লন্ডনের চিঠি

বিলেতের বাংলা বইমেলা নিয়ে অপ্রিয় ভাবনা

বিলেতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চাটিকে জিইয়ে রাখার জন্য অনেক দল কাজ করছেন

বিলেতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চাটিকে জিইয়ে রাখার জন্য অনেক দল কাজ করছেন। নিঃস্বার্থভাবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মূল্যবান সময় এবং অর্থ ব্যয় করে কিছুদিন পরপর নানা উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই কোনো রকমের দর্শনীর ব্যবস্থা থাকে না, পাওয়া যায় না স্পন্সর। ফলে, আয়োজনের পুরো ব্যয়ভার বহন করতে হয় আয়োজিত সংগঠনের কর্তাব্যক্তি এবং সদস্যগণকে। আমি নিজে এমন দুয়েকটা আয়োজনের সঙ্গে সামান্য সংশ্লিষ্ট থেকে বুঝেছি কী পরিমাণ অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার করে এমন অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করেন কর্তাব্যক্তিরা! এসব আয়োজনের বেশিরভাগই লন্ডনের ইস্টলন্ডন কেন্দ্রিক।

তবে গত কয়েক বছর ধরে ব্রিটেনের অন্য শহরগুলোতে অবস্থান করা বাঙালিরাও বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং উৎসবের আয়োজন করে আসছেন। এর সবই যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা প্রবাসী বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য ভীষণ আনন্দের গর্বের বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি এসব অনুষ্ঠানের বিষয়ে ভীষণ উৎসাহী। কোথাও এ ধরনের কোনো আয়োজন হচ্ছে শুনলে মন আনন্দে নেচে ওঠে। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে সব অনুষ্ঠানে সবসময় যোগ দিতে না পারলেও মনটা উদ্বেলিত হয়ে থাকে ভিনদেশের মাটিতে আমাদের আরাধ্য বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতির এসব কর্মকাণ্ড ।

সংগীত উৎসব, পিঠা উৎসব, বৈশাখী উৎসব, নাট্য উৎসব, কবিতা উৎসব, সাহিত্য আড্ডা-এমন নানা ধরনের আয়োজন চলতে থাকে বছর জুড়েই। তবে আমাকে বিশেষভাবে টানে বিলেতের বইমেলার আয়োজন। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিলেতের বাঙালিরা নানা প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করে প্রায় নিয়মিত আয়োজন করে আসছেন বইমেলার। করোনা মহামারীর দুই বছরের বিরতি ছাড়া আর প্রায় সব বছরই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বইমেলায় বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে, স্বনামধন্য প্রকাশকগণ আসেন।

কখনো কখনো অতিথি হিসেবে দুয়েকজন স্বনামধন্য সাহিত্যিককে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার এবং মতবিনিময়ের এই সুযোগে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেলিত থাকেন বিলেতের সর্বস্তরের সাহিত্যিকগণ। বাংলাদেশের সঙ্গে সারা বছরের যে দূরত্বের বাধা, সেটি দুয়েক দিনে পুষিয়ে নিতে চান। গল্পে, আড্ডায়, বেড়ানোতে খুব সুন্দর সময় কেটে যায় আমাদের, দেশ থেকে যারা আসেন তাদেরও।
আনন্দের বিষয় হলো, এ বছর এখানে একটি নয়, পরপর দুটো বড়সড় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দুটো প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে। সুতরাং, এখানকার বইপ্রেমীদের জন্য ডাবল আনন্দ-উৎসব! দুর্ভাগ্যক্রমে, এবারের এই আয়োজন দুটোর সঙ্গে বেরিয়ে এলো এখানকার সাহিত্যপাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানা অসংগতি, অহেতুক এবং অনাকাক্সিক্ষত দলীয় রাজনীতির কুটিলতা, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং চেনা অর্ধ-চেনা কিছু অন্ধকার দিকও।

স্বভাবতই দুটো প্রতিষ্ঠানই নিজেদের আয়োজনকে প্রধান হিসেবে দেখাতে ঢাকার দ্বারস্থ হন, হতেই হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঢাকার কর্তাব্যক্তিরা কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করে, প্রকৃত কর্মযজ্ঞ ও কর্মীদের প্রমোট না করে দুদিকেই লোকদেখানো ঢোল পেটান। একটি উদাহরণ দেই। এ বছর সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্যের আয়োজনে হয়ে গেল দশম বইমেলা। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ ঢাকার অন্যান্য কর্তাব্যক্তি দশম বইমেলাকে আশীর্বাদ জানিয়ে বিবৃতি দিলেন। এর দেড় মাসের মাথায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যুক্তরাজ্য যে বইমেলার আয়োজন করেছে, তার প্রচারপত্রে লেখা হলো- তেরোতম বইমেলা।

