একমাত্র সমতাই ভর্তি সংকট দূর করতে পারে

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শুরু করি। অনেক দিন আগে আমার এক প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। তাঁর চোখেমুখে আনন্দ-উচ্ছ্বাস একেবারে উপচে পড়ছে। তাঁর ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার আনন্দে একেবারে উদ্বেলিত তিনি।

সেই আনন্দের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে আমিও তাতে সংক্রমিত হয়ে মিষ্টি না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা ভেঙে টপ করে একটি রসগোল্লা মুখে পুরে দিলাম। সন্ধ্যায় বাইরে বেরোনোর সময় ভদ্রমহিলার সঙ্গে আবার তাঁর বাসার সামনে দেখা। এবার তাঁর মুখ থমথমে, দুশ্চিন্তার আঁধারে ঢাকা। নিজের অজান্তেই চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘ভাইয়া, সবাই তো দেখি জিপিএ ৫। এখন ভর্তি করব কোথায়?’ এই বছরও অভিভাবকরা একই কারণে ওই একই উদ্বেগে আক্রান্ত হয়ে আছেন।

জিপিএ ৫-এর দিক থেকে বিবেচনা করলে এবারের ফল খুবই ভালো। এবারের তুলনায় গতবারের পরীক্ষা অনেক সহজ হওয়া সত্ত্বেও এবার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আগে এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০। এবার সেটি বেড়ে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০২। এবার ইংরেজি ও অঙ্কের মতো বিষয়েও যথাক্রমে ৯৬.৬৫ ও ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। অথচ করোনার কারণে এই শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি স্কুলবঞ্চিত ছিল। তারা নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে না হতেই ১৮ মাসের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১-এ স্কুল খুললেও পুরোদমে ক্লাস হয়নি। সেটিও চলে অল্প কিছুদিনের জন্য। এরপর আবারও স্কুলগুলোতে তালা ঝোলে।

এত প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও এই শিক্ষার্থীদের এত ভালো ফল আমাদের মনে আশা জাগায়। আমরা বুঝতে পারি আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষা কর্মকর্তারা পরিবর্তিত সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলেন। অ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন ক্লাস, টিভি ক্লাস, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত যোগাযোগ—সব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েনি, বরং উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, যেটি এ যুগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষার্থীরা সেই স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। বিবিএস ও ইউনিসেফের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনার সময় আমাদের ৪৪.২ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বশিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের স্বশিক্ষায় অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে কার্যকর যে টুলটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি হলো অ্যাসাইনমেন্ট। বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২.১ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৮৭.৬ শতাংশ অভিভাবক এবং ৯১.৮ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আরো বেশি মনোযোগী করে তুলে তাদের স্বশিখন প্রক্রিয়ার দিকে প্রণোদিত করেছে।

এবার আসি ভর্তি সংকট নিয়ে। আমরা সবাই জানি এই ভর্তি সংকটের মূল কারণ একটাই। আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের দেশের গুটিকয় নামকরা কলেজে ভর্তি করাতে চাই। আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা যখন ওই কলেজগুলোর সীমিত আসনসংখ্যার সঙ্গে মেলে না, তখনই এই সংকটটা তৈরি হয়।

একই কারণে শিক্ষকসংখ্যাকে অপ্রতুল ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতকে বেশি মনে হয়। ব্যানবেইস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৯-এর দিকে তাকালে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। যেমন—আমাদের ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’-এর কলেজ সেকশনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত মাত্র ১:১৯ এবং ‘উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে’ সেটি আরো কম, ১:১৬। ‘ডিগ্রি (পাস) কলেজেও’ খুব বেশি নয়, ১:২৩। যেসব কলেজে অনার্স আছে, সেখানে একটু বেশি, ১:৪১। এই অনুপাতটি ‘মাস্টার্স কলেজে’ গিয়ে খুব বেশি হয়, ১:১৩১। দেশের নামকরা কলেজগুলোর বেশির ভাগই হচ্ছে মাস্টার্স কলেজ। তবে সব মাস্টার্স কলেজের নামডাক সমান নয়। যাদের নামডাক বেশি, সেখানে এই অনুপাত আরো অস্বাভাবিক।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই নামডাকের বিষয়টি এবং সেই সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রতিষ্ঠানটি সরকারি না বেসরকারি তার ওপরও নির্ভর করে। যেমন—আমাদের বেসরকারি ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ আছে এক হাজার ২০০টি। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ২৯২। অন্যদিকে সরকারি ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ আছে মাত্র ৬৫টি। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি, ৪৩৩। ‘উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোর’ অবস্থাও তাই। আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে এক হাজার ৩৩৫টি। সেখানে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ২৬৯। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ৪৯টি। সেখানে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯১৩। অন্য সব ধরনের কলেজের চিত্রও প্রায় এক।

