঠ্যবইসর্বস্ব ওই ব্যাপারটিকে আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে টিউটরের কাজ—কোচিং—নেহাতই একটা চাকরি—প্রাণহীন আলোহীন চাকরি। যে দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষক ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তা থেকে এ অনেক দূরে।