সেই তেরোতম বইমেলাকেই আবারও ঢাকার ঐ একই কর্তাব্যক্তিরাই আশীর্বাদ জানিয়ে নিজেদের সংহতি জানালেন। ‘সবারে বাসিব ভালো, করিব না আত্ম-পরভেদ’- তাদের এই নীতিটি আমাদের ভালো লেগেছে। সমস্যা হলো, এত বইমেলা হলো কখন যুক্তরাজ্যে! বিবৃতিপত্রে সই করার আগে সম্মানিত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ একবারের জন্যও কি খোঁজ নিয়েছিলেন যে, কে কারা কবে কোন ধারাবাহিকতা ধরে এই যে দশম এবং ত্রয়োদশ বইমেলা করছে বলে দাবি করছে, কারা ‘সত্যি পথের যাত্রী’? দশম কিংবা ত্রয়োদশে অবশ্য কিছু আসে যায় না। কে কী দাবি করল, তাতে আমাদের আমজনতার ভাবতে বয়েই গেছে। সমস্যা হলো ঢাকার কর্তাব্যক্তিদের ভূমিকাটি আমাদের বেশ বিভ্রান্তিতে ফেলেছে।

ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটিতে ছাড় দিতে গিয়ে তারা নিজেদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছেন। উচিত খোঁজ-খবরটি নিতেও হয় ভুলে গেছেন, অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার মতো সাদাসিধা লেখক, পাঠক, যারা স্রেফ সাহিত্যপ্রীতির কারণে এসব বইমেলায় দাওয়াত পেলে কিংবা না পেলেও যেতে পছন্দ করেন- এসব বিষয় তাদেরকে ভীষণ পীড়া দেয়। তার ওপর আমার সঙ্গে বাংলা একাডেমি আছে, তোমার সঙ্গে নেই- এ জাতীয় প্রতিযোগিতারও কোনো কারণ দেখি না। বাংলা একাডেমি তো সবার সঙ্গেই থাকতে পারে। আরও দুটো বইমেলা হলে সে দুটোর সহযোগী প্রতিষ্ঠানও হতে পারে বাংলা একাডেমি।

এতে অসুবিধা কিছু তো নেই। তবে বাংলা একাডেমির উচিত হবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটিতে বায়াসড না হয়ে সঠিক এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠানটিকে যথোচিত গুরুত্ব দেয়া, স্বীকৃতি জানানো। কারা সত্যিকার অর্থে প্রকৃত কাজ করছে তাদেরকে খুঁজে বের করা, আরেকটু বেশি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির আরেকটু বেশি দায়িত্ব জ্ঞানের পরিচয় দেওয়াটা খুব জরুরি বিবেচনা করি।
এদিকে আরেক হাস্যকর সমস্যা হলো এখানকার বইমেলার ফিতা কাটা বিষয়ে। মন্ত্রী, এমপি, আমলারা খুব সম্মানিত মানুষ। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ তারা। দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা ব্যস্ত থাকেন, দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন। কিন্তু, বেশিরভাগ সময়ই  বইমেলায় যখন তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য, ফিতা কেটে উদ্বোধন করার জন্য পীড়াপীড়ি দেখি, তখন ভীষণ হতাশ হতে হয়।

সাহিত্য সম্পর্কিত উৎসবে সাহিত্যের লোককে প্রাধান্য না (দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া) দিয়ে মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের বিশেষ দাওয়াত দিয়ে এনে এই যে তাদেরকে বিরক্ত করা, তাদের এবং আমার মতো সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের সময় নষ্ট করা- এর কোন মানেই হয় না। বইমেলায় গিয়ে আমি একজন সাহিত্যিকের, সমকালের বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা, কোন্ পথে হাঁটছে আমাদের বর্তমান বাংলা সাহিত্য সেসব বিষয়, প্রকৃত সাহিত্যিক এবং সাহিত্যের অধ্যাপকদের বক্তব্য শুনতে চাই। কিন্তু এ বিষয়ে প্রায় সবসময়ই হতাশ হতে হয়। এখনো সেই গতানুতিক পথে হাঁটছে আমাদের চিন্তাভাবনা।

সাঁকো উদ্বোধন কি বই সব জায়গাতেই বেচারা পদাধিকারদের নিয়ে টানাটানি। পদাধিকার বলে সম্মানিত মানুষরা অনেক ভালো ভালো কথা জানেন, সেসব শুনতে আমাদের মন্দ লাগে না। তবে সেসব কথা শোনার জন্য অন্য যেসব জায়গা আছে, সেসব জায়গায় যাওয়াই ভালো। এতে তাদের এবং আমাদের- উভয়েরই বিব্রত হতে হয় না। তারা অবশ্য এসব জায়গায় এসে উচিত কাজটিই করেন। বইমেলায় এসে তারা বক-সাহিত্যিক হবার চেষ্টা করেন না। সামনে মাইক্রোফোন পেলে তারা যে কাজ ভালো জানেন, রাজনীতি, সেসব বক্তব্য শুরু করেন। আর এদিকে আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি।

