প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও অরক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা

স্বপ্না রেজা

আমাদের দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস শিশু ও তরুণ সমাজের একটা অংশ যেমন পূর্ণাঙ্গভাবে জানে না, জানতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ঠিক তেমনি জানতে পারে না বাংলা ও বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের আদি উপান্ত।দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেনতেনভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। অনেকের মতে, শিক্ষা কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা মোটেও সুরক্ষিত নয়। দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় এবং সুস্থ জাতি গঠনে বর্তমান প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রচণ্ড উদাসীনতা আর অবহেলায় রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। নেই শিক্ষার প্রতি দায়িত্বশীলদের কড়া নজর। তাই দেশের আর সবকিছু সুরক্ষিত হলেও শিক্ষা কার্যক্রম সুরক্ষিত হতে পারছে না কোনোভাবেই। একটার পর একটা অঘটন ঘটে যাচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে গভীর উদ্বেগও যেন কোথাও নেই। নীতিনির্ধারকদের টনক নড়ছে না। কখনো নড়েছে বলেও মনে হয় না। তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করেই দায়মুক্ত হচ্ছেন বলে অনেকে মনে করছেন। সম্প্রতি এর আরও একটি নমুনা দেখা গেল চলমান উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্নে। বিধি লঙ্ঘন করে যেখানে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, ঠিক এমন একটি অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রমের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উসকানির মানে কী দাঁড়ায় এবং সংশ্লিষ্টরা তা বোঝেন কি না, সে বিষয়ে ভয়াবহ সংশয় দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রবেশ ঘটেছে, সেটা নিশ্চিত। রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি অনুষ্ঠান শেষে সংবাদকর্মীরা এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন।

বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর এই ‘দুঃখজনক’ কথায় অবাক হইনি, বরং হতাশ হয়েছি। কেন তিনি এমন একটি বিষয়কে ‘দুঃখজনক’ বলবেন? বরং তিনি যদি বলতেন, এটা তাঁর মন্ত্রণালয়ের এক বড় লজ্জাজনক ঘটনা, তাহলে তাতে আশ্বস্ত হতাম এই ভেবে যে বোধোদয়ের পথে তিনি সবাইকে নিয়ে পা বাড়িয়েছেন এবং সত্য অনুধাবন করছেন। দীপু মনি যখন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। প্রায় বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি আদর্শের জায়গায় নিয়ে যাবেন, সংবিধানসম্মতভাবে চলমান রাখবেন—এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। পাঠ্যপুস্তক একসময় হেফাজতিকরণ করা হলো বলে যখন অভিযোগ উঠল, তখন তেমনভাবে সোচ্চার হতে দেখা গেল না কাউকে। নীরবতা ছিল চারপাশে। এই নীরবতার নেপথ্যে অনেকেই রাজনৈতিক স্বার্থের গন্ধ খুঁজে পেলেন। সেটা কিন্তু অশনিসংকেত ছিল, বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টির বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি যা ছিল সংবিধানের পরিপন্থী। তার পরের ঘটনা কমবেশি সবাই জানেন। সবকিছুর পর ভরসা রেখেছিলাম, অন্তত দীপু মনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনাকে শিক্ষার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করবেন। আমাদের দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস শিশু ও তরুণ সমাজের একটা অংশ যেমন পূর্ণাঙ্গভাবে জানে না, জানতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ঠিক তেমনি জানতে পারে না বাংলা ও বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের আদি উপান্ত।

