পুস্তক মুদ্রণে এনসিটিবির স্থায়ী অদক্ষতা

আবু তাহের খান

গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) আওতাধীন পুস্তক মুদ্রণ কার্যক্রম নানাবিধ জটিলতার মধ্যে নিপতিত হয়েছে এবং মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ খবর শুনে অবশ্য কেউই বিস্মিত হয়নি; বরং এ বছরের এই কার্যক্রম যদি কোনোরূপ অনিয়ম, দুর্নীতি ও জটিলতা ছাড়াই সম্পন্ন হতো, তাহলে সেটিই হতো অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ এনসিটিবি যখন থেকে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ শুরু করেছে, তখন থেকে অদ্যাবধি কখনো তা অনিয়ম ও দুর্নীতি ছাড়া সম্পন্ন হয়েছে—এমন দৃষ্টান্ত নেই; বরং ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত থাকা এবং কোনোরূপ জবাবদিহি ও শাস্তির মুখে পড়তে না হওয়ার ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় এনসিটিবি একেবারে প্রথম সারিতে থাকবে বলেই ধারণা করা চলে।

এনসিটিবির দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতা নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বহু লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেসবের কোনোটিরই কোনো প্রতিকার হয়নি এবং এসব অনিয়ম, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে এনসিটিবির কাউকে কখনো কোনোরূপ শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি বা এ জন্য কাউকে কোনোরূপ জবাবদিহিও করতে হয়নি। এ যেন অনেকটা বেসিক ব্যাংকের এককালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর এবং খোদ তৎকালীন অর্থমন্ত্রীও শত চেষ্টা করে আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা নিতে পারেননি। একইভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধেও। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তাঁদের অবস্থান অনেকটাই যে কারও ধরাছোঁয়ার বাইরে। একইভাবে অদৃশ্য শক্তির সংশ্লিষ্টতার কারণে বছরের পর বছর ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

উল্লিখিত পরিস্থিতিতে এ নিয়ে লিখে শিগগিরই তেমন কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে লিখতে হবে এ কারণে যে তাদের এসব অন্যায় কর্মের ফল ভোগ করতে বা খেসারত দিতে হচ্ছে এ দেশের লাখ লাখ কোমলমতি শিশু-কিশোরকে। এখানে শিশু-কিশোরদের ওপর এ ক্ষতির প্রভাব দ্বিবিধ। প্রথমত, যথাসময়ে বই না পেলে তাদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হবে। আর সে বই নিম্নমানের কাগজে যেনতেনভাবে ছাপা হলে এর একটি নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তাদের ওপর পড়বে বৈকি! দ্বিতীয় প্রভাবটি হচ্ছে, শিশু-কিশোরেরা যখন জানতে পারবে যে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই বস্তুত বই পেতে বিলম্ব হচ্ছে, তখন অবচেতনভাবে নিজ রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে, পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে তাদের মধ্যে এর রেশ থেকে যেতে বাধ্য। কিন্তু ছোট ছোট অথচ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী এই মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গ নিয়ে আমাদের শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ কি কখনো ভেবে দেখেছে?

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, এ বছরের পুস্তক মুদ্রণের ক্ষেত্রে কার্যাদেশ দিতে বিলম্ব হয়েছে এবং কিছু কিছু কার্যাদেশ দেওয়ার কাজ এখনো বাকি আছে। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলবে কি কার্যাদেশ দিতে কেন বিলম্ব ঘটল বা ঘটছে? জবাব না শুনেই বলা যায়, তারা এমন কোনো যুক্তি অবশ্যই দেখাতে সক্ষম হবে, যা শুনে প্রশ্ন করার জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হবে; অর্থাৎ যথাসময়ে কার্যাদেশ দিতে না পারার পক্ষে কোনো না কোনো যুক্তি তারা অবশ্যই দেখাতে সক্ষম হবে, যে সক্ষমতা তারা প্রতিবছরই এবং নিয়মিতভাবেই দেখাতে সক্ষম হয়ে থাকে। কিন্তু কী করলে সময়মতো কার্যাদেশ দেওয়া, ভালো কাগজে ও ন্যূনতম মূল্যে মানসম্পন্ন মুদ্রণ নিশ্চিতকরণ, মুদ্রিত পুস্তকের সরবরাহ সময়মতো প্রাপ্তি ইত্যাদি কাজ নিশ্চিত করা যাবে, তা তারা প্রায় কখনোই ভেবে দেখে না এবং এই ভেবে না দেখার জন্য তাদের কোনোরূপ জবাবদিহিও করতে হয় না।