এর সঙ্গে যোগ হয় যখন দেখি রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষজন অধিকার করে নেয় মঞ্চ। তাদের মধ্যে কে আগে বক্তব্য রাখবেন, মন্ত্রীর সামনে নিজের গুণ জাহির করবেন-  সেসব নিয়ে প্রকাশ্যে দলীয় কোন্দল শুরু করে দেয়, তখন লজ্জা লুকানোর জায়গা থাকে না সত্যি। এবারে তো একটি বইমেলায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাইক কাড়াকাড়ির মতো অত্যন্ত বিব্রতকর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে! মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের বিরক্ত না করে আমরা কি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালি সাহিত্যিকদের বিলেতে একটি বার্ষিক মিলনমেলা উদ্যাপনের সুযোগ নিতে পারি না বইমেলাকে কেন্দ্র করে? তাতেই বোধহয় আমাদের মেলাগুলোর চারিত্রিক সততা বৃদ্ধি পেতে পারে। দূর হতে পারে জমে থাকা কলুষতাগুলো।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো সংগঠন আদম ব্যবসাসহ নানান ধরনের দলীয় ও ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ করার চেষ্টা করছেন, নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে বইমেলার আয়োজনকে ব্যবহার করছেন। অভিযোগটি বেশ পুরনো এবং অনেকটা প্রকাশ্যই। প্রতিবছর মেলার সময় এলেই বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় হতে দেখা যায়। পাল্টা-পাল্টি কথার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতাও দেখা যায়।

আমার মনে হয়, এখানকার পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে এসব অভিযোগের একটা সুরাহা করতে পারেন, যাতে বইমেলাকেন্দ্রিক আমাদের অর্জনগুলো কলুষিত না হয়ে যায়। একই সঙ্গে আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলোও সংবাদ সম্মেলন করে তাদের বলবার মতো কথাটি প্রকাশ্যে বলে নিজেদের অবস্থানটি পরিষ্কার করতে পারেন সবার কাছে। এসব বিষয়ে আড়ালে আবডালে কথা না বলে, টিকা-টিপ্পনীর বাদানুবাদ এড়িয়ে এটাই হতে পারে সবচেয়ে সময়োপযোগী ও সুস্থ পদক্ষেপ। ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড় করে বিষয়টি চাপা দিয়ে রাখার কিছু নেই।

আমাদের আবেগের সুযোগ নিয়ে কেউ যদি অন্যায় কিছু করে থাকেন, যার ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে বিলেতের বাংলা বইমেলা অনুষ্ঠিত হবার পথটিই রুদ্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তবে সে জায়গায় শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসে গেছে। না হলে, প্রকৃতই যারা নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিলেতের মাটিতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য নিরলস কাজ করছেন, নিজের সময়, মেধা ও অর্থ খরচ করে বছরজুড়ে নানা আয়োজন করছেন, জনসাধারণের মাঝে তাদের কাজের বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, যথোপযুক্ত সম্মান এবং স্বীকৃতিটি হতে তারা বঞ্চিত হন। এর ফলে একটা অবশ্যম্ভাবী বন্ধ্যত্ব তৈরি হবে, ভবিষ্যতে যারা কাজ করতে সংকল্পবদ্ধ, তারাও সঙ্গত কারণেই নিরুৎসাহিত হবেন।
বইমেলার সঙ্গে যে মৎস্যমেলা এবং পোশাকমেলা এবং নিদেন বৈশাখী মেলার পার্থক্য আছে- এ সত্যটা উপলব্ধি করার সময় বিগত হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। বিলেতে বইমেলা করার প্রধান বিপদ এবং আশঙ্কা এই যে, বইয়ের মেলায় লোক হবে না। আশঙ্কাটি অনেকাংশে সত্যি। এখানে বইমেলায় ঘুরে-ফিরে যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত, তাদেরকেই মূলত দেখা যায়। এর বাইরে যে সাধারণ বাঙালিরা, যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত নন কোনোভাবেই, তাদেরকে দেখা যায় কদাচিৎই। প্রশ্ন হলো, ঐ মানুষগুলোকে বইমেলায় আনার জন্য আমরা যথেষ্ট উদ্দীপনা রেখেছি কিনা।

