জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি ও মানবিক সহায়তার দৃষ্টান্ত

ড. কালিদাস ভক্ত

কোনো মানুষই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে দিতে পারে না। আবার তা যদি হয় অকালে ঝরে পড়া সম্ভাবনাময় মেধাবী তরুণ-যুবাদের। এ মৃত্যু আরো বেদনার, আরো কষ্টের। হৃদয় ভেঙে যাওয়ার মতো। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে এমন এক হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডির দিন। অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ দেখার জন্য তৎকালীন পরিষদ ভবনের টিভি কক্ষে উন্মুখ হয়ে কয়েক শ ছাত্র ও কয়েকজন অতিথি এসে উপস্থিত হন। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ টিভির পর্দায়। আকাশ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে ও সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে দমকা হাওয়া বইছে। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ টিভি কক্ষের ছাদ ধসে পড়ে। অনেক মানুষের কান্না আর হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। এই অন্ধকারের ভেতর আহতদের চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে পাশের সবাই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে রক্ত মিশে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৩৪ জন তরতাজা যুবকের। পরে আরো ছয়জনসহ মোট ৪০ জনের করুণ মৃত্যু হয়।

অত্যন্ত হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার খবর মুহূর্তের মধ্যেই ঢাকা শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ খবর রেডিও ও টেলিভিশনের ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সর্বত্র আলোচিত হতে থাকে। হলে অবস্থানরত ছাত্র-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থায় উদ্ধার তৎপরতায় শামিল হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, শিক্ষক, অন্যান্য হলের শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শহরের সাধারণ জনতা জাতি-বর্ণ-ধর্ম-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সাহায্যের জন্য আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন। ঘটনাস্থলে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেও মনে সাহস সঞ্চার করে উদ্ধারকাজে আগুয়ান হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরকেন্দ্রিক মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে উদ্ধারকাজে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। অ্যাম্বুল্যান্স, রিকশা, ভ্যান, ট্যাক্সিসহ সামনে যা পাওয়া যায়, তাতে করেই ছাত্রদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঢাকাসহ আশপাশের লোকজন ছুটে আসতে থাকে জগন্নাথ হলের দিকে, যেন শোক মিছিলের হাহাকারের ক্রন্দনরোল সর্বত্র ভেসে যাচ্ছে।

 

দিনমজুর, হকার, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ সেদিন শোকাকুলচিত্তে উদভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্রদের পাশে। তারা আহতদের রক্ত দিয়ে, টাকা-পয়সা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, সময় দিয়ে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে সহায়তা করে। সেদিন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ রক্ত দেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কে রক্ত আগে দেবে এ জন্য প্রতিযোগিতা করেছে। মন্দিরের পুরোহিতরা যেমন এসেছেন, তেমনি ইমাম, ফাদার, ভান্তেরা এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য হলের ছাত্র-ছাত্রীরাও হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। শহরের ওষুধ বিক্রেতারা বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করেছেন। মূলত সেদিন কে কোন বর্ণের, কে কোন গোত্রের, কে কোন গোষ্ঠীর, কে কোন জাতির এই বিষয়টি চিন্তাও করেননি। মানুষ মানুষের জন্য, সেটি সেদিন বাস্তবে প্রমাণ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই একত্রে শামিল হয়েছিলেন।

চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’—এই বাণীর মর্মার্থই সেদিন লক্ষ করা গেছে। সেদিন অনেকে রক্ত দিয়ে যেমন রক্তের বাঁধনে বেঁধেছে, তেমনি স্বজন হারানো মানুষের পাশে স্বজনের  ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মানবিকতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য যেভাবে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন, তেমনি খোলা আকাশের নিচে ঘুমানো মানুষগুলোও উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট জরুরি সভার আয়োজন করে সাত দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে আহতদের চাকরি দিয়ে, বৃত্তি দিয়ে স্থায়ী সমাধান করে দিয়েছে। সেদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠিত হয়েছিল। এভাবে মানবতার প্রকাশই সেদিনের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শিক্ষা।

লেখক : আবাসিক শিক্ষক, জগন্নাথ হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি ও মানবিক সহায়তার দৃষ্টান্ত