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নেপথ্যে যা ছিল অন্যতম একটি কারণ। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার পর সাম্প্রদায়িক মনোভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করে এবং সেটা পাকিস্তান শাসনামলের আদলে। সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত, নিপীড়ন, মৌলবাদ, ফতোয়াবাজসহ নানান ধরনের ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা এবং সেটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। পোশাক-আশাক, চিন্তা-চেতনায় পড়ে মরচে। এসবের বড় দৃষ্টান্ত হলো নিরাপত্তার দোহাইতে পয়লা বৈশাখ, বিজয় উৎসব উদ্‌যাপনে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ও বিধিনিষেধ আরোপ করা। বাংলা ও বাঙালির বড় উৎসব পয়লা বৈশাখ, যা সব ধর্মের নাগরিকগণ উদ্‌যাপন করে থাকে সম্মিলিতভাবে। এই উৎসবকে টার্গেট করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। আর এদের হাত থেকে রক্ষার অজুহাতে দায়িত্বশীলরা উৎসবকে সংকুচিত করে ধারা জারি করে বসে। যেমন—উৎসবের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া, কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তা প্রচার করা। সাম্প্রদায়িক শক্তি এভাবেই ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠ্যপুস্তক সব ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উপস্থিতি এখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে। সচেতন নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রপক্ষ কী টের পাচ্ছে না উইপোকার মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রে অবস্থান করে বিপন্ন করতে বসেছে জাতিসত্তাকে?

যাই হোক, দুর্ভেদ্য প্রশ্নপত্র প্রক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তির এমন আগ্রাসন ও প্রবেশ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। মনে অনেক সংশয় ও ভয় দেখা দিয়েছে। কারা প্রশ্নপত্র, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেন এবং কাদের রেফারেন্স ও সহায়তায় এরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তা কঠোরভাবে দেখা এবং তা প্রকাশ্যে আনার দাবি উঠেছে। শিক্ষার চাইতে মূল্যবান সম্পদ কিংবা অস্ত্র আর কী হতে পারে, যা দেশকে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত করতে পারে? একটি রাষ্ট্রে শিক্ষার বিকল্প নেই। একজন ব্যক্তির মূল্যবোধ, মনোভাব কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা নির্ধারণ করে সেই রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা। সঠিক শিক্ষা যদি ব্যক্তি না পায়, তাহলে তার অর্জিত শিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রের কোনো কল্যাণ কিংবা উন্নয়ন, এমনকি প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। উপরন্তু, রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং ষড়যন্ত্রকারীদের উত্থান ঘটে। অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পাশাপাশি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানির সুযোগ কী করে হয়, তা বোধগম্য নয়। কী জবাব দেবেন সংশ্লিষ্টরা, তা তাঁরাই জানেন। তবে এটা দৃশ্যমান হয়েছে যে শিক্ষা চরমভাবে অরক্ষিত ও অবহেলিত।

মাত্র কিছুদিন আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষা চলাকালীন কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হলো। এমন সিদ্ধান্তে মনে হলো যেন কোচিং সেন্টারই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। শিক্ষা বোর্ড থেকে কী করে প্রশ্নপত্র কোচিং সেন্টারে পৌঁছায়, তার কোনো দায় বা জবাবদিহি কিন্তু কোথাও দেখা গেল না। কেউ দিলেনও না। প্রশ্নপত্র ফাঁসে দেখা যায় কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও জড়িত থাকে। কিন্তু কী করে দুর্ভেদ্য শিক্ষা বোর্ডের ভেতর থেকে প্রশ্নপত্র বের হয়ে আসে, এসব সংরক্ষণের দায়-দায়িত্ব কাদের? কখনো তাদের চিহ্নিত করা হয় বলে মনে পড়ে না। ধরা খান তাঁরাই, যাঁরা মাঠে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন।

যখন লেখাটা লিখছি, তখন আন্তশিক্ষা বোর্ড থেকে বলা হলো, প্রশ্নকারী শিক্ষক ও সমন্বয়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো, বিষয়টি কি শুধু শিক্ষক ও সমন্বয়কারী পর্যন্তই চূড়ান্ত হয়? সমন্বয়কারী তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব কার? নাকি সমন্বয়কারীর মাথার ওপর কেউ থাকেন না, শুধু আকাশই থাকে? যাই হোক, শিক্ষাই রাষ্ট্রের মেগা কর্মসূচি হওয়া উচিত এবং তা সংবিধানসম্মতভাবে। এই সত্য উপলব্ধির ঘাটতি কিন্তু বড় ঘাটতি এবং চরম ব্যর্থতা। মনে রাখতে হবে, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার সুরক্ষাই রাষ্ট্রের বড় নিরাপত্তা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও অরক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা

স্বপ্না রেজা

আমাদের দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস শিশু ও তরুণ সমাজের একটা অংশ যেমন পূর্ণাঙ্গভাবে জানে না, জানতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ঠিক তেমনি জানতে পারে না বাংলা ও বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের আদি উপান্ত।দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেনতেনভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। অনেকের মতে, শিক্ষা কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা মোটেও সুরক্ষিত নয়। দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় এবং সুস্থ জাতি গঠনে বর্তমান প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রচণ্ড উদাসীনতা আর অবহেলায় রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। নেই শিক্ষার প্রতি দায়িত্বশীলদের কড়া নজর। তাই দেশের আর সবকিছু সুরক্ষিত হলেও শিক্ষা কার্যক্রম সুরক্ষিত হতে পারছে না কোনোভাবেই। একটার পর একটা অঘটন ঘটে যাচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে গভীর উদ্বেগও যেন কোথাও নেই। নীতিনির্ধারকদের টনক নড়ছে না। কখনো নড়েছে বলেও মনে হয় না। তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করেই দায়মুক্ত হচ্ছেন বলে অনেকে মনে করছেন। সম্প্রতি এর আরও একটি নমুনা দেখা গেল চলমান উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্নে। বিধি লঙ্ঘন করে যেখানে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, ঠিক এমন একটি অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রমের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উসকানির মানে কী দাঁড়ায় এবং সংশ্লিষ্টরা তা বোঝেন কি না, সে বিষয়ে ভয়াবহ সংশয় দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রবেশ ঘটেছে, সেটা নিশ্চিত। রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি অনুষ্ঠান শেষে সংবাদকর্মীরা এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন।

বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর এই ‘দুঃখজনক’ কথায় অবাক হইনি, বরং হতাশ হয়েছি। কেন তিনি এমন একটি বিষয়কে ‘দুঃখজনক’ বলবেন? বরং তিনি যদি বলতেন, এটা তাঁর মন্ত্রণালয়ের এক বড় লজ্জাজনক ঘটনা, তাহলে তাতে আশ্বস্ত হতাম এই ভেবে যে বোধোদয়ের পথে তিনি সবাইকে নিয়ে পা বাড়িয়েছেন এবং সত্য অনুধাবন করছেন। দীপু মনি যখন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। প্রায় বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি আদর্শের জায়গায় নিয়ে যাবেন, সংবিধানসম্মতভাবে চলমান রাখবেন—এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। পাঠ্যপুস্তক একসময় হেফাজতিকরণ করা হলো বলে যখন অভিযোগ উঠল, তখন তেমনভাবে সোচ্চার হতে দেখা গেল না কাউকে। নীরবতা ছিল চারপাশে। এই নীরবতার নেপথ্যে অনেকেই রাজনৈতিক স্বার্থের গন্ধ খুঁজে পেলেন। সেটা কিন্তু অশনিসংকেত ছিল, বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টির বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি যা ছিল সংবিধানের পরিপন্থী। তার পরের ঘটনা কমবেশি সবাই জানেন। সবকিছুর পর ভরসা রেখেছিলাম, অন্তত দীপু মনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনাকে শিক্ষার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করবেন। আমাদের দেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস শিশু ও তরুণ সমাজের একটা অংশ যেমন পূর্ণাঙ্গভাবে জানে না, জানতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ঠিক তেমনি জানতে পারে না বাংলা ও বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের আদি উপান্ত।