উত্তরে হয়ত বলা হবে, বিলেতের বইমেলা মানে তার সঙ্গে সংস্কৃতির মেলাও, মানে নাচ, গান ও আবৃত্তির মেলাও। সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য অনেক স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পীদের গান গাইতে নিয়ে আসা হয়। মুশকিল হলো, একই ছাদের নিচে এক পাশে বইমেলা এবং অন্যপাশে নাচগানের প্রদর্শনী হলে বই বিক্রি ও প্রদর্শনী মার খাবে- এটা স্বতঃসিদ্ধ। প্রায়ই দেখা যায়, আয়োজকরাই ডাকাডাকি করে মেলার দর্শনার্থীদের অনুষ্ঠান দেখার জন্য সংস্কৃতির মঞ্চের দিকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন, এদিকে বইয়ের পসরা সাজিয়ে প্রকাশক এবং বিক্রেতাগণ শুকনো মুখে বসে আছেন।

বইমেলায় যাওয়া মানে বই নিয়ে আড্ডা দিতে যাওয়া, সাহিত্য নিয়ে তর্ক-বির্তক করতে যাওয়া, সাহিত্যিক বন্ধুটির সঙ্গে কূটতর্কে উত্তপ্ত হতে যাওয়া। কিন্তু কানের কাছে যদি সারাক্ষণ মাইক বাজিয়ে সংস্কৃতি বাজতে থাকে, তখন ঐসব বজ্রকণ্ঠ কিংবা কিন্নর কণ্ঠ চাপিয়ে, চিৎকার করে করে তর্ক করা তো দূরের কথা, খোশগল্প করার উৎসাহও নিমেষে মিলিয়ে যায়। এ ব্যাধিটি প্রতিটি বইমেলায় দেখেছি। সংস্কৃতির মঞ্চ থাকুক, তবে তার সহাবস্থানটি যেন বইকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার মতো না হয়, সেদিকটাতে নজর রাখা জরুরি।
আমাদের এখানকার বইমেলাগুলোতে যেদিকটাতে সবচেয়ে খরা রয়ে যাচ্ছে, তা হলো বাঙালি শিশু-কিশোর এবং তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে না পারা, তাদেরকে এ মেলার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সংযুক্ত করতে না পারা। একেবারেই চেষ্টা যে করা হয় না, সেটি বলছি না, তবে প্রয়োজনের তুলনায় এটি একেবারেই অপ্রতুল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এখানে বেড়ে ওঠা সিংহভাগ বাচ্চাই বাংলা বই পড়তে পারে না। ফলে, স্বভাবতই বাচ্চাদের অংশগ্রহণের সুযোগটিও ভীষণ সীমিত। তাই বলে বাচ্চাদের জোড় করে বাংলা বই পড়া শিখিয়ে বইমেলায় নিয়ে আসার কথা বলছি না।

অন্তত ওদের কথা ভেবে, বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য বিশেষ কোনো আয়োজন, বিশেষ কোনো শিশু-কিশোর কর্নার বা এ জাতীয় কিছুর আয়োজনের কথা ভেবে দেখা যেতে পারে বলে মনে করি। বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা যেন তাদের শিশু-পুত্র এবং শিশু-কন্যাটিকে এ মেলায় নিয়ে আসেন, সেজন্য তাদের কাছে যেতে হবে। প্রচার ও প্রচারণার পরিকল্পনায় তাদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে দায়িত্ব সেরে না ফেলে বাঙালি পাড়ার স্কুলগুলোতে বাঙালি অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা এবং অন্যান্য উদ্দীপনমূলক কার্যক্রম চালানোর কথা ভাবা যেতে পারে।
কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও এক কথায় স্বীকার করতেই হবে, বিলেতের বাংলা বইমেলার অর্জন এবং সফলতা প্রশ্নাতীত। একজন লেখক ও পাঠক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে আমার আশা এবং স্বপ্ন এবং আবেগ অনেক। এ আয়োজনটির জন্য মুখিয়ে থাকি আমারা অনেকেই। তাই সংশ্লিষ্টরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন ভেবেও এই মানসিক অশান্তিগুলোর কথা লিখতে হলো। জানি, আপনারা অনেক কষ্ট করে বইমেলার আয়োজন করেন, তাতে আমরা অনেক উপকৃত হই। এসব আয়োজনের সফলতার গল্পটিও অনেক দীর্ঘ।

আপনাদের ত্যাগের কারণেই এখনো এখানে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রদীপটি প্রজ্বলিত হয়ে আছে। কিন্তু সেসব তো সবসময় বলা হয়ই। আজ এই অপ্রিয় ভাবনাগুলোই লিখতে হলো মূলত আপনাদের মঙ্গল কামনা করে। এতে আপনাদের কিছুটা মন খারাপ হলেও আমার অনুরোধ- এত কষ্ট স্বীকার করে, নিজের পকেটের অর্থ ও সময় নষ্ট করে বইমেলার আয়োজনটি করেনই যদি, বিষয়টি নিয়ে আপনাদের আরেকটু সাহিত্যকেন্দ্রিক ভাবনা ভাবুন। আয়োজনটি আরেকটু সুন্দর হোক, হোক সংহত।

