দেড় দশকেও সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে বড় ঘাটতি

মোশতাক আহমেদ

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাফাইল ছবি

অথচ এ পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা শিক্ষকদের। নিয়মানুযায়ী শিক্ষকেরা যখন সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবেন, তখন যাতে প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক ও মানসিক ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ ঘটে, সেটি লক্ষ রাখতে হয়।

কিন্তু চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অদক্ষতার চিত্রটিই নতুন করে সামনে এল। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে যে দুটি প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, তার দুটিই সৃজনশীল অংশের প্রশ্ন। এর মধ্যে গত রোববার অনুষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে একটি প্রশ্নের উদ্দীপক বা বিষয়বস্তু (সৃজনশীল প্রশ্নের অংশ) হিসেবে এমন বিষয়কে বেছে নেওয়া হয়, যা খুবই সংবেদনশীল। সেটা সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি উসকে দিতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। এ নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইতিমধ্যে প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও চার পরিশোধনকারীকে (মডারেটর) চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

একই দিনে অনুষ্ঠিত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি (বিএম) পরীক্ষায় বাংলা–২ (সৃজনশীল) পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্রে দেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে নিয়ে এমনভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে, যাতে তাঁকে হেয় করা হয়েছে, যেটি মূলত বিদ্বেষপূর্ণ।

অথচ সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ কোনো বক্তব্য যেন প্রশ্নপত্রে না থাকে, সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময়ই লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখানে কেবল প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অদক্ষতাই নয়, শিক্ষকদের মনমানসিকতার চিত্রটিও ফুটে উঠছে।

শিক্ষকেরা যে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র করার ক্ষেত্রে গলদঘর্ম হয়, তা সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনেও বহুবার উঠে এসেছে। বিষয়টি বোঝার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এ বছরের মে মাসে করা ‘একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনের’ দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। সব জেলা শিক্ষা অফিস ও মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে দেশের ৬ হাজার ৭৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তথ্য নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনটিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষকেরা সৃজনশীলে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ বা অদক্ষ, সেই তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকেরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন, এমন বিদ্যালয় প্রায় ৬১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ বিদ্যালয় বাইরে থেকে সৃজনশীলের প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে। বাইরে থেকে প্রশ্ন বলতে মূলত গাইড বই বা শিক্ষক সমিতির কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। এসব তথ্য বলছে, ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এখনো ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না।

মাউশির মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর বিনিয়োগ প্রকল্পের (সেসিপ) অধীন এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ মাত্র তিন দিনের, যার মাধ্যমে শিক্ষকেরা ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে পারেন না বলেও অভিযোগ আছে। আবার শিক্ষকদের চর্চার ক্ষেত্রেও বড় ঘাটতি আছে। এ কারণে মূলত শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এ পদ্ধতিতে একটি উদ্দীপক দিয়ে সেখান থেকে চারটি প্রশ্ন করা হয়। এতে প্রথম প্রশ্নের উত্তর বই থেকে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও বাকি তিনটি অংশের উত্তর দেওয়ার কথা বুদ্ধি খাঁটিয়ে। এ পদ্ধতিতে চিন্তার দক্ষতার বিভিন্ন স্তর যেমন জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, তুলনা ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়। এ পরীক্ষাপদ্ধতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে শিক্ষার্থীর মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ও বুদ্ধির ধার আরও তীক্ষ্ণ করা।

কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। উল্টো এখন নোট-গাইড বইয়ের নাম বদলে একই ধরনের বিষয় অনুশীলন বা এ-জাতীয় নাম দিয়ে দেদার চলছে। কোচিং-প্রাইভেটের দাপটও বেড়েছে। এমনকি সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে অনেক শিক্ষক নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও প্রাইভেট পড়ান। উপরন্তু এখন পাবলিক পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরির করার দুর্বলতার চিত্রই সবার সামনে উঠে এল।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সূত্রগুলো বলছে, আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে। এতে এখন যেভাবে প্রশ্ন করা হয়, সেই পদ্ধতি থাকবে না। নতুন নিয়মে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।

দেড় দশকেও সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে বড় ঘাটতি

মোশতাক আহমেদ

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাফাইল ছবি

অথচ এ পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা শিক্ষকদের। নিয়মানুযায়ী শিক্ষকেরা যখন সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবেন, তখন যাতে প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক ও মানসিক ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ ঘটে, সেটি লক্ষ রাখতে হয়।

কিন্তু চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অদক্ষতার চিত্রটিই নতুন করে সামনে এল। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে যে দুটি প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, তার দুটিই সৃজনশীল অংশের প্রশ্ন। এর মধ্যে গত রোববার অনুষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে একটি প্রশ্নের উদ্দীপক বা বিষয়বস্তু (সৃজনশীল প্রশ্নের অংশ) হিসেবে এমন বিষয়কে বেছে নেওয়া হয়, যা খুবই সংবেদনশীল। সেটা সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি উসকে দিতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। এ নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইতিমধ্যে প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও চার পরিশোধনকারীকে (মডারেটর) চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

একই দিনে অনুষ্ঠিত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি (বিএম) পরীক্ষায় বাংলা–২ (সৃজনশীল) পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্রে দেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে নিয়ে এমনভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে, যাতে তাঁকে হেয় করা হয়েছে, যেটি মূলত বিদ্বেষপূর্ণ।

অথচ সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ কোনো বক্তব্য যেন প্রশ্নপত্রে না থাকে, সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময়ই লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখানে কেবল প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অদক্ষতাই নয়, শিক্ষকদের মনমানসিকতার চিত্রটিও ফুটে উঠছে।

শিক্ষকেরা যে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র করার ক্ষেত্রে গলদঘর্ম হয়, তা সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনেও বহুবার উঠে এসেছে। বিষয়টি বোঝার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এ বছরের মে মাসে করা ‘একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনের’ দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। সব জেলা শিক্ষা অফিস ও মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে দেশের ৬ হাজার ৭৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তথ্য নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনটিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষকেরা সৃজনশীলে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ বা অদক্ষ, সেই তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকেরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন, এমন বিদ্যালয় প্রায় ৬১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ বিদ্যালয় বাইরে থেকে সৃজনশীলের প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে। বাইরে থেকে প্রশ্ন বলতে মূলত গাইড বই বা শিক্ষক সমিতির কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। এসব তথ্য বলছে, ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এখনো ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না।

মাউশির মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর বিনিয়োগ প্রকল্পের (সেসিপ) অধীন এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ মাত্র তিন দিনের, যার মাধ্যমে শিক্ষকেরা ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে পারেন না বলেও অভিযোগ আছে। আবার শিক্ষকদের চর্চার ক্ষেত্রেও বড় ঘাটতি আছে। এ কারণে মূলত শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এ পদ্ধতিতে একটি উদ্দীপক দিয়ে সেখান থেকে চারটি প্রশ্ন করা হয়। এতে প্রথম প্রশ্নের উত্তর বই থেকে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও বাকি তিনটি অংশের উত্তর দেওয়ার কথা বুদ্ধি খাঁটিয়ে। এ পদ্ধতিতে চিন্তার দক্ষতার বিভিন্ন স্তর যেমন জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, তুলনা ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়। এ পরীক্ষাপদ্ধতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে শিক্ষার্থীর মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ও বুদ্ধির ধার আরও তীক্ষ্ণ করা।

কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। উল্টো এখন নোট-গাইড বইয়ের নাম বদলে একই ধরনের বিষয় অনুশীলন বা এ-জাতীয় নাম দিয়ে দেদার চলছে। কোচিং-প্রাইভেটের দাপটও বেড়েছে। এমনকি সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে অনেক শিক্ষক নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও প্রাইভেট পড়ান। উপরন্তু এখন পাবলিক পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরির করার দুর্বলতার চিত্রই সবার সামনে উঠে এল।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সূত্রগুলো বলছে, আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে। এতে এখন যেভাবে প্রশ্ন করা হয়, সেই পদ্ধতি থাকবে না। নতুন নিয়মে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।