এদিকে পুস্তক মুদ্রণকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতি জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জন্য মুদ্রিতব্য পুস্তকের ৯০ শতাংশ কাজই এখনো বাকি আছে এবং আগামী ১ জানুয়ারির মধ্যে ৩৫ শতাংশের বেশি পুস্তক সরবরাহ করা সম্ভব হবে না; অর্থাৎ এনসিটিবির চরম অদক্ষতা ও অযোগ্যতার খেসারত দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অন্যদের মিলে এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, জিজ্ঞেস করি, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপনের পর্যালোচনায় এনসিটিবিসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ও অযোগ্যতা বাড়তে বাড়তে অধঃপতনের চরমে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি কী ছিল? বর্তমান আলোচনা যেহেতু শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট, তাই আপাতত এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কেই বলি, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫০ বছরে ভবন, উপকরণ, জনবল, বরাদ্দ ইত্যাদি সবই বেড়েছে; অর্থাৎ বাহ্যিক জৌলুশে এগুলো রমরমা হয়েছে। কিন্তু গুণগত মান বাড়েনি প্রায় কোনোটিরই। অধিদপ্তর, বোর্ড, ইনস্টিটিউট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়), একাডেমি, কমিশন—সর্বত্রই একটি ‘খাই খাই’ অবস্থা এবং সত্যি কথা বলতে কি, আষ্টেপৃষ্ঠে দুর্নীতি ও অদক্ষতায় ছাওয়া এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে চোখ তুলে যেন তাকানোই যায় না! লজ্জায় ও অপমানে মাথা নত হয়ে আসে। আত্মধিক্কারে প্রশ্ন জাগে, এ রকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই কি আমাদের মহান শিক্ষক ও অন্যরা ১৯৭১-এ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন? এ রকম একটি ব্যবস্থার ব্যয় মেটানোর জন্যই কি এ দেশের খেটে-খাওয়া দুঃখী মানুষ, যাদের ৪৩ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, দিনান্ত পরিশ্রম করে করের অর্থ জোগায়?

তো উপরিউক্ত তথ্য থেকে ইতিমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেল যে ২০২৩ সালের পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীরা সময়মতো পাচ্ছে না। কিন্তু ২০২৪ সালে বা তার পরের বছরগুলোতে কি তা পাওয়া যাবে? হলফ করে বলতে পারি, বর্তমানের জবাবদিহিবিহীন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় ও নমনীয়তা এবং অতীত কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা ও মূল্যায়নহীনতার ধারা বহাল থাকলে পরবর্তী বছরগুলোতেও তা পাওয়া যাবে না; বরং যথাসময়ে ও মানসম্পন্ন কাগজে পুস্তক মুদ্রণ না হওয়া, মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় বড় পরিসরের দুর্নীতি যুক্ত থাকা, শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই না পৌঁছা ইত্যাদি ঘটনা আরও অধিক দাপটের সঙ্গে ও নির্লজ্জ ভঙ্গিতে ঘটতেই থাকবে।

তাহলে এ অবস্থা থেকে বেরোনোর উপায় কী? বেরোনোর একটিই উপায় এবং তা হচ্ছে, স্বচ্ছতাপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দক্ষতা ও জবাবদিহিপূর্ণ আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, দীর্ঘমেয়াদি ও সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সময়ভিত্তিক কর্মকাঠামো প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। আর তা করতে না পারলে বিষয়টি প্রতিবছরই গণমাধ্যমের জন্য খবর তৈরির উপলক্ষ হবে মাত্র—বাস্তবে এ সমস্যার কোনোই সমাধান হবে না। আর এ ক্ষেত্রে চরম আক্ষেপের বিষয় এই যে স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও একই অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দুর্নীতি নিয়ে একই রূপ আলোচনা করতে হচ্ছে। কিন্তু তা আর কত দিন?