লেখক : কথাসাহিত্যিক
goddoshagor@gmail.com

লন্ডনের চিঠি

বিলেতের বাংলা বইমেলা নিয়ে অপ্রিয় ভাবনা

বিলেতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চাটিকে জিইয়ে রাখার জন্য অনেক দল কাজ করছেন

বিলেতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চাটিকে জিইয়ে রাখার জন্য অনেক দল কাজ করছেন। নিঃস্বার্থভাবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মূল্যবান সময় এবং অর্থ ব্যয় করে কিছুদিন পরপর নানা উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই কোনো রকমের দর্শনীর ব্যবস্থা থাকে না, পাওয়া যায় না স্পন্সর। ফলে, আয়োজনের পুরো ব্যয়ভার বহন করতে হয় আয়োজিত সংগঠনের কর্তাব্যক্তি এবং সদস্যগণকে। আমি নিজে এমন দুয়েকটা আয়োজনের সঙ্গে সামান্য সংশ্লিষ্ট থেকে বুঝেছি কী পরিমাণ অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার করে এমন অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করেন কর্তাব্যক্তিরা! এসব আয়োজনের বেশিরভাগই লন্ডনের ইস্টলন্ডন কেন্দ্রিক।

তবে গত কয়েক বছর ধরে ব্রিটেনের অন্য শহরগুলোতে অবস্থান করা বাঙালিরাও বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং উৎসবের আয়োজন করে আসছেন। এর সবই যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা প্রবাসী বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য ভীষণ আনন্দের গর্বের বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি এসব অনুষ্ঠানের বিষয়ে ভীষণ উৎসাহী। কোথাও এ ধরনের কোনো আয়োজন হচ্ছে শুনলে মন আনন্দে নেচে ওঠে। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে সব অনুষ্ঠানে সবসময় যোগ দিতে না পারলেও মনটা উদ্বেলিত হয়ে থাকে ভিনদেশের মাটিতে আমাদের আরাধ্য বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতির এসব কর্মকাণ্ড ।

সংগীত উৎসব, পিঠা উৎসব, বৈশাখী উৎসব, নাট্য উৎসব, কবিতা উৎসব, সাহিত্য আড্ডা-এমন নানা ধরনের আয়োজন চলতে থাকে বছর জুড়েই। তবে আমাকে বিশেষভাবে টানে বিলেতের বইমেলার আয়োজন। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিলেতের বাঙালিরা নানা প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করে প্রায় নিয়মিত আয়োজন করে আসছেন বইমেলার। করোনা মহামারীর দুই বছরের বিরতি ছাড়া আর প্রায় সব বছরই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বইমেলায় বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে, স্বনামধন্য প্রকাশকগণ আসেন।

কখনো কখনো অতিথি হিসেবে দুয়েকজন স্বনামধন্য সাহিত্যিককে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার এবং মতবিনিময়ের এই সুযোগে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেলিত থাকেন বিলেতের সর্বস্তরের সাহিত্যিকগণ। বাংলাদেশের সঙ্গে সারা বছরের যে দূরত্বের বাধা, সেটি দুয়েক দিনে পুষিয়ে নিতে চান। গল্পে, আড্ডায়, বেড়ানোতে খুব সুন্দর সময় কেটে যায় আমাদের, দেশ থেকে যারা আসেন তাদেরও।
আনন্দের বিষয় হলো, এ বছর এখানে একটি নয়, পরপর দুটো বড়সড় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দুটো প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে। সুতরাং, এখানকার বইপ্রেমীদের জন্য ডাবল আনন্দ-উৎসব! দুর্ভাগ্যক্রমে, এবারের এই আয়োজন দুটোর সঙ্গে বেরিয়ে এলো এখানকার সাহিত্যপাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানা অসংগতি, অহেতুক এবং অনাকাক্সিক্ষত দলীয় রাজনীতির কুটিলতা, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং চেনা অর্ধ-চেনা কিছু অন্ধকার দিকও।

স্বভাবতই দুটো প্রতিষ্ঠানই নিজেদের আয়োজনকে প্রধান হিসেবে দেখাতে ঢাকার দ্বারস্থ হন, হতেই হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঢাকার কর্তাব্যক্তিরা কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করে, প্রকৃত কর্মযজ্ঞ ও কর্মীদের প্রমোট না করে দুদিকেই লোকদেখানো ঢোল পেটান। একটি উদাহরণ দেই। এ বছর সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্যের আয়োজনে হয়ে গেল দশম বইমেলা। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ ঢাকার অন্যান্য কর্তাব্যক্তি দশম বইমেলাকে আশীর্বাদ জানিয়ে বিবৃতি দিলেন। এর দেড় মাসের মাথায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যুক্তরাজ্য যে বইমেলার আয়োজন করেছে, তার প্রচারপত্রে লেখা হলো- তেরোতম বইমেলা।

সেই তেরোতম বইমেলাকেই আবারও ঢাকার ঐ একই কর্তাব্যক্তিরাই আশীর্বাদ জানিয়ে নিজেদের সংহতি জানালেন। ‘সবারে বাসিব ভালো, করিব না আত্ম-পরভেদ’- তাদের এই নীতিটি আমাদের ভালো লেগেছে। সমস্যা হলো, এত বইমেলা হলো কখন যুক্তরাজ্যে! বিবৃতিপত্রে সই করার আগে সম্মানিত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ একবারের জন্যও কি খোঁজ নিয়েছিলেন যে, কে কারা কবে কোন ধারাবাহিকতা ধরে এই যে দশম এবং ত্রয়োদশ বইমেলা করছে বলে দাবি করছে, কারা ‘সত্যি পথের যাত্রী’? দশম কিংবা ত্রয়োদশে অবশ্য কিছু আসে যায় না। কে কী দাবি করল, তাতে আমাদের আমজনতার ভাবতে বয়েই গেছে। সমস্যা হলো ঢাকার কর্তাব্যক্তিদের ভূমিকাটি আমাদের বেশ বিভ্রান্তিতে ফেলেছে।

ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটিতে ছাড় দিতে গিয়ে তারা নিজেদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছেন। উচিত খোঁজ-খবরটি নিতেও হয় ভুলে গেছেন, অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার মতো সাদাসিধা লেখক, পাঠক, যারা স্রেফ সাহিত্যপ্রীতির কারণে এসব বইমেলায় দাওয়াত পেলে কিংবা না পেলেও যেতে পছন্দ করেন- এসব বিষয় তাদেরকে ভীষণ পীড়া দেয়। তার ওপর আমার সঙ্গে বাংলা একাডেমি আছে, তোমার সঙ্গে নেই- এ জাতীয় প্রতিযোগিতারও কোনো কারণ দেখি না। বাংলা একাডেমি তো সবার সঙ্গেই থাকতে পারে। আরও দুটো বইমেলা হলে সে দুটোর সহযোগী প্রতিষ্ঠানও হতে পারে বাংলা একাডেমি।

এতে অসুবিধা কিছু তো নেই। তবে বাংলা একাডেমির উচিত হবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটিতে বায়াসড না হয়ে সঠিক এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠানটিকে যথোচিত গুরুত্ব দেয়া, স্বীকৃতি জানানো। কারা সত্যিকার অর্থে প্রকৃত কাজ করছে তাদেরকে খুঁজে বের করা, আরেকটু বেশি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির আরেকটু বেশি দায়িত্ব জ্ঞানের পরিচয় দেওয়াটা খুব জরুরি বিবেচনা করি।
এদিকে আরেক হাস্যকর সমস্যা হলো এখানকার বইমেলার ফিতা কাটা বিষয়ে। মন্ত্রী, এমপি, আমলারা খুব সম্মানিত মানুষ। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ তারা। দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা ব্যস্ত থাকেন, দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন। কিন্তু, বেশিরভাগ সময়ই  বইমেলায় যখন তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য, ফিতা কেটে উদ্বোধন করার জন্য পীড়াপীড়ি দেখি, তখন ভীষণ হতাশ হতে হয়।

সাহিত্য সম্পর্কিত উৎসবে সাহিত্যের লোককে প্রাধান্য না (দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া) দিয়ে মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের বিশেষ দাওয়াত দিয়ে এনে এই যে তাদেরকে বিরক্ত করা, তাদের এবং আমার মতো সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের সময় নষ্ট করা- এর কোন মানেই হয় না। বইমেলায় গিয়ে আমি একজন সাহিত্যিকের, সমকালের বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা, কোন্ পথে হাঁটছে আমাদের বর্তমান বাংলা সাহিত্য সেসব বিষয়, প্রকৃত সাহিত্যিক এবং সাহিত্যের অধ্যাপকদের বক্তব্য শুনতে চাই। কিন্তু এ বিষয়ে প্রায় সবসময়ই হতাশ হতে হয়। এখনো সেই গতানুতিক পথে হাঁটছে আমাদের চিন্তাভাবনা।

সাঁকো উদ্বোধন কি বই সব জায়গাতেই বেচারা পদাধিকারদের নিয়ে টানাটানি। পদাধিকার বলে সম্মানিত মানুষরা অনেক ভালো ভালো কথা জানেন, সেসব শুনতে আমাদের মন্দ লাগে না। তবে সেসব কথা শোনার জন্য অন্য যেসব জায়গা আছে, সেসব জায়গায় যাওয়াই ভালো। এতে তাদের এবং আমাদের- উভয়েরই বিব্রত হতে হয় না। তারা অবশ্য এসব জায়গায় এসে উচিত কাজটিই করেন। বইমেলায় এসে তারা বক-সাহিত্যিক হবার চেষ্টা করেন না। সামনে মাইক্রোফোন পেলে তারা যে কাজ ভালো জানেন, রাজনীতি, সেসব বক্তব্য শুরু করেন। আর এদিকে আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি।

