দরকার সততা ও নৈতিকতার শিক্ষা

ড. এ কে এম লুৎফর রহমান

‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে, যারা প্রতিবাদ করে, তারাই ইতিহাস রচনা করে’-কথাগুলো সত্য হলেও আমরা ধরে নিই এগুলো কথার কথা; সবাই তো বলে, এ আর নতুন কী!

কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি স্পষ্ট হবে। গণমানুষের অধিকার নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাস রচনা করেছেন আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ড. মার্টিন লুথার কিং।

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ছিল আবেগতাড়িত জনতার ওপর নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ। আর ওই নৃশংসতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চরম ধিক্কার ও ঘৃণাবোধ থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাইটহুড’ (স্যার টাইটেল) উপাধি ত্যাগ করেন, যা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রতিবাদ জানানোর এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে।

ধর্মের গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিপক্ষে কথা বলেছেন আর ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ ও লড়াই করেছেন মহাত্মা সাধক বাউল সম্রাট লালন শাহ। আফ্রিকার গণমানুষের লড়াইয়ের জন্য যিনি তার পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে যিনি লড়াই করেছিলেন, সারা জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন কালো ও সাদা চামড়ার বৈষম্য দূর করতে-লোকে তাকে ভালোবেসে ডাকে ‘মাদিবা’। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো যার সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন-‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি, ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়; তিনি হলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন আপসহীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিশ্বাস্য সাহসী ও বীরত্বের অপরিসীম এক ইতিহাস বঙ্গবন্ধু। এভাবেই ইতিহাস বারবার সাক্ষ্য দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার।

কিন্তু আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিবাদ ও লড়াই তেমন নেই বলেই দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়লেও সমাজে অস্থিরতা কমেনি, নেই চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য। আছে আকাশসম প্রত্যাশা, যা সামর্থ্যরে বাইরে (অবৈধভাবে হলেও তা পেতেই হবে)। শুধুই নিজের অনুচিত সুবিধা হাসিলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

আর হবে নাই বা কেন? কেউ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে আমরা বলি আরও ভালো রেজাল্ট করো; কারও কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তি হলে আমরা বলি আরও বড় প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করো, আরও বড় কিছু বৈষয়িক পাওয়ার জন্য লড়াই করো। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বলি বিসিএস দিয়ে ফরেন সার্ভিস, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স ইত্যাদি ক্যাডারে যোগ দিয়ে বড় অফিসার হও। সরকারি চাকরিতে প্রতি বছর হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত মানুষ ক্যাডার অফিসার হিসাবে যুক্ত হচ্ছে। তার পরও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নৈতিক তথা সামাজিক অবক্ষয় লক্ষণীয়, কেন? অবশ্য আমরা অভিভাবকরাও এখন তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে বলি না যে, সবার আগে আমার সন্তান হিসাবে ভালো মানুষ হও। আমরা এখন শুধুই ক্ষমতা ও অর্থের পূজারি। সন্তানকে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বানাতে পারলে জীবন সার্থক বলে মনে করি।

কিছু দিন আগে কজন বন্ধু মিলে একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক বন্ধু বলল তাকে উঠতে হবে। বললাম, কেন? সে বলল, বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা মিস্টার এক্স আসছেন, তাকে রিসিভ করতে হবে এবং তাকে সঙ্গ দিতে হবে। তখন আমার মনে হলো, একজন শিক্ষকের চেয়েও সমাজের বেশি প্রয়োজন একজন বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা। একজন শিক্ষকের না আছে অর্থ না আছে ক্ষমতা, কাজেই তাকে সঙ্গ দিয়ে তেমন কোনো সিদ্ধি লাভ করা যায় না। যা হোক, হয়তোবা বন্ধুটির মি. এক্সের সঙ্গে আরও কোনো ব্যক্তিগত সংযোগ থাকতে পারে।