অর্থাৎ এটা স্পষ্ট আমাদের আসন বা শিক্ষক সংখ্যার অপ্রতুলতা নেই। সমস্যা হচ্ছে বণ্টন বা সমতায়। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যদি একটা যৌক্তিক সমতা আনা যেত, তাহলে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির সংকট বলে কোনো সংকট থাকত না। এই অসমতার কিছু বড় কারণ হচ্ছে সরকারি বা ভালো কলেজগুলোতে ভালো শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো, কম বেতন এবং সর্বোপরি বহুদিন ধরে তৈরি হওয়া মিথ।

তবে বস্তুত শিক্ষার্থী-বেতন ছাড়া অন্য কারণগুলো বিবেচনায় নিলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতর তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যেমন—সরকারি কলেজের ভালো শিক্ষকরা তাঁদের ক্লাসে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর উদ্দেশে গলা ফাটিয়ে ভালো লেকচার হয়তো দিতে পারেন, কিন্তু এত শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে প্রকৃত শিক্ষাদান অসম্ভব। একইভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই অস্বাভাবিক অনুপাতের কারণে শিক্ষার্থীরা বড় অবকাঠামোর সুবিধাটিও ঠিকমতো পাচ্ছে না। অন্যদিকে এনটিআরসি-এ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু করার পর বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকের মান বাড়ছে।

অভিভাবকরা যে মনে করছেন নামকরা কলেজে ভর্তি করাতে পারলেই তাঁদের সন্তানরা ভালো করবে, পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এই ধারণাটাও পাল্টে যাবে। দেখা যাবে, যত ভালো ফল নিয়ে শিক্ষার্থীরা এসব নামকরা কলেজে ভর্তি হয়, এইচএসসিতে তারা তত ভালো করে না।

কলেজগুলোর মধ্যে সমতা আনাটা খুব সহজ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে এখনই একটি পরীক্ষিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। করোনার সময় স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে যে লটারি পদ্ধতি চালু হয়েছিল, সেটি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর সমতা আনার ক্ষেত্রে একটি কার্যকর পদ্ধতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে সেই একই পদ্ধতি আমরা কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেও অনুসরণ করতে পারি। এতে অভিভাবকদের আক্ষেপ কমবে, কলেজগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেমে আসবে এবং সর্বোপরি কলেজগুলোর মধ্যে একটা সমতা আসার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

এই ভর্তি সংকট ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণে এই সমতার বিষয়টিকে নিশ্চিত করা উচিত। এই সমতা ছাড়া কোনো দেশে গুণগত শিক্ষা অর্জন করা যায়নি, আমাদের দেশেও যাবে না।

লেখক : মাউশির সাবেক মহাপরিচালক

 

একমাত্র সমতাই ভর্তি সংকট দূর করতে পারে

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শুরু করি। অনেক দিন আগে আমার এক প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। তাঁর চোখেমুখে আনন্দ-উচ্ছ্বাস একেবারে উপচে পড়ছে। তাঁর ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার আনন্দে একেবারে উদ্বেলিত তিনি।

সেই আনন্দের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে আমিও তাতে সংক্রমিত হয়ে মিষ্টি না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা ভেঙে টপ করে একটি রসগোল্লা মুখে পুরে দিলাম। সন্ধ্যায় বাইরে বেরোনোর সময় ভদ্রমহিলার সঙ্গে আবার তাঁর বাসার সামনে দেখা। এবার তাঁর মুখ থমথমে, দুশ্চিন্তার আঁধারে ঢাকা। নিজের অজান্তেই চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘ভাইয়া, সবাই তো দেখি জিপিএ ৫। এখন ভর্তি করব কোথায়?’ এই বছরও অভিভাবকরা একই কারণে ওই একই উদ্বেগে আক্রান্ত হয়ে আছেন।

জিপিএ ৫-এর দিক থেকে বিবেচনা করলে এবারের ফল খুবই ভালো। এবারের তুলনায় গতবারের পরীক্ষা অনেক সহজ হওয়া সত্ত্বেও এবার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আগে এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০। এবার সেটি বেড়ে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০২। এবার ইংরেজি ও অঙ্কের মতো বিষয়েও যথাক্রমে ৯৬.৬৫ ও ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। অথচ করোনার কারণে এই শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি স্কুলবঞ্চিত ছিল। তারা নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে না হতেই ১৮ মাসের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১-এ স্কুল খুললেও পুরোদমে ক্লাস হয়নি। সেটিও চলে অল্প কিছুদিনের জন্য। এরপর আবারও স্কুলগুলোতে তালা ঝোলে।

এত প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও এই শিক্ষার্থীদের এত ভালো ফল আমাদের মনে আশা জাগায়। আমরা বুঝতে পারি আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষা কর্মকর্তারা পরিবর্তিত সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলেন। অ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন ক্লাস, টিভি ক্লাস, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত যোগাযোগ—সব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েনি, বরং উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, যেটি এ যুগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষার্থীরা সেই স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। বিবিএস ও ইউনিসেফের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনার সময় আমাদের ৪৪.২ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বশিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের স্বশিক্ষায় অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে কার্যকর যে টুলটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি হলো অ্যাসাইনমেন্ট। বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২.১ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৮৭.৬ শতাংশ অভিভাবক এবং ৯১.৮ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আরো বেশি মনোযোগী করে তুলে তাদের স্বশিখন প্রক্রিয়ার দিকে প্রণোদিত করেছে।