পুস্তক মুদ্রণে এনসিটিবির স্থায়ী অদক্ষতা

আবু তাহের খান

গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) আওতাধীন পুস্তক মুদ্রণ কার্যক্রম নানাবিধ জটিলতার মধ্যে নিপতিত হয়েছে এবং মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ খবর শুনে অবশ্য কেউই বিস্মিত হয়নি; বরং এ বছরের এই কার্যক্রম যদি কোনোরূপ অনিয়ম, দুর্নীতি ও জটিলতা ছাড়াই সম্পন্ন হতো, তাহলে সেটিই হতো অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ এনসিটিবি যখন থেকে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ শুরু করেছে, তখন থেকে অদ্যাবধি কখনো তা অনিয়ম ও দুর্নীতি ছাড়া সম্পন্ন হয়েছে—এমন দৃষ্টান্ত নেই; বরং ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত থাকা এবং কোনোরূপ জবাবদিহি ও শাস্তির মুখে পড়তে না হওয়ার ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় এনসিটিবি একেবারে প্রথম সারিতে থাকবে বলেই ধারণা করা চলে।

এনসিটিবির দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতা নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বহু লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেসবের কোনোটিরই কোনো প্রতিকার হয়নি এবং এসব অনিয়ম, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে এনসিটিবির কাউকে কখনো কোনোরূপ শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি বা এ জন্য কাউকে কোনোরূপ জবাবদিহিও করতে হয়নি। এ যেন অনেকটা বেসিক ব্যাংকের এককালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর এবং খোদ তৎকালীন অর্থমন্ত্রীও শত চেষ্টা করে আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা নিতে পারেননি। একইভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধেও। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তাঁদের অবস্থান অনেকটাই যে কারও ধরাছোঁয়ার বাইরে। একইভাবে অদৃশ্য শক্তির সংশ্লিষ্টতার কারণে বছরের পর বছর ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

উল্লিখিত পরিস্থিতিতে এ নিয়ে লিখে শিগগিরই তেমন কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে লিখতে হবে এ কারণে যে তাদের এসব অন্যায় কর্মের ফল ভোগ করতে বা খেসারত দিতে হচ্ছে এ দেশের লাখ লাখ কোমলমতি শিশু-কিশোরকে। এখানে শিশু-কিশোরদের ওপর এ ক্ষতির প্রভাব দ্বিবিধ। প্রথমত, যথাসময়ে বই না পেলে তাদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হবে। আর সে বই নিম্নমানের কাগজে যেনতেনভাবে ছাপা হলে এর একটি নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তাদের ওপর পড়বে বৈকি! দ্বিতীয় প্রভাবটি হচ্ছে, শিশু-কিশোরেরা যখন জানতে পারবে যে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই বস্তুত বই পেতে বিলম্ব হচ্ছে, তখন অবচেতনভাবে নিজ রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে, পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে তাদের মধ্যে এর রেশ থেকে যেতে বাধ্য। কিন্তু ছোট ছোট অথচ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী এই মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গ নিয়ে আমাদের শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ কি কখনো ভেবে দেখেছে?

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, এ বছরের পুস্তক মুদ্রণের ক্ষেত্রে কার্যাদেশ দিতে বিলম্ব হয়েছে এবং কিছু কিছু কার্যাদেশ দেওয়ার কাজ এখনো বাকি আছে। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলবে কি কার্যাদেশ দিতে কেন বিলম্ব ঘটল বা ঘটছে? জবাব না শুনেই বলা যায়, তারা এমন কোনো যুক্তি অবশ্যই দেখাতে সক্ষম হবে, যা শুনে প্রশ্ন করার জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হবে; অর্থাৎ যথাসময়ে কার্যাদেশ দিতে না পারার পক্ষে কোনো না কোনো যুক্তি তারা অবশ্যই দেখাতে সক্ষম হবে, যে সক্ষমতা তারা প্রতিবছরই এবং নিয়মিতভাবেই দেখাতে সক্ষম হয়ে থাকে। কিন্তু কী করলে সময়মতো কার্যাদেশ দেওয়া, ভালো কাগজে ও ন্যূনতম মূল্যে মানসম্পন্ন মুদ্রণ নিশ্চিতকরণ, মুদ্রিত পুস্তকের সরবরাহ সময়মতো প্রাপ্তি ইত্যাদি কাজ নিশ্চিত করা যাবে, তা তারা প্রায় কখনোই ভেবে দেখে না এবং এই ভেবে না দেখার জন্য তাদের কোনোরূপ জবাবদিহিও করতে হয় না।