আজ সমাজে অনেক উচ্চশিক্ষিত বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডার, শিক্ষক। কিন্তু এত শিক্ষিত মানুষ মিলেও সমাজের অস্থিরতাকে আমরা দূর করতে পারছি না। শিক্ষা আছে, তবে প্রকৃত শিক্ষা, নৈতিকতার শিক্ষা, মানবতার শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা হয়তো নেই। আজকের সমাজে অস্থিরতার কারণ হলো অতিরিক্ত লোভ, স্বল্প শ্রম অথবা শ্রম না দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের তাড়না, আত্ম অহংকার, বিবেকতাড়িত না হয়ে রিপুর তাড়িত হওয়া, আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি। চার পাশ বিষাক্ত করে তার ঠিক মাঝখানে নিজেকে সুস্থ রাখার অলীক স্বপ্নে বিভোর আমরা। আমাদের পঠন, পাঠন, শিখন আমাদের লোভকে সংবরণ করাতে পারছে না, আমাদের আত্ম অহংকারকে নিয়ন্ত্রণ করাতে পারছে না, আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতাকে দূর করাতে পারছে না, পারছে না আমাদের চেতনাকে, আমাদের মননশীলতাকে জাগ্রত করাতে।

এই তো সেদিন একটা অনুষ্ঠানে গেলাম, সেখানে কৃতী শিক্ষার্থীদের গোল্ড মেডেল প্রদান করা হলো। বক্তারা তাদের বক্তব্যে বললেন, এ গোল্ড মেডেলপ্রাপ্তি তোমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমরা এখানেই থেমে থেকো না, আরও বড় বড় পুরস্কার তুলে নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও। এই মোটিভেশনের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে আমার মনে হয়, এর চেয়েও এখন বেশি প্রয়োজন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা, মানবিক হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা, নৈতিক মূল্যবোধে শক্তিশালী হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা বলা। আজকে বেশি প্রয়োজন ন্যায়পরায়ণতা, সততা, শিষ্টাচার, শাসন বা শোষণ নয়-সেবা করার মানসিকতা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, সহানুভূতি ও সমানুভূতি অর্জনের প্রতিযোগিতার কথা বলা। সেটা না হলে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা কঠিন। এক সময় আমরা বৈষয়িক এসব প্রতিযোগিতায় অনেক কিছু পাবো হয়তো, কিন্তু কোনোটাই টেকসই হবে না, যদি না আমরা নৈতিকভাবে উন্নত-সমৃদ্ধ হতে পারি। জাপান পৃথিবীর একটি উন্নত দেশ। সেখানে যাওয়ার সুযোগ যাদের হয়েছে, তারা দেখেছেন জাপানিরা কতটা সৎ এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী। ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের কতটুকু আছে জানি না, তবে অনৈতিক কোনো স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা তারা কখনোই করে না। কাউকে ঠকানোর চিন্তা করে না। প্রি-প্রাইমারি স্কুল থেকেই সেখানে সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, অপরাধ করলে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চাওয়া, আন্তরিকতা দিয়ে যে কোনো দায়িত্ব সম্পন্ন করা, লোভ সংবরণ করা ইত্যাদি হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। সে জন্য জাপানি যে কোনো পণ্য বা সেবা বিশ্বের সবার কাছে নির্ভরতায় অদ্বিতীয়।