এর সঙ্গে যোগ হয় যখন দেখি রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষজন অধিকার করে নেয় মঞ্চ। তাদের মধ্যে কে আগে বক্তব্য রাখবেন, মন্ত্রীর সামনে নিজের গুণ জাহির করবেন-  সেসব নিয়ে প্রকাশ্যে দলীয় কোন্দল শুরু করে দেয়, তখন লজ্জা লুকানোর জায়গা থাকে না সত্যি। এবারে তো একটি বইমেলায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাইক কাড়াকাড়ির মতো অত্যন্ত বিব্রতকর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে! মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের বিরক্ত না করে আমরা কি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালি সাহিত্যিকদের বিলেতে একটি বার্ষিক মিলনমেলা উদ্যাপনের সুযোগ নিতে পারি না বইমেলাকে কেন্দ্র করে? তাতেই বোধহয় আমাদের মেলাগুলোর চারিত্রিক সততা বৃদ্ধি পেতে পারে। দূর হতে পারে জমে থাকা কলুষতাগুলো।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো সংগঠন আদম ব্যবসাসহ নানান ধরনের দলীয় ও ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ করার চেষ্টা করছেন, নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে বইমেলার আয়োজনকে ব্যবহার করছেন। অভিযোগটি বেশ পুরনো এবং অনেকটা প্রকাশ্যই। প্রতিবছর মেলার সময় এলেই বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় হতে দেখা যায়। পাল্টা-পাল্টি কথার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতাও দেখা যায়।

আমার মনে হয়, এখানকার পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে এসব অভিযোগের একটা সুরাহা করতে পারেন, যাতে বইমেলাকেন্দ্রিক আমাদের অর্জনগুলো কলুষিত না হয়ে যায়। একই সঙ্গে আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলোও সংবাদ সম্মেলন করে তাদের বলবার মতো কথাটি প্রকাশ্যে বলে নিজেদের অবস্থানটি পরিষ্কার করতে পারেন সবার কাছে। এসব বিষয়ে আড়ালে আবডালে কথা না বলে, টিকা-টিপ্পনীর বাদানুবাদ এড়িয়ে এটাই হতে পারে সবচেয়ে সময়োপযোগী ও সুস্থ পদক্ষেপ। ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড় করে বিষয়টি চাপা দিয়ে রাখার কিছু নেই।

আমাদের আবেগের সুযোগ নিয়ে কেউ যদি অন্যায় কিছু করে থাকেন, যার ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে বিলেতের বাংলা বইমেলা অনুষ্ঠিত হবার পথটিই রুদ্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তবে সে জায়গায় শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসে গেছে। না হলে, প্রকৃতই যারা নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিলেতের মাটিতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য নিরলস কাজ করছেন, নিজের সময়, মেধা ও অর্থ খরচ করে বছরজুড়ে নানা আয়োজন করছেন, জনসাধারণের মাঝে তাদের কাজের বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, যথোপযুক্ত সম্মান এবং স্বীকৃতিটি হতে তারা বঞ্চিত হন। এর ফলে একটা অবশ্যম্ভাবী বন্ধ্যত্ব তৈরি হবে, ভবিষ্যতে যারা কাজ করতে সংকল্পবদ্ধ, তারাও সঙ্গত কারণেই নিরুৎসাহিত হবেন।
বইমেলার সঙ্গে যে মৎস্যমেলা এবং পোশাকমেলা এবং নিদেন বৈশাখী মেলার পার্থক্য আছে- এ সত্যটা উপলব্ধি করার সময় বিগত হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। বিলেতে বইমেলা করার প্রধান বিপদ এবং আশঙ্কা এই যে, বইয়ের মেলায় লোক হবে না। আশঙ্কাটি অনেকাংশে সত্যি। এখানে বইমেলায় ঘুরে-ফিরে যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত, তাদেরকেই মূলত দেখা যায়। এর বাইরে যে সাধারণ বাঙালিরা, যারা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত নন কোনোভাবেই, তাদেরকে দেখা যায় কদাচিৎই। প্রশ্ন হলো, ঐ মানুষগুলোকে বইমেলায় আনার জন্য আমরা যথেষ্ট উদ্দীপনা রেখেছি কিনা।