ড. কালিদাস ভক্ত

কোনো মানুষই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে দিতে পারে না। আবার তা যদি হয় অকালে ঝরে পড়া সম্ভাবনাময় মেধাবী তরুণ-যুবাদের। এ মৃত্যু আরো বেদনার, আরো কষ্টের। হৃদয় ভেঙে যাওয়ার মতো। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে এমন এক হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডির দিন। অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ দেখার জন্য তৎকালীন পরিষদ ভবনের টিভি কক্ষে উন্মুখ হয়ে কয়েক শ ছাত্র ও কয়েকজন অতিথি এসে উপস্থিত হন। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ টিভির পর্দায়। আকাশ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে ও সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে দমকা হাওয়া বইছে। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ টিভি কক্ষের ছাদ ধসে পড়ে। অনেক মানুষের কান্না আর হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। এই অন্ধকারের ভেতর আহতদের চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে পাশের সবাই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে রক্ত মিশে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৩৪ জন তরতাজা যুবকের। পরে আরো ছয়জনসহ মোট ৪০ জনের করুণ মৃত্যু হয়।

অত্যন্ত হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার খবর মুহূর্তের মধ্যেই ঢাকা শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ খবর রেডিও ও টেলিভিশনের ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সর্বত্র আলোচিত হতে থাকে। হলে অবস্থানরত ছাত্র-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থায় উদ্ধার তৎপরতায় শামিল হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, শিক্ষক, অন্যান্য হলের শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শহরের সাধারণ জনতা জাতি-বর্ণ-ধর্ম-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সাহায্যের জন্য আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন। ঘটনাস্থলে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেও মনে সাহস সঞ্চার করে উদ্ধারকাজে আগুয়ান হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরকেন্দ্রিক মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে উদ্ধারকাজে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। অ্যাম্বুল্যান্স, রিকশা, ভ্যান, ট্যাক্সিসহ সামনে যা পাওয়া যায়, তাতে করেই ছাত্রদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঢাকাসহ আশপাশের লোকজন ছুটে আসতে থাকে জগন্নাথ হলের দিকে, যেন শোক মিছিলের হাহাকারের ক্রন্দনরোল সর্বত্র ভেসে যাচ্ছে।

 

দিনমজুর, হকার, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ সেদিন শোকাকুলচিত্তে উদভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্রদের পাশে। তারা আহতদের রক্ত দিয়ে, টাকা-পয়সা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, সময় দিয়ে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে সহায়তা করে। সেদিন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ রক্ত দেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কে রক্ত আগে দেবে এ জন্য প্রতিযোগিতা করেছে। মন্দিরের পুরোহিতরা যেমন এসেছেন, তেমনি ইমাম, ফাদার, ভান্তেরা এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য হলের ছাত্র-ছাত্রীরাও হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। শহরের ওষুধ বিক্রেতারা বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করেছেন। মূলত সেদিন কে কোন বর্ণের, কে কোন গোত্রের, কে কোন গোষ্ঠীর, কে কোন জাতির এই বিষয়টি চিন্তাও করেননি। মানুষ মানুষের জন্য, সেটি সেদিন বাস্তবে প্রমাণ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই একত্রে শামিল হয়েছিলেন।

চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’—এই বাণীর মর্মার্থই সেদিন লক্ষ করা গেছে। সেদিন অনেকে রক্ত দিয়ে যেমন রক্তের বাঁধনে বেঁধেছে, তেমনি স্বজন হারানো মানুষের পাশে স্বজনের  ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মানবিকতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য যেভাবে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন, তেমনি খোলা আকাশের নিচে ঘুমানো মানুষগুলোও উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট জরুরি সভার আয়োজন করে সাত দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে আহতদের চাকরি দিয়ে, বৃত্তি দিয়ে স্থায়ী সমাধান করে দিয়েছে। সেদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠিত হয়েছিল। এভাবে মানবতার প্রকাশই সেদিনের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শিক্ষা।

লেখক : আবাসিক শিক্ষক, জগন্নাথ হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়