বর্তমানে দেশে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও সমাজে অনেক। এমনকি আমরা অনেকে কানাডা, জাপানসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো থেকে নৈতিকতার উদাহরণ নিজ চোখে দেখে এসেছি। কিন্তু নিজের মাটিতে এসে এসব শিক্ষার প্রয়োগ খুব একটা করি না। তাই উচ্চশিক্ষায় অনেক শিক্ষিত হলেও ভালো ও মন্দের পার্থক্য করে কোনটি গ্রহণীয় বা বর্জনীয়, তা বিবেচনা করে চলা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম। ভালোকে সহজভাবে ভালো বলতে পারা এবং মন্দ ও অসত্যকে সাবলীলভাবে মন্দ বলতে পারা মানুষের সংখ্যা যৎকিঞ্চিত। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারে এ ধরনের মানুষের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অবশ্য আমরা নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব যখন বুঝতে পারি না, অর্থাৎ স্কুলের ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে এ শিক্ষা গ্রহণ করি; কিন্তু যখন বুঝতে পারি, অর্থাৎ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স লেভেলে, তখন পড়ানো বা পড়ার সুযোগ থাকে না। সততার সঙ্গ আমরা পছন্দ করি না, মিথ্যার সঙ্গে বন্ধুত্বে আমাদের সময় বেশ ভালো কাটে। বিপদে পড়লে সত্য-মিথ্যা একসঙ্গে করে ককটেল বানিয়ে ফেলতে পারি। এই হলো আমাদের তথাকথিত শিক্ষার ফল। অবশ্য আমরা মাঝে মাঝে সস্তা সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করলেও সমানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করি না। মাঝে মাঝে সস্তা মানবিক হওয়ার চেষ্টা করলেও নিজেকে পরিপূর্ণ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি না। উপরে উপরে ভালো মানুষ সাজি, কিন্তু ভেতরের আসল চেহারা অন্যরকম। কথায় কথায় সত্য প্রমাণ করার সাক্ষ্য হাজির করার নানা অঙ্গভঙ্গি দেখাই বা ফন্দি-ফিকির করার চেষ্টা করি, কিন্তু আদৌ সত্য প্রমাণ করতে চাই না বা এর ধারেকাছেও যেতে চাই না। এসব করে লোক দেখানো ভালো মানুষ হওয়ার ভান করি।

কাজেই যে প্রথা বা প্রতিযোগিতা ভালো-মন্দের পার্থক্য করার শিক্ষা দিতে পারে না, সত্যকে সত্য বলার এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎ সাহস জোগাতে পারে না, সেই প্রথা বা প্রতিযোগিতা দিয়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। বৈষয়িক শিক্ষা বা প্রতিযোগিতাকে নৈতিক শিক্ষা ও প্রতিযোগিতায় পরিণত করতে পারলেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হবে। তা না হলে শুধুই ঠুনকো বৈষয়িক কিছু প্রাপ্তিই হবে আমাদের সম্বল। আসুন, টেকসই পরবর্তী প্রজন্ম, সমাজ ও দেশ বিনির্মাণে এসবের দিকে একটু মনোযোগ দেই।

ড. এ কে এম লুৎফর রহমান : অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

দরকার সততা ও নৈতিকতার শিক্ষা

ড. এ কে এম লুৎফর রহমান

‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে, যারা প্রতিবাদ করে, তারাই ইতিহাস রচনা করে’-কথাগুলো সত্য হলেও আমরা ধরে নিই এগুলো কথার কথা; সবাই তো বলে, এ আর নতুন কী!

কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি স্পষ্ট হবে। গণমানুষের অধিকার নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাস রচনা করেছেন আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ড. মার্টিন লুথার কিং।

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ছিল আবেগতাড়িত জনতার ওপর নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ। আর ওই নৃশংসতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চরম ধিক্কার ও ঘৃণাবোধ থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাইটহুড’ (স্যার টাইটেল) উপাধি ত্যাগ করেন, যা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রতিবাদ জানানোর এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে।

ধর্মের গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিপক্ষে কথা বলেছেন আর ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ ও লড়াই করেছেন মহাত্মা সাধক বাউল সম্রাট লালন শাহ। আফ্রিকার গণমানুষের লড়াইয়ের জন্য যিনি তার পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে যিনি লড়াই করেছিলেন, সারা জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন কালো ও সাদা চামড়ার বৈষম্য দূর করতে-লোকে তাকে ভালোবেসে ডাকে ‘মাদিবা’। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো যার সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন-‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি, ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়; তিনি হলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন আপসহীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিশ্বাস্য সাহসী ও বীরত্বের অপরিসীম এক ইতিহাস বঙ্গবন্ধু। এভাবেই ইতিহাস বারবার সাক্ষ্য দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার।

কিন্তু আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিবাদ ও লড়াই তেমন নেই বলেই দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়লেও সমাজে অস্থিরতা কমেনি, নেই চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য। আছে আকাশসম প্রত্যাশা, যা সামর্থ্যরে বাইরে (অবৈধভাবে হলেও তা পেতেই হবে)। শুধুই নিজের অনুচিত সুবিধা হাসিলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

আর হবে নাই বা কেন? কেউ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে আমরা বলি আরও ভালো রেজাল্ট করো; কারও কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তি হলে আমরা বলি আরও বড় প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করো, আরও বড় কিছু বৈষয়িক পাওয়ার জন্য লড়াই করো। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বলি বিসিএস দিয়ে ফরেন সার্ভিস, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স ইত্যাদি ক্যাডারে যোগ দিয়ে বড় অফিসার হও। সরকারি চাকরিতে প্রতি বছর হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত মানুষ ক্যাডার অফিসার হিসাবে যুক্ত হচ্ছে। তার পরও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নৈতিক তথা সামাজিক অবক্ষয় লক্ষণীয়, কেন? অবশ্য আমরা অভিভাবকরাও এখন তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে বলি না যে, সবার আগে আমার সন্তান হিসাবে ভালো মানুষ হও। আমরা এখন শুধুই ক্ষমতা ও অর্থের পূজারি। সন্তানকে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বানাতে পারলে জীবন সার্থক বলে মনে করি।

কিছু দিন আগে কজন বন্ধু মিলে একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক বন্ধু বলল তাকে উঠতে হবে। বললাম, কেন? সে বলল, বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা মিস্টার এক্স আসছেন, তাকে রিসিভ করতে হবে এবং তাকে সঙ্গ দিতে হবে। তখন আমার মনে হলো, একজন শিক্ষকের চেয়েও সমাজের বেশি প্রয়োজন একজন বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা। একজন শিক্ষকের না আছে অর্থ না আছে ক্ষমতা, কাজেই তাকে সঙ্গ দিয়ে তেমন কোনো সিদ্ধি লাভ করা যায় না। যা হোক, হয়তোবা বন্ধুটির মি. এক্সের সঙ্গে আরও কোনো ব্যক্তিগত সংযোগ থাকতে পারে।

আজ সমাজে অনেক উচ্চশিক্ষিত বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডার, শিক্ষক। কিন্তু এত শিক্ষিত মানুষ মিলেও সমাজের অস্থিরতাকে আমরা দূর করতে পারছি না। শিক্ষা আছে, তবে প্রকৃত শিক্ষা, নৈতিকতার শিক্ষা, মানবতার শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা হয়তো নেই। আজকের সমাজে অস্থিরতার কারণ হলো অতিরিক্ত লোভ, স্বল্প শ্রম অথবা শ্রম না দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের তাড়না, আত্ম অহংকার, বিবেকতাড়িত না হয়ে রিপুর তাড়িত হওয়া, আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি। চার পাশ বিষাক্ত করে তার ঠিক মাঝখানে নিজেকে সুস্থ রাখার অলীক স্বপ্নে বিভোর আমরা। আমাদের পঠন, পাঠন, শিখন আমাদের লোভকে সংবরণ করাতে পারছে না, আমাদের আত্ম অহংকারকে নিয়ন্ত্রণ করাতে পারছে না, আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতাকে দূর করাতে পারছে না, পারছে না আমাদের চেতনাকে, আমাদের মননশীলতাকে জাগ্রত করাতে।

এই তো সেদিন একটা অনুষ্ঠানে গেলাম, সেখানে কৃতী শিক্ষার্থীদের গোল্ড মেডেল প্রদান করা হলো। বক্তারা তাদের বক্তব্যে বললেন, এ গোল্ড মেডেলপ্রাপ্তি তোমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমরা এখানেই থেমে থেকো না, আরও বড় বড় পুরস্কার তুলে নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও। এই মোটিভেশনের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে আমার মনে হয়, এর চেয়েও এখন বেশি প্রয়োজন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা, মানবিক হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা, নৈতিক মূল্যবোধে শক্তিশালী হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা বলা। আজকে বেশি প্রয়োজন ন্যায়পরায়ণতা, সততা, শিষ্টাচার, শাসন বা শোষণ নয়-সেবা করার মানসিকতা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, সহানুভূতি ও সমানুভূতি অর্জনের প্রতিযোগিতার কথা বলা। সেটা না হলে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা কঠিন। এক সময় আমরা বৈষয়িক এসব প্রতিযোগিতায় অনেক কিছু পাবো হয়তো, কিন্তু কোনোটাই টেকসই হবে না, যদি না আমরা নৈতিকভাবে উন্নত-সমৃদ্ধ হতে পারি। জাপান পৃথিবীর একটি উন্নত দেশ। সেখানে যাওয়ার সুযোগ যাদের হয়েছে, তারা দেখেছেন জাপানিরা কতটা সৎ এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী। ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের কতটুকু আছে জানি না, তবে অনৈতিক কোনো স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা তারা কখনোই করে না। কাউকে ঠকানোর চিন্তা করে না। প্রি-প্রাইমারি স্কুল থেকেই সেখানে সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, অপরাধ করলে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চাওয়া, আন্তরিকতা দিয়ে যে কোনো দায়িত্ব সম্পন্ন করা, লোভ সংবরণ করা ইত্যাদি হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। সে জন্য জাপানি যে কোনো পণ্য বা সেবা বিশ্বের সবার কাছে নির্ভরতায় অদ্বিতীয়।