উত্তরে হয়ত বলা হবে, বিলেতের বইমেলা মানে তার সঙ্গে সংস্কৃতির মেলাও, মানে নাচ, গান ও আবৃত্তির মেলাও। সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য অনেক স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পীদের গান গাইতে নিয়ে আসা হয়। মুশকিল হলো, একই ছাদের নিচে এক পাশে বইমেলা এবং অন্যপাশে নাচগানের প্রদর্শনী হলে বই বিক্রি ও প্রদর্শনী মার খাবে- এটা স্বতঃসিদ্ধ। প্রায়ই দেখা যায়, আয়োজকরাই ডাকাডাকি করে মেলার দর্শনার্থীদের অনুষ্ঠান দেখার জন্য সংস্কৃতির মঞ্চের দিকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন, এদিকে বইয়ের পসরা সাজিয়ে প্রকাশক এবং বিক্রেতাগণ শুকনো মুখে বসে আছেন।

বইমেলায় যাওয়া মানে বই নিয়ে আড্ডা দিতে যাওয়া, সাহিত্য নিয়ে তর্ক-বির্তক করতে যাওয়া, সাহিত্যিক বন্ধুটির সঙ্গে কূটতর্কে উত্তপ্ত হতে যাওয়া। কিন্তু কানের কাছে যদি সারাক্ষণ মাইক বাজিয়ে সংস্কৃতি বাজতে থাকে, তখন ঐসব বজ্রকণ্ঠ কিংবা কিন্নর কণ্ঠ চাপিয়ে, চিৎকার করে করে তর্ক করা তো দূরের কথা, খোশগল্প করার উৎসাহও নিমেষে মিলিয়ে যায়। এ ব্যাধিটি প্রতিটি বইমেলায় দেখেছি। সংস্কৃতির মঞ্চ থাকুক, তবে তার সহাবস্থানটি যেন বইকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার মতো না হয়, সেদিকটাতে নজর রাখা জরুরি।
আমাদের এখানকার বইমেলাগুলোতে যেদিকটাতে সবচেয়ে খরা রয়ে যাচ্ছে, তা হলো বাঙালি শিশু-কিশোর এবং তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে না পারা, তাদেরকে এ মেলার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সংযুক্ত করতে না পারা। একেবারেই চেষ্টা যে করা হয় না, সেটি বলছি না, তবে প্রয়োজনের তুলনায় এটি একেবারেই অপ্রতুল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এখানে বেড়ে ওঠা সিংহভাগ বাচ্চাই বাংলা বই পড়তে পারে না। ফলে, স্বভাবতই বাচ্চাদের অংশগ্রহণের সুযোগটিও ভীষণ সীমিত। তাই বলে বাচ্চাদের জোড় করে বাংলা বই পড়া শিখিয়ে বইমেলায় নিয়ে আসার কথা বলছি না।

অন্তত ওদের কথা ভেবে, বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য বিশেষ কোনো আয়োজন, বিশেষ কোনো শিশু-কিশোর কর্নার বা এ জাতীয় কিছুর আয়োজনের কথা ভেবে দেখা যেতে পারে বলে মনে করি। বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা যেন তাদের শিশু-পুত্র এবং শিশু-কন্যাটিকে এ মেলায় নিয়ে আসেন, সেজন্য তাদের কাছে যেতে হবে। প্রচার ও প্রচারণার পরিকল্পনায় তাদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে দায়িত্ব সেরে না ফেলে বাঙালি পাড়ার স্কুলগুলোতে বাঙালি অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা এবং অন্যান্য উদ্দীপনমূলক কার্যক্রম চালানোর কথা ভাবা যেতে পারে।
কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও এক কথায় স্বীকার করতেই হবে, বিলেতের বাংলা বইমেলার অর্জন এবং সফলতা প্রশ্নাতীত। একজন লেখক ও পাঠক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে আমার আশা এবং স্বপ্ন এবং আবেগ অনেক। এ আয়োজনটির জন্য মুখিয়ে থাকি আমারা অনেকেই। তাই সংশ্লিষ্টরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন ভেবেও এই মানসিক অশান্তিগুলোর কথা লিখতে হলো। জানি, আপনারা অনেক কষ্ট করে বইমেলার আয়োজন করেন, তাতে আমরা অনেক উপকৃত হই। এসব আয়োজনের সফলতার গল্পটিও অনেক দীর্ঘ।

আপনাদের ত্যাগের কারণেই এখনো এখানে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রদীপটি প্রজ্বলিত হয়ে আছে। কিন্তু সেসব তো সবসময় বলা হয়ই। আজ এই অপ্রিয় ভাবনাগুলোই লিখতে হলো মূলত আপনাদের মঙ্গল কামনা করে। এতে আপনাদের কিছুটা মন খারাপ হলেও আমার অনুরোধ- এত কষ্ট স্বীকার করে, নিজের পকেটের অর্থ ও সময় নষ্ট করে বইমেলার আয়োজনটি করেনই যদি, বিষয়টি নিয়ে আপনাদের আরেকটু সাহিত্যকেন্দ্রিক ভাবনা ভাবুন। আয়োজনটি আরেকটু সুন্দর হোক, হোক সংহত।

লেখক : কথাসাহিত্যিক
goddoshagor@gmail.com