এবার আসি ভর্তি সংকট নিয়ে। আমরা সবাই জানি এই ভর্তি সংকটের মূল কারণ একটাই। আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের দেশের গুটিকয় নামকরা কলেজে ভর্তি করাতে চাই। আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা যখন ওই কলেজগুলোর সীমিত আসনসংখ্যার সঙ্গে মেলে না, তখনই এই সংকটটা তৈরি হয়।

একই কারণে শিক্ষকসংখ্যাকে অপ্রতুল ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতকে বেশি মনে হয়। ব্যানবেইস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৯-এর দিকে তাকালে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। যেমন—আমাদের ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’-এর কলেজ সেকশনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত মাত্র ১:১৯ এবং ‘উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে’ সেটি আরো কম, ১:১৬। ‘ডিগ্রি (পাস) কলেজেও’ খুব বেশি নয়, ১:২৩। যেসব কলেজে অনার্স আছে, সেখানে একটু বেশি, ১:৪১। এই অনুপাতটি ‘মাস্টার্স কলেজে’ গিয়ে খুব বেশি হয়, ১:১৩১। দেশের নামকরা কলেজগুলোর বেশির ভাগই হচ্ছে মাস্টার্স কলেজ। তবে সব মাস্টার্স কলেজের নামডাক সমান নয়। যাদের নামডাক বেশি, সেখানে এই অনুপাত আরো অস্বাভাবিক।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই নামডাকের বিষয়টি এবং সেই সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রতিষ্ঠানটি সরকারি না বেসরকারি তার ওপরও নির্ভর করে। যেমন—আমাদের বেসরকারি ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ আছে এক হাজার ২০০টি। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ২৯২। অন্যদিকে সরকারি ‘স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ আছে মাত্র ৬৫টি। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি, ৪৩৩। ‘উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোর’ অবস্থাও তাই। আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে এক হাজার ৩৩৫টি। সেখানে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ২৬৯। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ৪৯টি। সেখানে গড় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯১৩। অন্য সব ধরনের কলেজের চিত্রও প্রায় এক।

অর্থাৎ এটা স্পষ্ট আমাদের আসন বা শিক্ষক সংখ্যার অপ্রতুলতা নেই। সমস্যা হচ্ছে বণ্টন বা সমতায়। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যদি একটা যৌক্তিক সমতা আনা যেত, তাহলে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির সংকট বলে কোনো সংকট থাকত না। এই অসমতার কিছু বড় কারণ হচ্ছে সরকারি বা ভালো কলেজগুলোতে ভালো শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো, কম বেতন এবং সর্বোপরি বহুদিন ধরে তৈরি হওয়া মিথ।

তবে বস্তুত শিক্ষার্থী-বেতন ছাড়া অন্য কারণগুলো বিবেচনায় নিলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতর তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যেমন—সরকারি কলেজের ভালো শিক্ষকরা তাঁদের ক্লাসে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর উদ্দেশে গলা ফাটিয়ে ভালো লেকচার হয়তো দিতে পারেন, কিন্তু এত শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে প্রকৃত শিক্ষাদান অসম্ভব। একইভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই অস্বাভাবিক অনুপাতের কারণে শিক্ষার্থীরা বড় অবকাঠামোর সুবিধাটিও ঠিকমতো পাচ্ছে না। অন্যদিকে এনটিআরসি-এ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু করার পর বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকের মান বাড়ছে।

অভিভাবকরা যে মনে করছেন নামকরা কলেজে ভর্তি করাতে পারলেই তাঁদের সন্তানরা ভালো করবে, পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এই ধারণাটাও পাল্টে যাবে। দেখা যাবে, যত ভালো ফল নিয়ে শিক্ষার্থীরা এসব নামকরা কলেজে ভর্তি হয়, এইচএসসিতে তারা তত ভালো করে না।

কলেজগুলোর মধ্যে সমতা আনাটা খুব সহজ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে এখনই একটি পরীক্ষিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। করোনার সময় স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে যে লটারি পদ্ধতি চালু হয়েছিল, সেটি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর সমতা আনার ক্ষেত্রে একটি কার্যকর পদ্ধতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে সেই একই পদ্ধতি আমরা কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেও অনুসরণ করতে পারি। এতে অভিভাবকদের আক্ষেপ কমবে, কলেজগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেমে আসবে এবং সর্বোপরি কলেজগুলোর মধ্যে একটা সমতা আসার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

এই ভর্তি সংকট ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণে এই সমতার বিষয়টিকে নিশ্চিত করা উচিত। এই সমতা ছাড়া কোনো দেশে গুণগত শিক্ষা অর্জন করা যায়নি, আমাদের দেশেও যাবে না।

লেখক : মাউশির সাবেক মহাপরিচালক