বর্তমানে দেশে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও সমাজে অনেক। এমনকি আমরা অনেকে কানাডা, জাপানসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো থেকে নৈতিকতার উদাহরণ নিজ চোখে দেখে এসেছি। কিন্তু নিজের মাটিতে এসে এসব শিক্ষার প্রয়োগ খুব একটা করি না। তাই উচ্চশিক্ষায় অনেক শিক্ষিত হলেও ভালো ও মন্দের পার্থক্য করে কোনটি গ্রহণীয় বা বর্জনীয়, তা বিবেচনা করে চলা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম। ভালোকে সহজভাবে ভালো বলতে পারা এবং মন্দ ও অসত্যকে সাবলীলভাবে মন্দ বলতে পারা মানুষের সংখ্যা যৎকিঞ্চিত। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারে এ ধরনের মানুষের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অবশ্য আমরা নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব যখন বুঝতে পারি না, অর্থাৎ স্কুলের ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে এ শিক্ষা গ্রহণ করি; কিন্তু যখন বুঝতে পারি, অর্থাৎ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স লেভেলে, তখন পড়ানো বা পড়ার সুযোগ থাকে না। সততার সঙ্গ আমরা পছন্দ করি না, মিথ্যার সঙ্গে বন্ধুত্বে আমাদের সময় বেশ ভালো কাটে। বিপদে পড়লে সত্য-মিথ্যা একসঙ্গে করে ককটেল বানিয়ে ফেলতে পারি। এই হলো আমাদের তথাকথিত শিক্ষার ফল। অবশ্য আমরা মাঝে মাঝে সস্তা সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করলেও সমানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করি না। মাঝে মাঝে সস্তা মানবিক হওয়ার চেষ্টা করলেও নিজেকে পরিপূর্ণ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি না। উপরে উপরে ভালো মানুষ সাজি, কিন্তু ভেতরের আসল চেহারা অন্যরকম। কথায় কথায় সত্য প্রমাণ করার সাক্ষ্য হাজির করার নানা অঙ্গভঙ্গি দেখাই বা ফন্দি-ফিকির করার চেষ্টা করি, কিন্তু আদৌ সত্য প্রমাণ করতে চাই না বা এর ধারেকাছেও যেতে চাই না। এসব করে লোক দেখানো ভালো মানুষ হওয়ার ভান করি।

কাজেই যে প্রথা বা প্রতিযোগিতা ভালো-মন্দের পার্থক্য করার শিক্ষা দিতে পারে না, সত্যকে সত্য বলার এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎ সাহস জোগাতে পারে না, সেই প্রথা বা প্রতিযোগিতা দিয়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। বৈষয়িক শিক্ষা বা প্রতিযোগিতাকে নৈতিক শিক্ষা ও প্রতিযোগিতায় পরিণত করতে পারলেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হবে। তা না হলে শুধুই ঠুনকো বৈষয়িক কিছু প্রাপ্তিই হবে আমাদের সম্বল। আসুন, টেকসই পরবর্তী প্রজন্ম, সমাজ ও দেশ বিনির্মাণে এসবের দিকে একটু মনোযোগ দেই।

ড. এ কে এম লুৎফর রহমান : অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়