এদিকে পুস্তক মুদ্রণকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতি জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জন্য মুদ্রিতব্য পুস্তকের ৯০ শতাংশ কাজই এখনো বাকি আছে এবং আগামী ১ জানুয়ারির মধ্যে ৩৫ শতাংশের বেশি পুস্তক সরবরাহ করা সম্ভব হবে না; অর্থাৎ এনসিটিবির চরম অদক্ষতা ও অযোগ্যতার খেসারত দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অন্যদের মিলে এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, জিজ্ঞেস করি, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপনের পর্যালোচনায় এনসিটিবিসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ও অযোগ্যতা বাড়তে বাড়তে অধঃপতনের চরমে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি কী ছিল? বর্তমান আলোচনা যেহেতু শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট, তাই আপাতত এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কেই বলি, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫০ বছরে ভবন, উপকরণ, জনবল, বরাদ্দ ইত্যাদি সবই বেড়েছে; অর্থাৎ বাহ্যিক জৌলুশে এগুলো রমরমা হয়েছে। কিন্তু গুণগত মান বাড়েনি প্রায় কোনোটিরই। অধিদপ্তর, বোর্ড, ইনস্টিটিউট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়), একাডেমি, কমিশন—সর্বত্রই একটি ‘খাই খাই’ অবস্থা এবং সত্যি কথা বলতে কি, আষ্টেপৃষ্ঠে দুর্নীতি ও অদক্ষতায় ছাওয়া এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে চোখ তুলে যেন তাকানোই যায় না! লজ্জায় ও অপমানে মাথা নত হয়ে আসে। আত্মধিক্কারে প্রশ্ন জাগে, এ রকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই কি আমাদের মহান শিক্ষক ও অন্যরা ১৯৭১-এ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন? এ রকম একটি ব্যবস্থার ব্যয় মেটানোর জন্যই কি এ দেশের খেটে-খাওয়া দুঃখী মানুষ, যাদের ৪৩ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, দিনান্ত পরিশ্রম করে করের অর্থ জোগায়?

তো উপরিউক্ত তথ্য থেকে ইতিমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেল যে ২০২৩ সালের পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীরা সময়মতো পাচ্ছে না। কিন্তু ২০২৪ সালে বা তার পরের বছরগুলোতে কি তা পাওয়া যাবে? হলফ করে বলতে পারি, বর্তমানের জবাবদিহিবিহীন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় ও নমনীয়তা এবং অতীত কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা ও মূল্যায়নহীনতার ধারা বহাল থাকলে পরবর্তী বছরগুলোতেও তা পাওয়া যাবে না; বরং যথাসময়ে ও মানসম্পন্ন কাগজে পুস্তক মুদ্রণ না হওয়া, মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় বড় পরিসরের দুর্নীতি যুক্ত থাকা, শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই না পৌঁছা ইত্যাদি ঘটনা আরও অধিক দাপটের সঙ্গে ও নির্লজ্জ ভঙ্গিতে ঘটতেই থাকবে।

তাহলে এ অবস্থা থেকে বেরোনোর উপায় কী? বেরোনোর একটিই উপায় এবং তা হচ্ছে, স্বচ্ছতাপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দক্ষতা ও জবাবদিহিপূর্ণ আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, দীর্ঘমেয়াদি ও সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সময়ভিত্তিক কর্মকাঠামো প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। আর তা করতে না পারলে বিষয়টি প্রতিবছরই গণমাধ্যমের জন্য খবর তৈরির উপলক্ষ হবে মাত্র—বাস্তবে এ সমস্যার কোনোই সমাধান হবে না। আর এ ক্ষেত্রে চরম আক্ষেপের বিষয় এই যে স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও একই অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দুর্নীতি নিয়ে একই রূপ আলোচনা করতে হচ্ছে। কিন্তু তা আর কত দিন?