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নেপথ্যে যা ছিল অন্যতম একটি কারণ। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার পর সাম্প্রদায়িক মনোভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করে এবং সেটা পাকিস্তান শাসনামলের আদলে। সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত, নিপীড়ন, মৌলবাদ, ফতোয়াবাজসহ নানান ধরনের ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা এবং সেটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। পোশাক-আশাক, চিন্তা-চেতনায় পড়ে মরচে। এসবের বড় দৃষ্টান্ত হলো নিরাপত্তার দোহাইতে পয়লা বৈশাখ, বিজয় উৎসব উদ্‌যাপনে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ও বিধিনিষেধ আরোপ করা। বাংলা ও বাঙালির বড় উৎসব পয়লা বৈশাখ, যা সব ধর্মের নাগরিকগণ উদ্‌যাপন করে থাকে সম্মিলিতভাবে। এই উৎসবকে টার্গেট করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। আর এদের হাত থেকে রক্ষার অজুহাতে দায়িত্বশীলরা উৎসবকে সংকুচিত করে ধারা জারি করে বসে। যেমন—উৎসবের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া, কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তা প্রচার করা। সাম্প্রদায়িক শক্তি এভাবেই ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠ্যপুস্তক সব ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উপস্থিতি এখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে। সচেতন নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রপক্ষ কী টের পাচ্ছে না উইপোকার মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রে অবস্থান করে বিপন্ন করতে বসেছে জাতিসত্তাকে?

যাই হোক, দুর্ভেদ্য প্রশ্নপত্র প্রক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তির এমন আগ্রাসন ও প্রবেশ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। মনে অনেক সংশয় ও ভয় দেখা দিয়েছে। কারা প্রশ্নপত্র, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেন এবং কাদের রেফারেন্স ও সহায়তায় এরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তা কঠোরভাবে দেখা এবং তা প্রকাশ্যে আনার দাবি উঠেছে। শিক্ষার চাইতে মূল্যবান সম্পদ কিংবা অস্ত্র আর কী হতে পারে, যা দেশকে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত করতে পারে? একটি রাষ্ট্রে শিক্ষার বিকল্প নেই। একজন ব্যক্তির মূল্যবোধ, মনোভাব কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা নির্ধারণ করে সেই রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা। সঠিক শিক্ষা যদি ব্যক্তি না পায়, তাহলে তার অর্জিত শিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রের কোনো কল্যাণ কিংবা উন্নয়ন, এমনকি প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। উপরন্তু, রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং ষড়যন্ত্রকারীদের উত্থান ঘটে। অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পাশাপাশি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানির সুযোগ কী করে হয়, তা বোধগম্য নয়। কী জবাব দেবেন সংশ্লিষ্টরা, তা তাঁরাই জানেন। তবে এটা দৃশ্যমান হয়েছে যে শিক্ষা চরমভাবে অরক্ষিত ও অবহেলিত।

মাত্র কিছুদিন আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষা চলাকালীন কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হলো। এমন সিদ্ধান্তে মনে হলো যেন কোচিং সেন্টারই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। শিক্ষা বোর্ড থেকে কী করে প্রশ্নপত্র কোচিং সেন্টারে পৌঁছায়, তার কোনো দায় বা জবাবদিহি কিন্তু কোথাও দেখা গেল না। কেউ দিলেনও না। প্রশ্নপত্র ফাঁসে দেখা যায় কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও জড়িত থাকে। কিন্তু কী করে দুর্ভেদ্য শিক্ষা বোর্ডের ভেতর থেকে প্রশ্নপত্র বের হয়ে আসে, এসব সংরক্ষণের দায়-দায়িত্ব কাদের? কখনো তাদের চিহ্নিত করা হয় বলে মনে পড়ে না। ধরা খান তাঁরাই, যাঁরা মাঠে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন।

যখন লেখাটা লিখছি, তখন আন্তশিক্ষা বোর্ড থেকে বলা হলো, প্রশ্নকারী শিক্ষক ও সমন্বয়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো, বিষয়টি কি শুধু শিক্ষক ও সমন্বয়কারী পর্যন্তই চূড়ান্ত হয়? সমন্বয়কারী তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব কার? নাকি সমন্বয়কারীর মাথার ওপর কেউ থাকেন না, শুধু আকাশই থাকে? যাই হোক, শিক্ষাই রাষ্ট্রের মেগা কর্মসূচি হওয়া উচিত এবং তা সংবিধানসম্মতভাবে। এই সত্য উপলব্ধির ঘাটতি কিন্তু বড় ঘাটতি এবং চরম ব্যর্থতা। মনে রাখতে হবে, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার সুরক্ষাই রাষ্ট্রের বড় নিরাপত্তা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক