নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই

ইসরাত জাহান নিঝুম

২ ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যে মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হলো, তা বর্ণনাতীত। কী বীভৎসভাবে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলেন পথচারী নারী! বাস্তবতা হলো, বহিরাগতদের দৌরাত্ম্যে সব সময়ই অতি মাত্রায় কোলাহলপূর্ণ থাকে ঢাবি ক্যাম্পাস। অধিকাংশ সময়ই বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে—এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস না-কি বিনোদন কেন্দ্র! বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের উপস্থিতি যে কোনো নামিদামি পার্কের দৃশ্যকেও হার মানায়। উপরন্তু, ক্যাম্পাস জুড়ে যত্রতত্র ভাসমান খাবারের দোকান, উদ্বাস্তু-পাগল, ভিক্ষুক, ছিন্নমূল মানুষজনসহ বখাটেদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্যাম্পাসের এহেন করুণ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।

বলা বাহুল্য, বারবার এসব নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে। যার ফলস্বরূপ ক্যাম্পাস এরিয়ায় মাঝেমধ্যেই ঘটে মর্মান্তিক সব ঘটনা। বিশেষ করে, সড়ক দুর্ঘটনা। ঢাবি ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা যে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আসছে—এ তো কারো অজানা নয়। সুতরাং, এ বিষয়ে কেন ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা, তা বোধগম্য নয়। ক্যাম্পাসের মধ্যে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে অহরহ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষকে সন্তোষজনক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। বহিরাগতরা কার্জন হলসহ পুরো ক্যাম্পাস চষে বেড়ালেও তাদের থামানোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বহিরাগতদের অপ্রত্যাশিত-কুরুচিপূর্ণ কার্যকলাপে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় সন্তানের ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থীদের অভিবাবকদের। নামে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হলেও এ যেন টিকটকার, পেশাদার মডেল থেকে শুরু করে ওয়েডিং ফটোশুটারদের অবাধ অভয়ারণ্য!

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এ কেমন পরিবেশে থাকছেন দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা? এভাবে কী চলতে পারে? নিজের ক্যাম্পাসে নিজের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা নেই। কী সাংঘাতিক! বহিরাগতদের বিশৃঙ্খলার শিকার হয়ে যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রাণ হারান, তার দায় কে নেবে? হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস খুব সহজেই হয়তো সেই শিক্ষার্থীকে ভুলে যেতে পারবে; কিন্তু তার পরিবারের লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যুর মাশুল কে গুনবে? বস্তুত, এমন নাজুক পরিস্থিতিতেও প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায়—কী অদ্ভুত কথা! অথচ শিক্ষার্থীকে তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বাঁচানো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে সড়ক ব্যবস্থাপনার নাজেহাল দশার কথা কারো অজানা নয়। রাস্তায় বের হলেই তীব্র যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনায় সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়। সভ্য সমাজে এই চিত্র নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন অর্থাৎ ১৩ শতাংশ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। সড়কে শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরা নিয়ে মিছিল-বিক্ষোভ হয়েছে; কিন্তু দিনশেষে কাজের কাজ হয়নি কিছুই।

বলতে দ্বিধা নেই, সড়কে শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটলে যে আন্দোলন হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অথচ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্ষেত্রে চৌকস ও স্বাধীন ভূমিকা পালন করার কথা। শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ববোধের জায়গাটি যেন বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই রকম। ‘শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতির কর্ণধার’ বলা হলেও তাদের অধিকার, নিরাপত্তার বিষয়গুলো সর্বক্ষেত্রেই বেশ অবহেলিত।

যানজট নিরসনে জাতীয় স্বার্থে ঢাবি ক্যাম্পাস এরিয়াকে অবমুক্ত রাখা হয়েছে—কর্তৃপক্ষের এই দাবি কতটা গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। ঢাবি ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে কতটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে, তা গবেষণাসাপেক্ষ। এর পক্ষে কোনো যুক্তিই টিকবে না; কারণ, এর পরও ‘যেই লাউ সেই কদু’—তীব্র যানজটই রাজধানীর প্রতিদিনকার চিত্র। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্য দিয়ে চলাচলের রাস্তা করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করা হবে কেন? উন্নত দেশে এই রীতি আছে বটে; কিন্তু তারা তো ‘ডিসিপ্লিনড্’।

এমতাবস্থায়, শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও অধিকারের দিকগুলো বিবেচনায় রেখে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শিক্ষার্থীবান্ধব করতে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলেই শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা। বস্তুত, এটা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে বহু আগেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই

ইসরাত জাহান নিঝুম

২ ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যে মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হলো, তা বর্ণনাতীত। কী বীভৎসভাবে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলেন পথচারী নারী! বাস্তবতা হলো, বহিরাগতদের দৌরাত্ম্যে সব সময়ই অতি মাত্রায় কোলাহলপূর্ণ থাকে ঢাবি ক্যাম্পাস। অধিকাংশ সময়ই বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে—এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস না-কি বিনোদন কেন্দ্র! বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের উপস্থিতি যে কোনো নামিদামি পার্কের দৃশ্যকেও হার মানায়। উপরন্তু, ক্যাম্পাস জুড়ে যত্রতত্র ভাসমান খাবারের দোকান, উদ্বাস্তু-পাগল, ভিক্ষুক, ছিন্নমূল মানুষজনসহ বখাটেদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্যাম্পাসের এহেন করুণ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।

বলা বাহুল্য, বারবার এসব নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে। যার ফলস্বরূপ ক্যাম্পাস এরিয়ায় মাঝেমধ্যেই ঘটে মর্মান্তিক সব ঘটনা। বিশেষ করে, সড়ক দুর্ঘটনা। ঢাবি ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা যে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আসছে—এ তো কারো অজানা নয়। সুতরাং, এ বিষয়ে কেন ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা, তা বোধগম্য নয়। ক্যাম্পাসের মধ্যে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে অহরহ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষকে সন্তোষজনক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। বহিরাগতরা কার্জন হলসহ পুরো ক্যাম্পাস চষে বেড়ালেও তাদের থামানোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বহিরাগতদের অপ্রত্যাশিত-কুরুচিপূর্ণ কার্যকলাপে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় সন্তানের ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থীদের অভিবাবকদের। নামে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হলেও এ যেন টিকটকার, পেশাদার মডেল থেকে শুরু করে ওয়েডিং ফটোশুটারদের অবাধ অভয়ারণ্য!

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এ কেমন পরিবেশে থাকছেন দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা? এভাবে কী চলতে পারে? নিজের ক্যাম্পাসে নিজের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা নেই। কী সাংঘাতিক! বহিরাগতদের বিশৃঙ্খলার শিকার হয়ে যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রাণ হারান, তার দায় কে নেবে? হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস খুব সহজেই হয়তো সেই শিক্ষার্থীকে ভুলে যেতে পারবে; কিন্তু তার পরিবারের লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যুর মাশুল কে গুনবে? বস্তুত, এমন নাজুক পরিস্থিতিতেও প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায়—কী অদ্ভুত কথা! অথচ শিক্ষার্থীকে তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বাঁচানো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে সড়ক ব্যবস্থাপনার নাজেহাল দশার কথা কারো অজানা নয়। রাস্তায় বের হলেই তীব্র যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনায় সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়। সভ্য সমাজে এই চিত্র নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন অর্থাৎ ১৩ শতাংশ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। সড়কে শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরা নিয়ে মিছিল-বিক্ষোভ হয়েছে; কিন্তু দিনশেষে কাজের কাজ হয়নি কিছুই।

বলতে দ্বিধা নেই, সড়কে শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটলে যে আন্দোলন হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অথচ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্ষেত্রে চৌকস ও স্বাধীন ভূমিকা পালন করার কথা। শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ববোধের জায়গাটি যেন বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই রকম। ‘শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতির কর্ণধার’ বলা হলেও তাদের অধিকার, নিরাপত্তার বিষয়গুলো সর্বক্ষেত্রেই বেশ অবহেলিত।

যানজট নিরসনে জাতীয় স্বার্থে ঢাবি ক্যাম্পাস এরিয়াকে অবমুক্ত রাখা হয়েছে—কর্তৃপক্ষের এই দাবি কতটা গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। ঢাবি ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণের যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে কতটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে, তা গবেষণাসাপেক্ষ। এর পক্ষে কোনো যুক্তিই টিকবে না; কারণ, এর পরও ‘যেই লাউ সেই কদু’—তীব্র যানজটই রাজধানীর প্রতিদিনকার চিত্র। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্য দিয়ে চলাচলের রাস্তা করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করা হবে কেন? উন্নত দেশে এই রীতি আছে বটে; কিন্তু তারা তো ‘ডিসিপ্লিনড্’।

এমতাবস্থায়, শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও অধিকারের দিকগুলো বিবেচনায় রেখে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শিক্ষার্থীবান্ধব করতে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলেই শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা। বস্তুত, এটা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে বহু আগেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়